রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংসদ মন্ত্রিসভা ও বিবিধ প্রশ্ন

অনেক ‘বিতর্কের’ জন্ম দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভাও শপথ নিয়েছে এবং বোধকরি গণতান্ত্রিক সমাজে এই প্রথম একটি দেশ যেখানে নামমাত্র একটি বিরোধী দল সরকারেও আছে, আবার একইসঙ্গে বিরোধী দলেও আছে। শুধু তাই নয়, এমন একটি নির্বাচন হলো, যেখানে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ও হলেন! আরও অবাক করার বিষয়Ñ নবম জাতীয় সংসদকে রেখেই দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হলো এবং দশম জাতীয় সংসদ থেকে সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভাও গঠিত হলো! পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। পুরো প্রক্রিয়াটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। এরই মধ্যে হাইকোর্টে দু’দুটো রিট করা হয়েছে। এ রিটের ভাগ্য কী, তা আমরা জানি না, তবে সংবিধান যারা বোঝেন, ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তাদের কারও কারও মতামত আমরা পেয়েছি। আর ওইসব মতামত সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করে না। সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই যেখানে সংবাদপত্রে, টিভি টকশোতে বারবার বলা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে, সেখানে নয়া মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে করে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সারা বিশ্বেই একটা প্রশ্নের মুখে, সেখানে অনেক সিনিয়র মন্ত্রীকে বলতে শুনলামÑ ‘সরকার থাকবে পাঁচ বছরের জন্য’! সাধারণ নিয়মে একটা সরকার পাঁচ বছরই থাকে। কিন্তু যে ‘নির্বাচন’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে সংসদ তার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে, সেই সংসদের আয়ুষ্কাল পাঁচ বছর বলা হলে সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বুধবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নয়া কর্মসূচি দিয়েছে। ২৯ জানুয়ারি নয়া সংসদের উদ্বোধনী দিন। ওইদিন হরতাল দেয়নি প্রধান বিরোধী দল। এটাকে সমঝোতা ও সংলাপের ব্যাপারে শুভ সঙ্কেত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বিএনপির এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা কিরূপ হয় নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই ‘নির্বাচন’ নিয়ে যত প্রশ্নই উঠুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদের ২৯২ জন সদস্যই শপথ নিয়েছেন (বাকি ৮টি আসনে নির্বাচন হয়নি)। সংবিধান অনুযায়ী তারা এখন সংসদ সদস্য, তবে সরকারি ভাষ্য মতে, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ২৪ তারিখের পর। অর্থাৎ নবম সংসদ বিলুপ্ত হলো না। নিয়মমাফিক ২৪ তারিখ ওই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং দশম সংসদের কার্যক্রম শুরু হবে। এ নির্বাচন এবং শপথ গ্রহণ নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ১৪৮ ২(ক) অনুযায়ী সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করে সংসদ সদস্যরা (দশম সংসদ) শপথ নিয়েছেন। এটা সংবিধান অনুযায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ১৪৮(১) যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে দেখব এ ধারা বলে যে শপথ গ্রহণ করা হলো তা ৬৫(২) ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৪৮(১) ধারাটা এরকম ‘তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যগ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন।’ এর অর্থ কী? এমপি সাহেবরা শপথ নিয়েছেন কার্যগ্রহণের আগে। অর্থাৎ ৯ তারিখ থেকেই তিনি সংসদ সদস্য! কিন্তু ১২২টি আসনে যেখানে অন্য এমপি রয়েছেন, তার কী হবে? সংবিধানের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি নয়া এমপি দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এমপি আর তার দায়িত্বে থাকবেন না। এখানে এক ধরনের জটিলতা রয়েছে। দেশের আইনজীবীরাও এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত। এ দেশে যিনি আজীবন কোম্পানি আইন পড়েছেন, কোম্পানি আইনে মামলা-মোকদ্দমা করেন, তিনি হয়ে যান সংবিধান বিশেষজ্ঞ! তারা তাদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। এখন শপথ গ্রহণের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। ব্যাখ্যাটা আদালতই দেবেন। এমনকি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিংবা ড. কামাল হোসেন, যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত, তারা আদালতের কাছে স্বউদ্যোগেও একটা ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা ভালো। মন্ত্রিসভা হয়েছে। এই মন্ত্রিসভা ভালো কী মন্দ এ নিয়ে কম কথা হয়নি এ ক’দিনে। বিতর্কিত মন্ত্রীরা বাদ পড়েছেন। বলা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে, যারা বেশি কথা বলে বারবার বিতর্ক সৃষ্টি করতেন, তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। এটা তো ঠিক, যারা মন্ত্রী হয়ে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের প্রধানমন্ত্রী দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত অন্যদের একটা মেসেজ পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ যারা নতুন মন্ত্রী