অর্থমন্ত্রী ২০১৩-১৪ সালের জন্য যে বিশাল বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, তা নিয়ে ইতোমধ্যে নানাজন নানা কথা বলেছেন। এই বাজেটকে ‘পরাবাস্তব’, ‘উচ্চাভিলাষী’, ‘নির্বাচনবান্ধব’, কিংবা ‘বিগ বিউটিফুল বেলুন’ ইত্যাদিতে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহাজোটের শরিকরাও যে সন্তুষ্ট তা বলা যাবে না। বাজেট যে উচ্চাভিলাষী তা স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। বাজেটে ইতিবাচক দিকগুলোর চাইতে নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি। বাজেটের যে আকার ধরা হয়েছে সে আকারের অর্থায়ন কীভাবে হবে এর নির্দেশ রয়েছে বটে কিন্তু যেসব সূত্র থেকে তা হবে বলে ধরা হয়েছে সেটা কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে এ নিয়ে সঙ্গতই প্রশ্ন আছে। মহাজোট সরকারের এটা শেষ বাজেট। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে বর্তমান সংসদের শেষ দিন। সে কারণে সরকার যে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করবে, এতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। বিশাল আকারের সরকারের বাজেট আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। ব্যয় হবে ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। ঘাটতি ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এ ঘাটতি সরকার মেটাবে কীভাবে? অবশ্যই সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। বলা হয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর অর্থ দাঁড়ালো সরকার ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে দেশে শিল্পায়ন হবে না। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। এতে একদিকে বাড়বে বেকার সমস্যা, অন্যদিকে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান কীভাবে হবে এর কোনো দিকনির্দেশনা নেই এ বাজেটে। শিক্ষিত কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই শিক্ষিত শ্রেণীকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের কর্মহীন থাকাটা সুবার্তা নয়। সবচেয়ে বড় কথা দেশ ধীরে ধীরে একটি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে সংলাপ এর সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তার ‘মৃত্যু’ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনি এক রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে এই বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে না। যেহেতু এটা নির্বাচনমুখী বাজেট, সেহেতু সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা জনগণকে আকৃষ্ট করবে। এর একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। বিশাল অঙ্ক বরাদ্দ রাখা হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য। নিজ অর্থায়নে সরকার এই সেতুটি করতে যাচ্ছে। এটা একটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সরকার কাজটি করতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এ খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করার ফলে সরকারকে অনেক অগ্রাধিকারভুক্ত খাতে কাটছাঁট করতে হবে। ওইসব খাত থেকে অর্থ এনে পদ্মা সেতুতে ব্যয় করতে হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে সমস্যা আমাদের সংকটে নিপতিত করেছে এর প্রেক্ষাপট সচেতন মানুষ মাত্রই জানা। গত ১১ জুন ২০১৩ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি জোহানেস জুট অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বিষয়ে এক্সটার্নাল এক্সপার্ট প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি তার হাতে তুলে দেন। আমরা জানি না এই প্রতিবেদনে কি আছে। তবে বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাতে আশঙ্কা করছি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বাজেটে। বলা হয়েছে ফ্ল্যাট ও জমিতে এ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এভাবে কালো টাকা সাদা করায় অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব পড়েনি। এতে সুবিধাভোগী কিছু মানুষ উপকৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ থেকে সুবিধা পায়নি। কালো টাকা শিল্পে বিনিয়োগ হয়নি। নতুন কোনো শিল্প হয়নি। ফলে সৃষ্টি হয়নি কর্মসংস্থান। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শতকরা ১১ দশমিক ৩ ভাগ। টাকার হিসাবে ২৫ হাজার ১১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এখানে রয়েছে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি। মোট ৪টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে এ বাজেট। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে এটা খুব বরাদ্দ নয়। এখানে রয়েছে মজার কাহিনী। বলা হয়েছে, বাজেট বরাদ্দ দিয়ে ১ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩২৫টি মাদ্রাসা ও ৬০০ কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। সেই সঙ্গে ২০ হাজার ৫শ’ প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া দেয়া হবে। অতীতেও আমরা দেখেছি অনেক স্কুলে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে। অথচ সারাবছর ওই কম্পিউটার হেডমাস্টার মহাশয়ের রুমে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়েছে। কেননা স্কুলগুলোতে কম্পিউটার প্রশিক্ষক নেই।
