রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকার কি মেয়াদ পূর্ণ করার কথা ভাবছে

গেল ২০ জানুয়ারি বিএনপির উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা এবং জামায়াতকে 'মাইনাস' করার পর একটা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে উঠেছে যে একটি সংলাপের ক্ষেত্র বোধ হয় তৈরি হলো। এমনকি ২১ তারিখ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বললেন দ্রুত সংলাপের কথা। গত ১০ দিনের সংবাদগুলো যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে কিংবা ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাতে একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে সংলাপ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওই সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের আপাতত কোনো সম্ভাবনাও নেই! শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে এবং বিএনপির নেতা-কর্মীরা হয়তো আশাহত হতে পারেন একথা শুনে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকার এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। এর অনেক কারণও আছে। প্রথমত, নির্বাচন নিয়ে প্রথম দিকে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে থেকে যত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই আসুক না কেন, সরকার মনে করছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তার 'অবস্থান' এখন অনেক শক্তিশালী। বিদেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দন আসছে। এর মধ্য দিয়ে তার 'লেজিটেমেসি' বেড়েছে। সরকার মনে করছে তারা খুব সহজেই পাঁচ বছর পার করে দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, যারা দশম জাতীয় সংসদে এসেছেন, তাঁরা চাইবেন না এখনই সংসদ ভেঙে দেওয়া হোক। তাঁরা চাইবেন পুরো টার্ম পূরণ করতে। বিদেশে এই সংসদ নিয়ে যত নেতিবাচক ধারণারই জন্ম হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটা সংসদ গঠিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ষষ্ঠ সংসদের বয়স ছিল মাত্র ১৩ দিন। আমরা ওই সংসদের সঙ্গে দশম সংসদকে মেলালে ভুল করব। কেননা, ওই সংসদ গঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এ কারণে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। কিন্তু দশম সংসদের কাছে এ রকম কোনো এজেন্ডা নেই। ফলে সংসদ ভেঙে দেওয়ার চাপ থাকলেও তা খুব শক্তিশালী হবে বলে মনে হয় না। তৃতীয়ত, সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে বিএনপি তথা ১৮ দল আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে 'নির্বাচন প্রতিহত' করার ডাক দিয়েও তা 'প্রতিহত' করা যায়নি। এখন সংসদ গঠিত হওয়ায় সরকারের অবস্থান ভালো। বিএনপি শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সরকার 'চাপে' থাকবে না এবং সে ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করানো যাবে না। চতুর্থত, সরকার বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা 'ব্যবধান' তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়েছে। এই কৌশলে সরকার লাভবান হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বিএনপির। সরকার কখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না! অথচ সরকার ইচ্ছা করলে তা পারে। সংবিধানের ৩৮ (গ) ও (ঘ) রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স ১৯৭২, দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর ধারা-উপধারা বলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতে দায়ের করা একটা আপিল মামলার নিষ্পত্তি করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। সরকার সেদিকে যাবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে যদি বিএনপির 'দূরত্ব' সৃষ্টি করা যায়, তাতে দুর্বল হবে ১৮ দল। আর তাতে লাভ সরকারের। সরকার, সুধীসমাজ এবং মিডিয়ার কারণে জামায়াত একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সরকারের বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। এতে করে পরোক্ষভাবে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। পঞ্চমত, দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী (ত্রাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যমন্ত্রী) সরাসরি বলেছেন, নির্বাচন চাইতে হলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অর্থমন্ত্রীর অভিমতও অনেকটা তেমনি। অন্যদিকে আরো কয়েকজন মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া বেগম জিয়ার বক্তব্যের (সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অপারেশন প্রসঙ্গে) যেভাবে সমালোচনা করেছেন, তাতে করে সংলাপের সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ হয়ে এলো। বেগম জিয়াকে 'ক্ষমা চাইতে হবে', 'জঙ্গিদের সেনাপতি' (সৈয়দ আশরাফ), 'খালেদা সঙ' (আমির হোসেন আমু), 'তিনি অশান্তি চান' (হাসানুল হক ইনু), 'তাঁর বক্তব্য বিপজ্জনক' (ওবায়দুল কাদের)- এ ধরনের বক্তব্য সংলাপের পরিবেশের জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। এমনকি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। আমরা এখানে সাতক্ষীরায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও (খালেদা জিয়ার শয়নে স্বপনে পেয়ারে পাকিস্তান) উল্লেখ করতে পারি। এতে করে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে আগামীতে সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ষষ্ঠত, নির্বাচনের পর এখন সংলাপের এজেন্ডা কী? বিএনপি যদি এখনো তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলতে চায়, তাহলে সরকারের সমর্থন তাতে থাকবে না। বিএনপি সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে) আওতায় নির্বাচন দিতে। সরকার যেভাবে সংবিধানে পরিবর্তন এনেছিল (পঞ্চদশ সংশোধনী), সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে এবং আগামীতেও হবে। এখন বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে রেখেই নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু বিএনপি কি তা করবে? এটা যদি বিএনপি করে, তাহলে প্রশ্ন আসবে বিএনপি তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিল না কেন? সপ্তমত, সরকার আন্দোলনের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে জনগণ যাতে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হয় সে জন্য উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন হয় না। তবে দলীয় নেতা ও কর্মীরা অন্য মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটবে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই নির্বাচনে অংশ নেবে। এখানে বিএনপির সমর্থকরা যদি বিজয়ীও হয়, তাতে করে তা সরকারের ওপর আদৌ কোনো 'প্রভাব' ফেলবে না। এতে করে আন্দোলনও আপাতত স্থগিত থাকবে। অষ্টমত, সরকারের এখন স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা ও আইন-আদালত করে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা। নেতাদের কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও অন্য মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুদকের মামলায় নিম্ন আদালত থেকে খালাস পেলেও দুদক আপিল করেছে। নব নিযুক্ত আইনমন্ত্রী বলেছেন, তারেক রহমান নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জামিন পাবেন। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে একটি- তারেক রহমানের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করে পরোক্ষভাবে বেগম জিয়ার ওপর 'মনস্তাত্তি্বক চাপ' প্রয়োগ করা। নবমত, নতুন করে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে সরকার গঠন করেছেন, তাঁকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন 'ঐকমত্যের সরকার' হিসেবে। এ মুহূর্তে এই সরকারে চারটি দল রয়েছে- আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে এই সরকারে আরো দু-চারটি দল (সিপিবি, তরিকত ইত্যাদি) যোগ দিতে পারে। বিএনপির একটি অংশ যদি যোগ দেয়(?) আমি তাতে অবাক হব না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি 'মালয়েশিয়ান মডেল' উপহার দিতে পারেন, যেখানে উমনো বা ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও ১৩টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা বারিসোআ নেসিওনাল, যারা ১৯৬৪ সাল থেকেই জোটগতভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। সেখানে বিরোধী দলের অস্তিত্ব তেমন শক্তিশালী নয়, যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে (২০১৩) বিরোধী দল কিছুটা ভালো করেছে (বিরোধী পিপলস অ্যালায়েন্স পেয়েছে ৮৯ আসন, আর ক্ষমতাসীন ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩। মোট আসন ২২২)। বারিসোআ নেসিওনাল সেখানে 'নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র' চালু করেছে। মাহাথির মোহাম্মদ দীর্ঘ ২২ (১৯৮১-২০০৩) বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৩ সালে অবসর নেন। মালয়েশিয়ায় নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে নাগরিক অধিকার কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু নিয়মমাফিক পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না কিংবা 'ভোটকেন্দ্র দখল' কিংবা 'সিল মারার' ঘটনা কখনো ঘটেনি। তারা রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে মালয়েশিয়া আজ বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক শক্তির জন্ম দিয়েছে। শেখ হাসিনা যদি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক মডেলকে অনুসরণ করেন, তিনি ভালো করবে আপাতত মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারেও সরকারের কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। সরকারের অবস্থান এখন শক্তিশালী। কিন্তু তার পরও 'রিয়েল পলিটিকস' বলছে স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসা উচিত সরকারের। আগামী দুই থেকে তিন মাস বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবে না। বেগম জিয়া আবারও বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসভা করবেন। ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতকে মাইনাস করে বিএনপির জনসভা সফল হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে বিএনপি জামায়াতনির্ভর একটি দল নয়। এখন সরকার যদি বিএনপির এই উদ্যোগে সাড়া না দেয়, তাহলে বিএনপি আবারও ফিরে যাবে জামায়াতের মিত্রতায়। একমাত্র সংলাপ আর বিএনপিকে আস্থায় নেওয়ার মাধ্যমেই জামায়াতকে চূড়ান্তভাবে মাইনাস করা সম্ভব। একই সঙ্গে মন্ত্রীরা যত কম আক্রমণাত্মক কথা বলবেন, ততই সরকারের জন্য মঙ্গল। জাতীয় পার্টিকে একই সঙ্গে সরকারে, আবার বিরোধী দলে রেখে একটি নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া যাবে বটে, কিন্তু স্থিতিশীল রাজনীতি নিশ্চিত করা যাবে না। তাই 'অঙ্কের হিসাবে' আপাতত কোনো সংলাপ ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা না থাকলেও সরকারপ্রধান দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সংলাপের সূচনা করবেন- এটাই প্রত্যাশিত। Daily KALERKONTHO 04.02.14

0 comments:

Post a Comment