তার
নাম রাসেল। টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে চতুর্থ বর্ষে পড়ে। বাড়ি টাঙ্গাইল।
র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে। রাসেল জানিয়েছে, সে নিজে বহুল আলোচিত আল
কায়দার অডিওবার্তাটি ইন্টারনেটে আপলোড করেছে। সে গত ৩০ নভেম্বর ‘দাওয়া
ইল্লাহ’ নামে একটি সাইটে এটা আপলোড করে এবং পরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়।
রাসেল শিবিরকর্মী এবং শিবিরের বিভিন্ন সাইটের এডমিন। র্যাব এই অডিওবার্তার
আপলোডকারীকে গ্রেফতার করায় আমরা অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে গত ক’দিনে
এই কথিত আল কায়দার অডিও টেপ নিয়ে যে লংকাকাণ্ড ঘটে গেল, তার ব্যাখ্যা আমরা
কীভাবে দেব? আমি একাধিক টিভি চ্যানেলে কথা বলেছি। কিন্তু দু-একজন বিশেষজ্ঞ
যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে আমি অবাক হয়েছি তাদের জ্ঞানের গভীরতা দেখে। একজন
অধ্যাপক বললেন, এই টেপের সঙ্গে একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত! যদিও
তিনি এটাও বলেছেন, এটা সাজানো নাটক। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তো বলেই
ফেললেন, ওই অডিও টেপের বক্তব্যের সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির অতীত বক্তব্যের
মিল আছে। ১৬ ফেব্র“য়ারি (যেদিন এটি প্রকাশ পায়) থেকে ১৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত
তিনি অন্তত গোটা সাতেক চ্যানেলে একই কথা বলে গেছেন। এ ধরনের বিশেষজ্ঞরা
যখন প্রকাশ্যে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। এ
ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেয়ার আগে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের ধরন,
আল কায়দার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের স্ট্র্যাটেজি, বাংলাদেশে ইসলামী
রাজনীতির সংস্কৃতির ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবে
বলতেই হবে, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার হাফিজ কিংবা সাখাওয়াত হোসেন এ ব্যাপারে
যথেষ্ট অগ্রগণ্য। সাখাওয়াত সাহেব আল কায়দা নিয়ে লিখেছেন। তার প্রকাশিত
একটি গ্রন্থে একটি অধ্যায়ও রয়েছে আল কায়দা নিয়ে। টিভি চ্যানেলে তিনিও কথা
বলেছেন। তবে তিনি এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।প্রসঙ্গক্রমে আল কায়দা
নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিন লাদেনের মৃত্যুর (অথবা হত্যা) পর আমি
যুগান্তরে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি আল কায়দার ভবিষ্যৎ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। আমি
বলার চেষ্টা করেছি, আল কায়দা তার স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনেছে। যারা এ
সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তাদের আল কায়দা সম্পর্কে বলা ঠিক নয়। বাংলাদেশে
আল কায়দার নেটওয়ার্ক কাজ করছে, এমন একটা কথা আমরা বিভিন্ন মহল থেকে শুনে
আসছি। কিন্তু আমি গবেষণা করে দেখেছি, আল কায়দার যে স্ট্র্যাটেজি, যেভাবে
তারা অপারেশন পরিচালনা করে, বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না। আল কায়দার
তাত্ত্বিক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। তার একটি গ্রন্থ রয়েছে- ‘গ্লোবাল
রেজিস্ট্যান্স ম্যুভমেন্ট’। তার ‘স্পাইডার ওয়েব’ তত্ত্বটি এখন ইসলামী
জঙ্গিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। মাকড়সারা যেভাবে জাল বিস্তার করে এবং জাল নষ্ট
হয়ে গেলে অন্য জায়গায় গিয়ে জাল বোনে, আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত জঙ্গিরা
এভাবেই তাদের অপারেশন পরিচালনা করে। তবে ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া
পর্যন্ত তারা বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠনকে তাদের সহযোগী সংগঠন বলে মনে করে এবং
তাদের সাহায্য করে। ২০০০ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলে গঠিত হয়েছে আল কায়দা ইন
অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা, আল কায়দা ইন ইসলামিক মাগরেব, আল কায়দা ইন ইরাক।
এগুলো হচ্ছে আল কায়দার স্থানীয় সংগঠন। এর বাইরে বেশ কিছু সংগঠন আছে, যাদের
