রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়!

তাঁর সোজাসাপ্টা কথা। ক্রেস্ট নয়। চাই নগদ টাকা। প্রকাশ্যে জনসভায় তিনি জানিয়ে দিলেন কোথায় কখন টাকা দিতে হবে। তিনি আমাদের সংসদের চিফ হুইপ, মন্ত্রীর পদমর্যাদা তাঁর। এর আগে একজন নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী 'স্বর্ণের নৌকা' নিয়েছিলেন। উপহার পাওয়া এই নৌকা সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি যখন পত্রিকায় ছাপা হলো, তখন তিনি এটা বেচে দিয়ে প্রাপ্ত অর্থ দান করলেন একটি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে। কাজটি ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন, একটি সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার, তিনি কি সচেতন মনে এই 'স্বর্ণ নৌকা'টি গ্রহণ করেছিলেন? তাঁর কি একবারও মনে হয়নি যে এটা নেওয়া তাঁর উচিত নয়! পত্রপত্রিকায় সংবাদটি ছাপা না হলে কি 'স্বর্ণ নৌকা'টি তিনি তার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম বিতর্কিত এবং তরুণ নেতৃত্বকে এবার মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন। এটা একটা ভালো দিক। এটা বোঝাই যায়, তিনি আগামী দশকের জন্য আওয়ামী লীগে নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ এসেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ কাজটি কী করলেন? দেশজুড়ে যখন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে তোলপাড়, সেখানে 'স্বর্ণ নৌকা' নেওয়া কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল, সেটা তিনি এখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন। আর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন চিফ হুইপ কিনা চাইলেন টাকা? টাকার কথা তিনি স্বীকার করেছেন বটে। তবে বিতর্কের মুখে একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন- টাকাটা দরকার তাঁর দলের জন্য! সত্যিই কী তাই? দল কি তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছিল? নয়া নেতৃত্ব চাই। কিন্তু কেমন হচ্ছে এই নয়া নেতৃত্ব? চিফ হুইপ কিংবা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি গাছের চারা চাইতেন, আমি খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি। হরতাল আর অবরোধের কারণে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আমাদের যে কত ক্ষতি হয়ে গেল, আমরা কেউই তা উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মন্ত্রীরা উপঢৌকন হিসেবে গাছের চারা নিন। রাস্তার পাশে নতুন করে গাছের চারা রোপণ করা হোক। মন্ত্রীদের অভ্যর্থনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে গাছের চারা কেনা হোক। লাগানো হোক হাজার হাজার গাছের চারা। একেকজন কর্মী যদি একটি করে গাছের চারাও লাগান, হাজার হাজার চারা লাগানো হবে। এতে কিছুটা ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।
চিফ হুইপের টাকা চাওয়ার ঘটনা যখন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ঠিক তখনই ছাপা হয়েছে আরো একটি সংবাদ- নারী আসনে নতুনরা প্রাধান্য পাবেন আওয়ামী লীগে। সংবাদটিতে আমি খুব উৎসাহ বোধ করছি না। কেননা সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাঁদের নাম দেখলাম, তাতে হতাশা আরো বাড়ল। একজন অভিনেত্রী, একজন চিত্রনায়িকা, একজন ভাস্কর্য শিল্পী সবাই মহিলা এমপি হতে চান! একজন মঞ্চ অভিনেত্রী বা একজন নায়িকার এমন কী অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান রয়েছে যে তিনি একজন আইনপ্রণেতা হতে চান? তাঁদের জন্য কি মঞ্চ বা সিনেমাই ভালো জায়গা নয়, যেখানে তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারবেন। সংসদ কেন? পুরনো সংসদে (নবম জাতীয় সংসদ) আওয়ামী লীগের অনেক এমপি বারবার বিতর্কিত হয়েছেন। অশ্লীল বাক্য ব্যবহার, উত্তেজিত হয়ে কথা বলা, গালিগালাজ করে তাঁরা সংসদের সৌন্দর্যও নষ্ট করেছেন অনেক। তাঁদের আবারও মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। অনেক মহিলা এমপি আছেন। বিগত পাঁচ বছরে তাঁরা সংসদে আদৌ একটি কথা বলেছেন কি না সন্দেহ। তাঁদেরও মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। সমাজের নামিদামি অনেক সমাজকর্মী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাঁদের দলে টানতে পারে। তাঁদের সুযোগ করে দিতে পারে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। একজন ড. শিরীন শারমিন শুধু একজন নারী হিসেবেই নন, একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই তিনি আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তাই বিতর্কিত মহিলা এমপিদের বাদ দিয়ে যোগ্য নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক আওয়ামী লীগ। নতুন নেতৃত্ব দরকার। সিনিয়র রাজনীতিবিদরা আর কত দিন রাজনীতির মাঠে বিচরণ করবেন? দশম সংসদে তাঁদের দু-একজনকে দেখেছি বটে, কিন্তু একাদশ সংসদে তাঁরা থাকবেন কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ভারতে কিন্তু একটা নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে এসেছে। তারা আধুনিক মনস্ক, উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তিবান্ধব। যদিও অনেকেই এসেছেন পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে। আমি তাতে দোষ দেখি না। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, তাতে কংগ্রেস জোট যদি বিজয়ী হয়, তাহলে রাহুল গান্ধী হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতাও বটে। তবে তাঁর চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে তিনি একটি তরুণ প্রজন্মকে তাঁর সঙ্গে পেয়েছেন। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের যত অভিযোগই আনুক না কেন, তিনি ভারতব্যাপী একটি 'ইমেজ' তৈরি করে ফেলেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি।
