টক শো: গণতন্ত্র চর্চার বিকল্প মাধ্যম
16:34
1 comment
কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করতে চাই। দৃশ্যপট এক। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত একটি চ্যানেল। আমন্ত্রিত ‘টকার’দের (যারা কথা বলেন) মাঝে আমিও একজন। বাড়িতে বসে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন একজন মন্ত্রী, যিনি ক’দিন আগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আর রাজনীতি করবেন না। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন! কিন্তু তিনি রাজনীতি করছেন এবং মন্ত্রীও হয়েছেন। প্রসঙ্গ ছিল চলমান রাজনীতি। কিন্তু আলোচনা এগোলো না। তিনি হঠাৎ করেই আক্রমণ করে বসলেন আমরা যারা আলোচনা করি ‘টক শো’গুলোতে তাদের ওপর। বললেন ‘জ্ঞানপাপী।’ বললেন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় আমরা প্রধান অন্তরায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কয়েকজন মন্ত্রীর মতো তিনি উত্তেজিত হয়ে কথা বলেননি। অত্যন্ত মার্জিত ভাষাতেই তিনি টিভির ‘টকার’দের সমালোচনা করলেন। আমরা অর্থাৎ দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তা শুনলাম। মন্ত্রীর সঙ্গে তো আর ‘বেয়াদবি’ করা যায় না। দৃশ্যপট দুই। বারিধারায় অবস্থিত একটি চ্যানেলের স্টুডিও। আলোচকদের মাঝে আমিও একজন। অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক যিনি পড়ান টেলিভিশন এবং ফ্লিম মেকিংয়ের ওপর। আলোচনাটা ছিল জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে বিরোধী দলে ও মন্ত্রিসভায় থাকা নিয়ে। আমি বলছিলাম এটা ঐকমত্যের সরকার নয়। ঐকমত্যের সরকার বললে দৃষ্টান্ত দিতে হবে জার্মানির, যেখানে অতি সম্প্রতি ক্ষমতাসীন সিডিইউ প্রধান বিরোধী দল এসপিডিকে সঙ্গে নিয়ে একটি সরকার গঠন করেছে। ওই অধ্যাপক দৃষ্টান্ত দিলেন ওবামা প্রশাসনের। বললেন তার দেশরক্ষা মন্ত্রী চাক হেগেল রিপাবলিকান পার্টি করেন এখনো। কথাটা কি সত্যি? চাক হেগেল সিনেটর ছিলেন ১৯৯৬-২০০৮ সময়সীমায়। এরপর তিনি আর রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি বুশের ইরাক নীতির সমালোচনা করেছিলেন। এই দৃষ্টান্ত কি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? একজন অধ্যাপক যদি বিভ্রান্তকর বক্তব্য দেন তাতে মন্ত্রীরা তো ‘জ্ঞানপাপী’ বলবেনই। দৃশ্যপট তিন। একই চ্যানেলের ৫ ফেব্র“য়ারির রাতের শো। উপস্থাপক একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক। তিনি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং মিডিয়া বিষয়ে পড়ান কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলোচনার শুরুতে আমি জানলাম তিনি আমার লেখার সঙ্গে আদৌ পরিচিত নন। পড়েননি কখনো! যিনি রাজনীতি নিয়ে ‘শো’ করেন, আমার লেখা তার চোখে পড়েনি! কী অবাক কাণ্ড! রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কলাম লিখছি আজ কত বছর? সেই মধ্য আশির দশক থেকে। রাজনীতি নিয়ে আমার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৩২টিরও মতো। তিনি সাংবাদিকতা পড়ান। তিনি কি আদৌ পড়েননি আমার রাজনৈতিক কলামগুলো! নাকি শুধু এটা তার অহংকার! সত্যকে অস্বীকার করা? দৃশ্যপট চার। মগবাজার এলাকায় অবস্থিত একটি চ্যানেল। ওখানে আমার যাতায়াত নিয়মিত। চলতি ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম দিকে আমন্ত্রণ পেলাম। বিষয় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) সাম্প্রতিক জরিপ যেখানে বলা হয়েছে, ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ যদি নির্বাচন হতো তাহলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী ৪২.