রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিষয়টি উদ্বেগের


বিষয়টি উদ্বেগের এবং তা অগ্রহণযোগ্য। টিআইবি ২ জুন 'পার্লামেন্ট ওয়াচ' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এক সুপারিশে সংসদ বর্জন রোধে আইন করার সুপারিশ করেছে। তারা মোট ২২ দফা সুপারিশ করেছে। তাদের সুপারিশ তথা টিআইবির ভূমিকা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, টিআইবি কি এখন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে? তাদের আদৌ কি এখতিয়ার রয়েছে রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলার? তারা কি তাদের মূল কাজ বাদ দিয়ে অন্য 'কাজে' নিজেদের সম্পৃক্ত করছে না? মূল বিষয়টি হচ্ছে রাজনীতি। এই রাজনীতিতে বিদেশি আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত সংস্থার 'হস্তক্ষেপ' নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। আরো লক্ষ রাখার বিষয়, টিআইবি এ ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার এমন একটা সময় বেছে নিল, যখন বিরোধী দল সংসদে যোগ দিয়েছে। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বারবার বলছেন, তথাকথিত 'তৃতীয় শক্তি'কে আর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে না, ঠিক তখনই টিআইবি এ ধরনের একটি তথাকথিত গবেষণা নিয়ে এলো!
আমরা অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছি, টিআইবি মাঝেমধ্যে এ ধরনের তথাকথিত 'গবেষণা' উপস্থাপন করে সমাজে একটি বিশেষ 'মেসেজ' পেঁৗছে দিতে চাচ্ছে। তাদের প্রতিটি গবেষণায় মারাত্মক মেথোডলজিক্যাল ত্রুটি রয়েছে। আগেও আমরা এ ব্যাপারে টিআইবিকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু টিআইবি এ ব্যাপারে আদৌ দৃষ্টি দিয়েছে বলে মনে হয় না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, টিআইবি যাঁদের নিয়ে এ ধরনের সিরিয়াস গবেষণাকর্ম পরিচালনা করে, তাঁদের অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। কোনো সিরিয়াস গবেষক, অধ্যাপক, পরিসংখ্যানবিদের পরামর্শ তারা নিয়েছে, এ রকম 'তথ্য' আমাদের জানা নেই। আরো দেখা যাবে, কিছু 'পরিচিত মুখ'কে তারা সব সময়ই আমন্ত্রণ জানায়। এসব 'পরিচিত মুখ' আবার সব বিষয়ে 'বিশেষজ্ঞ'! বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি আর এখন সংসদীয় গণতন্ত্র। তাঁরা অর্থনীতি নিয়ে যেমন মন্তব্য করেন, ঠিক তেমনি মন্তব্য করেন সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়েও! তাঁরা সর্ববিশেষজ্ঞ! সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যদি তাঁরা 'এ কাজ' করেন, আমি তাকে সমর্থন জানাব। এই সমাজে আরো নানা বিষয় রয়েছে, যেখানে অনিয়ম হচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে। কই, টিআইবি কি এসব নিয়ে কাজ করছে? গত সপ্তাহে একটি জনপ্রিয় দৈনিক দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের খবর ছেপেছে। এটা বড় ধরনের দুর্নীতি, সরকারি টাকা লুটপাটের শামিল। টিআইবি নীরব কেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম এখন চরম পর্যায়ে। ইউজিসি এখানে ব্যর্থ। যদি সচেতনতা সৃষ্টি টিআইবির মূল কাজ হয়ে থাকে, তাহলে টিআইবি এ ব্যাপারে কথা বলছে না কেন? তাই সংগত কারণেই যে প্রশ্নটি বিভিন্ন মহলে উঠবে, তা হচ্ছে টিআইবি তথাকথিত এ ধরনের গবেষণার নামে 'নিজেদের মতবাদ' জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে! তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়।
সংসদ বর্জন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অতীতে আওয়ামী লীগও সংসদ বয়কট করেছে। এখন বিএনপি করছে। সংসদ বর্জন আমরা কেউ চাই না। কিন্তু এর জন্য আইন করতে হবে? সব কাজ কী আইন দিয়ে করা সম্ভব? এখানে প্রয়োজন মানসিকতা পরিবর্তনের। পরস্পরের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা যদি স্থাপন করা না যায়, তাহলে আইন করেও 'সংসদ বর্জন' বন্ধ করা যাবে না। টিআইবি এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করত। টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে কিছু পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছে। এটা ঠিক আছে। এ ক্ষেত্রে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি, তা হচ্ছে টিআইবি একজন এমপির অনুপস্থিতির 'অর্থমূল্য' নির্ধারণ করল কিভাবে? তাদের হিসাব অনুযায়ী এর 'অর্থমূল্য' নূ্যনতম তিন হাজার ৫৫৮ টাকা! তারা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে, বিরোধী জোটের সংসদ বর্জনের অর্থমূল্য প্রায় চার কোটি এক লাখ ৩৪ হাজার টাকা! তারা যেভাবে হিসাব কষেছে, তা নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন