প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে বর্তমান সংসদের শেষ দিন।
এরপর ২৫ জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো একদিন নির্বাচন হবে। কিন্তু একটা বিষয়ে
এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি- আর তা হচ্ছে, নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারে কারা
কারা থাকবেন? বর্তমান সংবিধানে যেভাবে রয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে এর
ব্যাখ্যা করেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের
জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাচ্ছেন। বিএনপির আপত্তিটা সেখানেই। ১০ জুন
বেগম জিয়া আবারও স্পষ্ট করে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে
দেয়া হবে না। নির্বাচন প্রশ্নে তাই একটা জটিলতা রয়েই গেছে। এ ক্ষেত্রে
সরকারের স্ট্রাটেজি অনেক।
এক. বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যাতে করে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রয়োজনে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা সচল করা ও তার বিচার নিশ্চিত করা।
দুই. প্রধানমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন।
তিন. তথাকথিত সংলাপের প্রক্রিয়াকে ‘লো প্রোফাইল’-এ রাখা। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দাতাগোষ্ঠীকে একটা মেসেজ পৌঁছে দেয়া যে, সরকার সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা ভালো করেই জানেন, সংলাপের এজেন্ডা নির্ধারিত না থাকায় বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে না। বিএনপির মূল দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এটা স্পষ্ট করেছেন, শেখ হাসিনাই হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। এর বাইরে অন্য কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবেন না। আর বিএনপির এ ক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে। ফলে সংলাপের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
চার. সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা মনে করেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। অথবা বিএনপির একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটা সমর্থনও তাতে থাকতে পারে। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করাও বিচিত্র নয়। এরশাদ এরই মধ্যে সরকারবিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে তার একটি ভূমিকা থাকবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
তবে সব ‘অঙ্কের’ হিসাব বদলেও যেতে পারে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন। ১৫ জুন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এই নির্বাচন ছিল একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং বিএনপি প্রার্থীরা যদি বিজয়ী হন, তাহলে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় মনিরুজ্জামান মনি, বরিশালে আহসান হাবিব কামাল ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি প্রার্থী। ১৮ দল তাদের সমর্থন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন (রাজশাহী, সিলেট)। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এর মধ্যে জনগণ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছেন এবং চার সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন হয়েছে মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। জনগণ সরকারের ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত রায় প্রদান করেছেন। এটি সরকারের জন্য একটি বার্তাও বটে। সে ক্ষেত্রে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাওয়ায়, তা বিএনপিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে প্ররোচিতও করতে পারে।
তবে নির্বাচন প্রশ্নে শুধু কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন, এ প্রশ্নেই যে জটিলতা রয়েছে, তা নয়। আরও বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ ব্যাপারেও একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। ধরে নিচ্ছি সংসদ যদি ভেঙে যায়, তা যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে নবম জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভূমিকা কী হবে? তারা কী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন না? শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী থেকে যান, তাহলে দলীয় এমপিরা একটা প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবেন। সম্প্রতি একটি কাগজে বলা হয়েছে, সরকার এরই মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন সাজানো শুরু করে দিয়েছে। সরকারের (অন্তর্বর্তী) এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এমনকি অন্তর্বর্তী প্রশাসনে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারটিরও ফয়সালা হয়নি। যারা অন্তর্বর্তী প্রশাসনে থাকবেন, তারা কী নির্বাচন করতে পারবেন? এখানে যে প্রশ্নটি উঠেছে, সংসদ সদস্যের পদটি কি ‘লাভজনক’ পদ? এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ‘লাভজনক’ পদের যারা অধিকারী, সে ব্যাপারে সংবিধানের ৬৬(৪) ২(ক) ধারায় একটি ব্যাখ্যা আছে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে (অর্থাৎ সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা) কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত পদগুলো সংবিধান অনুযায়ী ‘লাভজনক পদ’ নয়। যদিও এখানে ‘সংসদ সদস্যপদ’ কথাটি লেখা হয়নি। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে মেয়র পদকে লাভজনক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত, সংসদ সদস্যরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ অবস্থায় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করতে পারবেন কি-না, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে [২০০৮(১৪)-ধারা (১)] বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন না এবং প্রচারও চালাতে পারবেন না। এর অর্থ কী? একজন মন্ত্রী বা এমপি, তিনি তো সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সরকারের কাছ থেকে ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা নেন। তিনি তো সরকারের সুবিধাভোগী। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারেন, তাহলে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর তিনি কী তা মানবেন? তিনি কী প্রভাব খাটাবেন না? অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন, তার নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে?