প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ! সিঙ্গাপুরে লি ফুয়ান ইউর ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তিনি প্রমাণ করেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপাইনে কোরাজন আকিনোর ছেলের বেলায়ও একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে-Vasudua kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায়। 'all the universe is a family'। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরা শাসন করেন। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহেরু পরিবারের বাইরে বেশ কিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যাঁরা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, চরণ সিং, দেবগৌড়া, সারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিঙ্গিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পৃথক নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ভবিষ্যতে সক্রিয় হবেন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন, আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, যিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি, তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তাঁর বিদেশি স্ত্রী, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতির কোনো কারণ হতে পারে না। একুশ শতকে এক তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগকে সজীব ওয়াজেদ জয় একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। গেল বছর জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমি নেতৃত্বের একটি 'গন্ধ' পাচ্ছি। তিনিই বিএনপির নেতা। বেগম জিয়া-পরবর্তী দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যে 'ভুল' করেননি, তা নয়। অতীত থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি যথেষ্ট 'ম্যাচিওরড'। তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তিনি বাংলাদেশকে ২১ শতকে নিয়ে যেতে চান। বিএনপিকে এখন এই তরুণ নেতৃত্বের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাদের নিয়ে আসতে হবে স্থায়ী কমিটিতে। স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে যাঁরা আছেন, তাঁদের দু-একজন বাদে অনেকেই কর্মহীন। প্রত্যাশা অনুযায়ী দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না।
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দরকার। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেওয়া এবং রাজনীতি থেকে তাঁদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিকে উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা- এই যে রাজনীতির চিত্র, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁরা জাতির জন্য কোনো 'রোল মডেল' নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমেদ, আজ এত বছর পর দল কি 'আরেকজন শেখ মুজিব' কিংবা 'আরেকজন তাজউদ্দীন' তৈরি করতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে। কিন্তু 'স্বর্ণ নৌকা' উপহার নেওয়া, সাধারণ মানুষের কাছে নগদ টাকা চাওয়া, বাস-ট্রাক বন্ধ করে সড়ক দখল করে হুইপের সংবর্ধনা নেওয়া (কালের কণ্ঠ, ৯ ফেব্রুয়ারি) আর যা-ই হোক, এতে আস্থার জাগয়াটা তৈরি হয় না। চিফ হুইপ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী স্বর্ণ বিক্রি করে সে টাকা দান করেছেন। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা এ ধরনের তরুণ নেতৃত্ব আদৌ চাই না। এ থেকে আমাদের দেশের তরুণ নেতৃত্ব যদি কিছু শেখেন, সেটা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া। বাস্তবতাই হচ্ছে বাংলাদেশ তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে। তবে সেই তরুণ নেতৃত্বকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিকমনস্ক। মানুষের পাশে থাকার মানসিকতা তাঁদের থাকতে হবে। শত শত তোরণ তৈরি করে (শেরপুর) জোর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা নেওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে যে 'ইমেজ' তৈরি হয়, তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। তরুণ নেতৃত্ব আসুক। কিন্তু সেই নেতৃত্ব যেন 'স্বর্ণের নৌকা' আর নগদ টাকা নেওয়ার জন্য উদগ্রীব না থাকেন।
Daily Kalerkontho
19.02.14

0 comments:

Post a Comment