রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উপজেলা নির্বাচন কী মেসেজ দিয়ে গেল

>
প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল ১৯ ফেব্রুয়ারি। আরও চার পর্যায়ে এ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। শেষ হবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। প্রথম দফায় অনুষ্ঠিত হলো ৯৭টি উপজেলার নির্বাচন। মোট ৪৮৭টি উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে মার্চের শেষ সপ্তাহের মধ্যে। যদিও উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে মেলান যাবে না; কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে উপজেলা নির্বাচন এমন একটি স্তর, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশেও জাতীয় পর্যায়ে এমন অনেক নেতা আছেন, যারা উপজেলা থেকে উঠে এসেছেন।স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়ে ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে চলে এসেছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন কেউ কেউ। যদিও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে এ নির্বাচনকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। ১৯৮২ সালে এরশাদীয় জমানায় দেশে উপজেলা অধ্যাদেশ বলে এ উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এরশাদের আমলে দু'বার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একবার ১৯৮৫ সালে, আর দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর, এমনকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ও (১৯৯৬-২০০১) উপজেলা নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ডিসেম্বর) এক মাসের মাথায় শেষবারের মতো উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, যে প্রত্যাশা নিয়ে উপজেলা আইন সৃষ্টি করা হয়েছিল, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নানা কারণে ওই উপজেলা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। একটা প্রধান সমস্যা ছিল, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব। দু'জনই জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায়, কার ক্ষমতা কতটুকু, এই দ্বন্দ্ব রয়ে গিয়েছিল। ফলে সত্যিকার অর্থে উপজেলা পরিষদ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আইনে নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তার ক্ষমতা নির্ধারিত নেই এবং তিনি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। ফলে কাগজে-কলমে উপজেলা পরিষদ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা ভিত্তি হলেও, এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। উপজেলা থেকে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি এবং আগামীতেও হবে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারি অর্থে পাজেরো গাড়ি কিনে দেয়া ও মাসে মাসে জ্বালানি এবং বেতন-ভাতা দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে ভিত্তি, তা গড়ে তোলা যায়নি।


এখন উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল, তার ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব? প্রথমত, এটাও অনেকটা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে একটি ফলাফল বেসরকারিভাবে পাওয়া গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। এতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। সুতরাং এটা বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়ে এ দুই দলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলান যাবে না। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে এই দল দুটির গণভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আর এ গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। চতুর্থত, যেহেতু এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচনপ্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত, উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকতে চায়। অর্থাৎ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, সে ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে, তারা এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও সিরিয়াস। ষষ্ঠত, এই নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছে। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে হাল্কাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সপ্তমত, উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীরা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে এ সত্যটাই প্রমাণ করবে যে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরোটারই কৃতিত্ব ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে অন্যত্র জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল, তা পার্টির জন্য কোনো 'শুভ' সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা, আবার বিরোধী দলেও থাকা- এই যে 'রাজনীতি', এই রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। অষ্টমত, উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এখানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, তা তারা করেনি। নবমত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'বেস্নম গেম', অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে 'রাজনীতি', তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছেনির্বাচনের পরপরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা অভিযোগ করলেন, 'বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে'। বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত এক কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, এই দোষারোপের রাজনীতি যদি পরিত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না।প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মার্চে হবে আরও দু'দফা নির্বাচন। আমার ধারণা, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ই দুটো বড় দলের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকবে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের নীতি-নির্ধারকদের কাছে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেবে। তবে এই ফলাফল থেকে তারা কতটুকু ধারণ করবেন, সেটা ভিন্ন একটা প্রশ্ন।যে প্রশ্নটি অনেকেই এখন করার চেষ্টা করবেন, তা হচ্ছে এই নির্বাচনের ফলাফল কী সরকারের নীতি-নির্ধারকদের একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাব বিস্তার করবে? আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র পর্যায়ের নেতা আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন, দশম সংসদ পাঁচ বছর টিকে থাকবে এবং ২০১৯ সালে 'সমঝোতা'র ব্যাপারে কথা হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নীতি-নির্ধারককে বলতে শুনেছি, সংসদ যদি দীর্ঘদিন চলে, তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। তাতে করে বিএনপি ভেঙে যাবে! এ ধরনের কথাবার্তা কোনো বাস্তববাদী কথাবার্তা নয়।এখন নির্বাচন আয়োজন করে প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে 'বিজয়ী' হয়েছেন! কিন্তু তার 'পরাজয়' ঘটবে যদি তিনি বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ না করেন। আর বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করতে হলে তাকে বিএনপির সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে হবে। এই সমঝোতার ধরন কী হবে, কিংবা সরকার কতটুকু ছাড় দেবে, তা এই মুহূর্তে হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন এবং জনপ্রিয়তা আরও বাড়াতে পারবেন, যদি থেমে যাওয়া সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ তিনি দেন। মনে রাখতে হবে, দশম সংসদ নির্বাচন কিংবা উপজেলা নির্বাচন আয়োজন করে 'পূর্ণ বিজয়' নিশ্চিত করা যাবে না। দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। কেননা এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত।প্রথমত, দশম সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা না আসায় বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। 'সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনের' যে দাবি দাতারা করেছিল, তা নিশ্চিত করা যায়নি। এর জন্য কে দায়ী, সে হিসাব নিশ্চয়ই করা যায়। কিন্তু এর চেয়েও যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে নির্বাচনের প্রশ্নে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছা এবং সহিংসতা বন্ধে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। বিগত দশম সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। এই সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায়, সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তারা তখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। আজকে নিউইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায়, যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু যে দেশটি এখন বিশ্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মডেল (শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইত্যাদি), সেই দেশটির সব উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। আমাদের নেতারা ব্যর্থ হলেন একটা সমঝোতায় যেতে।সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে 'গৃহযুদ্ধের' মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে! বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। এই প্রতিবেদনটি, যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ২ জানুয়ারি। ঠিক তার একদিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলেছে, ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে মারা গেছেন ৫৭৩ জন, যার মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩ জন।একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। 'গৃহযুদ্ধের' ধারণা যারা দেন, তারা এই পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারে। অনেকেই এখন জানেন, ওই নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। শতকরা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের এটা ছিল পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে 'প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এই শব্দগুলো সংবিধানে সনি্নবেশিত হয়। আমাদের সবার মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু সহিংসতা রোধে ব্যর্থতা এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয়(?) প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার।বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত। কিন্তু 'সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে' ইসি বিতর্কিত হয়েছিল। কমিশন ২৮ জুলাই (২০১৩) নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই।নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তি করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। আমরা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা থেকেও কিছু শিখিনি।জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করে সরকার আবারও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করল। এটা সরকারের এক ধরনের 'বিজয়' সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মানুষ নির্বাচন চায়। কিন্তু সব দলের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। উপজেলা নির্বাচন এ কথাটাই আবার প্রমাণ করল। উপজেলা নির্বাচনের এই 'গ্রহণযোগ্যতা'কে ধারণ করে সরকার যদি একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেয়, তাহলে ভালো করবে। Daily ALOKITO BANGLADESH 24.02.14

0 comments:

Post a Comment