৭ ভাগ আর বিএনপি ৩৫.১ ভাগ ভোট পেত। আমার সঙ্গে আলোচক ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি ব্যবসা প্রশাসনের শিক্ষক। রাজনীতির গতিধারা, রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কোনোদিন একটা প্রবন্ধ লেখেননি। অতি সম্প্রতি ‘নানা কারণে’ তিনি আলোচিত এবং প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে তাকে নিত্য দেখা যায়। তিনি আবার ‘অতি কৌশলে’ ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি ব্যবহার করেন না। ডিআইয়ের ওই ‘গবেষণা’ নানা কারণে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং কিছুদিন আগে দেশের দুটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) যে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল (যা একটি বিদেশি জরিপ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত), তার সঙ্গে ডিআইয়ের জরিপের কোনো মিল দেখা যায় না।
আমাদের সহকর্মীদের অনেকেই যারা এ ধরনের সার্ভে করেন তাদের ভেতরে একটি প্রশ্ন সব সময়ই কাজ করে যে, এ ধরনের দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে মতামত নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা? যেখানে বাংলাদেশে ভোটার সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৮৫২ জন, সেখানে মতামত নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৫০০ ব্যক্তির। সেই সঙ্গে মোবাইলে মতামত নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৪ জনের। এতে কি কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়? উপরন্তু ৫ জেলায় আদৌ কোনো ভোট হয়নি, ১৫ জেলায় মাত্র ১টি আসনে ভোট হয়েছে, ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন (আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টির ২, জামায়াতের ৩, জাতীয় পার্টির ২০, জেপির ১) সেখানে কোন কোন এলাকায় সার্ভে করা হলো? আমি ডিআইয়ের ওয়েবসাইটে গেলাম, সেখানে এই সার্ভের কোনো ফলাফল নেই। ওই ভদ্রলোক (নামটা উল্লেখ করলাম না। খুব নামিদামি ব্যক্তি) অবলীলায় ‘ভুল তথ্য’ দিয়ে বলে গেলেন প্রথম আলো ও স্টারের জরিপ ভুল! সার্ভে সঠিক হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। চ্যানেলে এ ধরনের আলোচনায় ‘ঝগড়া’ করা যায় না। সেটা শোভনও নয়। কিন্তু লক্ষ্য করলাম ‘জোর করে’ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করার একটা প্রবণতা। সেই একই কাজটি তিনি করলেন জিটিভির অনুষ্ঠানে। এবার সরাসরি আক্রমণ করে বললেন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে। মেজর (অব.) আখতারের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলেন! আর যায় কোথায়? লাখ লাখ দর্শক লাইভ সম্প্রচারে দেখল দু’জনের মধ্যকার ঝগড়া, এমনকি প্রায় মারামারি পর্যন্ত। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের রুচি কোথায়, কীভাবে টক-শো’তে কথা বলতে হয় তা তিনি জানেন না। অথচ ওইসব ব্যক্তিকেই চ্যানেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়! দৃশ্যপট পাঁচ। একটি নিবন্ধ ‘টক শো আর টকারদের কথা।’ লেখক সৈয়দ ইমতিয়াজ রেজা, ব্যক্তি জীবনে যিনি ৭১ চ্যানেলের বার্তা বিভাগের পরিচালক। এটি প্রকাশিত হয় অনলাইন সংবাদপত্র নতুন বার্তায় গত ৩১ জানুয়ারি। ওই নিবন্ধে তিনি অনেক সাহসী কথা উচ্চারণ করেছেন। যেমন বলেছেন, ১. ‘টক শো’তে অসৎ একজন সম্পাদকের কদর সবচেয়ে বেশি, ২. যারা পত্রিকা চালাতে পারেন না, তারা ‘টক শো’তে এসে জ্ঞান দেন, ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সব বিষয়ে জ্ঞানী। পড়ান সাংবাদিকতা, বলেন অর্থনীতি নিয়ে ৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বউ পেটানো’ অধ্যাপক ‘টক শো’তে নীতিমালার কথা বলেন। ক্লাস ফাঁকি দেন ইত্যাদি। ব্যক্তিগতভাবে রেজা সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি যেসব কথা বলেছেন বা অন্যের উদ্ধৃতি দিয়ে (শওকত হোসেন মাসুম, প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক) উল্লেখ করেছেন তা সব মিথ্যা বলি কী করে? মজার ব্যাপার হলো তার নিজের চ্যানেলেই ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়, যারা আলোচিত বিষয় নিয়ে কোনো ধারণা রাখেন না। এটা কেন হয়? তাহলে কি তিনি নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন? তার সঙ্গে আমি একমত। অর্থনীতির বিষয় হলে অর্থনীতির অধ্যাপককে ডাকা ভালো। আর রাজনীতির বিষয় হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এ বিষয়ে ভালো বলতে পারতেন। কিন্তু টিভি সাংবাদিকতা কিংবা ফিল্ম পড়ানো ‘অধ্যাপক’ যদি রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান দেন, তখন প্রশ্ন উঠবেই। ‘অসৎ সম্পাদক’দের কথা বলেছেন তিনি। চারজন সম্পাদক এখন ঘুরে ফিরে সব চ্যানেলেই আসেন। এর মাঝে দু’জন উপস্থাপকের অনুষ্ঠানে একাধিকবার আমি আমন্ত্রিত হয়েছি। দুজন ‘টকার।’ তাদের একটা চাহিদা আছে। বাকি দুজনকে আমি চিনি ২০ বছরের ওপরে। কিন্তু এই দুজন সম্পর্কে আমার কখনো মনে হয়নি, তারা ‘জ্ঞান’ দেন। ‘বউ পেটানো’ অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাকে খোঁচা দিলেন বলতে পারব না। তবে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই ‘টক শো’তে আসেন। যারা আসেন, তারা কেউ ‘বউ পিটিয়েছেন’ বলে আমার জানা নেই। আমার নিজের ‘বউ’ও থাকেন আমেরিকাতে।
মূল কথা হচ্ছে একটিই ‘টক শো’ থাকবে কি থাকবে না। শুনছি একটি নীতিমালা নাকি করা হচ্ছে। আরো একটি কথা শুনলাম সরকার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাদের যাতে আমন্ত্রণ না জানানো হয়। কোন একটি চ্যানেলে নাকি একটি লিস্টও পড়ে শোনানো হয়েছে যে কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রথম কথা হচ্ছে সরকার যদি এটা পাঠিয়ে থাকে তাহলে সরকার ভুল করেছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হবে না। তাছাড়া, যদি সরকার সমর্থকদের দিয়ে ‘টক শো’ পরিচালনা করা হয়, তাহলে ‘টক শো’ জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে না। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এটা চাইবেন না। চ্যানেলগুলোর ‘টক শো’র মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। যেখানে সংসদ হয়ে পড়েছে এক দলীয়, যেখানে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই সেখানে কথা বলার মাধ্যম তো এই চ্যানেলই। এখানে সরকারের সমালোচনা হয়। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা তো সরকারের জন্যই মঙ্গল। সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীরা কখনোই সরকারের সমালোচনা করবেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি সরকারকে সঠিক পথটি ধরিয়ে দেয়, সেটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। এটাকে ‘সরকারের সমালোচনা’ ধরলে ভুল করা হবে। টক শোগুলোতে সরকারের ভুল-ত্র“টিগুলো ধরিয়ে দেয়া হয়। এটা যে কোনো সরকারের জন্যই মঙ্গল। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা তো আরো জরুরি। যেখানে দশম সংসদে ‘বিরোধী দল’ হচ্ছে সরকারেরই অংশ, এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির সমালোচনা হবে কম। ফলে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যেতে পারে এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি সংসদের যে জনপ্রিয়তা, তাতে ধস নামবে। ‘টক শো’গুলো বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিকল্প মাধ্যম বলেই মানুষ গভীর রাতে এসব শোনেন এবং দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে একটা ধারণা পান। নীতিমালা থাকতে পারে। জঙ্গিবাদবিরোধী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী কিংবা জাতীয় নেতাদের ব্যাপারে কটূক্তি নিষিদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি ‘নির্দেশ’ থাকতেই পারে। তবে তাই বলে ‘টক শো’ নিয়ন্ত্রণ নয়।
টক শো সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই শুনি। বলা হয় ‘টক শো’ উপস্থাপকরা একটি বিশেষ মর্তাদশের অনুসারী এবং তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। অন্তত একটা চ্যানেল সম্পর্কে আমি এই সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। আমি অনেক চ্যানেলেই যাই। অনেকের উপস্থাপনায় আমি অংশ নিতে আগ্রহ বোধ করি। বিশেষ করে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এক সময়ের সাংবাদিক এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিষয়ের গভীরে গিয়ে তিনি মূল সত্যটি বের করার চেষ্টা করেন। আমাকে লেখার জগতে এনেছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। সেই দৈনিক বাংলার যুগ থেকে আজ অবধি। সুকান্ত গুপ্ত অলোক, প্রণব সাহা, পান্না এদের মাঝে পেশাদারিত্ব আমার চোখে ধরা পড়েছে বেশি। অলোক যখন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে অতিথির কাছ থেকে মূল জবাবটি বের করে আনেন, তখন তার মাঝে এই পেশাদারিত্বে ফুটে ওঠে বেশি। আর প্রণব? তার মাঝে দেখেছি জানার প্রচণ্ড একটা আগ্রহ। প্রণব প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘স্যার প্রতিদিনই আপনাকে রাখতে চাই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ আমরা আর কোথাও পাব না।’ প্রণবের কথায় আমি হাসি। বলি, আপনার পক্ষেও এটা সম্ভব নয়, আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। এটা ঠিক অনেক সময় তার আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারি না। মতি ভাই আমার প্রিয় মানুষ। আর শ্যামল দা একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। এটা আমার ভালো লাগা যে এরা আমাকে আমন্ত্রণ জানান। আরো একটা কথা। বারিধারার ওই চ্যানেলের একজন প্রযোজক যখন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি আশির দশক থেকেই আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত, সেখানে তারই উপস্থাপক অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এমনকি শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি ‘টক শো’তে যখন বলেন যে, তিনি আমার লেখা পড়েন, তখন ভাবি এখনো শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ আছেন। কিন্তু দুঃখটা এখানেই রাজনৈতিক প্রোগ্রামের একজন উপস্থাপক যখন তার ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রকাশ করেন, তখন ওই চ্যানেলের ওপর আস্থাটা আর রাখতে পারি না। রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে দল চালানো যায়, কিন্তু চ্যানেল চালানো যায় না। চ্যানেলের উদ্যোক্তারা এটি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।
