রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

টিকা-জাতীয়তাবাদ এবং ধনী-গরিব রাষ্ট্রের বৈষম্য

করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এর টিকা নিয়ে আছে সুখবর, আছে মন্দ খবরও। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ফাইজারের তৈরি টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রায় নব্বই বছর বয়সী মহিলা মার্গারেট প্রথম টিকাটি গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এটিই বিশ্বের প্রথম MRNA Vaccine, যা মানুষের শরীরে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, টিকাটি ৯৫ শতাংশ কভিড-১৯ প্রতিরোধ সক্ষম। সাধারণত দুটি টিকা নিতে হবে প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২১তম দিনে দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হবে। কিন্তু বড় সমস্যা যা, তা হচ্ছে টিকার সংরক্ষণ। বলা হচ্ছে, এ ধরনের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এই টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। আরও তিনটি কোম্পানির টিকা বাজারে আসছে, তাদের এ সমস্যা নেই। মডার্নার টিকা শতকরা ৯৫ ভাগ সফল এবং তা রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুতনিক ভি) টিকার এ সমস্যা নেই। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। করোনর টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যেহেতু এই টিকাটি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, সেহেতু অনেক গরিব দেশের পক্ষে তা এ মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ফলে টিকা নিয়ে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ধনী দেশগুলো টিকা মজুদ করছে। বলা হচ্ছে, ধনী দেশগুলো এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ((Vaccine Nationlism))-এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ আগে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। যেমন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টিকা মার্কিন নাগরিকদের দিতে চান। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। আগে আমার টিকা নিশ্চিত করা। অন্যরা পাক বা না পাক। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভ্যাকসিন বা টিকা ছাড়া কভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না (যেমনটি হয়েছিল ‘স্মল পক্স’-এর ক্ষেত্রে), তখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এলো টিকা গবেষণায় ও উৎপাদনে। ২০২০ সালের মধ্যে এই টিকার পুরোপুরি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হলো না। কিন্তু এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র) বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার আগেই তাদের দেশের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ টিকাটি তারা আগে নিতে চায়। যেখানে বিশ্ব সংস্থা, GAVI- The Vaccine Alliance, Coatition for Epidemic preparedness Innovations (CEPI) দ্রুত টিকাটি বিশ্বের সব মানুষে কাছে পৌঁছে দিতে চায় (নিঃসন্দেহে যা সময় সাপেক্ষ), সেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকাটি আগে নিতে চায়। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। বিশে^র জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৭৮০ কোটি। একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। ফলে টিকাটি সবার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে আর টিকাটি বাজারে আসবে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত Astrazeneca-এর টিকাটি নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। যাদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোম্পানি তৃতীয় ট্রায়াল স্থগিত রেখে আবার তা শুরু করেছিল। ফলে যে কোম্পানিগুলো কভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ইতিমধ্যে সফলভাবে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে (চীন ও রাশিয়ার কোম্পানি), তাদের টিকা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফাইজারের টিকা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছিল। এখন বড় দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না, এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ‘হু’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেডরস আদহানোম গেব্রেয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিহত করতে হবে। পড়াধী ইতিমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কভিড-১৯ টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, , Astrazeneca-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাসও ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে, ২০০৯ সালে যখন মহামারী ঐ১ঘ১ ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ, যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ছয় লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হলো। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে, Airfinity-এর মতে ২০২২ সালের প্রথম ভাগের আগে কোনো মতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয়, টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হবে? উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে সরবরাহ করতে বাধ্য। তাহলে আমরা পাব কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ভরসা আমাদের চীনা ও রাশান কোম্পানি। এদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ ‘My nation first’ এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ ‘আমার দেশ আগে পাবে’ এই ধারণা নিয়ে এগিয়ে আছে ধনী দেশগুলো, এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু ‘My nation first’ ধারণার কারণে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলোর স্বার্থ। Harvard Business Review- এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে ‘If Countries with a large number of cases lag to obtain