দশম
জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে। দীর্ঘ ৩০
বছর পর তৃতীয়বারের মতো বিএনপি সংসদের বাইরে। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের তৃতীয় ও
চতুর্থ সংসদেও বিএনপি সংসদের বাইরে ছিল। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
অনেক ‘বিতর্ক’ আর ‘প্রশ্ন’ নিয়ে দশম সংসদ তার যাত্রা শুরু করল। মির্জা
ফখরুল এই সংসদকে অভিহিত করেছেন ‘সাংবিধানিক গোঁজামিলের’ সংসদ হিসেবে। তিনি
বলেছেন, ‘এটি ৫ শতাংশের ভোটের সংসদ।’ প্রথা অনুযায়ী সংসদের প্রথম
অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণেই ফুটে উঠল মূল
বক্তব্যটি। রাষ্ট্রপতি গণতন্ত্র বিকাশে সরকারের সঙ্গে সংলাপ করতে নির্বাচন
বর্জনকারী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানালেন। কিন্তু নির্বাচনের পরপরই সিনিয়র
মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেছেন এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের কোনো মিল
আমি খুঁজে পাই না। সদ্য নিযুক্ত চিফ হুইফ জানিয়ে দিলেন ১৮২৫ দিন অপেক্ষা
করার কথা। তাই রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের কথা বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
মনে হচ্ছে এই সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের আপাতত কোনো
সম্ভাবনাও নেই। শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা হয়তো
আশাহত হতে পারেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকার এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী
নির্বাচনের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। এর অনেক কারণও আছে। নির্বাচন
নিয়ে প্রথম দিকে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে থেকে যত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই
আসুক না কেন, সরকার মনে করছে বদলে যাওয়া পরিস্থিতির কারণে তার ‘অবস্থান’
এখন অনেক শক্তিশালী। বিদেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দন বার্তা আসছে। এর মধ্যে
দিয়ে সরকারের ‘লেজিটেমেসি’ বেড়েছে। সরকার মনে করছে তারা খুব সহজেই পাঁচ
বছর পার করে দিতে পারবে এবং যারা দশম জাতীয় সংসদে এসেছেন, তারা চাইবেন না
সংসদ ভেঙে দেয়া হোক। তারা চাইবেন পুরো টার্ম পূরণ করতে। বিদেশে এই সংসদ
নিয়ে যত নেতিবাচক ধারণারই জন্ম হোক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে একটা সংসদ গঠিত
হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের ষষ্ঠ সংসদের বয়স ছিল মাত্র ১৩ দিন।
আমরা ওই সংসদের সঙ্গে দশম সংসদকে মেলালে ভুল করব। ওই সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী
পাস হয়েছিল। কিন্তু দশম সংসদের কাছে এ রকম কোনো এজেন্ডা নেই। ফলে সংসদ
ভেঙে দেয়ার ‘চাপ’ থাকলেও তা খুব শক্তিশালী হবে বলে মনে হয় না। এখন সরকারের
শক্ত অবস্থানের কারণে বিএনপি তথা ১৮ দল (১৯ দল) আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে
পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের অনেকেই আন্দোলনের
সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে ‘নির্বাচন প্রতিহত’ করার ডাক দিয়েও তা
‘প্রতিহত’ করা যায়নি। এখন সংসদ গঠিত হওয়ায় সরকারের অবস্থান ভালো। বিএনপি
শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সরকার ‘চাপ’-এ থাকবে না এবং সে ক্ষেত্রে
মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করানো যাবে না। এটা স্বীকার
করতেই হবে সরকার বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা ‘ব্যবধান’ তৈরি করে দিতে
সমর্থ হয়েছে। এই কৌশলে সরকার লাভবান হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বিএনপির। সরকার
কখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না, অথচ সরকার ইচ্ছে করলে তা পারে। সংবিধানের
৩৮(গ) ও (খ) রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অডিন্যান্স, ১৯৭২, দ্যা পলিটিক্যাল
পার্টিস অডিন্যান্স ১৯৭৮-এর ধারা, উপধারা বলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। এ
ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতের দায়ের
করা একটি আপিল মামলার নিষ্পত্তি করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে।
সরকার সেদিকে যাবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের স্ট্রাটেজি হচ্ছে জামায়াতের
সঙ্গে বিএনপির ‘দূরত্ব’ যদি সৃষ্টি করা যায় তাতে দুর্বল হবে ১৯ দল, আর
তাতে লাভ সরকারের। সরকার, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ায় জামায়াত একটি জঙ্গিবাদী
সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।সরকারের বড় প্লাসপয়েন্ট হচ্ছে বিদেশে,
বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি কর্মকাণ্ড হিসেবে
অভিহিত করেছে। এতে পরোক্ষভাবে সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। এরই মাঝে
দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী (ত্রাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যমন্ত্রী)
সরাসরি বলেছেন নির্বাচন চাইতে হলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
অর্থমন্ত্রীর অভিমতও অনেকটা তেমনই। অন্যদিকে আরো কয়েকজন মন্ত্রী
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া বেগম জিয়ার বক্তব্যের (সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর
অপারেশন প্রসঙ্গে) যেভাবে সমালোচনা করেছেন তাতে ‘সংলাপ’ এর সম্ভাবনা আরো
ক্ষীণ হয়ে এলো। বেগম জিয়াকে ‘ক্ষমা চাইতে হবে’, ‘জঙ্গিদের সেনাপতি’ (সৈয়দ
আশরাফ), ‘খালেদা সঙ্গ’ (আমির হোসেন আমু), ‘তিনি অশান্তি চান’ (হাসানুল হক
ইনু), ‘তার বক্তব্য বিপজ্জনক’ (ওবায়দুল কাদের)-এ ধরনের বক্তব্য ‘সংলাপ’ এর
পরিবেশের জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও
বলা হচ্ছে। আমরা এখানে সাতক্ষীরায় দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও (খালেদা
জিয়ার শয়নে স্বপনে পেয়ারে পাকিস্তান) উল্লেখ করতে পারি। এতে এমন একটা
ধারণার জন্ম হয়েছে যে, আগামীতে সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। প্রশ্ন হচ্ছে
নির্বাচনের পর এখন ‘সংলাপ’ এর এজেন্ডা কী? বিএনপি যদি এখনো তত্ত্বাবধায়ক
কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলতে চায়, তাহলে সরকারের সমর্থন তাতে
থাকবে না। বিএনপি সরকারকে বাধ্য করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
(প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে) আওতায় নির্বাচন দিতে। সরকার যেভাবে সংবিধানে
পরিবর্তন এনেছিল (পঞ্চদশ সংশোধনী) সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে এবং আগামীতেও
হবে। এখন বিএনপিকে নির্বাচন যেতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে অন্তবর্তীকালীন সরকার
প্রধান হিসেবে রেখেই নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু বিএনপি কি তা করবে? এটা
যদি বিএনপি করে, তাহলে প্রশ্ন আসবে বিএনপি তাহলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ
নিল না কেন? অন্যদিকে সরকার আন্দোলনের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য
জনগণকে আন্দোলন সম্পৃক্ত না হওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছে।
দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন হয় না। তবে দলীয় নেতা ও কর্মীরা অন্য মার্কা
নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটবে। বিএনপির নেতাকর্মীরা এই
নির্বাচনে অংশ নেবেন। এখানে বিএনপির সমর্থকরা যদি বিজয়ীও হন তাতে তা
সরকারের ওপর আদৌ কোনো ‘প্রভাব’ ফেলবে না। আন্দোলনও আপাতত ‘স্থগিত’ই থাকবে।
সরকার এখন শক্তিশালী। সরকারের এখন স্ট্রাটেজি হচ্ছে মামলা, মোকদ্দমা,
আইন-আদালত করে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা। নেতাদের কেউ কেউ
উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও অন্য মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। জেলেই থাকছেন
তারা। অন্যদিকে পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুদকের মামলায়
