রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সহযোগিতার নতুন মডেল!

চীনের নয়া রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দু'দিনব্যাপী এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন গত ৮ জুন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ওবামা 'সহযোগিতার নতুন মডেল' হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে ওবামা এটা স্পষ্ট করেছেন যে, সাইবার হ্যাকিং ভবিষ্যৎ সম্পর্কের পথে অন্তরায়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, চীনা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়ে অনেক গোপন তথ্য পাচার করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। যদিও চীনা প্রতিনিধি দল এর ব্যাখ্যা দিয়েছে অন্যভাবে। তারা বলেছে, সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুতে দ্বন্দ্ব নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে চায় চীন। উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে দু'দেশ কাছাকাছি এসেছে বলেও জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে দু'দেশ অন্যতম গ্রিনহাউস গ্যাস Hydroflurocarbon (HFC নির্গমন হ্রাসেও ঐকমত্যে পেঁৗছেছে। বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দু'দেশ HFCর পরিমাণ ৯০ গিগাটনে নামিয়ে আনবে। বলা ভালো, এয়ারকন্ডিশনারে ঐঋঈ ব্যবহৃত হয়। তা বায়ুমণ্ডলে ১৫ বছর পর্যন্ত থাকে। এক সময় রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনারেCFC গ্যাস ব্যবহৃত হতো। ১৯৯০ সালের মনট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী CFC গ্যাস নিষিদ্ধ। এর পর থেকে CFCর পরিবর্তে HFC ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে ওবামা-শ জিনপিংয়ের মধ্যকার শীর্ষ বৈঠকের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও শীর্ষ বৈঠকে কোনো বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি, তবুও এই শীর্ষ বৈঠকের প্রয়োজন ছিল। কেননা, দুটি বড় অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার টানাপড়েন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি উত্তেজনা বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একমাত্র শক্তি হচ্ছে চীন। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ঊধর্ে্ব। বিশ্বের ৫০০টি বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে চীনের রয়েছে ৩৭টি। বিশ্বের জ্বালানির শতকরা ১৬ ভাগ চীন ব্যবহার করে। আর জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে চীনের অবস্থান তৃতীয়। চীন যেসব দেশ থেকে জ্বালানি ক্রয় করে (ইরান), সেখানে যথেষ্ট মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীন বিশ্বের রূপান্তরযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। চীন গত বছর এ খাতে সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পর তার স্থান। ইতিমধ্যে জাতীয় উৎপাদনের দিক দিয়ে চীন জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে যত ফটোকপি, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদন হয়, তার তিন ভাগের দু'ভাগ উৎপাদন হয় চীনে। বিশ্বের মোবাইল ফোনের শতকরা ৬০ ভাগ চীন একাই উৎপাদন করে। একই সঙ্গে বিশ্বের মধ্যে ডিভিডি শতকরা ৫৫ ভাগ, ক্যামেরা ৫০ ভাগ, পারসোনাল কম্পিউটার ৩০ ভাগ, শিশুদের খেলনা ৭৫ ভাগ চীন একাই উৎপাদন করে। চীনের এই অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বড় ধরনের আঘাত হানছে। প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনকে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করছে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে চীনের যে বিনিয়োগ, তাতে উৎকণ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। লাতিন আমেরিকাতে এর পরিমাণ বেড়েছে ১ বিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর এশিয়াতে বেড়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন থেকে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। সুদান ও কম্বোডিয়ায় বিনিয়োগের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে চীন। অন্যদিকে সুদানের পাশাপাশি ইরানের তেল সেক্টরে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০৯ সালে চীন ইরানের তেল ও গ্যাস সেক্টরে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। আগামী ৫ বছরে এই সেক্টরে তারা বিনিয়োগ করবে ১২০ বিলিয়ন ডলার। ইরানের তেলের অন্যতম ক্রেতা আজ চীন। আন্তর্জাতিক অবরোধ উপেক্ষা করে চীন ইরান থেকে তেল আমদানি করছে। বিষয়টি মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অনেকেরই জানার কথা, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। এই ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণ যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান চীনের উপস্থিতি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের চিন্তার অন্যতম কারণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাসহ সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে যে এক ধরনের 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, সেই