রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আরব বসন্ত কি জঙ্গিবাদ উসকে দিয়েছে?

‘আরব বসন্ত’ চতুর্থ বর্ষে পা দিয়েছে। তিউনেসিয়ার ছোট্ট ও অখ্যাত সিদি বওজিদ শহরের বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট বোউয়াজিজির আত্মহননের মধ্য দিয়ে অন্যায়-অত্যাচারের যে প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন, তা রূপ নিয়েছিল ‘আরব বসন্তে’। সেই প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছিল তিউনেসিয়া থেকে মিসর, ইয়েমেনে ও লিবিয়ায়। একের পর এক পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী সরকারের। রচিত হয়েছিল ইতিহাস। সেটা ২০১১ সালের কথা। তারপর কেটে গেছে তিন বছর। এরই মাঝে এ অঞ্চলে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। বোউয়াজিজির নিজের দেশ তিউনেসিয়ায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলেও সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধান রচনা করার ব্যর্থতা আর বিরোধী দলের নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার রেশ ধরে সেখানে মেহদি জোমাকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবে। বলা ভালো, দীর্ঘদিন অচলাবস্থা চলার পর দেশটির সংসদ একটি নয়া সংসদ অনুমোদন করেছে। দেশে ইসলামী শাসন বাতিলের বিষয়ে সম্মত হয় সংসদ। তবে সংবিধানে দেশটির রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামকেই রাখা হয়েছে।মিসরে গণঅভ্যুত্থানে হোসনি মোবারকের পতন সুখের হয়নি মিসরবাসীর জন্য। মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থী মুরসির বিজয় একটি সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেনাবাহিনী পুনরায় সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে মিসর আবার ফিরে গেল পুরনো বৃত্তে। ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের শাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহর অপশাসনের অবসান ঘটলেও সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে আবদ রাব্বু মনসুর হাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও সেখানে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো কী হবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি ‘ন্যাশনাল ডায়লগ কনফারেন্স’, যাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার।লিবিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ। গাদ্দাফি হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে সংসদ বা জেনারেল পিপলস কংগ্রেসের নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু নয়া সংবিধান এখনও রচিত হয়নি। ইতিমধ্যে সেখানে খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করার জন্য একটি গণপরিষদের নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে। ৬০ সদস্যবিশিষ্ট এই গণপরিষদের নির্বাচন হবে ২০ ফেব্র“য়ারি। এই গণপরিষদ আগামী ১২০ দিনের মধ্যে নতুন একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করবে এবং ২০১৪ সালের শেষদিকে সেখানে পূর্ণাঙ্গ সংসদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে পুরনো কাঠামো এখনও বজায় রয়েছে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
সিরিয়ায় পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। প্রেসিডেন্ট আসাদ এখনও রয়ে গেছেন ক্ষমতায়। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ দেশান্তরিত হয়েছে। সেখানে শেষ মুহূর্তে মার্কিন হামলা এড়ানো গেছে বটে, কিন্তু জেনেভা সম্মেলনে যদি কোনো ‘সমাধান’ না হয়, তাহলে সেই হামলার সম্ভাবনা আরও বাড়বে।আরব বসন্ত একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল যে, সেখানে একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবাধিকার রক্ষিত হবে। সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যে সম্ভাবনা নিয়ে আরব বসন্তের জন্ম হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই অতীত। আরব বসন্ত যখন চতুর্থ বর্ষে পড়েছে, তখন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে। মিসরে বহুল আলোচিত সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এখন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদাংকই অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এপ্রিলে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর জেনারেল সিসি তাতে প্রার্থী হচ্ছেন। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে তিনি সেনাঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। সেনাবাহিনীর শীর্ষ সামরিক পরিষদ ইতিমধ্যে তার এই মনোনয়নকে সমর্থন করেছে। এর মধ্য দিয়ে মিসরে সিসির যুগ শুরু হচ্ছে এই এপ্রিল থেকেই। অন্যদিকে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিচার হচ্ছে একটি বেসামরিক আদালতে। যদিও তিনি নিজেকে এখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার পূর্ব পদে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি মিসরের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও বেশি মাত্রায় ইসলামের দিকে ঝুঁকেছিলেন। মিসরকে তিনি খুব দ্রুত একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কোনো কোনো আইনে নারীদের অধিকারও খর্ব করা হয়েছিল। তাহরির স্কোয়ারের ‘বিপ্লবীরা’, যাদের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, তারা এটা চাননি। আর এ সুযোগটাই নিয়েছিল সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার গত ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি সেখানে সংবিধানের পক্ষে একটি গণভোটের আয়োজন করে। প্রস্তাবিত সংবিধানের পক্ষে শতকরা ৯৮.১ ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে। ব্রাদারহুড এই গণভোট বর্জন করেছিল। প্রস্তাবিত সংবিধানে এ ধারাগুলো সংযোজন করা হয়েছে- ১. প্রেসিডেন্ট ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। তবে তিনি দু’টার্মের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না; ২. ইসলাম হবে রাষ্ট্রধর্ম; ৩. ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ বা ভৌগোলিকতাকে কেন্দ্র করে দেশে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না; ৪. আগামী ৮ বছর প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেবে সেনাবাহিনী।এদিকে জেনেভা থেকে এসেছে হতাশাজনক খবর। জেনেভায় সিরিয়ার সরকার পক্ষ ও বিরোধীদের মধ্যে আলোচনা (যা জেনেভা-২ নামে পরিচিত) ব্যর্থ হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ থাকবেন কী থাকবেন না- এটা একটা প্রধান ইস্যু। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেবে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আলোচনায় সরকারি পক্ষ ‘নীতিগত ঘোষণা’ সংবলিত যে অবস্থানপত্র উত্থাপন করে, তাতে ক্ষমতা পরিবর্তনের কোনো কথা উল্লেখ নেই। ফলে একটি জটিলতা রয়েই গেল। একই সঙ্গে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের আরও ব্যাপ্তি হয়েছে। সরকারি বাহিনীর হাতে প্রায় একশ’ বিদ্রোহী সেনা মারা গেছেন জেনেভা আলোচনা চলাকালীন। আরও একটি উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন নুসরা ফ্রন্ট কর্তৃক সিরিয়ার তেল কূপগুলোর (ফালুজা শহরে) দখল। এটা পশ্চিমা বিশ্বে একটি ভুল সিগনাল পৌঁছে দিতে পারে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা যুদ্ধের সম্ভাবনা কমিয়ে আনলেও সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান একটি বড় ধরনের সংবাদের জš§ দিয়েছে। এটি এখন আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। কোনো কোনো অনলাইন সংবাদপত্রে [ফ্রন্টপেইজ ম্যাগ (২০ সেপ্টেম্বর)] এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বাহ্যত আল কায়দাকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন। গেল বছর লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাটি ‘আইএইচএস জেন’ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে (সংখ্যায় প্রায় এক লাখ), সেই বিদ্রোহী বাহিনীর প্রায় অর্ধেক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে লন্ডনের জেন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি কোনো অপরিচিত নাম নয়। জেনের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালনা করেন চার্লস লিস্টার। লিস্টার তার গবেষণায় এটাও উল্লেখ করেছেন, বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা রয়েছেন, যারা আদৌ সিরিয়ার নাগরিক নন। তারা জঙ্গিবাদী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট, ইসলামিক টেস্ট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার ব্যানারে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার একটা বড় অংশ চলে গেছে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর কাছে। এখন এমন ধারণাও পোষণ করা হচ্ছে যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডার চলে যাবে এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের কাছে, যাদের প্রায় সবাই আল কায়দার সঙ্গে জড়িত।সিরিয়ায় আল কায়দার উত্থান নিয়ে খোদ ওবামা প্রশাসনও উৎকণ্ঠিত। গেল বছর ওয়াশিংটনে সিনেটের এক শুনানিতে (হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) টম জোসেলিনও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। যারা নিয়মিত সিরিয়ার ঘটনাবলী মনিটর করেন তাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, কিছুদিন আগে ইসলামী জঙ্গিরা আলেপ্পো শহরের কাছাকাছি আস সাদ্দাদি শহরটি (লোকসংখ্যা ৭০ হাজার) দখল করে নিয়েছিল।
জেনের গবেষণা প্রতিবেদনে যে উদ্বেগজনক দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ যোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ, লিবারেলপন্থী। বাকিরা সবাই বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। যদিও এ ধরনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না, তবে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, গবেষণা নিবন্ধ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আগামীতে যদি আসাদ সরকারের পতন ঘটে, তাহলে কোন শক্তি সিরিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে?সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্র“পগুলো কোনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না। তারা বিভিন্ন গ্র“প, উপ-গ্র“পে বিভক্ত। এককভাবে কোনো বিরোধী দল বা গ্র“প নেই, যারা আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় সরকার গঠন করতে পারে। এ সময় সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাউন্সিল এখন বিলুপ্ত। এর পরিবর্তে গঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিরিয়ান রেভ্যুলেশনারি অ্যান্ড অপজিশন ফোর্সেস’ (এনসিএসআরও)। এটি গঠিত হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে দোহায়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আহমেদ জারবা এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যেখানে সংসদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হবে। এরা আসাদ সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন না। এদের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল তাদের সমর্থন করে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মরক্কোর মারাকাশে আসাদ বিরোধীদের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় ১০০ দেশ সেখানে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল, তাতে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এদের সমর্থন করে। সিরিয়ার বামপন্থীরা ‘ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি’র ব্যানারে কাজ করে। মোট ১৩টি দল এ ব্যানারে রয়েছে। কুর্দিরাও এ ব্যানারের আওতায় কাজ করে। এর বাইরে রয়েছে ইসলামিক শক্তিগুলো, যাদের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে জাবহাল উল নুসরা। মোট ১২টি ইসলামী জঙ্গি সংগঠন সিরিয়ান ইসলামিক ফ্রন্টের ব্যানারে একত্রিত হয়েছে। নুসরা ফ্রন্টের বাইরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া, আহরার আল সামের মতো সংগঠনের নাম পাওয়া যায়, যারা আলাদাভাবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার জঙ্গি সেনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, কোনো কোনো গ্র“পের হাতে ২৫ হাজার সেনা পর্যন্ত রয়েছে। যদিও এরা কেউই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নন। এদের মূল দর্শন হচ্ছে সিরিয়াকে একটি ইসলামিক এমিরাতে পরিণত করা। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মূলত সিরিয়ান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে বিদ্রোহী দলে যোগ দেয়া সেনাসদস্য ও ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের নিয়ে গঠিত। এই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও আগামী দিনের রাজনীতিতে এদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র চলে গেছে। এই অস্ত্র আগামী দিনের সিরিয়ার রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এর আগে যে দুটি দেশে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন হয়েছে (ইরাক ও লিবিয়া), সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে (২০০৩) সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হওয়ার পর একটি সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে শক্তিশালী হয়েছে, যা সাদ্দামের জমানায় ছিল না। ইরাকে এখন আÍঘাতী বোমা সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। লিবিয়ায়ও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানকার ইসলামী জঙ্গিরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের হাতেই বেনগাজিস্থ মার্কিন দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছিল এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করেছিল। এখন সিরিয়ার পরিস্থিতিও অনেকটা সেরকম।সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে গত ৩৪ মাস ধরে। ২০১১ সালের এপ্রিলে সিরিয়ায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তা মিসরের আন্দোলন দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবান্বিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়েছে। জঙ্গিদের এ উত্থান নিঃসন্দেহে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের ‘ডিলেমা’র মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আসাদ বিরোধিতাকে সমর্থন করার অর্থ ইসলামী জঙ্গিদের উত্থানকে সমর্থন করা। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি খুব সুখের হয়নি। একসময় তালেবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল মার্কিনিরা। পরবর্তীকালে তালেবানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরতে হয় মার্কিনিদের। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেক। উপরন্তু এ অঞ্চলের সন্নিহিত দেশগুলোতে রয়েছে পশ্চিমা শক্তিগুলোর সামরিক ঘাঁটি। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আরব আমিরাত ও সাইপ্রাসে। সুতরাং একটি জঙ্গিগোষ্ঠী যদি সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করে, তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র তা চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেখানে বিকশিত হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সুন্নিদের নেতৃত্বাধীন একটি জোট সেখানে আসাদের বিকল্প হতে পারে। কিন্তু ইরাকের অভিজ্ঞতা সে দেশটির জন্য আদৌ সুখের হয়নি। আপাতত বাশার আল আসাদ রয়ে যাচ্ছেন ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ২০১৪ সালেই সেখানে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আসাদের অংশগ্রহণ না করা (বিনিময়ে আসাদকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না করা), সিরিয়ার সব রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়া (যাতে আসাদ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন)- এ দুটো বিষয় সামনে রেখেই রাজনীতি এখন আবর্তিত হতে পারে। কিন্তু জেনেভা-২ আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা আসাদকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না। আরব লীগ ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আয়োজিত জেনেভা-২ আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেয় কি-না, তার প্রতিই লক্ষ্য থাকবে অনেকের। তবে ইসলামী জঙ্গিরা যে এখন সিরিয়ায় একটি শক্তি, তা বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের ভূমিকা হবে অনেকের জন্যই উদ্বেগের একটি কারণ।‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়নি। ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান সেখানে সব সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটিয়েছে। আরব বসন্ত পূর্ব পর্যন্ত আরব বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে মিসর, তিউনেসিয়া, ইয়েমেন কিংবা লিবিয়ায় নারী সমাজ এক বিশেষ অধিকার ভোগ করত। বহু বিবাহ প্রায় প্রতিটি দেশেই নিষিদ্ধ ছিল। পর্দা প্রথায় বাধ্যবাধকতা ছিল না। এখন আরব বসন্ত একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন ঘটিয়েছে সত্য; কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নারী সমাজকে কি আবার ঠেলে দেয়া হচ্ছে পর্দা প্রথায়, কঠোর ইসলামী বিধিবিধানে? প্রায় প্রতিটি দেশে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর উত্থান ও তাদের ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। আরব বসন্ত যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, তা এখন সুদূরপরাহত। সেখানে দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা শাসকদের পতন হয়েছে সত্য, কিন্তু জন্ম দিয়েছে ইসলামী জঙ্গিবাদের, যারা আগামী দিনে এ অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। Daily JUGANTOR 08.02.14

0 comments:

Post a Comment