পড়াশোনা ও গবেষণার সুবাদে আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গেছি। আমাদের এই উপমহাদেশের সন্তান ফরিদ জাকারিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় একজন টিভি উপস্থাপক। সিএনএন কিংবা আল জাজিরার নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপকরা এক একজন স্টার। প্রেসিডেন্ট ওবামাও তাদের সমীহ করেন। নিউজ চ্যানেলগুলো টক শো করবেই। এই ‘টক শো’গুলোর কারণেই চ্যানেলগুলো টিকে আছে এবং তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশেও শুধু নিউজ বা সংবাদ বিশ্লেষণের জন্য চ্যানেল রয়েছে কয়েকটি তবে সংখ্যা খুব বেশি নয়। সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণও যে বিনোদন দিতে পারে তা দু’একটি চ্যানেল প্রমাণ করেছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। সময় চ্যানেল তরুণ প্রজন্মনির্ভর। যারা চ্যানেলটি চালান, উপস্থাপন করেন, তাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশের ঘরে, সংবাদকর্মীদের আরো কম, ত্রিশের নিচে। এই প্রচেষ্টাকে আমি ভালো মনে করি। তুষার আবদুল্লা নিজেও ত্রিশের ঘরে। তাকে আমার কখনো দলবাজ মনে হয়নি। কিংবা আহমেদ জোবায়ের এরা নতুন প্রজšে§র টিভি ব্যক্তিত্ব। মানুষকে এরা সম্মান দেন। কোনো অহংকার নেই। কোনো বাহাদুরিও নেই। একটা টিভি চ্যানেল এভাবেই দাঁড়ায়। যখন টিভি রেটিংয়ে সময়কে শীর্ষে দেখি তখন ভালো লাগে। তবে তুলনামূলক বিচারে দেশ টিভির টক শো আমার মনে হয়েছে বেশ গোছানো ও সুপরিকল্পিত। পুরনো চ্যানেলগুলো নতুনদের কাছে দাঁড়াতে পারেনি শুধু ভুল পরিকল্পনার কারণে।
পাঁচটা দৃষ্টান্ত দিয়ে টিভির ‘টক শো’গুলোর বর্তমান অবস্থা বোঝাতে চেয়েছি। ‘টক শো’গুলোর জনপ্রিয়তা আছে। মানুষ গভীর রাতে এসব টক শো দেখে। বলাই যায় এক ধরনের বিকল্প গণতন্ত্র চর্চার জন্ম হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। কিন্তু অর্থনীতির অধ্যাপক যদি রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন, যদি ফিল্ম বানানোর অধ্যাপক ‘রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ’ হয়ে যান তখন কোনো কোনো ব্যক্তি ‘বউ পেটানো অধ্যাপকের’ মতো অবান্তর প্রশ্ন তুলে ‘টক শো’র গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দেবেন বৈকি! মন্ত্রী মহোদয়রা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন যে ‘সংসদে ঘুমিয়ে থেকে’ যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সেখানে ‘টক শো’গুলোতেই সরকারি নীতির সমালোচনা করা হয় যা সংসদে হওয়া উচিত ছিল। আমরা সংসদ আলোচনা বা ডিবেটকে প্রাণবন্ত করতে পারিনি শুধু একটি কারণে আর তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, কেউ কাউকে সহ্য করতে না পারা, কিংবা জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে কটূক্তি করা। ‘টক শো’তে এটা কম হয়। এ জন্যই ‘টক শো’গুলো জনপ্রিয়। ‘টক শো’ থাকুক। মন্ত্রীরাও এতে অংশ নিন। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক হবে না ‘রাজনৈতিক কর্মীদের’ উপস্থাপনার দায়িত্বটি দেয়া। সেই সঙ্গে যিনি আদৌ বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক প্রবন্ধ পড়তে আগ্রহবোধ করেন না, কিংবা বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ পড়ে একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা নিয়ে পর্দায় আসেন, তার উচিত হবে পর্দার আড়ালে থেকেই ‘চাকরি’ করে যাওয়া! কোনো ব্যক্তি বিশেষের কারণে আমার এতদিনের অর্জনকে আমি ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি না। আমি রাজনীতি করি না। ‘টক শো’গুলো আমার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মও নয়। সত্যকে ধারণ করি আর সত্যটাই বলে যেতে চাই। যিনি এই মানসিকতা ধারণ করে আমন্ত্রণ জানাবেন, আমার অন্তত তাতে সায় থাকবেই
Daily MANOB KONTHO
13.02.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
দারুণ
ReplyDelete