রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

স্বর্ণের নৌকা যখন উপহার

জনপ্রতিনিধিদের স্বর্ণের তৈরি নৌকা ‘উপহার’ হিসেবে নেয়া এখন যেন ট্রেডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রথমে খবর এলো একজন নয়া প্রতিমন্ত্রীর। তারপর এলো চিফ হুইপের। তিনি নৌকা চাইলেন না। তিনি চাইলেন টাকা, তাও প্রকাশ্যে জনসভায়। আর এবার তিনি সোনার নৌকা (ফোন পিন) নিলেন বাগেরহাট-৪-এর এমপি। এবারো জনসভায় (সকালের খবর, ১৬ ফেব্র“য়ারি)। একজন নয়া প্রতিমন্ত্রীর সোনার নৌকা উপহার নেয়া সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি যখন পত্রিকায় ছাপা হলো, তখন তিনি এটা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দান করলেন একটি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে। কাজটি ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন একটি সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। তিনি কি সচেতন মনে এই ‘স্বর্ণ নৌকা’টি গ্রহণ করেছিলেন? তার কি একবারো মনে হয়নি যে এটা নেয়া তার উচিত নয়? পত্র-পত্রিকায় সংবাদটি ছাপা না হলে কি ‘স্বর্ণ নৌকা’টি তিনি তার ড্রইং রুমে সাজিয়ে রাখতেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম বিতর্কিত এবং তরুণ নেতৃত্বকে এবার মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন। এটা একটা ভালো দিক। এটা বোঝাই যায় তিনি আগামী দশকের জন্য আওয়ামী লীগে নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ এসেছে, কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ কাজটি কি করলেন? দেশজুড়ে যখন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের সহায়সম্পত্তি নিয়ে তোলপাড়, সেখানে ‘স্বর্ণ নৌকা’ নেয়া কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল, সেটা তিনি এখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে পারেন। আর মন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন চিফ হুইপ চাইলেন টাকা! টাকার কথা তিনি স্বীকার করেছেন বটে, তবে বিতর্কের মুখে একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন-টাকাটা দরকার তার দলের জন্য! সত্যিই কি তাই? দল কি তাকে এই অনুমতি দিয়েছিল? নয়া নেতৃত্ব চাই, কিন্তু কেমন হচ্ছে এই নয়া নেতৃত্ব? চিফ হুইপ কিংবা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি গাছের চারা চাইতেন, আমরা খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি। হরতাল আর অবরোধের কারণে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আমাদের যে কত ক্ষতি হয়ে গেল কেউই তা উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মন্ত্রীরা উপঢৌকন হিসেবে গাছের চারা নিন। রাস্তার পাশে নতুন করে গাছের চারা রোপণ করা হোক। মন্ত্রীদের অভ্যর্থনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে গাছের চারা কেনা হোক। লাগানো হোক হাজার হাজার গাছের চারা। একজন কর্মী যদি একটি করে গাছের চারাও লাগান, হাজার হাজার চারা লাগানো হবে। এতে কিছুটা ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।চিফ হুইপের টাকা চাওয়ার ঘটনা যখন পত্র-পত্রিকায় চাপা হয়েছে, ঠিক তখনই ছাপা হয়েছে আরো একটি সংবাদ নারী আসনে নতুনরা প্রাধান্য পাবেন আওয়ামী লীগে। সংবাদটিতে আমি খুব উৎসাহিত বোধ করছি না। কেননা সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম দেখলাম, তাতে হতাশা আরো বাড়ল। অভিনেত্রী, নায়িকা, ভাস্কর্য শিল্পী সবাই মহিলা এমপি হতে চান! একজন মঞ্চ অভিনেত্রী বা একজন চলচ্চিত্র নায়িকার এমন কী অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, তিনি একজন আইন প্রবণতা হতে চান? তাদের জন্য কি মঞ্চ বা সিনেমাই ভালো জায়গা নয়, যেখানে তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারবেন। সংসদ কেন? পুরনো সংসদে (নবম জাতীয় সংসদ) আওয়ামী লীগের অনেক এমপি বারবার বিতর্কিত হয়েছেন। অশ্লীল বাক্য ব্যবহার, উত্তেজিত হয়ে কথা বলা, গালিগালাজ করে তারা সংসদের সৌন্দর্যও নষ্ট করেছেন অনেক। তাদের পুনরায় মনোনয়ন দেয়া ঠিক হবে না। অনেক মহিলা এমপি আছেন বিগত পাঁচ বছরে তারা সংসদে একটি কথা বলেছেন কি-না সন্দেহ। তাদেরও মনোনয়ন দেয়া ঠিক হবে না। সমাজে নামি-দামি অনেক সমাজকর্মী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ তাদের দলের টানতে পারে। তাদের সুযোগ করে দিতে পারে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। একজন ড. শিরীন শারমিন শুধু একজন নারী হিসেবেই নন, একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই তিনি আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তাই বিতর্কিত মহিলা এমপিদের বাদ দিয়ে যোগ্য নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুক আওয়ামী লীগ। নয়া নেতৃত্ব দরকার। জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা আর কত দিন রাজনীতির মাঠে বিচরণ করবেন? দশম সংসদে তাদের দু’একজনকে দেখেছি বটে, কিন্তু একাদশ সংসদে তারা থাকবেন কি-না নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ভারতে কিন্তু একটা নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে এসেছে। তারা আধুনিকমনস্ক। উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তিবান্ধব। যদিও