গত ২৬ ও ২৯ মে বিএনপি হরতাল পালন করলেও, এরপর বিএনপি আর কোনো বড় কর্মসূচি দেয়নি। জামায়াত হরতাল দিয়েছিল ১০ জুন। জামায়াতের এই হরতালে আবার বিএনপির সমর্থন ছিল না। গত ১২ জুন বিএনপি বড় জমায়েত করেছে। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিএনপি আপাতত হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক এবং বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর অনেকেই এই ‘হরতাল না দেয়ার’ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দাতাগোষ্ঠীর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাধিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা দলটি ছিল অতি ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা একদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেমনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে মার্কিন জনগণের উৎকণ্ঠার খবরও জানিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিকল্প জনমত কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির এই সংকটকালীন সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে করে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়া এখন ঝুলে গেল। সংলাপ হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল, সরকার ও বিরোধী দল আদতেই ‘সংলাপ’ চায় না। সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার, এই মুহূর্তে সেই পরিবেশ নেই। সরকারের কর্মকা- দেখে ওই সিদ্ধান্তে আসা যায়, সরকার এককভাবে নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে। কিন্তু এই পক্ষ ভালো নয়। এই পক্ষ দেশের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। পরিকল্পনামাফিক সরকার ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, সরকারপ্রধান এরই মধ্যে ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া’ শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। কারা কারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাও ঠিক করে ফেলেছেন। ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যিনি সরকারপ্রধানের খুব ঘনিষ্ঠ। একদিকে সংলাপের কথা বলে বিএনপিকে তথাকথিত ‘আমন্ত্রণ’, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখাÑ আর এক সময় হঠাৎ করেই নির্বাচনের ‘সিডিউল’ ঘোষণা করা হবে! উদ্দেশ্য একটাই, বিএনপি তথা ১৮ দলকে নির্বাচনী প্রচার তথা প্রস্তুতির সুযোগ না দেয়া এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় নির্বাচন সম্পন্ন করা।
কিন্তু এ ধরনের নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এবং এতে করে সংকট আরও বাড়বে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন আর ২০১১ সালে সেই সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও নেপাল নির্বাচনকালীন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ২ জুন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো শপথ নিয়েছেন। জুন মাসেই নেপালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানে গেল মার্চে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। একদিকে উগ্র তালেবানি রাজনীতি পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যখন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সেখানে সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রমাণ করল, পাকিস্তানের মানুষ এ নতুন ব্যবস্থায় আস্থাশীল।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার টার্ম শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয় ও গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের ৫ বছরের টার্ম শেষ করে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানে এবং নেপালে নির্বাচনকালীন সময়ে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো, এই দেশ দু’টোর রাজনীতিবিদরা চেয়েছেন নির্বাচনকে অর্থবহ এবং গ্রহণযোগ্য করতে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সেখানকার পরিস্থিতিকে উত্যপ্ত করেছিল। এখন পাকিস্তান নতুন এক সরকার পেয়েছে। ধারণা করছি, নেপালে যে সরকার গঠিত হবে, তারাও স্থিতিশীলতা উপহার দিতে পারবে। বাংলাদেশ পাকিস্তান ও নেপালের দৃষ্টান্ত থেকে ‘শিখতে’ পারে। আগামীতে নির্বাচন হতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। সব দলের অংশগ্রহণ না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। তাই সংলাপটা জরুরি, সেটা সংসদের ভেতরেও হতে পারে, সংসদের বাইরেও হতে পারে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দেবেন। তাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর যে ধারণা, সেটাই প্রমাণ করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। বিএনপি এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। সুতরাং বিএনপির এই স্পিরিটকে ধারণ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠনকল্পে আলাপ-আলোচনা শুরু করার সময় এখনই।
Alokito Bangladesh
17.06.2013
এক. বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যাতে করে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে না পারেন। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। প্রয়োজনে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা সচল করা ও তার বিচার নিশ্চিত করা।
দুই. প্রধানমন্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তিনি প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন।