আছে। আমি ইতিমধ্যে দু-একজন পরিসংখ্যানবিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা সবাই টিআইবির এই 'মূল্যায়নের' সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। টিআইবি প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান গবেষণা উপস্থাপনকালে বলেছেন, 'সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ বর্জনের কোনো সুযোগ নেই।' কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। ভারতের মতো দেশেও সংসদ বর্জন হয়েছে, তবে এটা সত্য, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ওয়াকআউটের ব্যাপার তো হরহামেশাই ঘটে। গ্রিসের সংসদেও আমরা বামপন্থীদের সংসদ বয়কটের কথা জানি। টিআইবির প্রতিবেদনে সংসদ কার্যকর করার জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশ নিয়েও প্রশ্ন আছে।
আজ টিআইবি যখন একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে ও কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করে, তখন সুশীল সমাজ কর্তৃক বহুল আলোচিত 'তৃতীয় শক্তির' উত্থানের সঙ্গে তার কোথায় যেন একটা 'মিল' রয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তী সময়ে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই তৃতীয় শক্তি গঠনের উদ্যোগ এখনো আছে। এই তৃতীয় শক্তির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সুশীল সমাজ। যারা বিশ্ব রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখে, তারা জানে উন্নয়নশীল বিশ্বে সুশীল সমাজের উত্থানের পেছনে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আর এর পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যাঁরা 'আরব বসন্ত'-এর প্রেক্ষাপট জানেন, তাঁরা জানেন কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র ওই দেশে (মিসর, ইয়েমেন) সুশীল তথা তরুণ সমাজকে প্রমোট করেছিল। লক্ষ করলে দেখবেন, বাংলাদেশে যাঁরাই সুশীল সমাজের উত্থান নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সবারই এনজিও আছে এবং মাঠ পর্যায়ে তাঁরা এনজিও-কর্মীদের তাঁদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ঢাকায় একবার তথাকথিত সুশীলদের নিয়ে একটা মহাসম্মেলনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রথম সারির কয়েকজন সম্পাদক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মেধা নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। বরং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তাঁরা দেশের উন্নয়নের জন্য অনেক অবদান রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে পারেন। একজন সম্পাদক হিসেবে কিংবা একজন এনজিও কর্ণধার হিসেবে রাজনীতিককে আপনারা নির্দেশ দিতে পারেন না! টিআইবির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা সবাই সুশীল। একজন সাবেক আমলা, একজন সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট কয়েকজন শিক্ষাবিদ, যাঁদের প্রায় সবাইকে একটি 'নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী' বলে ধরে নেওয়া হয়, তাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্র কিভাবে চলবে, তার বয়ান দিতে পারেন না। তাঁদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণ তাঁদের চেনেও না। কোনো দিন নিজ এলাকায় গিয়েছেন, এটাও মনে হয় না। ঢাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে রাজনীতির দিকনির্দেশনা না দেওয়াই মঙ্গল। যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে যেতে হবে গ্রামে। রাজনীতিবিদদের নিয়ে প্রশ্ন হয়তো আছে। তাঁদের সততা, মেধা, শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁরাই কোনো বিপদে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সুশীল বাবুরা কিন্তু যান না।
টিআইবি ১০০ শতাংশ বিদেশি ফান্ডনির্ভর। 'পার্লামেন্ট ওয়াচ' প্রকল্পে তারা দাতা সংস্থার কাছ থেকে কত কোটি টাকা বাজেট পেয়েছে, অনুসন্ধানী কোনো সাংবাদিক তা খুঁজে বের করতে পারেন। রিপোর্টে তথ্য আছে। কিন্তু শুধু কিছু তথ্য দিয়ে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ বা গণভোট দিয়ে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন। এই বিষয়টি যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে সংসদ অধিবেশন বর্জনের প্রবণতা আর থাকবে না। এই বিষয়টি নিয়ে টিআইবি কাজ করুক। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করুক। আইন করে কখনো কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের সমাধান করা যায় না।Daily KALERKONTHO10.06.13

0 comments:

Post a Comment