হেফাজতে
ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফী সম্প্রতি দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে ৫ মে
ঢাকার শাপলা চত্বরে রাতের বেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও
বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথের দোকানগুলোতে তথাকথিত হামলা এবং অগ্নিসংযোগের
ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। আল্লামা শফী সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন
রেখেছেন পায়জামা, পাঞ্জাবী পরা ও ইলেকট্রিক করাত দিয়ে অল্প সময়ে শত শত
গাছ কাঁটলো কারা? কারা পবিত্র কুরআন শরিফে আগুন দিয়েছে? তার এই
সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে দৈনিক মানব জমিন এ গত ৩০ মে। আল্লামা শফী হেফাজতে
ইসলামির নেতা হলেও, তার একটা ধর্মীয় পরিচয় আছে। তিনি সবার মুরুব্বী।
সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। এমনকি বর্তমান সরকারও তাঁকে কওমী মাদরাসা
শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পর্যন্ত করেছেন। গত ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনা
নিয়ে সারাদেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। শাপলা চত্বরে
অবস্থানকারী হাজার হাজার মানুষ ‘প্রতিবাদের অংশ’ হিসেবে রাতের বেলা
অবস্থান করে ভোর বেলায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু অতর্কিতে
কমান্ডো স্টাইলে ঘুমন্ত অবস্থায় রাতের লাইট নিভিয়ে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ
করা হয়। তাতে প্রচুর লোক মারা যায়। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়েও বিভ্রান্তি
রয়েছে। কতজন মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে
নানা মত আছে। এখানে এই হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি যে বিষয়টি মিডিয়াতে ফলাও
করে প্রচার করা হয়েছে, তা হচ্ছে বায়তুল মোকাররম এলাকায় ফুটপাথের দোকানে
আগুন দেয়া ও পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানো। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কুরআন
পোড়ানোর ঘটনাকে দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করা। আমরা সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম
এবং ্ পত্রিকাতেই লিখেছিলাম কারা এই কাজটি করলো? যেসব তরুণ জীবন দর্শন
হিসেবে ইসলাম ধর্মকে বেছে নিয়েছে, পবিত্র কুরআন যাদের জীবন, মানস গঠনে
সাহায্য করে, যারা নিজের জীবন দিয়ে হলেও কুরআন শরিফকে রক্ষা করে, তারা কী
করে কুরআন পোড়ায়। আল্লামা শফী যথার্থই বলেছেন, বিশেষ ‘স্বার্থান্বেষী
মহল’ এই কাজটি করে দোষ চাপিয়েছে হেফাজতে ইসলামের ওপর। এ দেশের সুধী সমাজের
কেউ কেউ এভাবেই শাপলা চত্বরের ওই দিনের ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু
দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমরা লক্ষ্য করেছি এ ক্ষেত্রে সরকারের নীরবতা। কেন সরকার
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করলো না? আমরা আরো লক্ষ্য করলাম সরকার,
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ফুটপাথে যেসব দোকানী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের
ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু
সরকার কেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করছে না। এটা একটা গুরুতর অপরাধ।
এই অপরাধ যেই করে থাকুক, তার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। একজনের অপরাধ
অন্যজনের ঘাড়ে চাপানো ঠিক নয়। পাঠক, আপনাদের অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা
বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা এম কে আনোয়ার কুরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনার সাথে জনৈক
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার নাম উল্লেখ করেছিলেন। এর ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা
হয়। সেই মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। কী অদ্ভুত দেশ! যারা কুরআন
পোড়ালো,তাদের কাউকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারলো না। কথা বলায় জেলে গেলেন
আনোয়ার সাহেব। পাঠক, আপনাদের আরো একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এসব
ক্ষেত্রে অর্থাৎ বড় ধরনের জমায়েত মিটিং-মিছিলে পুলিশের ভিডিও টিম থাকে।
তারা সবকিছু ধারণ করে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস পুলিশের কাছে এই দিনের বায়তুল
মোকাররমের ঘটনার ভিডিও আছে। তাহলে পুলিশ ভিডিও দেখে অভিযুক্তদের গ্রেফতার
করে না কেন? যারা নিয়মিত সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ‘ভিজিট’ করেন, তারা
স্পষ্ট করে দেখেছেন কিছু তরুণ করাত দিয়ে গাছ কাটছে। এদের মুখায়ন স্পষ্ট।
পুলিশ কী পারে না ওই ছবি পত্রিকায় রিলিজ করে জনগণকে এদের পরিচিতি জানাতে?
