রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইউক্রেন-সংকটের গভীরতা বাড়ছে

ইউক্রেন-সংকটের গভীরতা বাড়ছে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। সেখানে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্বাঞ্চলের বেশ কটি শহর দখল করে নিয়েছিল। ক্রিমিয়ার মতো এ শহরগুলোও রাশিয়ার সঙ্গে একত্রিত হতে চায়। সর্বশেষ ঘটনায় ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে শহরগুলো মুক্ত করার জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। সেনাবাহিনীর গুলিতে অন্তত ৫ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হয়েছেন। এই অভিযানকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও আমেরিকা পরস্পর বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। এর আগে গত ১৭ এপ্রিল জেনেভায় যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা এখন অকার্যকর। রাশিয়া ইতোমধ্যে পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে তাদের হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ‘নিরাপত্তা’র স্বার্থে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোয় ৬০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। স্পষ্টতই ইউক্রেনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। অনেকের দৃষ্টি এখন মলদোভার ট্রান্স দানিয়েস্টার অঞ্চলের দিকে। কেননা এ অঞ্চলে রাশান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। পুতিন এ ক্ষেত্রে কী করবেন? ইউক্রেনে আগামী দিনে বসনিয়ার মতো পরিস্থিতির জন্ম হয় কি না- সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন পুতিন রাশিয়ার সীমান্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানায় নিয়ে যেতে চান। আর এ লক্ষ্যেই রাশিয়া কাজাকিস্তান ও বেলারুশের সমন্বয়ে একটি ‘ইউনিয়ন স্টেট’ গঠন করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের ‘কাস্টম ইউনিয়ন’ গঠন করে এ দুটো দেশের অর্থনীতি তথা বাণিজ্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এ ‘ইউনিয়ন স্টেট’-এ এ অঞ্চলের আরও অনেক রাষ্ট্র আগামীতে যোগ দিতে পারে। সুতরাং রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযুক্তি ও পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ক্রিমিয়ার ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এশিয়া সফর করেছেন। এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনায় ক্রিমিয়ার বিষয়টি যে প্রাধান্য পেয়েছে, সেটা এক রকম নিশ্চিতই ছিল সবার। ইতোমধ্যে জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। সব মিলিয়ে ক্রিমিয়ার ঘটনাবলি স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর সূচনা করলেও যে প্রশ্নের সমাধান এখনও হয়নি, তা হচ্ছে রাশিয়াকে ‘বয়কট’ করে পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাবে কীভাবে? সেনাবাহিনী পাঠিয়ে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বটে, কিন্তু পুরো ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে কীভাবে? কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? পাঠকমাত্রই জানেন, পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে পুরো পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রভাবে ছিল, তারা এখন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তারা পরিপূর্ণভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের রিজার্ভ হচ্ছে রাশিয়ায়। মূলত ৩টি পথে এই গ্যাস যায় ইউরোপে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যারা একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্লকে ছিল, তারাও এখন জ্বালানি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। ৩টি পাইপলাইন, নর্ডস্টিম পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় বছরে ৫৫ বিলিয়ন কিউসিক মিটার (বিসিএম), বেলারুশ লাইনে সরবরাহ করা হয় ৩৬ বিসিএম, আর ইউক্রেন লাইনে সরবরাহ করা হয় ১০৭ বিসিএম। এখন ইইউর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া যদি এই সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক বড় ধরনের জ্বালানি-সংকটে পড়বে ইউরোপ। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস বিক্রি। এটা সত্য, রাশিয়া অত্যন্ত সস্তায় বেলারুশ ও ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই দেশ দুটো আবার রাশিয়ার গ্যাসের রিজার্ভ গড়ে তুলে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপে তা বিক্রি করে কিছু আলাদা অর্থ আয় করে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০৯ সালে ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল ‘গ্যাস ওয়ার’ অর্থাৎ গ্যাসযুদ্ধ। ইউক্রেনে অত্যন্ত সহজ মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করত রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা ইউরোপে একটি সংকট তৈরি করে। শুধু গ্যাস নয়, রাশিয়া বেলারুশকে সস্তা মূল্যে তেলও দেয়। ওই তেল আবার বেলারুশ অধিক মূল্যে ইউরোপে বিক্রি করে। উৎুঁযনধ অথবা ঋৎরবহফংযরঢ় পাইপলাইনের মাধ্যমে ওই গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হত। বেলারুশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়েছিল। তারা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। রাশিয়া পাইপলাইনে গ্যাস ও তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন আঙ্গিকে ওই ‘গ্যাস ওয়ার’ শুরু হবে। ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া এখন রাশিয়ার অংশ হওয়ায় ইউক্রেন এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান পতাকা উঠেছে। সেখানে যে ইউক্রেনের নৌঘাঁটি রয়েছে তা দখল করে নিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ইউক্রেনের সব সম্পত্তি তাদের দখলে। সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া তার ইউক্রেন পাইপলাইন বন্ধ করে দিতে পারে। আর এটা হলে বুলগেরিয়া, রুমানিয়া আর সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এ তিন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা গ্যাসপ্রোম (এধংঢ়ৎড়স)-এর ইউক্রেনের কাছে পাওনা রয়েছে ২ মিলিয়ন ডলার। এ টাকা এখন ইউক্রেন কীভাবে শোধ করবে? এ সংকট এখানে যুদ্ধের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি করছে। পুরো ইইউর গ্যাসের চাহিদার ৩০ ভাগ একা জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির ৪০ ভাগ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওই গ্যাস আগামী দিনে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে ইউরোপের রাজনীতিতে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, বিশেষ করে ইরাক ও লিবিয়ায়, তার পেছনের মূল কারণ ছিল তেল। ইরাক ও লিবিয়ার তেলের সহজলভ্যতার কারণে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর মদদে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধে ইরাককে ধ্বংস করে দিয়ে এখন মার্কিন কোম্পানিগুলোই ওই তেল বিক্রির টাকায় ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে। আর লিবিয়ার তেল ও গ্যাস যায় ইতালিতে। গাদ্দাফিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এ তেল-গ্যাসের কারণেই। সুতরাং রাশিয়ার গ্যাসের ওপর পুরো ইউরোপের নির্ভরতা, সেখানে নতুন করে ‘গ্যাসযুদ্ধ’-এর সূচনা করবে। তবে পার্থক্য একটাই- রাশিয়া ইরাক কিংবা লিবিয়া নয়। পুতিনের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। সুতরাং ওবামা এ অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে কোনও সুবিধা করতে পারবেন না। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো পশ্চিম ইউরোপ যখন সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তখন এক পর্যায়ে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ রাজনীতির এক নয়া দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। ব্রান্ড বুঝতে পেরেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। আজ নতুন আঙ্গিকে এ প্রশ্নটিই উঠেছে- রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা অর্থহীন। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বিবেচনায় নিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে ১৯৯৭ সালে ন্যাটোর একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তিতে ন্যাটোতে রাশিয়াকে পরামর্শকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৭ মে প্যারিসে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন (রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন। সেই সঙ্গে ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্যসব দেশের সরকারপ্রধানরাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়াকে একটি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেয়। অনেকটাই সেই ‘কনটেইনমেন্ট থিউরির’ মতো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ন্যাটো। ক্রিমিয়ার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণসাগর বা ব্লাক সির পশ্চিমে রুমানিয়ার মিথাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে সেনা রসদ সরবরাহের জন্য এ বিমান ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। গত বছর কৃষ্ণসাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই চাইছে জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিক। এটা যদি হয়, তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে মার্কিন সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সমর নায়করা এটা মানবেন না। আজকে ইউক্রেনের পরিস্থিতিও অনেকটা তেমনি। রাশিয়া মনে করে ইউক্রেনে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাতের পেছনে ওয়াশিংটনের হাত রয়েছে। ইয়ানুকোভিচ ছিলেন রুশপন্থী এবং ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আগামী ২৫ মে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সঙ্গত কারণে রাশিয়া চাইবে রুশপন্থী একজন সেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরোধীরা চাইবে তাদের পছন্দের কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক। এ ক্ষেত্রে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ওলেকজান্ডার তুর্চিনভের সম্ভাবনা বেশি। এতে করে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার একটা বিরোধ থেকে গেল। এই বিরোধ এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র এবং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে এ পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এখন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি ‘পরাজিত’ হয় এবং শহরগুলো যদি ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দখল করে নেয়, তাতে করে সাময়িকভাবে হয়তো ইউক্রেনের ‘বিজয়’ হবে। কিন্তু এ অঞ্চল ঘিরে দীর্ঘস্থায়ী একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করবে। Daily Amader Somoy 28.04.14

0 comments:

Post a Comment