তিন. তথাকথিত সংলাপের প্রক্রিয়াকে ‘লো প্রোফাইল’-এ রাখা। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দাতাগোষ্ঠীকে একটা মেসেজ পৌঁছে দেয়া যে, সরকার সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা ভালো করেই জানেন, সংলাপের এজেন্ডা নির্ধারিত না থাকায় বিএনপি সংলাপে অংশ নেবে না। বিএনপির মূল দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এটা স্পষ্ট করেছেন, শেখ হাসিনাই হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান। এর বাইরে অন্য কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবেন না। আর বিএনপির এ ক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে। ফলে সংলাপের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
চার. সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটা মনে করেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে। অথবা বিএনপির একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটা সমর্থনও তাতে থাকতে পারে। এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করাও বিচিত্র নয়। এরশাদ এরই মধ্যে সরকারবিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে তার একটি ভূমিকা থাকবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
তবে সব ‘অঙ্কের’ হিসাব বদলেও যেতে পারে। চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন। ১৫ জুন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য এই নির্বাচন ছিল একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং বিএনপি প্রার্থীরা যদি বিজয়ী হন, তাহলে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনায় মনিরুজ্জামান মনি, বরিশালে আহসান হাবিব কামাল ও সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি প্রার্থী। ১৮ দল তাদের সমর্থন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন (রাজশাহী, সিলেট)। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এর মধ্যে জনগণ ব্যালট পেপারের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত রায় প্রদান করেছেন এবং চার সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন হয়েছে মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। জনগণ সরকারের ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত রায় প্রদান করেছেন। এটি সরকারের জন্য একটি বার্তাও বটে। সে ক্ষেত্রে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাওয়ায়, তা বিএনপিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে প্ররোচিতও করতে পারে।
তবে নির্বাচন প্রশ্নে শুধু কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন, এ প্রশ্নেই যে জটিলতা রয়েছে, তা নয়। আরও বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এ ব্যাপারেও একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। ধরে নিচ্ছি সংসদ যদি ভেঙে যায়, তা যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে নবম জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভূমিকা কী হবে? তারা কী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন না? শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী থেকে যান, তাহলে দলীয় এমপিরা একটা প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবেন। সম্প্রতি একটি কাগজে বলা হয়েছে, সরকার এরই মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন সাজানো শুরু করে দিয়েছে। সরকারের (অন্তর্বর্তী) এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এমনকি অন্তর্বর্তী প্রশাসনে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারটিরও ফয়সালা হয়নি। যারা অন্তর্বর্তী প্রশাসনে থাকবেন, তারা কী নির্বাচন করতে পারবেন? এখানে যে প্রশ্নটি উঠেছে, সংসদ সদস্যের পদটি কি ‘লাভজনক’ পদ? এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ‘লাভজনক’ পদের যারা অধিকারী, সে ব্যাপারে সংবিধানের ৬৬(৪) ২(ক) ধারায় একটি ব্যাখ্যা আছে। ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে (অর্থাৎ সংসদ সদস্য হবার যোগ্যতা) কোনো ব্যক্তি (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী) প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত পদগুলো সংবিধান অনুযায়ী ‘লাভজনক পদ’ নয়। যদিও এখানে ‘সংসদ সদস্যপদ’ কথাটি লেখা হয়নি। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে মেয়র পদকে লাভজনক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত, সংসদ সদস্যরাও জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ অবস্থায় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হন, তিনি মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করতে পারবেন কি-না, সেটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলের আচরণবিধিতে [২০০৮(১৪)-ধারা (১)] বলা হয়েছে, মন্ত্রী বা সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারবেন না এবং প্রচারও চালাতে পারবেন না। এর অর্থ কী? একজন মন্ত্রী বা এমপি, তিনি তো সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। সরকারের কাছ থেকে ভাতা নেন, সুযোগ-সুবিধা নেন। তিনি তো সরকারের সুবিধাভোগী। তিনি যদি নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারেন, তাহলে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর তিনি কী তা মানবেন? তিনি কী প্রভাব খাটাবেন না? অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে যে নির্বাচন, তার নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে?