অনেকেই এসেছেন পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে। আমি তাতে দোষ দেখি না। চলতি বছরের মাঝামাঝি সেখানে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, তাতে কংগ্রেস জোট যদি বিজয়ী হয়, তাহলে রাহুল গান্ধী হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধী ইতোমধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতাও বটে। তবে তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তিনি একটি তরুণ প্রজন্মকে তার সঙ্গে পেয়েছেন। বিজেপি তার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের যত অভিযোগই আনুক না কেন, তিনি ভারতব্যাপী একটি ‘ইমেজ’ তৈরি করে ফেলেছেন। তরুণ প্রজšে§র প্রতিনিধি তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউ’র ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি ফিলিপাইনে কোরাজন একিনোর ছেলের বেলায়। একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে Vasudua Kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘All the Univers is a Family।’ অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তারা শাসন করে। ভারতের রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় চরণ সিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আব্দুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি ও সিন্ধিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। পারিবারিক ও রাজনীতির ধারা বাংলাদেশেও আছে এবং থাকবে। বাংলাদেশে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি আগামীতে সক্রিয় হবেন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, তিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তার বিদেশি স্ত্রী তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতির কোনো কারণ হতে পারেন না। একুশ শতকে এক তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগকে সজীব ওয়াজেদ জয় একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও। গেল বছর জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমি নেতৃত্বের একটি ‘গন্ধ’ পাচ্ছি। তিনিই বিএনপির নেতা। বেগম জিয়া-পরবর্তী দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যে ‘ভুল’ করেননি তা নয়। অতীত থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি এখন যথেষ্ট ‘ম্যাচিউরড’। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তিনি বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান। বিএনপিকে এখন এই তরুণ নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তাদের নিয়ে আসতে হবে স্থায়ী কমিটিতে। স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে যারা আছেন, তাদের দু’একজন বাদে অনেকেই কর্মহীন। প্রত্যাশা অনুযায়ী দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দরকার। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেয়া এবং রাজনীতি থেকে তাদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির পরিবেশ উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা এই যে রাজনীতির চিত্র তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যারা রয়েছেন দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, তারা জাতির জন্য কোনো ‘রোল মডেল’ নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে এক সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমদ, আজ এত বছর পর দল কি ‘আরেকজন শেখ মুজিব’ কিংবা ‘আরেকজন তাজউদ্দীন’ তৈরি করতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী সুযোগ দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে। কিন্তু ‘স্বর্ণ নৌকা’ উপহার নেয়া, সাধারণ মানুষের কাছে নগদ টাকা চাওয়া, বাস-ট্রাক বন্ধ করে, সড়ক দখল করে হুইপের সংবর্ধনা নেয়া আর যাই হোক এতে আস্থার জায়গাটা তৈরি হয় না এবং এমনটি রাজনীতিকে কালিমালিপ্ত করে। চিফ হুইপ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী স্বর্ণ বিক্রি করে সে টাকা দান করেছেন, কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা এ ধরনের তরুণ নেতৃত্ব আদৌ চাই না। এ থেকে আমাদের দেশের তরুণ নেতৃত্ব যদি কিছু শেখেন, সেটা হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি। তবে সেই তরুণ নেতৃত্বকে হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত ও আধুনিকমনস্ক। দেশপ্রেম বোধে উজ্জীবিত হয়ে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির রাজনীতি বর্জন করে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। নীতি-নৈতিকতাকে রাজনৈতিক জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের পাশে থাকার মানসিকতা তাদের থাকতে হবে। শত শত তোরণ তৈরি করে জোর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাত্রদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা পায় বটে; কিন্তু তাতে যে ‘ইমেজ’ তৈরি হয়, তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। তরুণ নেতৃত্ব আসুক, কিন্তু সেই নেতৃত্ব যেন ‘স্বর্ণের নৌকা’ আর নগদ টাকা নেয়ার জন্য উদগ্রীব না থাকেন। Daily Manobkontho 20.02.14

0 comments:

Post a Comment