রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও ব্যয়ের গুণগত মান নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন

বেশ ক’বছর ধরেই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়ে চলেছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এখন বোধ হয় সময় এসেছে ভেবে দেখার। বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ায় নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাতে মানসম্মত শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। উপরন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনি আদৌ কতটুকু ভাবেন, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন করেননি। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০১-০২ অর্থবছরে যেখানে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৭৩৮ কোটি ৯৭ লাখ, তা ২০১০-১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ লাখ ৩০ হাজার ১২ কোটি ১৩ লাখ টাকার মধ্যে পেয়েছে ১৩ হাজার ৩৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৬ হাজার ১১৩ কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৯ হাজার ১০৮ কোটি ও ২২ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। উক্ত সময়ে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৪১৪ কোটি ও ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। ২০০১-০২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ৪৭৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ থাকে, তার একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। আলোচনার সুবিধার্থে ২০০১-০২ ও ২০১০-১১ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করছি। ২০০১-০২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩ কোটি ৫৭ লাখ আর ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। জাতীয় বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে (২০০১-০২)। এ পরিসংখ্যান বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৪  শতাংশ ২০১০-১১ অর্থবছরে। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে— এ বরাদ্দ মাত্র ৭ দশমিক ৮৫ (২০০১-০২) থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ (২০১০-১১) হয়েছে। অর্থাত্ পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও। যদিও তুলনামূলক বিচারে উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম।
তার পরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে— কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, তা হচ্ছে— বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, উপাচার্য মহোদয়রা সেটি শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কযেকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। জাহাঙ্গীরনগর এরই মধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ অর্থবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬৫ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে শিক্ষকদের বেতন দিতে। বিমক যে বরাদ্দ দেয় তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্য কিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না। ঢাকার পাশাপাশি দ্বিতীয় বরাদ্দ পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওই সময় বেতন খাতে ব্যয় করেছে ১০০ কোটি ৫০ লাখ টাকা (বিমক বরাদ্দ ১৩৯ কোটি), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ কোটি ৫০ লাখ (বিমক বরাদ্দ ১১৩ কোটি ৭৫ লাখ), বুয়েট ৪৭ কোটি ৮০ লাখ (বিমক বরাদ্দ ৭১ কোটি ৯০ লাখ), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫২ কোটি টাকা (বিমক বরাদ্দ ৭৮ কোটি ৬০ লাখ)। চলতি বছরে এ ‘চাপ’ আরো বাড়বে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের কারণে। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ কিংবা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে ৩৬টি) প্রতিষ্ঠা শিক্ষার মানোন্নয়নকে নির্দেশ করে না। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত্ এখন অন্ধকার। এক বিষয়ের ছাত্রকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন বিভাগ খুলে সেসব বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানে দেখভাল করার কেউ নেই।
একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য নীতিনির্ধারকরা কতগুলো বিকল্প ভেবে দেখতে পারেন। ১. পিপিপির মাধ্যমে অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিনিয়োগে উত্সাহিত করা যেতে পারে। যেমন— ব্যবসায় প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যা, ফার্মেসি বিভাগগুলোয় বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব স্থাপন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন এখন একটি সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন। ২. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। ৩. গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারেন বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। ৪. গার্মেন্টের পর আমাদের একটা সম্ভাবনায় খাত হচ্ছে ওষুধশিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোট কথা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে— এ মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে একুশ শতকে আমাদের যে দক্ষ জনশক্তি দরকার, সেটি আমরা তৈরি করতে পারব না।
Bonik Barta
17.06.2013

0 comments:

Post a Comment