নিু আদালত থেকে খালাস পেলেও দুদক আপিল করেছে। নবনিযুক্ত আইনমন্ত্রী বলেছেন,
তারেক রহমান নিু আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জামিন পাবেন। এখানে মূল বিষয়
হচ্ছে একটি তারেক রহমানের মামলাগুলো সচল রেখে পরোক্ষভাবে বেগম জিয়ার ওপর
‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ প্রয়োগ করা। নতুন করে দায়িত্ব নেয়ার পর
প্রধানমন্ত্রী যে সরকার গঠন করেছেন, তাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘ঐকমত্যের
সরকার’ হিসেবে। এই মুহূর্তে এই সরকারে চারটি দল রয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ,
ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি। আমার ধারণা ভবিষ্যতে এই সরকারে আরো
দু’চারটি দল (সিপিবি, তরিকত ইত্যাদি) যোগ দিতে পারে। বিএনপির একটি অংশ যদি
যোগ দেয়(?) আমি তাতে অবাক হব না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি ‘মালয়েশিয়ান
মডেল’ উপহার দিতে পারেন; যেখানে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন
প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও ১৩টি রাজনৈতিকর দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ন্যাশনাল
ফ্রন্ট, যারা ১৯৬৪ সাল থেকেই জোটগতভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করে আসছে।
সেখানে বিরোধী দলের অস্তিত্ব তেমন শক্তিশালী নয়, যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে
(২০১৩) বিরোধী দল কিছুটা ভালো করেছে (বিরোধ পিপলস অ্যালায়েন্স পেয়েছে ৮৯
আসন, আর ক্ষমতাসীন ফ্রন্ট পেয়েছে ১৩৩। মোট আসন ২২২)। সেখানে ‘নিয়ন্ত্রিত
গণতন্ত্র’ চালু করেছে। মাহাথির মোহাম্মদ দীর্ঘ ২২ বছর (১৯৮১-২০০৩) ক্ষমতায়
থাকার পর ২০০৩ সালে অবসর নেন। মালয়েশিয়াতে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এ নাগরিক
অধিকার কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু নিয়মমাফিক ৫ বছর পর পর নির্বাচন হয়।
সেখানে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। ‘ভোট কেন্দ্র দখল’ কিংবা ‘সিল
মারার’ ঘটনাও কখনো ঘটেনি। তারা রাজনীতির চাইতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেশি
গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে মালয়েশিয়া আজ বিশ্বে নতুন এক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে
জন্ম নিয়েছে। শেখ হাসিনা যদি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক মডেলকে অনুসরণ তাহলে
করেন তিনি ভালো করবেন। রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের কথা বলেছেন, সেটা নিয়েও
প্রশ্ন আছে। কেননা রাষ্ট্রপতির ওই ভাষণ সরকারের বক্তব্য হিসেবেই চিহ্নিত
হয়। কেননা রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করা হয় এবং
মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিতও হয়। প্রতিটি লাইন ‘চেক’ করে দেখা হয়। এর বাইরে
রাষ্ট্রপতির ভাষণে একটি লাইনও তিনি যোগ করতে পারেন না। অতীতে এটা নিয়ে নানা
কথা উঠেছিল। সুতরাং রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বক্তব্যে যা ফুটে উঠেছে তা
হচ্ছে সরকারের বক্তব্য। যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সরকারই সংলাপ
চাচ্ছে। আমরা বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারি। তবে সরকারের পক্ষ
থেকে বারবার একটা কথা বলা হচ্ছে তা হচ্ছে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে
হবে। তাহলেই সংলাপ। বিএনপি কৌশলগত কারণে জামায়াতকে না নিয়েই সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানের জনসভা করেছে। সরকারের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছে বিএনপি। কিন্তু
তাদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ‘রাজনৈতিক।’ তারা জামায়াতকে ১৯ দলীয় জোট
থেকে বের করে দেবে না। বিএনপি বৃহত্তর ঐক্য করার ব্যাপারে একটি উদ্যোগ
নিয়েছে। জামায়াত না থাকলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে কাদের সিদ্দিকী, ড.
