রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জাতীয় স্বার্থ ও মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি দেশ জাতীয় স্বার্থ সামনে রেখেই তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এরই মধ্যে সরকার চার বছর পাঁচ মাস অতিক্রম করেছে। মহাজোট সরকারের শেষ সময় এসে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এ সরকার তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছে। এ নিয়ে বিতর্ক আছে এবং কোনো কোনো ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক আসরে সরকার বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এক. অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা, যা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে নতুন একটি মাত্রা এনেছে। দুই. রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ, যা কিনা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়গুলোর কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় সে দেশের সঙ্গে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয়-সংক্রান্ত দুটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ অস্ত্র ক্রয় আমাদের যেমন একদিকে সনাতন অস্ত্র সরবরাহকারীর (চীন) কাছ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে আসবে, অন্যদিকে রাশিয়ার ওপর আমাদের সামরিক তথা রাজনৈতিক নির্ভরতা বাড়াবে।
মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল, ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা ভারতের। কিন্তু এরই মধ্যে এ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে— এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ‘সাত বোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতা গোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা-সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটা ভারী, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। এ ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তি হলেও তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এ সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তিও এখানে কম। যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ও জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রতিশ্রুতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিআইসিএফ’ (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তি করতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে, এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি ঝড়ভঃ চড়বিৎ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। যেকোনো বিবেচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটাই স্বীকার করে গিয়েছিলেন। যারা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের এ অর্জনকে ধরে রাখা। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায়, এই সম্ভাবনা এখন আরো বাড়ল। তবে যেতে হবে অনেক দূর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এরই মধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজায় ১ হাজার ১২৭ জন পোশাককর্মীর মৃত্যু, গার্মেন্টশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, গার্মেন্টশিল্পে শ্রমমান বজায় রাখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. ইউনূস ইস্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি দুটো সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা বাদ দিতে ওবামা প্রশাসনের ওপর শ্রম অধিকার রক্ষায় জড়িত মার্কিন সংগঠনগুলোর চাপ বাড়ছে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কেউ কেউ গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমমান ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টের সব আইটেমে জিএসপি সুবিধা পায় না। কিছু কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা পায়। এসব পণ্যের সবগুলো আবার বাংলাদেশ রফতানিও করে না। বাংলাদেশ অনেক দিন থেকেই গার্মেন্ট সেক্টরে এ জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। চলতি জুনেই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। এখন পুরো জিএসপি সুবিধা ঝুলে গেল। দ্বিতীয় আরো একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়টি। এ-সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে গত ৩১ মে। ন্যাটোর ওয়েবসাইটেও বিষয়টি আছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ১৫ মে ব্র্যাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতর পরিদর্শন করেছেন এবং ন্যাটোর এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন বাংলাদেশের কোনো পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি এবং বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করা হয়নি। তবে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মোটামুটি ধারণা রাখেন। ন্যাটোর লিসবন শীর্ষ সম্মেলনে ২০১০ সালে এ ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল।
এ ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি সম্প্রসারিত এ কর্মসূচিতে নিজেকে জড়িত করে, তা যে অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে, তা বলা যায়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশকয়টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোয় দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়বে। সঙ্গত কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা প্রশ্নের মধ্যে থেকে যাবে। তবে এখানে একটা কথা বলা বাঞ্ছনীয়। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মের (১৯৯৬-২০০১) পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বর্তমান টার্মের পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রথম টার্মে তিনি যতটা না ‘স্পষ্ট’ ছিলেন, এবার তিনি অনেক বেশি ‘স্পষ্ট’। তবে তার প্রথম টার্মেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। প্রথম টার্মে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্র ঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এই সময় বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (১২৪ মিলিয়ন ডলার), যা পরে নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। তার দ্বিতীয় টার্মেও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেন। আসলে জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি। মহাজোট সরকারের আমলে এ স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
 Bonik Barta 
09.06.2013

0 comments:

Post a Comment