চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে বিএনপি তথা ১৮ দল এখন কী করবে? চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা ১৮ দল কি শেষ পর্যন্ত অংশ নিতে যাচ্ছে? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও তাদের একটা বড় ডায়লামার মাঝে ফেলে দিয়েছে। প্রথমত, এই বিজয় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের উৎসাহিত করবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে। তাদের এই ‘চাপ’ উপেক্ষা করা কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে ১৮ দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে জাতির কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে থাকবে। কেননা বিএনপি তথা ১৮ দল বারবার বলে আসছে তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তৃতীয়ত, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে বিএনপি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে থাকবে। একটি মহল এটা চাইতে পারে। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা হয়তো এই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের পেছনে একটি ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করতে পারেন! নির্বাচনে বিরোধী দলের শক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মহাজোট সরকারের নিজেদের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার না করে, কিংবা অন্যতম ‘মিত্র’ জাতীয় পার্টিকে আলাদাভাবে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার একটা ‘ক্ষেত্র’ তৈরি হয়েছিল ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর প্রবক্তারা এই যুক্তি তখন দেখাতে পারেন। অনেকে বলতে চাইবেন নির্বাচনের পর পরই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এর প্রবক্তাদের উৎসাহিত করতে পারে। মনে রাখতে হবে সিটি নির্বাচনটা হলো এমন একটা সময় যখন জাতীয় নির্বাচনের আর বাকি আছে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাস। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে একটি বড় বাধা এখনো দূর হয়নি অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি একটি নিরপেক্ষ সরকার এ প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের ‘রায়ে’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সমর্থন মিলেছে। নির্বাচিত মেয়ররাও সে কথা বলেছেন। ফলে এ প্রশ্নে একটা জটিলতা থেকেই গেল।
এমতাবস্থায় নিশ্চিত করেই বলতে পারি সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে, দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হচ্ছে এটা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের ‘পারফরমেন্স’-এ খুশি ছিলেন না। জলাবদ্ধতা দূরকরণে তার ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমূহূর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর আবিষ্কারের ঘটনা নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনাতে। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তার শুভাকাক্সক্ষীদের কেউ কেউ এমন সব কাণ্ড করেছেন, যা তাকে বির্তকিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর পরীক্ষায় (ইসলাম ধর্ম শিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত উমর (রা.)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা ভালো চোখে নেননি। তার ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল, চূড়ান্ত বিচারে দুটি বড় দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগে করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচন বিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী জাইকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তার ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত করতে পারেননি। এক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল, তারা ততটুকু কঠোর হতে পারেনি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফলাফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তার তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পরদিন অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে অবিশ্যি শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি ‘ছোট্ট’ ঘটনা শংকা তৈরী করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচকে সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসন সাজাচ্ছে। এই জুন মাসেই বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বাইরে কাজ করতে পারবে এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্রশাসনের কাছে নির্বাচন কমিশন যে কত দুর্বল তা একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীদের যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না, যাতে ভোটাররা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। কিন্তু রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের পরেও এ কাজটি করতে পারতেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইসির যে কর্তৃত্ব তা কাগজ-কলমে থাকবে, ইসি তা প্রয়োগ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দলের সভানেত্রী। তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা আরো বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হবেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন, কিংবা রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখন আর এ প্রশ্নগুলো উঠবে না। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এখন পর্যন্ত অকল্পনীয় একটি বিষয়। অবশ্যই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুুল কাদের বলেছেন, ‘ওয়েফ আপ কল ফর দি রুলিং পার্টি’ আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, একটি ‘অশনি সংকেত’-এর কথা। তারা মিথ্যা বলেননি। দু’জনই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা শোনেন ও জানেন কেন মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতারা এর মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না’ (যায়যায়দিন ১৭ জুন) তখন আমরা এক ধরনের হতাশার মাঝে পরে যাই। আমি জানি না কোন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে না’। নিশ্চয়ই নির্বাচন হবে। আর সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার আর ‘এক-এগারো’র জন্ম হবে না। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যাচাই করা ঠিক নয়। আমরা ১৯৯৬ সালে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পেয়েছিলাম, যারা সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এর আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানেও বিতর্ক ছিল কম। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা ঠিক নয়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সরকার নিরপেক্ষ থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং এর কৃতিত্ব নিতেই পারে। কিন্তু সরকারের কৃতিত্ব আরো বাড়বে, যদি সরকার একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত কোনো সদস্যকে দিয়ে, যিনি নিরপেক্ষ থাকবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তাকে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে সংসদের শেষ দিন। এর অর্থ কী? তিনি কি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাবেন? ২৫ অক্টোবরের পরেও কি সংসদ সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন? এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ফলে নানারকম গুজব ও ডালপালা গজাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি উজ্জীবিত, এতে সন্দেহ করার কিছু নেই। কিন্তু ওই নির্বাচন বিএনপিকে এক জটিল সমীকরণের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।