কামাল হোসেন, কিংবা অধ্যাপক বি. চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বকে আমরা দেখতে
পেতাম। সেটা হয়নি জামায়াতের কারণে। আমি মনে করি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির
প্রেক্ষাপট এজেন্ডা হওয়া উচিত একটাই আর তা হলো গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এই
নির্বাচন গণতন্ত্রের বিকাশকে অনেক ‘ক্ষতি’ করেছে। বাংলাদেশের বিকাশমান
গণতন্ত্রের জন্য এই ‘ক্ষতি’ অনেক। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে একসময়
প্রশংসাসূচক কথাবার্তা আমরা শুনতে পেতাম বিশ্ব নেতাদের মুখ থেকে। খোদ
একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চাকে প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ। মুসলমানপ্রধান দেশও যে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ। এটা বিশ্বে প্রশংসিত
হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা
ঘটেছে। দু’দুজন রাষ্ট্রপতি সেনা অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন। এমন একটি
দেশেও যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, বাংলাদেশ সেটা প্রমাণ করেছে।
বাংলাদেশের প্রশংসা এ কারণেই। আমি বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান শক্তি
হিসেবে মনে করি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টার্মে আমরা বলি বাংলাদেশ হচ্ছে
একটি ‘সফট পাওয়ার।’ বিশ্বকে অনেক কিছু দেয়ার আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ দিতে
পারে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। একটি
দক্ষ, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন আমাদের সেনা নেতৃত্ব। তৈরি পোশাক
খাতে আমরা ‘লিডার।’ শত প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের ওপর
ধনী দেশগুলোর নির্ভরতা থাকবেই। ওষুধ শিল্পেও বাংলাদেশের অবস্থান উজ্জ্বল।
বাংলাদেশের রয়েছেন দক্ষ ওষুধ প্রযুক্তিবিদ। আইটি সেক্টরেও বাংলাদেশ ভালো
করেছে। অদক্ষ জনশক্তি রফতানিতেও বাংলাদেশের বিকল্প কোনো দেশ নেই। সুতরাং
এমনি এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা চাইবে উন্নত বিশ্ব। সে জন্যই
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক না কেন, পশ্চিমা বিশ্ব
চাইবে জি-২ পর্যায়ে, অর্থাৎ ‘সরকার টু সরকার’ পর্যায়ে সম্পর্ক উন্নত করতে।
রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, সে ব্যাপারে বিএনপি তথা ১৯ দলের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারকেই উদ্যোগটা নিতে হবে। সংসদ নেত্রী প্রয়োজনে একটি সংসদীয় কমিটির গঠন করে দিতে পারেন। বিএনপি এই আলোচনায় বৃহত্তর বিরোধী গোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারবিরোধী ত্রিদলীয় জোট (কাদের সিদ্দিকী, বি. চৌধুরী ও আসম আবদুর রবের দল) এর সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গঠন করতে পারে। এটা হতে পারে ১৯ প্লাস ৪ দলীয় ঐক্য। ড. কামাল হোসেনও থাকতে পারেন। বস্তুত পক্ষে বিএনপির সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওপরে উল্লেখিত চারটি রাজনৈতিক দলের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই রাজনীতিকদের সবাই মনে করেন যে প্রক্রিয়ায় দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। তারা চাচ্ছেন অতি দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করা। এমনকি নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকা উচিত এ ব্যাপারেও সবার অভিমত এক। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানকে অন্তবর্তীকালীন সরকারপ্রধান রেখে যে নির্বাচন হয় এবং তা যে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় না, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করা হয়েছে। এটা বিবেচনায় নিলেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি। এই অভিমত বিএনপিসহ বাকি দলগুলোর। শুধু মতপার্থক্য এক জায়গায় আর তা হচ্ছে জামায়াতকে ছাড়তে হবে। যদি বিএনপি জামায়াতকে মাইনাস করত তাহলে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য হতে পারে। এই মুহূর্তে একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ স্বাক্ষরিত হওয়া জরুরি। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন ২০০৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে লন্ডনে পাকিস্তানের দুটি বড় দল পিপলস পার্টি (বেনজির ভুট্টো) ও মুসলিম লীগ (নেওয়াজ শরীফ) এর মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা ‘গণতন্ত্র সনদ’ নামে অভিহিত হয়েছে। এই সময়ে ওই দুই দলের প্রধান টার্গেট ছিল পারভেজ মোশাররফ। তিনি তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।মোশাররফবিরোধী তথা পাকিস্তানে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ২০০৭ সালে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ একত্রিত হয়েছিল। এ দুটি দলের মাঝে বৈরিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সবার জানা। শুধু এই দুই দলের মাঝে বৈরিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন সেখানে কোনো সরকারই স্থায়িত্ব পায়নি। বেনজির ভুট্টো এবং নেওয়াজ শরীফ দু’দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। একজনের ব্যর্থতা (বেনজির ভুট্টো ১৯৮৮, ১৯৯৩ দু’বার) অন্যজনকে (নেওয়াজ শরীফ ১৯৯০, ১৯৯৭, দু’বার) ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা এখনো বহমান। মোশাররফের উৎখাতের পর প্রথমবারের মতো পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন (বেনজিরের মৃত্যুর পর) একটি কোয়ালিশন সরকার তার পাঁচ বছরের টার্ম