ফলে কোথাও বাক্সবন্দি, কোথাও ‘শোপিস’ হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব দেয়ার ফল কী হলো? ছাত্ররা এ থেকে আদৌ উপকৃত হয়নি। এসব ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে হলে যা দরকার ছিল তাহলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনবল নিয়োগ দেয়া। কিন্তু তা না করে কাল্পনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর ফল শূন্য হয়েছে। এবার ছিল ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে এ ল্যাপটপ চালাবে কে? মাল্টিমিডিয়া কোথায় চালানো হবে? যেখানে প্রশিক্ষক নেই, জীর্ণশীর্ণ ভবন, বিদ্যুৎ নেই, সেখানে মাল্টিমিডিয়া কার কাজে আসবে? নাকি কোনো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা দেয়ার জন্যই কোটি কোটি টাকার এই বাণিজ্য? এসব ব্যক্তি চাহিদামাফিক ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ এবং নিজেদের আখের গোছানোর পথটা প্রশস্ত করবেন? সরকার কি এভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়? সরকারের উচিত ছিল স্কুল পর্যায়ে প্রতিটি স্কুলে একাধিক কম্পিউটার প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয়া। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সচিব আছেন। তিনি চান গ্রামগঞ্জে মানুষদের ‘ছাগল না দিয়ে ল্যাপটপ দেয়া হোক।’ শুনতে কথাটা ভালোই শোনায়। কিন্তু সচিব সাহেব তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ‘তত্ত্ব’ দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রদের গ্রামগঞ্জে ল্যাপটপ চালানো শেখাবে কে? সে রকম জনবল কি নিয়োগ দেয়া হয়েছে? ইতোমধ্যে এসব কিছুর নামে নানা অপচয় হয়েছে। এই অপচয়ের অর্থ বাস্তবসম্মত খাতে ব্যয় করা যেত এবং সুফলভোগী হতে পারত শিক্ষার্থীরা। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এমন ভাবনা অসঙ্গত নয় কিন্তু এসব বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার তা না করে সুফল লাভের আশা করা দুরাশা মাত্র।
বাজেট ব্যয় বরাদ্দের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে সুদ। এখানে ব্যয় হবে ১২ দশমিক ৫ ভাগ অর্থ। বোঝাই যাচ্ছে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়বে। ফলে তাকে বেশি সুদ দিতে হবে। যেখানে জনপ্রশাসনে বরাদ্দ ১০ দশমিক ৬ ভাগ অর্থ সেখানে কৃষিতে মাত্র ৩ দশমিক ৬ ভাগ। এর অর্থ কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৫ দশমিক ১ ভাগ অর্থ। এই বিপুল অর্থ ব্যয় হবে বেসরকারি খাত থেকে কেনা বিদ্যুতের পেছনে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে। অথচ নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা ঠিক, বর্তমান সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দিয়েছে। কিন্তু কারা এতে উপকৃত হয়েছে। কাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। অথচ এর মাশুল দিয়েছে সাধারণ মানুষ। বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আগামীতে ‘চাপ’ কমানোর জন্য জ্বালানি তেল ও বিদ্যতের দাম বাড়ানো হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ খাতে সরকার ইতোমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। রানা প্লাজার ১ হাজার ১২৩ জন মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের শ্রমমান নিয়ে কথা উঠেছে। সরকারের উচিত ছিল এ খাতের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা। সরকার সেটা করেনি। অর্থমন্ত্রী এ খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ৭ দশমিক ২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। এটা যে সম্ভব হবে না, এটা অনেক অর্থনীতিবিদই এখন বলছেন। এমনকি মূল্যস্ফীতি ৭ ভাগের মধ্যে রাখার বিষয়টিও হবে কঠিন। বিশ্বব্যাপী এখনো অর্থনীতি এক ধরনের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থবিরতা আছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে শ্লথগতি আছে। অথচ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কীভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই এ বাজেটে। বাজেটের বড় দুর্বলতার দিক হচ্ছে-হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ সরকারি সোনালী ব্যাংক থেকে যে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল, সেই অর্থোদ্ধারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নেই ডেসটিনি কর্তৃক পাচারকৃত অর্থোদ্ধারের বিষয়টিও। আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে এর নেতিবাচক প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের যা কিছু করণীয় ছিল সে পথে সরকার যায়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছাকাছি আছে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে ঋণ বিতরণ সফল হয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি। এগুলো সরকারের প্লাস পয়েন্ট। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রয়েছে। চাল আমদানি করতে হয়নি। এটা প্রমাণ হয়েছে আমাদের কৃষকরা প্রায় ১৬ কোটি লোকের যে খাদ্য দরকার তার উৎপাদন করতে সক্ষম। চালের দাম বাড়লেও এখনো তা মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে প্রশংসা করা যায় না। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমস্যা আন্তর্জাতিক আসরে আমাদের ভার্বমূর্তি নষ্ট করেছে। এর প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন বেশ কটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে-এরও কোনো দরকার ছিল না। পিপিপি বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