সরকারের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এর মৃত্যু ঘটেছে। যত দিন যাবে ততই সংকটের মাত্রা আরো বাড়বে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলেও মনে হয় না। সম্ভবত বিএনপি এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের বিজয়কে সামনে রেখে ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ ইস্যুকে প্রাধান্য দেবে। বেগম জিয়া অচিরেই বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসংযোগ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজয়ের পক্ষে তিনি চারটি বিভাগীয় শহরে যাবেন। নিঃসন্দেহে সরকার এখন ‘ব্যাকফুটে’। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে সরকার তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করেছে, এজন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে এই স্পিরিটকে সামনে রেখে সরকার যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করে, আমার বিশ্বাস সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তাতে আরো বাড়বে। অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিবেচনায় রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবেই আবার জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াবেন। প্রয়োজন নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কিন্তু প্রয়োজন আছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
এমতাবস্থায় নিশ্চিত করেই বলতে পারি সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে, দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হচ্ছে এটা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের ‘পারফরমেন্স’-এ খুশি ছিলেন না। জলাবদ্ধতা দূরকরণে তার ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমূহূর্তে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর আবিষ্কারের ঘটনা নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনাতে। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তার শুভাকাক্সক্ষীদের কেউ কেউ এমন সব কাণ্ড করেছেন, যা তাকে বির্তকিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর পরীক্ষায় (ইসলাম ধর্ম শিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত উমর (রা.)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা ভালো চোখে নেননি। তার ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল, চূড়ান্ত বিচারে দুটি বড় দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা তাদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগে করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচন বিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী জাইকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তার ‘নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত করতে পারেননি। এক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল, তারা ততটুকু কঠোর হতে পারেনি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফলাফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তার তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পরদিন অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে অবিশ্যি শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি ‘ছোট্ট’ ঘটনা শংকা তৈরী করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচকে সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসন সাজাচ্ছে। এই জুন মাসেই বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বাইরে কাজ করতে পারবে এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। প্রশাসনের কাছে নির্বাচন কমিশন যে কত দুর্বল তা একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীদের যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রীরা গেছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না, যাতে ভোটাররা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। কিন্তু রাজশাহীতে গ্যাস সরবরাহ চালু হয়েছে নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনের পরেও এ কাজটি করতে পারতেন। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইসির যে কর্তৃত্ব তা কাগজ-কলমে থাকবে, ইসি তা প্রয়োগ করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দলের সভানেত্রী। তিনি যখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা আরো বেশি মাত্রায় উৎসাহিত হবেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন, কিংবা রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখন আর এ প্রশ্নগুলো উঠবে না। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। সেনাবাহিনী ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এখন পর্যন্ত অকল্পনীয় একটি বিষয়। অবশ্যই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুুল কাদের বলেছেন, ‘ওয়েফ আপ কল ফর দি রুলিং পার্টি’ আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, একটি ‘অশনি সংকেত’-এর কথা। তারা মিথ্যা বলেননি। দু’জনই যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তারা শোনেন ও জানেন কেন মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতারা এর মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না’ (যায়যায়দিন ১৭ জুন) তখন আমরা এক ধরনের হতাশার মাঝে পরে যাই। আমি জানি না কোন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন হবে না’। নিশ্চয়ই নির্বাচন হবে। আর সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার আর ‘এক-এগারো’র জন্ম হবে না। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যাচাই করা ঠিক নয়। আমরা ১৯৯৬ সালে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পেয়েছিলাম, যারা সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। এর আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেখানেও বিতর্ক ছিল কম। শুধু ‘এক-এগারো’র ঘটনা দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করা ঠিক নয়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সরকার নিরপেক্ষ থেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং এর কৃতিত্ব নিতেই পারে। কিন্তু সরকারের কৃতিত্ব আরো বাড়বে, যদি সরকার একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত কোনো সদস্যকে দিয়ে, যিনি নিরপেক্ষ থাকবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না, তাকে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, ২৫ অক্টোবর হচ্ছে সংসদের শেষ দিন। এর অর্থ কী? তিনি কি সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাবেন? ২৫ অক্টোবরের পরেও কি সংসদ সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন? এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ফলে নানারকম গুজব ও ডালপালা গজাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি উজ্জীবিত, এতে সন্দেহ করার কিছু নেই। কিন্তু ওই নির্বাচন বিএনপিকে এক জটিল সমীকরণের দিকেও ঠেলে দিয়েছে।
সরকারের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এর মৃত্যু ঘটেছে। যত দিন যাবে ততই সংকটের মাত্রা আরো বাড়বে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলেও মনে হয় না। সম্ভবত বিএনপি এখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের বিজয়কে সামনে রেখে ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ ইস্যুকে প্রাধান্য দেবে। বেগম জিয়া অচিরেই বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসংযোগ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজয়ের পক্ষে তিনি চারটি বিভাগীয় শহরে যাবেন। নিঃসন্দেহে সরকার এখন ‘ব্যাকফুটে’। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে সরকার তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করেছে, এজন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে এই স্পিরিটকে সামনে রেখে সরকার যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করে, আমার বিশ্বাস সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তাতে আরো বাড়বে। অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিবেচনায় রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবেই আবার জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াবেন। প্রয়োজন নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কিন্তু প্রয়োজন আছে একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের। চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
0 comments:
Post a Comment