পুলিশ ওই ছবি প্রকাশ করে এদের নাম, ঠিকানা জনগণের কাছে আহ্বান করতে পারে।
পুলিশ এ কাজটি করছে না কেন? হেফাজতের তরুণ কর্মীরা ঢাকা চেনে না। অনেকেই
প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছিলেন। চিড়া, গুড় ছিল তাদের সাথে। তারা করাত
নিয়ে ঢাকায় আসবে, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য কথা? করাত বহন করার সময় বাসে
কিংবা মিছিলে তা তো পুলিশের দেখার কথা। আসলে পুরো বিষয়টিতে ধূম্রজাল
সৃষ্টি করা হয়েছে। অভিযোগ চাপানো হয়েছে হেফাজতের ওপর। হেফাজতের মহাসচিবকে
সুস্থ শরীরে গ্রেফতার করা হলো। রিমান্ডে নেয়া হলো বারবার। আর অসুস্থ এবং
অনেকটা ‘মৃত্যুর মুখ’ থেকে তাঁকে জামিন দেয়া হলো গত ৩০ মে। হেফাজতের
নেতারা বারবার বলেছেন, তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন করেন না। ভবিষ্যতে তারা
রাজনৈতিক সংগঠন করবে না। ভবিষ্যতে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও যেতে চান না।
তারা ঈমান-আকিদা নিয়ে কাজ করেন। গরিব ছাত্রদের পড়ান। ধর্মশিক্ষা দেন।
রাজনীতির সাথে তাদের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ঢাকায় সমাবেশ করেছে (যার
অনুমতি সরকার দিয়েছে)। শুধুমাত্র রাসূলে করিম (সা.) এর অবমাননার
প্রতিবাদে। তাদের ১৩ দফার মধ্যে কোথাও সরকারের পদত্যাগের কথাটি নেই। অথচ
তাদেরকে আজ টার্গেট করা হলো। ওই দিনের ঘটনায় কী ধরনের গোলাবারুদ ব্যবহার
করা হযেছিল, তার একটি পরিসংখ্যান অবশ্য আগের লেখাতে দিয়েছি। আজ তাই সকল
বিভ্রান্তি এড়াতে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। আজকে
এ ঘটনার যদি সুষ্ঠু বিচার না হয়, তাহলে স্বার্থান্বেষী মহল উৎসাহিত হবে
এবং এ ধরনের অপকর্ম করে দোষ চাপানোর সুযোগ পাবে অন্য দলের ওপর। হেফাজতের ওই
দিনের সমাবেশ নিয়ে সরকারি দলের বক্তব্য তো আমরা দেখেছি। বারবার বলা হচ্ছে
সরকারের তরফ থেকে যে হেফাজতের ওই কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছিল বিএনপি ও
জামায়াত। খোদ হেফাজতের আমীর এর প্রতিবাদ করলেও এই ‘অভিযোগ’ এখনও অব্যাহত
রয়েছে। এই দোষারোপের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা যতদিন না বের হয়ে আসতে
পারবো, ততদিন আমাদের দেশে গণতন্ত্রের বিনির্মাণের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত
হবে। গণতন্ত্রের অর্থ নয় একদলীয় শাসন। গণতন্ত্র শেখায় পরমত সহিষ্ণুতা।
গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। এই বিশ্বাস ও
আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে
তাই প্রশ্ন থাকবেই। এখানে নির্বাচন হয়। সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু শুধু
নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট, বিরোধী পক্ষকে
সহ্য করে নেয়ার যে মানসিকতা, আস্থায় নেয়ার যে ‘রাজনীতি’, এই সংস্কৃতি
এখানে গড়ে ওঠেনি। অথচ ৪২ বছর আমরা পার করেছি। হেফাজতকে নিয়ে যে
মিথ্যাচার, তা বন্ধ হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে,
অনেক কওমী মাদরাসা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। ছাত্র ও শিক্ষকরা সেখানে শিক্ষা
নিতে ও শিক্ষা দিতে যেতে পারছে না পুলিশের ভয়ে। কোনো কোনো মাদরাসায়
ছাত্র-ছাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। একটা ‘ভয়ের সংস্কৃতি’
বিরাজ করছে কওমী মাদরাসাগুলোতে। সরলপ্রাণ ছাত্র-ছাত্রীদের কী দোষ? এরা তো
এখন রাজনীতির শিকার হলো? এই উপমহাদেশে মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরনো।
ইতিহাস বলে ১৮৬৬ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যালকাটা মাদরাসা’। ১৯৪৭ সালে
কলকাতার মাদরাসার আরবি শাখাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয়
আলিয়া মাদরাসা। এটি পরে সরকারি করা হয়। পরে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত হয়
কওমী মাদরাসা। হাজার হাজার তরুণ, গরিব কিন্তু মেধাবী তারা এখন কওমী
মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। এখানে সরকারি অনুদান নেই। সাধারণ মানুষের
সাহায্যে এবং কোনো কোনো ইসলামী ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব কওমী
মাদরাসা পরিচালিত হয়। এখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাকে
বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অতীতে এ দেশের গুণী অনেক ব্যক্তি শৈশবে মাদরাসায়
পড়াশোনা করেছেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবুল কালামও এক সময় মাদরাসার
ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশে কওমী মাদরাসায় যারা পড়ে তারা সাধারণ ঘরের সন্তান।
গরিব, পিতৃহারা,অনাথ যাদের রাষ্ট্র দেখভাল করতে পারে না, তাদের
আশ্রয়স্থল হচ্ছে এই কওমী মাদরাসা। কিন্তু এদের সম্পর্কে সমাজের একটি
শ্রেণীর নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। প্রচারণার কারণে এদেরকে জঙ্গি, উগ্রবাদী
ইত্যাদিতে ভূষিত করা হচ্ছে। তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে এসব কওমী
মাদরাসাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই প্রবণতা সমাজে কখনো মঙ্গল
ডেকে আনবে না। ৫ মের হেফাজতের সমাবেশ নিয়ে কওমী মাদরাসার বিরুদ্ধে
প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। এটি ঠিক নয়। এ জন্য আল্লামা শফী যে বিচার
বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন, এটাই ঠিক। দ্রুত একটি তদন্ত
কমিটি গঠন করা হোক। অতীতে কোনো কোনো ঘটনায় সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত
কমিটি গঠন করেছে। আজ যদি সরকার এ ধরনের একটি কমিটি গঠন করে, আমার বিশ্বাস
তা সকল প্রশ্নের জবাব দেবে। এর মধ্যে দিয়েই আমরা দুষ্কৃতিকারীদের চিহ্নিত
করতে পারবো। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এ ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে,
ততই রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। বিদেশী দাতাগোষ্ঠী, এমনকি সাধারণ মানুষের যে
প্রত্যাশা, সকলদলের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে একটি নির্বাচন, সেই নির্বাচন
নিয়ে শঙ্কা এখনও দূর হয়নি। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরকার বারবার
প্রত্যাখ্যান করছে। অথচ সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন (আমাদের অর্থনীতি ২১ মে, ২০১৩)। তাতে
তিনি বলেছেন, এটা সম্ভব যদি রাজনীতিবিদরা এক হতে পারেন। যদিও তিনি এটা
স্পষ্ট করেছেন যে ১. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হতে
পারে, ২. অনির্বাচিতদের নিয়ে এই সরকার করা যাবে না, ৩. বিচারপতি হক নিজে
কোনো দায়িত্ব নেবেন না, ৪. পূর্ণাঙ্গ রায়ে (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল
সংক্রান্ত) আরো দু’ টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলা হয়েছে, ৫.
গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য রাজনীতিতে সুস্থিরতা প্রয়োজন। বলা
প্রয়োজন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার)
বাতিল ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা রাজনীতিতে বড় ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে।
এখন যেহেতু তিনি বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্ভব, সেহেতু একটা
উদ্যোগ সরকার নিতে পারে।
আমি আল্লামা শফীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই। বাংলাদেশকে একটি
‘জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র’ বানাতে (?) সকল ধরনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সবাইকে
সচেষ্ট হতে হবে। এ দায়িত্ব আজ সবার। তাই একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও
সেই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সকল ধরনের বিভ্রান্তির অবসান
সম্ভব।
07.06.13
0 comments:
Post a Comment