সরকার বলেছিল প্রতিটি ঘরে একজনকে কাজ দেয়া হবে। সরকার সেটাও পারেনি। বাজেটের পর পরই বাজারে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এখন অবধি বড় কোনো প্রভাব আমরা দেখিনি। বাজেটে এমন কোনো কোনো পণ্যের (রিফ্রেজেটার, মেমোরি কার্ড, সিমকার্ড, ভারতীয় বিস্কুট, ক্যামেরা) শুল্ক কমানো হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ এসব পণ্যের দাম কমবে কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কোনো কোনো পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে (শিশুখাদ্য, গুঁড়ো দুুধ, মোবাইল ইত্যাদি)। তার যুক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর ফলে সংবাদপত্র শিল্পে কালোছায়া পড়বে। দেশের জনমতের বাহক হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্রের জন্য বাড়তি শুল্ক আরোপ গোটা শিল্পের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে নানা মহল থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে শুধু সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরাই নন, সচেতন অনেকেই এই প্রস্তাবের পক্ষে নন। এটিই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। সবার প্রতিক্রিয়া আমলে নিয়ে এই প্রস্তাবটি সংশোধন করা হবে এ প্রত্যাশা সচেতন সবার।
সরকারের শেষ সময় এসে অর্থমন্ত্রী একটি রাজনৈতিক বাজেট দিলেন। এই বাজেট বিশাল অঙ্কের। বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব সব মিলিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার বিষয়টি একটা প্রশ্নের মধ্যেই থেকে যাবে। সব মিলিয়ে এ বাজেট যেসব প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে সেসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই আসুক না কেন, অর্থমন্ত্রী কিংবা সরকারের তরফে। আমাদের বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেট অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির বাজেট শুধুই এবং সামনে লক্ষ্য হিসেবে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ফলে কোথাও বাক্সবন্দি, কোথাও ‘শোপিস’ হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব দেয়ার ফল কী হলো? ছাত্ররা এ থেকে আদৌ উপকৃত হয়নি। এসব ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে হলে যা দরকার ছিল তাহলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনবল নিয়োগ দেয়া। কিন্তু তা না করে কাল্পনিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর ফল শূন্য হয়েছে। এবার ছিল ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে এ ল্যাপটপ চালাবে কে? মাল্টিমিডিয়া কোথায় চালানো হবে? যেখানে প্রশিক্ষক নেই, জীর্ণশীর্ণ ভবন, বিদ্যুৎ নেই, সেখানে মাল্টিমিডিয়া কার কাজে আসবে? নাকি কোনো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা দেয়ার জন্যই কোটি কোটি টাকার এই বাণিজ্য? এসব ব্যক্তি চাহিদামাফিক ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ এবং নিজেদের আখের গোছানোর পথটা প্রশস্ত করবেন? সরকার কি এভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চায়? সরকারের উচিত ছিল স্কুল পর্যায়ে প্রতিটি স্কুলে একাধিক কম্পিউটার প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয়া। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সচিব আছেন। তিনি চান গ্রামগঞ্জে মানুষদের ‘ছাগল না দিয়ে ল্যাপটপ দেয়া হোক।’ শুনতে কথাটা ভালোই শোনায়। কিন্তু সচিব সাহেব তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ‘তত্ত্ব’ দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রদের গ্রামগঞ্জে ল্যাপটপ চালানো শেখাবে কে? সে রকম জনবল কি নিয়োগ দেয়া হয়েছে? ইতোমধ্যে এসব কিছুর নামে নানা অপচয় হয়েছে। এই অপচয়ের অর্থ বাস্তবসম্মত খাতে ব্যয় করা যেত এবং সুফলভোগী হতে পারত শিক্ষার্থীরা। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এমন ভাবনা অসঙ্গত নয় কিন্তু এসব বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার তা না করে সুফল লাভের আশা করা দুরাশা মাত্র।
