এটা এখন একটা 'ওয়ান মিলিয়ন ডলার' এর প্রশ্ন- সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে এ ধরনের একটি নির্বাচনে যখন সরকারি দলের সমর্থকরা হেরে যান, তখন হাজারটা প্রশ্ন এসে ভিড় করে। এই নির্বাচনের ফলাফল কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? বিএনপি কি শেষ পর্যন্ত বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো মেনেই নির্বাচনে যাবে? আগামী দিনগুলোয় এ রকম হাজারটা প্রশ্ন রাজনীতির ময়দানে ঘুরপাক খাবে। নিঃসন্দেহে এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন একটি 'লিটম্যাস টেস্ট'। জনসাধারণের পালস বোঝার জন্য তা যথেষ্ট। কিন্তু 'হুট' করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি এই নির্বাচনের ফলাফলকে দেখেছি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রথমত, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বড় ধরনের কোনো অনিয়ম হয়নি। ছোটখাটো দু-একটি ঘটনা, রাজশাহীতে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা, খুলনায় ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা কিংবা রাজশাহীতে ইভিএম মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বড় করে দেখার সুযোগ নেই। শতকরা ৬০ ভাগের ওপর ভোট পড়েছে। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন এক ধরনের কৃতিত্ব নিতেই পারে। সেই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থাশীল। মানুষ মনে করে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব। তৃতীয়ত, বিএনপি সেনা মোতায়েনের দাবি জানালেও শুধু র্যাব ও বিজিবিকে দিয়ে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এখন নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের সময় এই প্রশ্নটি তুলতেই পারে। তারা আরপিওতে সেনা মোতায়েন না করার যে বিধান রেখেছে, এটা সঠিক- এ প্রশ্নটি এখন ইসি তুলতেই পারে। চতুর্থত, এই নির্বাচনী ফলাফলের মধ্য দিয়ে সরকার এটা বলতেই পারে যে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের' আওতায়ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকারের দাবির কোনো প্রয়োজন নেই- এ প্রশ্ন তখন সরকারের নীতি নির্ধারকরা তুলতেই পারেন।
আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সরকারের নীতিনির্ধারকরা তখন হাজারটা যুক্তি দেখাবেন যে দলীয় সরকারের আওতায়ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব! এখানে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হচ্ছে এটা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের তুলনা করা যাবে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাজ করে স্থানীয় ইস্যু। যেমন সিলেটের সাধারণ মানুষ মেয়র কামরানের পারফরম্যান্সে খুশি ছিলেন না। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে তাঁর ব্যর্থতা ছিল চরমে। উপরন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর 'দ্বিতীয় স্ত্রী'র আবিষ্কারের ঘটনা(?) নারী ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে খুলনায়ও। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেক ছিলেন ব্যর্থ। উপরন্তু তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ এমনসব কাণ্ড করেছেন, যা তাঁকে বিতর্কিত করেছে। তিনি মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। খুলনার পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় (ইসলাম ধর্ম শিক্ষা) তালুকদার আবদুল খালেককে হজরত উমর (রা.)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা ভালো চোখে নেননি। তাঁর ব্যক্তিগত আচরণে (রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার ঘটনা) অনেকে অখুশি ছিলেন। এটা সত্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল চূড়ান্ত বিচারে দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন। মন্ত্রীরা নির্বাচনবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন। অর্থমন্ত্রী জাইকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বাদ দিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। তিনি রিকশায় চড়ে এবং সরকারি গাড়ি ব্যবহার না করেও তাঁর 'নিরপেক্ষতা' নিশ্চিত করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে ইসির যতটুকু কঠোর হওয়া উচিত ছিল, তারা ততটুকু কঠোর হতে পারেনি। ইসির ভূমিকা তাই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই গেল। সিলেটে রিটার্নিং অফিসারের ভূমিকা কিছুটা হলেও নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। যখন সিলেটের ১২৮টি কেন্দ্রের ফলাফল রাতের মধ্যেই এসে গিয়েছিল, তখন তিনি বিরোধী ১৮ দলের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করতে ইতস্তত করছিলেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তাঁর তর্কও হয়। রিটার্নিং অফিসার পরদিন, অর্থাৎ রোববার দুপুরে এটা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। পরে শনিবার রাতেই আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই একটি 'ছোট্ট' ঘটনা প্রমাণ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন। এরই মধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার তার প্রশাসনকে সাজাচ্ছে। এই জুন মাসেই বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বেশ কিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর মাঝে যোগ্যতা নেই, মেধাহীন- এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন। ফলে মাঠপর্যায়ে জনপ্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগেছেন। বলেছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তিনি এটা ভাবতেই পারেন। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে একটি 'রাজনৈতিক প্রশ্ন' রয়েছে। আর তা হচ্ছে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় এই নির্বাচন সম্পন্ন করা। মনে রাখতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন আর জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন এক নয়। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জাতীয় কোনো ইস্যু কাজ করেনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ইস্যু কাজ করবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ডেসটিনির দুর্নীতি, সরকারের অদক্ষতা, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের 'প্লাস পয়েন্ট' তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও উচিত হবে না শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। বিএনপি এরই মধ্যে তার অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছে। বিএনপি নেতারা এখন নিরপেক্ষ সরকারের ওপর জোর দিচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন কম। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেভাবে অংশ নিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকলে এই স্বতঃস্ফূর্ততা আর থাকবে না। অংশগ্রহণ কম হবে। তাই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল কাদের যখন সিটি করপোরেশনের ফলাফলের পর মন্তব্য করেন 'ওয়েক আপ কল ফর দ্য রুলিং পার্টি', তখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন- এটিই প্রত্যাশা করি। জনগণের বাইরে গিয়ে কেউ কখনো কোনোদিন টিকে থাকতে পারেনি। দেয়ালের লিখন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আমাদের রাজনীতিবিদরা এ কাজটি করেন না, দুঃখটা এখানেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এখন ভাবতে হবে ভুলটা কোথায়? একজন কামরান কিংবা একজন তালুকদার খালেক হারেননি, হেরেছে তার দল আওয়ামী লীগ। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। কামরান, খালেক কিংবা হিরন উন্নয়ন কাজ কম করেননি। তার পরও যে ভোটাররা ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁদের সবাইকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল, আজ তারা মুখ ফিরিয়ে নিল কেন? যে তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটাররা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, এবার তারা মুখ ফিরিয়ে নিল। তারা চেয়েছে পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তন ব্যক্তির চেয়ে দলের বেশি। মানুষের মাঝে হতাশা বাড়ছে, দুর্নীতি, কোনো কোনো মন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, হেফাজতের সমাবেশে রাতের বেলায় গুলি করে মানুষ মারা ইত্যাদি কোনো একটি ঘটনাও সরকারের জনপ্রিয়তাকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়নি। এখন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন থেকে সরকার যদি কিছু শেখে, সেটা হবে আমাদের জন্য স্বস্তির কারণ। এই নির্বাচন বিএনপির হাতকে যেমন শক্তিশালী করল, ঠিক তেমনি সরকারের জন্যও একটা 'ওয়েক আপ কল'। সরকার এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে যদি কিছু শেখে, সেটা আমাদের বড় ধরনের একটা স্বস্তি দেবে আর শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে।Daily KALERKONTHO17.06.13
0 comments:
Post a Comment