হয়েছেন, তারা দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবেন। এ সিদ্ধান্তটি ভালো। তরুণ অনেক মুখ ছোট মন্ত্রী হয়েছেন। এটাও ভালো। এর মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হবে। এটা খুবই দরকার। দলের সিনিয়র নেতারা সম্ভবত শেষবারের মতো কেবিনেটে থাকলেন। আগামীতে আর বয়সের ভারে তারা কর্মক্ষম থাকবেন না। সুতরাং নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তবে মন্ত্রিসভায় দক্ষ ও আধুনিকমনস্ক লোকদের আমি কম দেখেছি। একুশ শতকে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আধুনিকমনস্ক, শিক্ষিত ও যোগ্য মন্ত্রী দরকার। যদি সংসদে না থাকেন তাহলে টেকনোক্রেট কোটায় বাইরে থেকে নিতে হবে। কিন্তু যাকে টেকনোক্রেট কোটায় নেয়া হলো তিনি ঠিক এ মানদ-ে পড়েন না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ্য ব্যক্তি দরকার। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুনরুদ্ধারে দরকার যোগ্য ব্যক্তি। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে আমাদের দেশ সম্পর্কে একটা বাজে ধারণার জন্ম হয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, সিনেটে অবিলম্বে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচজন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, জজ বুজম্যান, বারবারা বস্ক্রার, মাইকেল রি এন্ডি ও সিনেটর ক্রিস্টোফার এস মার্ফি ১১ ডিসেম্বর এই প্রস্তাবটি পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই আলোচনা হয়। সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবে ছয়টি বিষয় রয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দুই নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এসব মন্তব্য এখন বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার হার্ডলাইনে গেলে ভুল করবে। ১৩ জানুয়ারি বিএনপি ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে কূটনীতিকরা মন্তব্য করেছেন, দশম নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। তারা সহিংসতা পরিহার করে সব দলের প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। জাতির জন্য, সমাজের জন্য এ সহিংসতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে, বিশেষ করে বিরোধী দলের মাঝে এ উপলব্ধি বোধটুকু আসতে হবে। তবে এটা ভালো খবর যে, নির্বাচনের পরপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর দেশে তেমন সহিংসতার খবর আসছে না। জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব এখন আলোচিত হতে থাকবে বারবার। নির্বাচনের আগে দলটি আরেক দফা ভেঙে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচনের পর বর্তমান মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রিসভাকে বড় ধরনের বিতর্কের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যতদূর জানা যায়, ২০০৬ সালে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিলÑ একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শনিবার হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছেন। এখানে ঐকমত্যের ধারণার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ঐকমত্যের ব্যানারে যাদের পেলাম তারা সবাই মূলত আগের মহাজোট সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাতে ‘ঐকমত্য’ সরকার হলো কোথায়? অনেকেই এটা স্বীকার করবেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে একটা ঐকমত্যের সরকারের প্রয়োজন ছিল। এটা ভালো হতো যদি সব দল ও মতের প্রতিনিধিত্ব এই মন্ত্রিসভায় থাকত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকেও এ মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। কেননা, পরিস্থিতি এটাই দাবি করে। তবে সংবিধান যেহেতু ‘সংসদ সদস্য নন’ এমন লোকদের নিয়ে মন্ত্রী করার বিধান সীমিত, এক্ষেত্রে টেকনোক্রেট কোটায় কিংবা উপদেষ্টা পরিষদে তাদের রাখা যেত। মন্ত্রিসভায় সব মতের প্রতিনিধিত্ব থাকলে, সঙ্কট সমাধানের পক্ষে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হলো না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। গেজেটে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাকে সে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার দল যখন মন্ত্রিসভায় থাকে, তখন তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ছুরিকাঘাতের শামিল। বেশ কিছুদিন ধরেই জাতীয় পার্টির মাঝে একটা ধারা লক্ষ্য করা গেছেÑ আর তা হচ্ছে, মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ! এখন রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে তারা নিজেরা মন্ত্রী হলেন। আমি এর আগেও বলেছি এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটা অংশ আওয়ামী লীগের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে, অপর অংশ চলে যাবে বিএনপিতে। এরশাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও তার সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে তৃতীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। অতীতেও একাধিকবার জাতীয় পার্টি ভেঙেছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু কিংবা সর্বশেষ কাজী জাফর মূল দল ত্যাগ করে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কিংবা নাজিউর রহমান মঞ্জু ‘এক দল এক নেতা’ হিসেবে বিবৃতির মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখলেও লাভবান হয়েছেন এক জায়গায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আবারও মন্ত্রী হয়েছেন। আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর অবর্তমানে তার ছেলে দলটিকে ভোলাকেন্দ্রিক একটি দলে পরিণত করেছেন। সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত জাতীয় পার্টির কারোরই নেই। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে, মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার জন্যই যেন রাজনীতি! আর এ রাজনীতির কারণেই জাতীয় পার্টি আগামীতে তার অস্তিত্ব হারাবে। বুধবার খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে নয়া কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তার বক্তব্যের অনেক দিক আছে। প্রথমত, তিনি কোনো অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি বোধকরি উপলব্ধি করেছেন, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এ সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও তা সমর্থন করে না। বিএনপি ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে কূটনীতিকরা সবাই ওই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ‘চাপ’ প্রয়োগ করার জন্য এ ধরনের সমাবেশ বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত। তৃতীয়ত, বিএনপি ২৯ জানুয়ারি কালো পতাকা প্রদর্শনের ডাক দিয়েছে। সবার জানা ওই দিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। চতুর্থত, খালেদা জিয়া আবার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার কথা বলেছেন। এটাও ভালো দিক। এতে করে কর্মীদের ধরে রাখা ও উজ্জীবিত করা সহজ হবে। পঞ্চমত, খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলেছেন। এই প্রচেষ্টাও ভালো। মূলত একটি সমঝোতা ও সংলাপের কথা সবাই বলছেন। দাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে এ সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ আহ্বান নিঃসন্দেহে এখন একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপাতত সহিংসতানির্ভর রাজনীতির অবসান ঘটল। ক’দিন পরই ভাষার মাস। সুতরাং ভাষার মাসে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে না, এটাই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। এ মাসেও বিএনপি হরতাল আর অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবে না, এটাও ধারণা করা যায়। কিন্তু তাতে করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান হবে কি? আমার মনে হয় না। সরকার যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা থেকে যাবে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর ‘রাজনীতির বল’টা এখন স্পষ্টতই সরকারের কোর্টে। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তাহলে সমস্যা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থেকে যাবে। বরং তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কছেদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে বলেছেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল, এর সঙ্গে অনেকেই ঐক্য করেছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তিনি হয়তো এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেবেন। কৌশলগত কারণে সম্পর্কছেদের বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। এর আগে তো তিনি একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। আমরা যারা রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, তারা সবাই জানি রাজনীতি বিষয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটি ‘রাজনীতিতে স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই, স্থায়ী কোনো শত্রু নেই।’ এটা তো সত্য, এ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। ১৯৮৬ সালে দেশে যখন তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (এরশাদীয় জমানায়), তখন বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। সুতরাং রাজনীতিতে ‘স্থায়ী শত্রু, স্থায়ী মিত্র’-এর ধারণা থেকে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য টিকে আছে। আগামীতে এ ঐক্য নাও টিকে থাকতে পারে। তাই বোধকরি খালেদা জিয়া বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি এবার যাচ্ছেন ধীরগতিতে। নির্বাচনটা হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভাও হয়ে গেছে। এটাই বাস্তবতা। এই মন্ত্রিসভা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, নির্বাচন নিয়ে যত বিরূপ মন্তব্যই আসুক না কেন, সরকার এটাকে আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। তাই বিএনপি তথা ১৮ দলের কাছে বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১৮ দল এখন হরতাল নয়, বরং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখেই তাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছে। এ কারণেই দেখা যায়, বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার পুরো বিষয়টিই এখন নির্ভর করছে সরকারের ওপর। Daily Alokito Bangladesh 22.01.14

0 comments:

Post a Comment