বাজেট ব্যয় বরাদ্দের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে সুদ। এখানে ব্যয় হবে ১২ দশমিক ৫ ভাগ অর্থ। বোঝাই যাচ্ছে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়বে। ফলে তাকে বেশি সুদ দিতে হবে। যেখানে জনপ্রশাসনে বরাদ্দ ১০ দশমিক ৬ ভাগ অর্থ সেখানে কৃষিতে মাত্র ৩ দশমিক ৬ ভাগ। এর অর্থ কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৫ দশমিক ১ ভাগ অর্থ। এই বিপুল অর্থ ব্যয় হবে বেসরকারি খাত থেকে কেনা বিদ্যুতের পেছনে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে। অথচ নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। এটা ঠিক, বর্তমান সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দিয়েছে। কিন্তু কারা এতে উপকৃত হয়েছে। কাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। অথচ এর মাশুল দিয়েছে সাধারণ মানুষ। বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আগামীতে ‘চাপ’ কমানোর জন্য জ্বালানি তেল ও বিদ্যতের দাম বাড়ানো হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ খাতে সরকার ইতোমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। রানা প্লাজার ১ হাজার ১২৩ জন মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের শ্রমমান নিয়ে কথা উঠেছে। সরকারের উচিত ছিল এ খাতের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা। সরকার সেটা করেনি। অর্থমন্ত্রী এ খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ৭ দশমিক ২ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। এটা যে সম্ভব হবে না, এটা অনেক অর্থনীতিবিদই এখন বলছেন। এমনকি মূল্যস্ফীতি ৭ ভাগের মধ্যে রাখার বিষয়টিও হবে কঠিন। বিশ্বব্যাপী এখনো অর্থনীতি এক ধরনের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্থবিরতা আছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে শ্লথগতি আছে। অথচ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কীভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই এ বাজেটে। বাজেটের বড় দুর্বলতার দিক হচ্ছে-হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ সরকারি সোনালী ব্যাংক থেকে যে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল, সেই অর্থোদ্ধারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নেই ডেসটিনি কর্তৃক পাচারকৃত অর্থোদ্ধারের বিষয়টিও। আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে এর নেতিবাচক প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের যা কিছু করণীয় ছিল সে পথে সরকার যায়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছাকাছি আছে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে ঋণ বিতরণ সফল হয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ সবচেয়ে বেশি। এগুলো সরকারের প্লাস পয়েন্ট। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রয়েছে। চাল আমদানি করতে হয়নি। এটা প্রমাণ হয়েছে আমাদের কৃষকরা প্রায় ১৬ কোটি লোকের যে খাদ্য দরকার তার উৎপাদন করতে সক্ষম। চালের দাম বাড়লেও এখনো তা মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে প্রশংসা করা যায় না। গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সমস্যা আন্তর্জাতিক আসরে আমাদের ভার্বমূর্তি নষ্ট করেছে। এর প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন বেশ কটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে-এরও কোনো দরকার ছিল না। পিপিপি বাস্তবায়নে বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
সরকার বলেছিল প্রতিটি ঘরে একজনকে কাজ দেয়া হবে। সরকার সেটাও পারেনি। বাজেটের পর পরই বাজারে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এখন অবধি বড় কোনো প্রভাব আমরা দেখিনি। বাজেটে এমন কোনো কোনো পণ্যের (রিফ্রেজেটার, মেমোরি কার্ড, সিমকার্ড, ভারতীয় বিস্কুট, ক্যামেরা) শুল্ক কমানো হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ এসব পণ্যের দাম কমবে কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কোনো কোনো পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে (শিশুখাদ্য, গুঁড়ো দুুধ, মোবাইল ইত্যাদি)। তার যুক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর ফলে সংবাদপত্র শিল্পে কালোছায়া পড়বে। দেশের জনমতের বাহক হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্রের জন্য বাড়তি শুল্ক আরোপ গোটা শিল্পের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে নানা মহল থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে শুধু সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরাই নন, সচেতন অনেকেই এই প্রস্তাবের পক্ষে নন। এটিই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। সবার প্রতিক্রিয়া আমলে নিয়ে এই প্রস্তাবটি সংশোধন করা হবে এ প্রত্যাশা সচেতন সবার।
সরকারের শেষ সময় এসে অর্থমন্ত্রী একটি রাজনৈতিক বাজেট দিলেন। এই বাজেট বিশাল অঙ্কের। বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব সব মিলিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার বিষয়টি একটা প্রশ্নের মধ্যেই থেকে যাবে। সব মিলিয়ে এ বাজেট যেসব প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে সেসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই আসুক না কেন, অর্থমন্ত্রী কিংবা সরকারের তরফে। আমাদের বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেট অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির বাজেট শুধুই এবং সামনে লক্ষ্য হিসেবে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
0 comments:
Post a Comment