শূন্যতা চীন পূরণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। চীন ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশের আইনাক (অুহধশ) নামক স্থানে কপার ফিল্ড উন্নয়নে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নেপালের মহাসড়ক নির্মাণ, সীমান্ত পোর্ট নির্মাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন জড়িত রয়েছে। মিয়ানমারে মহাসড়ক নির্মাণ, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে যে বিশাল গ্যাস রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা এখন পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে যাবে। আর ঐতিহাসিকভাবেই চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি রয়েছে মিয়ানমারের। মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। তারা পাকিস্তানেও (গাওদার) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। কারাকোরাম পর্বতমালায় সড়কপথও নির্মাণ করছে চীন। শ্রীলংকায় হামবানতোতায় (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের এলাকা) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এই পোর্ট পুরোপুরি চালু হবে ২০২০ সালে। একই সঙ্গে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চীন এই দ্বীপরাষ্ট্রটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তৈরি করছে। হামবানতোতায় ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি তাদেরই তৈরি করে দেওয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই যে বিশাল বিনিয়োগ, তা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অজানা নয়। এমনকি বাংলাদেশেও বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। বাংলাদেশেও সোনাদিয়া দ্বীপের গভীরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় চীন। ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করে চীন যে ংঃৎরহম ড়ভ ঢ়বধৎষং বা মুক্তার মালার নীতি গ্রহণ করেছে, তা যুক্তরাষ্ট্র নয়; ভারতের স্বার্থেও আঘাত হানছে।
ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের 'স্নায়ুযুদ্ধ'। এখানে কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই বিপুল জলসীমা, তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এ অঞ্চলজুড়ে গাওদার (বেলুচিস্তান, পাকিস্তান), হামবানতোতা (শ্রীলংকা), সিটওয়ে, কিয়াউক-পাইউই বন্দরে (মিয়ানমার) রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর রিফুয়েলিং সুবিধা ও সাবমেরিন ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জও চীনা নৌবাহিনী ব্যবহার করে। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। তার জ্বালানি চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ এ অঞ্চলে অবস্থিত মালাক্কা প্রণালী দিয়ে পরিবহন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে শ্রীলংকা পর্যন্ত ভারত মহাসাগর। তারপর এই মহাসাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালী (মালয়েশিয়া) অতিক্রম করে ইন্দোনেশিয়ার পাশ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর যাওয়ার যে সমুদ্রপথ, এই পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম নৌ-শক্তি। এ অঞ্চলে চীনা নৌ-শক্তির উপস্থিতি তার কাম্য নয়। অথচ জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তার জন্যও এই রুটটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠুক_ চীন তা কখনও চাইবে না। এমনকি মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার বন্দরের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের পূর্বাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার এক বিশাল ও ব্যয়বহুল প্রকল্পও হাতে নিয়েছে চীন। এ জন্য ভারত মহাসাগর তার নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব থাকুক। কেননা, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগর তথা গাওদার পোর্টের গুরুত্ব রয়েছে। গাওদার থেকে 'স্ট্রেইট অব হরমুজ'-এর দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল (এ পথ দিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে)। আর ৭২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ইরান সীমান্ত। বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত একটি বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করত। সুতরাং আগামী দিনে ভারত মহাসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মার্কিন সমরনায়কদের কাছে।
তাই নয়া চীনা নেতাকে জানার প্রয়োজন ছিল মার্কিন প্রশাসনের। শি জিনপিংয়ের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক এখন স্থাপিত হলো। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে 'টিকফা' আর মালদ্বীপের সঙ্গে 'সোফা' চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়, যা চীনা নেতৃবৃন্দ খুব সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। তাই ওবামা দু'দেশের সম্পর্ককে যতই 'সহযোগিতার নতুন মডেল' বলুন না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
Daily SAMAKAL
16.06.13

0 comments:

Post a Comment