the vaccine and other mediciner, the disease will continue to disrupt global supply chains, and, as a result, economics around the would’ (Rebecca weintraub ২২, ২০২০) এর প্রবন্ধে The Denger of Vaccine Nationalism, may 22, 2020) কভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারী। এ ক্ষেত্রে একটা বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কিছু কিছু দেশ ‘এককভাবে’ চলতে চেষ্টা করছে এবং সম্মিলিতভাবে কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল গ্রহণ করেনি। কয়েকটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো, বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন, ও wellcome Trust 800 কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT অর্থাৎ কভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবিলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ফ্রান্সের কোম্পানি সানোফির ( (Sanofi)) সিইও পল হাডসন মনে করেন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ও টিকা সরবরাহের ব্যাপারে একটি প্রি-অর্ডার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু তাদের টিকা পাওয়ার অধিকারটি বেশি। ভারতের Serum Institute, যারা টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আছে, সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, Serum যা উৎপাদন করবে, তা প্রথমে পাবে ভারতের জনগণ। এরপর তা বহির্বিশ্বের মানুষ পাবে। Astrazeneca, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কভিড-১৯ টিকা উৎপাদন করছে, তাদের উৎপাদিত টিকা প্রথমে পাবে ব্রিটেনের মানুষ (প্রায় তিন কোটি ডোজ)। কেননা যুক্তরাজ্য সরকার টিকা উৎপাদনে ৭৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পরে ট্রাম্প প্রশাসন, এখানে তাদের বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত টিকার মধ্যে ৩০ কোটি ডোজ পাবে। ট্রাম্প প্রশাসন Operation Warp Speed,, অর্থাৎ দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার আওতায়ই এই টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে (ওই)। এর অর্থ হচ্ছে ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ আগেই নিশ্চিত তরেছে। এমনকি ট্রাম্প বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া আগে। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 ev Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২,৮৪,০০০ মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ রয়েছে বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেল আগে। দ্রুত যে দেশগুলো সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে টিকা পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এই দুর্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনা টিকা আসবে। কিন্তু এই টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যই সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে টিকা-জাতীয়তাবাদ এবং ধনী-গরিব রাষ্ট্রের বৈষম্য করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এর টিকা নিয়ে আছে সুখবর, আছে মন্দ খবরও। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ফাইজারের তৈরি টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রায় নব্বই বছর বয়সী মহিলা মার্গারেট প্রথম টিকাটি গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এটিই বিশ্বের প্রথম MRNA Vaccine, যা মানুষের শরীরে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, টিকাটি ৯৫ শতাংশ কভিড-১৯ প্রতিরোধ সক্ষম। সাধারণত দুটি টিকা নিতে হবে প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২১তম দিনে দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হবে। কিন্তু বড় সমস্যা যা, তা হচ্ছে টিকার সংরক্ষণ। বলা হচ্ছে, এ ধরনের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এই টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। আরও তিনটি কোম্পানির টিকা বাজারে আসছে, তাদের এ সমস্যা নেই। মডার্নার টিকা শতকরা ৯৫ ভাগ সফল এবং তা রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুতনিক ভি) টিকার এ সমস্যা নেই। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। করোনর টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যেহেতু এই টিকাটি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, সেহেতু অনেক গরিব দেশের পক্ষে তা এ মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ফলে টিকা নিয়ে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ধনী দেশগুলো টিকা মজুদ করছে। বলা হচ্ছে, ধনী দেশগুলো এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ((Vaccine Nationlism))-এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ আগে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। যেমন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টিকা মার্কিন নাগরিকদের দিতে চান। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। আগে আমার টিকা নিশ্চিত করা। অন্যরা পাক বা না পাক। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভ্যাকসিন বা টিকা ছাড়া কভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না (যেমনটি হয়েছিল ‘স্মল পক্স’-এর ক্ষেত্রে), তখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এলো টিকা গবেষণায় ও উৎপাদনে। ২০২০ সালের মধ্যে এই টিকার পুরোপুরি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হলো না। কিন্তু এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র) বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার আগেই তাদের দেশের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ টিকাটি তারা আগে নিতে চায়। যেখানে বিশ্ব সংস্থা, GAVI- The Vaccine Alliance, Coatition for Epidemic preparedness Innovations (CEPI) দ্রুত টিকাটি বিশ্বের সব মানুষে কাছে পৌঁছে দিতে চায় (নিঃসন্দেহে যা সময় সাপেক্ষ), সেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকাটি আগে নিতে চায়। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। বিশে^র জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৭৮০ কোটি। একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। ফলে টিকাটি সবার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে আর টিকাটি বাজারে আসবে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত Astrazeneca-এর টিকাটি নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। যাদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোম্পানি তৃতীয় ট্রায়াল স্থগিত রেখে আবার তা শুরু করেছিল। ফলে যে কোম্পানিগুলো কভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ইতিমধ্যে সফলভাবে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে (চীন ও রাশিয়ার কোম্পানি), তাদের টিকা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফাইজারের টিকা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছিল। এখন বড় দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না, এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ‘হু’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেডরস আদহানোম গেব্রেয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিহত করতে হবে। পড়াধী ইতিমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কভিড-১৯ টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, , Astrazeneca-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাসও ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে, ২০০৯ সালে যখন মহামারী ঐ১ঘ১ ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ, যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ছয় লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হলো। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে, Airfinity-এর মতে ২০২২ সালের প্রথম ভাগের আগে কোনো মতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয়, টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হবে? উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে সরবরাহ করতে বাধ্য। তাহলে আমরা পাব কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ভরসা আমাদের চীনা ও রাশান কোম্পানি। এদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ ‘My nation first’ এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ ‘আমার দেশ আগে পাবে’ এই ধারণা নিয়ে এগিয়ে আছে ধনী দেশগুলো, এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু ‘My nation first’ ধারণার কারণে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলোর স্বার্থ। Harvard Business Review- এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে ‘If Countries with a large number of cases lag to obtain the vaccine and other mediciner, the disease will continue to disrupt global supply chains, and, as a result, economics around the would’ (Rebecca weintraub ২২, ২০২০) এর প্রবন্ধে The Denger of Vaccine Nationalism, may 22, 2020) কভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারী। এ ক্ষেত্রে একটা বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কিছু কিছু দেশ ‘এককভাবে’ চলতে চেষ্টা করছে এবং সম্মিলিতভাবে কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল গ্রহণ করেনি। কয়েকটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো, বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন, ও wellcome Trust 800 কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT অর্থাৎ কভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবিলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ফ্রান্সের কোম্পানি সানোফির ( (Sanofi)) সিইও পল হাডসন মনে করেন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ও টিকা সরবরাহের ব্যাপারে একটি প্রি-অর্ডার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু তাদের টিকা পাওয়ার অধিকারটি বেশি। ভারতের Serum Institute, যারা টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আছে, সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, Serum যা উৎপাদন করবে, তা প্রথমে পাবে ভারতের জনগণ। এরপর তা বহির্বিশ্বের মানুষ পাবে। Astrazeneca, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কভিড-১৯ টিকা উৎপাদন করছে, তাদের উৎপাদিত টিকা প্রথমে পাবে ব্রিটেনের মানুষ (প্রায় তিন কোটি ডোজ)। কেননা যুক্তরাজ্য সরকার টিকা উৎপাদনে ৭৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পরে ট্রাম্প প্রশাসন, এখানে তাদের বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত টিকার মধ্যে ৩০ কোটি ডোজ পাবে। ট্রাম্প প্রশাসন Operation Warp Speed,, অর্থাৎ দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার আওতায়ই এই টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে (ওই)। এর অর্থ হচ্ছে ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ আগেই নিশ্চিত তরেছে। এমনকি ট্রাম্প বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া আগে। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 ev Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২,৮৪,০০০ মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ রয়েছে বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেল আগে। দ্রুত যে দেশগুলো সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে টিকা পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এই দুর্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনা টিকা আসবে। কিন্তু এই টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যই সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে Desh Rupantor 13.12.2020

0 comments:

Post a Comment