শেষ করেছে এবং ২০১৩ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেখানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে নেওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজ একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো একত্রিত হয়ে একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ প্রণয়ন করতে পারে। আর এ জন্যই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি ১৯ দল প্লাস ৪ দলের ওপর। বিরোধী দলগুলো একত্রিত হলেই সরকার বাধ্য হবে একাদশ সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপ শুরু করতে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। তারাও একসময় চাইবে একাদশ সংসদ নির্বাচন। যেহেতু রাষ্ট্রপতির ভাষণ মানেই সরকারের ভাষণ সেহেতু রাষ্ট্রপতির সংলাপের আহ্বানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে দ্রুত সংলাপ শুরু করা। এতে প্রধান প্রধান দলগুলোর মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাব। সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। সংসদ অধিবেশন চলুক। সেই সঙ্গে চলুক সংলাপও। Daily MANOBKONTHO 04.02.`14
রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, সে ব্যাপারে বিএনপি তথা ১৯ দলের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারকেই উদ্যোগটা নিতে হবে। সংসদ নেত্রী প্রয়োজনে একটি সংসদীয় কমিটির গঠন করে দিতে পারেন। বিএনপি এই আলোচনায় বৃহত্তর বিরোধী গোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকারবিরোধী ত্রিদলীয় জোট (কাদের সিদ্দিকী, বি. চৌধুরী ও আসম আবদুর রবের দল) এর সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গঠন করতে পারে। এটা হতে পারে ১৯ প্লাস ৪ দলীয় ঐক্য। ড. কামাল হোসেনও থাকতে পারেন। বস্তুত পক্ষে বিএনপির সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওপরে উল্লেখিত চারটি রাজনৈতিক দলের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই রাজনীতিকদের সবাই মনে করেন যে প্রক্রিয়ায় দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। তারা চাচ্ছেন অতি দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করা। এমনকি নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকা উচিত এ ব্যাপারেও সবার অভিমত এক। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানকে অন্তবর্তীকালীন সরকারপ্রধান রেখে যে নির্বাচন হয় এবং তা যে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় না, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করা হয়েছে। এটা বিবেচনায় নিলেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি। এই অভিমত বিএনপিসহ বাকি দলগুলোর। শুধু মতপার্থক্য এক জায়গায় আর তা হচ্ছে জামায়াতকে ছাড়তে হবে। যদি বিএনপি জামায়াতকে মাইনাস করত তাহলে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য হতে পারে। এই মুহূর্তে একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ স্বাক্ষরিত হওয়া জরুরি। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন ২০০৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে লন্ডনে পাকিস্তানের দুটি বড় দল পিপলস পার্টি (বেনজির ভুট্টো) ও মুসলিম লীগ (নেওয়াজ শরীফ) এর মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা ‘গণতন্ত্র সনদ’ নামে অভিহিত হয়েছে। এই সময়ে ওই দুই দলের প্রধান টার্গেট ছিল পারভেজ মোশাররফ। তিনি তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।মোশাররফবিরোধী তথা পাকিস্তানে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ২০০৭ সালে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ একত্রিত হয়েছিল। এ দুটি দলের মাঝে বৈরিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সবার জানা। শুধু এই দুই দলের মাঝে বৈরিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন সেখানে কোনো সরকারই স্থায়িত্ব পায়নি। বেনজির ভুট্টো এবং নেওয়াজ শরীফ দু’দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। একজনের ব্যর্থতা (বেনজির ভুট্টো ১৯৮৮, ১৯৯৩ দু’বার) অন্যজনকে (নেওয়াজ শরীফ ১৯৯০, ১৯৯৭, দু’বার) ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা এখনো বহমান। মোশাররফের উৎখাতের পর প্রথমবারের মতো পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন (বেনজিরের মৃত্যুর পর) একটি কোয়ালিশন সরকার তার পাঁচ বছরের টার্ম শেষ করেছে এবং ২০১৩ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেখানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে নেওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজ একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো একত্রিত হয়ে একটি ‘গণতন্ত্র সনদ’ প্রণয়ন করতে পারে। আর এ জন্যই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি ১৯ দল প্লাস ৪ দলের ওপর। বিরোধী দলগুলো একত্রিত হলেই সরকার বাধ্য হবে একাদশ সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপ শুরু করতে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। তারাও একসময় চাইবে একাদশ সংসদ নির্বাচন। যেহেতু রাষ্ট্রপতির ভাষণ মানেই সরকারের ভাষণ সেহেতু রাষ্ট্রপতির সংলাপের আহ্বানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে দ্রুত সংলাপ শুরু করা। এতে প্রধান প্রধান দলগুলোর মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাব। সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছে। সংসদ অধিবেশন চলুক। সেই সঙ্গে চলুক সংলাপও। Daily MANOBKONTHO 04.02.`14
0 comments:
Post a Comment