সঙ্গে আল কায়দার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেমন আল গামা আল ইসলামিয়া (মিসর),
আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া) ইত্যাদি। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় এবং
তিউনিসিয়ায় এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। সোমালিয়ার আল সাহাব কিংবা
কেনিয়ার বোকো হারাম গ্র“পের সঙ্গেও রয়েছে এদের যোগাযোগ। লিবিয়ার
পার্শ্ববর্তী দেশ মালিতে ইতিমধ্যে এরা শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। ইয়েমেনের
বিস্তীর্ণ অঞ্চল আল কায়দার নিয়ন্ত্রণে, যে কারণে আলী আবদুল্লাহ
সালেহ-পরবর্তী ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি এবং সেখানে এখনও ড্রোন বিমান
হামলা অব্যাহত রয়েছে।সুতরাং আল কায়দার বাংলাদেশে কোনো ‘সম্পর্ক’ আছে
কি-না এটা বুঝতে হলে আমাদের আল কায়দার ইতিহাস ও স্ট্র্যাটেজি বুঝতে হবে। আল
কায়দা শরীয়াহর ভিত্তিতে দেশ চালানোর পক্ষে। নুসরা ফ্রন্ট সিরিয়ায় একটি
ইসলামী আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবানের একটি
গ্র“পও আফগানিস্তানকে ইসলামী আমিরাতে পরিণত করতে চায়। ইয়েমেনেও আল কায়দা
তেমনটি চায়। এখন বাংলাদেশে যাদের আল কায়দার সহযোগী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত
করা হচ্ছে, তারা কি আদৌ এই ‘রাজনীতিতে’ বিশ্বাস করে? তারা কি চায় দেশে
শরীয়াহ আইন প্রবর্তিত হোক? জাতিসংঘ বাংলাদেশে সক্রিয় দুটি সংগঠনকে চিহ্নিত
করেছে, যারা আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দুটি সংগঠন হল ‘গ্লোবাল রিলিফ
ফাউন্ডেশন’ ও ‘আল হারমাইন’। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশে পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনকে ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরা
সবাই যে আল কায়দার রাজনীতিকে সমর্থন করে, তা নয়। অনেকের সঙ্গেই আল কায়দার
তাত্ত্বিক মতপার্থক্য রয়েছে। শায়েখ আবদুর রহমান কিংবা বাংলাভাইয়ের উত্থান
নিঃসন্দেহে জঙ্গি তৎপরতাকে উৎসাহিত করেছিল। রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে তাতে জঙ্গিবাদের অবসান ঘটেছে বলা যায় না। দেশে জঙ্গি
তৎপরতা যে এখনও নিয়ন্ত্রিত নয়, সর্বশেষ প্রিজন ভ্যান থেকে তিন জঙ্গি
ছিনতাইয়ের ঘটনাই তার প্রমাণ। তবে তারা আল কায়দার সঙ্গে জড়িত কি-না সেটা
খতিয়ে দেখতে হবে।যারা বা যে গোষ্ঠীই আল কায়দার বার্তাটি ইন্টারনেটে
ছাড়–ক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। আর রাসেল একা এ কাজটি করেছে, এটাও
আমার মনে হয় না। বলা হচ্ছে, রাসেল বাঁশের কেল্লা সাইটটির এডমিন। অথচ
বাঁশের কেল্লা থেকে জানানো হয়েছে, রাসেল তাদের এডমিন নন। সবাই জানে
ছাত্রশিবির ‘বাঁশের কেল্লা’ সাইটটি পরিচালনা করে। এখন সরকারের দায়িত্ব
খুঁজে বের করা- রাসেল কাদের হয়ে কাজ করেছে কিংবা তার উদ্দেশ্য কী ছিল।আমাদের
নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া। যদি সত্যিই এটা
প্রমাণিত হয় যে জাওয়াহিরির নাম ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলাম (কিংবা জামায়াত) এ
কাজটি করেছে, তাহলে তাদের আইনের আওতায় নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের
তদন্ত হওয়া উচিত। অডিও বার্তায় যে বক্তব্য ছিল, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও
সার্বভৌমত্ববিরোধী। যারা স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন
তোলে, তারা দেশের শত্র“। মুসলিম উম্মাহ নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর
পর শহীদ জিয়াউর রহমানের সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক
জোরদার হয়। সেই ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ এমন কিছু করেনি,
যাতে মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট, কোনো একটি পক্ষ
একটি ভুল মেসেজ দিতে চেয়েছিল। আর আমার সন্দেহটা তাই এ কারণেই যে, টেক্সটাইল
নিয়ে পড়া একটি ছেলের পক্ষে এভাবে এ বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব কি-না?বাংলাদেশকে
আমরা জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই না। এটা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার
