রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এশিয়ার ফিলিস্তিন’ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

জনপ্রিয় নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করেছে ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ হিসেবে। গত ৪ ডিসেম্বর ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের জীবন নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাময়িকীটি ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। নিউজ ম্যাগাজিনটি ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা আম্বিয়া পারভীনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ ইকোনমিস্ট বোঝাতে চাচ্ছে যে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের মতো হতে যাচ্ছে! ফিলিস্তিনিরা যেমনি ১৯৪৮ সালে নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী জীবন বেছে নিয়েছিল, ঠিক তেমনি রোহিঙ্গারাও একটি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে! তবে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আর ফিলিস্তিন এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ছিল নিজেদের জীবন। ঐতিহাসিকভাবেই তারা সেখানে বসবাস করত। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই। আজকে যেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ওই এলাকাটি ছিল ঐতিহাসিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ১৮৮০-এর দশকে সেখানে প্রথম ইহুদি বসতি স্থাপিত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলফো ব্রিটিশ জায়ানিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে এটাই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। তাকে কেন্দ্র করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম। এখানে পার্থক্য হলো, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের শতকরা ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কিন্তু ‘ইহুদি’দের মতো অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে সেখানে বসতি স্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। তার পরও মিয়ানমারের বৌদ্ধ নেতৃত্বের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার ‘ভার’ বইতে পারে না। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে তা গত তিন বছরেও সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশের কাছে বিকল্প কিছু ছিল না রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো ছাড়া। কক্সবাজারে তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করত, তা ছিল অমানবিক। ছোট ছোট খুপরি ঘরে তারা থাকতে বাধ্য হতো। সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ছিল। উপরন্তু সেখানে নিত্যদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বড় কথা, বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে একাধিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণকে বিতাড়িত করে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এদের উপস্থিতি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪৩০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। এ থেকে চার হাজার একর পাহাড়ি এলাকা নষ্ট করে সেখানে ক্যাম্প বানানো হয়েছে। টেকনাফ, উখিয়া, হিমচর এলাকায় পুরো বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা যদি আরও কিছুদিন এখানে অবস্থান করে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ এলাকায় কোনো গাছগাছালি থাকবে না। কেননা প্রতি মাসে ৬৮০০ টন কাঠ রোহিঙ্গারা ব্যবহার করে রান্নার কাজে। গাছ কেটে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাছে জ¦ালানির কোনো বিকল্প উৎসও নেই। ইতিমধ্যে এটা প্রমাণিত যে, বিশ^ব্যাপী বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজারে পুরো পাহাড় কেটে ফেলা, বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পরিবেশের যে ক্ষতি করে ফেলেছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিম্নাঞ্চলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে, হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সারা বিশ^ আজ যেখানে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেখানে কক্সবাজার এলাকায় হাজার হাজার বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গারা বড় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ জাতিসংঘ যখন ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে, তখন বাংলাদেশের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি জাতিসংঘ বিবেচনায় নেয়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হচ্ছে। ২৩১২ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরে আরও ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করতে পারে কি না? বিদেশি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সে পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশ পায়নি। ফলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকেই তা বহন করতে হচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এই ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। যে পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হয়, সে অর্থ অন্যত্র উন্নয়নকাজে ব্যয় করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে ব্যয় করা যায়। বন্যা মোকাবিলায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা যায়। কভিড-১৯ পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, হাসপাতালগুলোর আধুনিকীকরণ, ভাইরাস নির্ণয়-সংক্রান্ত গবেষণার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি কাজে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। জাতিসংঘ এক ধরনের আপত্তি করেছে বটে, কিন্তু আজ অবধি মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তির স্বার্থ দেখছে। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন একটা রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠিত ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জীবন একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ২০১৭ সালে যে ‘রোহিঙ্গা ঢল’ এ অঞ্চলের পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, গত ২৫ আগস্ট (২০২০) ছিল তার তৃতীয় বার্ষিকী। অর্থাৎ বর্তমান সংকট তিন বছর পার করে চার বছরে ‘পা’ দিল। কিন্তু বিশ্ব এই তিন বছরে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। এটা ঠিক, রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সে ব্যাপারে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ বা আইসিজে একটি রায় দিয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু ওই রায় সংকট সমাধানে কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। কিন্তু এ ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি নেই। বরং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গেল জুন মাসেও রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর দিয়েছে আলজাজিরা। এক প্রতিবেদনে তারা আমাদের জানিয়েছে, রাখইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০০ রোহিঙ্গা বসতি পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এরা বাধ্য হয়েছে রাখাইন ত্যাগ করতে। আরেকটি খবরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তিনজন সেনা সদস্যকে রাখাইনে ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কোর্ট মার্শাল করে শাস্তি দিয়েছে, যদিও এদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি যখন আরও অবনতি ঘটেছে, তখন গত ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। ওই ফোনালাপে তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রকাশিত এসব ঘটনা কতগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। গেল ডিসেম্বরে (২০১৯) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানানো হয়েছিল (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৮ ডিসেম্বর)। কিন্তু নতুন করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে মিয়ানমার সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। রোহিঙ্গা সংকট একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বারবার বলে আসছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন। সর্বশেষ আসিয়ান নেতাদের টেলি সম্মেলনেও মিয়ানমারের প্রতিনিধি একই কথা বলেছেন। এর অর্থ সারা বিশ্বের মতামতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। মিয়ানমারের কৌশল হচ্ছে রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। রোহিঙ্গা বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের জমি এখন চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। রাখাইনে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে (Kyawkphyu), যেখান থেকে দেশটি বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর নজর রাখতে পারে। এখানে চীনের স্বার্থ অনেক বেশি। সুতরাং চীন কখনোই মিয়ানমারের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেবে না। রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইনে চীন তার স্বার্থকে বড় করে দেখছে। গেল ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। তাতে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ, কোনো সামরিক ব্যবস্থা না নেওয়া, আলামত নষ্ট না করা, আদালতে চার মাস অন্তর রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আদালতের আদেশ মিয়ানমার মানছে না। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের রাখতে পারে না। ভাসানচরে তাদের স্থানান্তর তাই সাময়িক। তাদের নিজ বাসভূমে ফেরত যেতে হবে এটাই বাস্তব। এ ক্ষেত্রে ইকোনমিস্ট রোহিঙ্গাদের ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, রোহিঙ্গাদের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। এরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। এরা নিজ দেশে ফেরত যাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির দায়িত্ব এটাই। বাংলাদেশ মানবতার খাতিরে এদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। স্থায়ীভাবে নয়। Desh Rupantor 24.12.2020

0 comments:

Post a Comment