গত ২৬ ও ২৯ মে বিএনপি হরতাল পালন করলেও, এরপর বিএনপি আর কোনো বড় কর্মসূচি দেয়নি। জামায়াত হরতাল দিয়েছিল ১০ জুন। জামায়াতের এই হরতালে আবার বিএনপির সমর্থন ছিল না। গত ১২ জুন বিএনপি বড় জমায়েত করেছে। এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিএনপি আপাতত হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক এবং বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর অনেকেই এই ‘হরতাল না দেয়ার’ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দাতাগোষ্ঠীর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাধিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা দলটি ছিল অতি ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা একদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেমনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে মার্কিন জনগণের উৎকণ্ঠার খবরও জানিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিকল্প জনমত কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির এই সংকটকালীন সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার ও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে করে পুরো সংলাপ প্রক্রিয়া এখন ঝুলে গেল। সংলাপ হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল, সরকার ও বিরোধী দল আদতেই ‘সংলাপ’ চায় না। সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার, এই মুহূর্তে সেই পরিবেশ নেই। সরকারের কর্মকা- দেখে ওই সিদ্ধান্তে আসা যায়, সরকার এককভাবে নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে। কিন্তু এই পক্ষ ভালো নয়। এই পক্ষ দেশের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। পরিকল্পনামাফিক সরকার ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, সরকারপ্রধান এরই মধ্যে ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া’ শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গণভবনে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। কারা কারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাও ঠিক করে ফেলেছেন। ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যিনি সরকারপ্রধানের খুব ঘনিষ্ঠ। একদিকে সংলাপের কথা বলে বিএনপিকে তথাকথিত ‘আমন্ত্রণ’, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের ব্যতিব্যস্ত রাখাÑ আর এক সময় হঠাৎ করেই নির্বাচনের ‘সিডিউল’ ঘোষণা করা হবে! উদ্দেশ্য একটাই, বিএনপি তথা ১৮ দলকে নির্বাচনী প্রচার তথা প্রস্তুতির সুযোগ না দেয়া এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় নির্বাচন সম্পন্ন করা।
কিন্তু এ ধরনের নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এবং এতে করে সংকট আরও বাড়বে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন আর ২০১১ সালে সেই সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও নেপাল নির্বাচনকালীন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ২ জুন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো শপথ নিয়েছেন। জুন মাসেই নেপালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানে গেল মার্চে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। একদিকে উগ্র তালেবানি রাজনীতি পাকিস্তানের অস্তিত্বকে যখন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সেখানে সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রমাণ করল, পাকিস্তানের মানুষ এ নতুন ব্যবস্থায় আস্থাশীল।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টো দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার টার্ম শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয় ও গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের ৫ বছরের টার্ম শেষ করে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানে এবং নেপালে নির্বাচনকালীন সময়ে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হলো, এই দেশ দু’টোর রাজনীতিবিদরা চেয়েছেন নির্বাচনকে অর্থবহ এবং গ্রহণযোগ্য করতে এ ধরনের একটি সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সেখানকার পরিস্থিতিকে উত্যপ্ত করেছিল। এখন পাকিস্তান নতুন এক সরকার পেয়েছে। ধারণা করছি, নেপালে যে সরকার গঠিত হবে, তারাও স্থিতিশীলতা উপহার দিতে পারবে। বাংলাদেশ পাকিস্তান ও নেপালের দৃষ্টান্ত থেকে ‘শিখতে’ পারে। আগামীতে নির্বাচন হতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। সব দলের অংশগ্রহণ না হলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। তাই সংলাপটা জরুরি, সেটা সংসদের ভেতরেও হতে পারে, সংসদের বাইরেও হতে পারে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দেবেন। তাই ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর যে ধারণা, সেটাই প্রমাণ করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। বিএনপি এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। সুতরাং বিএনপির এই স্পিরিটকে ধারণ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার গঠনকল্পে আলাপ-আলোচনা শুরু করার সময় এখনই।
Alokito Bangladesh
17.06.2013
0 comments:
Post a Comment