পরিপন্থী। জঙ্গিবাদের প্রশ্নে আজ সবাইকে এক হতে হবে। আমরা যেন পাকিস্তানের
কথা ভুলে না যাই। অডিও টেপের বার্তার সঙ্গে জামায়াত ও বিএনপির অতীত
বক্তব্যের কিছু মিল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রীরা প্রকাশ্যেই তা
বলছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তা দুঃখজনক। বিএনপির মতো
একটি মূলধারার গণতান্ত্রিক দলকে আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কতটুকু
যৌক্তিক, সে প্রশ্ন উঠবেই। এই অডিওবার্তায় বিএনপির নাম নেই। কিন্তু কোনো
কোনো মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারক যখন বিএনপিকে জঙ্গি
সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তখন ব্লেইম গেমের কথাই মনে আসে। অর্থাৎ
দোষারোপের রাজনীতি! এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করছে। যেখানে ১৮
ফেব্র“য়ারি কানাডার হাইকমিশনার বললেন, কানাডা দ্রুত সংলাপ ও সমঝোতা চায়,
সেখানে একই দিন সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বললেন, বিএনপি ও জামায়াত জঙ্গি
তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এটা তো সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে দেবে! আমরা অত্যন্ত
দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করেছি, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের
পার্লামেন্টে বাংলাদেশে দ্রুত একটি নির্বাচন ও সমঝোতা নিয়ে কথা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সরকার এটাকে উপেক্ষা করে কীভাবে? আর যদি সত্যি
সত্যিই উপেক্ষা করে, তা কি এদেশের স্থিতিশীলতার জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে?
উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। এটা সরকারের জন্য একটি মেসেজ অথাৎ
নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি সিরিয়াস। সুতরাং যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হয়,
ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।আল কায়দার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত ঘৃণার
চোখে দেখা হয়। যেখানেই আল কায়দা ঢুকেছে, সেখানেই সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি
তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। সোমালিয়া আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তানও সে
পথেই যাচ্ছে। বাংলাদেশে আল কায়দার একটা বার্তা প্রচারিত হল। যেদিন রাসেলের
গ্রেফতারের খবর ছাপা হয়েছে (১৮ ফেব্র“য়ারি), সেদিন একই পত্রিকায় অনলাইনে
হাছান মাহমুদের একটি বক্তব্যও ছাপা হয়েছে (‘এই বার্তাটি আল কায়দার’)। এর
অর্থ কী? এ বক্তব্য দিয়ে তিনি কি অন্য কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন? মির্জা ফখরুল
বলছেন, আল কায়দার হুমকির কথা বলে সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে টানার চেষ্টা
করছে। উদ্দেশ্য যাই হোক, এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদকে প্রমোট করে না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তারা
জঙ্গিদের বারবার ঘৃণা করেই আসছে। বাংলাদেশে আল কায়দার কোনো স্থান নেই।র্যাবের
অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত র্যাবই রাসেলকে গ্রেফতার
করেছে। এখন যা দেখার বিষয়, তা হচ্ছে রাসেল স্বউদ্যোগে ‘অতি উৎসাহী’ হয়ে এ
কাজটি করেছে, নাকি তার পেছনে কোনো শক্তি আছে, কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের
ইন্ধন আছে। এ কাজটি র্যাবের গোয়েন্দা শাখা করতে পারবে- এ বিশ্বাসও আমার
আছে। র্যাবকে তার কাজ করতে দেয়া উচিত। আর একটা কথা। জঙ্গিবাদ একটা অভিশাপ।
আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। পরস্পরকে অভিযুক্ত করলে জঙ্গিরাই উৎসাহিত হবে
বেশি। কোনো প্রমাণ না থাকলে কোনো সংগঠনকে, কোনো শক্তিকে জঙ্গিবাদের অপবাদে
অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। এখন সত্যিকার অর্থেই দেখার বিষয়, এটা আসলেই একটা
‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা কি-না
Daily Jugantor
25.02.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment