রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টকশোতে ঝগড়া নয়, বিশেষজ্ঞ মতই কাম্য

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে এ কী আচরণ দেখলাম আমরা? একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যিনি আবার অ্যাক্টিভিস্টও, তার সঙ্গে রীতিমতো ‘ঝগড়া’ লেগে গেল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত একজন সাবেক সংসদ সদস্যের। শুধু ঝগড়া বললে ভুল বলা হবে- হুমকি-ধামকি, এমনকি দু’জন অতিথি একপর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। টিভি টকশোগুলোর দর্শক বেশি। লাখ লাখ দর্শক দেখল কীভাবে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (এ পরিচয় সচরাচর তিনি দেন না), যার জন্ম খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের পরে, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার(?) করেন দলীয় স্বার্থে। বিএনপির ওই সাবেক সংসদ সদস্য, যিনি একসময় সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাও বটে, তার আপত্তি লাগারই কথা। যেভাবে লাইভ সম্প্রচারে এ দুই ব্যক্তি ঝগড়া করলেন, হুমকি দিলেন, পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিলেন, তা শুধু ওই উপস্থাপককেই নয়, বরং ওই টিভি চ্যানেলকেও বিতর্কিত করল। অনলাইনের পাঠকরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা দেখেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এসব বিতর্কিত ব্যক্তিকে কেন টকশোতে ডাকে? যিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং কোনো সিনিয়র শিক্ষকও নন, তার রাজনৈতিক ‘কানেকশন’ শক্ত হতে পারে কিন্তু রাজনীতির গতিধারা, অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে কি তিনি যথেষ্ট ধারণা রাখেন? রাজনীতি তো তার বিষয় নয়। তিনি অন্য বিষয়ের ছাত্র। মেধা থাকলে তো তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হতেন। তাই সীমিত জ্ঞান নিয়ে টিভি টকশোতে যান এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে তিনি নিজেও বিতর্কিত হন। তার সামনে অনেক দিন পড়ে আছে। কথা বলার অনেক সুযোগ পাবেন তিনি। এখন কি তার সময় হয়েছে ‘বুদ্ধিজীবী’ হওয়ার? টিভি চ্যানেলের উপস্থাপকরা তাকে কেন ডাকেন, এটা আমরা বুঝি। লক্ষ্য করেছি, অনেক সময় কোনো কোনো উপস্থাপক অতিথিদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে নিজে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে তা দেখেন। এটা কি উপস্থাপকের কাজ? তিনি ঝগড়া লাগানোর সুযোগটা কেন তৈরি করবেন? কেন তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করতে দেবেন? টকশো মানুষ শোনে ও দেখে শুধু দেশের চলমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য। কিন্তু তারা যদি ঝগড়া দেখে, বিতর্কিত ব্যক্তিদের বারবার পর্দায় দেখে, তাহলে অচিরেই টকশোগুলো জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলবে। ‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’- এসব শব্দ খুব স্পর্শকাতর। প্রকাশ্যে এসব বিষয়ে কথা বলতে হলে একটু ভেবেচিন্তে বলা প্রয়োজন। এমন কোনো মন্তব্য করা শোভন নয়, যা অন্য অতিথিকে বিব্রত করতে পারে। আমি নিজে নিয়মিত টকশোতে যাই। ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গেও আমি থেকেছি একাধিক শোতে। আমার অভিজ্ঞতাও খুব ভালো নয়। আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি জোর করে অনেক কিছু চাপিয়ে দিতে চান। তার মাঝে এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করে। অনেক দিন থেকেই একটা কথা শুনছি- টকশো থাকবে কী, থাকবে না। শুনছি একটি নীতিমালা নাকি করা হচ্ছে। আরও একটি কথা শুনলাম, সরকার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত, তাদের আমন্ত্রণ না জানানোর। কোনো একটি চ্যানেলে নাকি একটি লিস্টও পড়ে শোনানো হয়েছে, কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, সরকার যদি এটা পাঠিয়ে থাকে, তাহলে সরকার ভুল করেছে। চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয় কথা, যদি সরকার সমর্থকদের দিয়ে টকশো পরিচালনা করা হয়, তাহলে টকশোগুলোর জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে না। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এটা চাইবে না। টিভি টকশোর মধ্য দিয়ে এক ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক। যেখানে সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়, যেখানে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, সেখানে কথা বলার মাধ্যম তো এই চ্যানেলগুলোই। সেখানে সরকারের সমালোচনা হয়। তবে এ সমালোচনা তো সরকারের জন্যই মঙ্গলজনক। সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা কখনোই সরকারের সমালোচনা করবেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি সরকারকে সঠিক পথটি ধরিয়ে দেয়, সেটা সরকারের জন্যই ভালো। এটাকে ‘সরকারের সমালোচনা’ ধরলে ভুল করা হবে। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা তো আরও জরুরি। যেখানে দশম সংসদে ‘বিরোধী দল’ সরকারেরই অংশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতির সমালোচনা হবে কম। ফলে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যেতে পারে এবং নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সংসদের যে জনপ্রিয়তা, তাতে ধস নামবে। টকশোগুলো বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিকল্প মাধ্যম বলেই মানুষ গভীর রাতে এসব শোনে এবং দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে একটা ধারণা পায়। নীতিমালা থাকতে পারে। জঙ্গিবাদবিরোধী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী কিংবা জাতীয় নেতাদের ব্যাপারে কটূক্তি নিষিদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি ‘উপদেশ’ থাকতেই পারে। তাই বলে টকশো নিয়ন্ত্রণ নয়। টকশো সম্পর্কে একটা কথা প্রায় শুনি। বলা হয় টকশো উপস্থাপকরা একটি বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী এবং তারা তাদের রাজনৈতিক দর্শন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। অন্তত একটা চ্যানেল সম্পর্কে আমি এ সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। আমি অনেক চ্যানেলেই যাই। অনেকের উপস্থাপনায় আমি অংশ নিতে আগ্রহবোধ করি। বিশেষ করে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এক সময়ের সাংবাদিক এখন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিষয়ের গভীরে গিয়ে তিনি মূল সত্যটি বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো কোনো উপস্থাপক যখন তাদের রাজনৈতিক দর্শন চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, উদ্ধত আচরণ করেন, তখন সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের ওপর আস্থাটা আর রাখতে পারি না। রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে দল চালানো যায়। কিন্তু চ্যানেল চালানো যায় না। চ্যানেলের উদ্যোক্তারা এটি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। পড়াশোনা ও গবেষণার সুবাদে আমি অনেক দেশে গেছি। আমাদের এ উপমহাদেশের সন্তান ফরিদ জাকারিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় একজন টিভি উপস্থাপক। সিএনএন কিংবা আল জাজিরার নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপকরা এক একজন ‘স্টার’। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওবামা তাদের সমীহ করেন। নিউজ চ্যানেলগুলো টকশো করবেই। এই টকশোগুলোর কারণেই চ্যানেলগুলো টিকে আছে এবং তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশে শুধু নিউজ বা সংবাদ বিশ্লেষণের জন্য চ্যানেল রয়েছে মাত্র ক’টি, খুব বেশি নয়। নিউজ ও সংবাদ বিশ্লেষণও যে বিনোদন দিতে পারে, তা দু’-একটি চ্যানেল প্রমাণ করেছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। একটি চ্যানেল তরুণ প্রজন্মনির্ভর। যারা চ্যানেলটি চালান, উপস্থাপনা করেন, তাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশের ঘরে, সংবাদকর্মীদের আরও কম, ত্রিশের নিচে। এ প্রবণতাকে আমি ভালো মনে করি। আমার মনে হয়, চ্যানেলের টকশোর উপস্থাপকরা অতিথিদের আমন্ত্রণের ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অলিখিত ‘উপদেশ’ অনুসরণ করেন। একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব পছন্দও প্রাধান্য পায়। আর এক্ষেত্রেই তারা বিপত্তি বাধিয়ে ফেলেন। যিনি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন, তাকে সেই বিষয়ের জন্য আমন্ত্রণ না জানানোই মঙ্গল। ১০ ফেব্র“য়ারির রাতে একটি চ্যানেলের টকশো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। বিষয় ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা। আমার সঙ্গে আরও দু’জন আলোচক ছিলেন- মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম ও মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। দু’জনই নিরাপত্তা নিয়ে ধারণা রাখেন এবং লেখালেখি করেন। জেনারেল ইবরাহিম নিজে দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করেছেন। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখেন। এক্ষেত্রে অতিথি নির্বাচন সঠিক হয়েছে। আমার নিজেরও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারণা রয়েছে। ফলে আলোচনাটা গুরুত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে যিনি বিষয় সম্পর্কে আদৌ ধারণা রাখেন না, তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে দর্শকদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতো না। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক চ্যানেলই এ কর্মটি করে থাকে- যিনি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন, তাকে সেই বিষয়ে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, কিছু ব্যক্তি অর্থনীতি থেকে নারীমুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি- সব বিষয়েই অবলীলায় বলে যাচ্ছেন। তারা ‘সর্ব বিশেষজ্ঞ’। আলোচিত-বিতর্কিত ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পাশাপাশি আরও একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে দেখেছি, যিনি খুব বেশি কথা বলেন এবং তিনি সব বিষয়েরই বিশেষজ্ঞ! অনেক চ্যানেলের উপস্থাপক জানেন, যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি যাই না। এটাই হওয়া উচিত। চ্যানেল কর্তৃপক্ষেরও উচিত এ দিকটা দেখা। চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষকে কোনো কিছু ‘উপদেশ’ দেয়া আমার জন্য শোভন নয়। তবে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিুোক্ত কাজগুলো করতে পারে : ১. আলোচক দু’জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ভালো। এতে করে আলোচকরা বিষয়ের গভীরে যেতে পারবেন; ২. যিনি যে বিষয়ের ‘বিশেষজ্ঞ’, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বিষয়ভিত্তিকভাবেই তাদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত। যেমন যিনি ফিল্ম মেকিং পড়ান, তাকে রাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় না ডাকাই ভালো। কিংবা যিনি দীর্ঘদিন সচিবালয়ে ছিলেন, তিনি বা তাকে বৈদেশিক নীতি নিয়ে আলোচনার জন্য না ডাকাই ভালো; ৩. বিতর্কিত ‘বিশেষজ্ঞ’ কিংবা অতিকথন প্রিয় লোকদের থেকে দূরে থাকা ভালো; ৪. সরাসরি যিনি রাজনীতি করেন, তারা কোনো অনুষ্ঠানে এলে তারা দল সম্পর্কে বলবেন বেশি। মূল আলোচনায় তার মতামত পাওয়া যাবে না। একই কথা প্রযোজ্য উপস্থাপকদের ক্ষেত্রেও। অনেকেই ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু উপস্থাপনায় কিংবা প্রশ্নের মাঝে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রাধান্য পেতে পারে; ৫. দর্শকদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে পারে কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক, অনলাইন, সরাসরি টেলিফোন, প্রশ্ন পাঠানো ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ দর্শকদের অংশগ্রহণ বাড়লে টকশোগুলো আরও জনপ্রিয় হবে। টকশোগুলোতে কাউকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখার জায়গা হতে পারে না। অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে, উত্তেজনা ছড়িয়ে জনপ্রিয় হওয়া যায় না। এতে করে সাধারণ দর্শকদের মাঝে ওই চ্যানেল, কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম হয়। Daily JUGANTOR ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

2 comments:

  1. চ্যানেল কত্ত্রিপক্ষ যদি ঝগড়াঝাঁটি দেখায় TRP বাড়ানোর ধান্দা করে সেখেত্রে আলোচক হিসেবে আপ্নাদের করনিয় কি হতে পারে?

    ReplyDelete
  2. চ্যানেল কত্ত্রিপক্ষ যদি ঝগড়াঝাঁটি দেখায় TRP বাড়ানোর ধান্দা করে সেখেত্রে আলোচক হিসেবে আপ্নাদের করনিয় কি হতে পারে?

    ReplyDelete