রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আয়বৈষম্য

করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ইউরোপে কোথাও কোথাও ‘দ্বিতীয় ঢেউ’, আবার কোথাও ‘তৃতীয় ঢেউ’ হচ্ছে। এর প্রতিবাদে লন্ডনে বড় বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও সরকারিভাবে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, তাতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। আমরা এটাকে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বলি আর না বলি, বাস্তবতা হচ্ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়নি। এখন একমাত্র ভরসা হচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন। অর্থাৎ করোনা টিকাই হচ্ছে একমাত্র প্রতিষেধক। টিকা ছাড়া কোনো মুক্তি নেই। এই টিকা নিয়েও বিশ্বব্যাপী চলছে এক ধরনের ‘ব্যবসা’ ও ‘বৈষম্য’। অর্থাৎ টিকাপ্রাপ্তি ও টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আরও কথা আছে। যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশে করোনা আঘাত করেছে, সেখানে সব দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার গরিব দেশগুলো এই টিকা সবাই পাবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা এই টিকা প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ নগদ অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। সেই অর্থ গরিব দেশগুলো কোত্থেকে সংগ্রহ করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। Truthout নামে একটি নিউজ পোর্টাল আমাদের জানাচ্ছে, যে পাঁচটি টিকা অনুমোদন পেতে যাচ্ছে, তাদের উৎপাদিত টিকা বিশ্বের তিন ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে ২০২২ সালের আগে পৌঁছানো সম্ভব হবে না (১৭ নভেম্বর)। এর অর্থ হচ্ছে টিকা নিয়ে যে বৈষম্য তা আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করবে। একদিকে টিকা নিয়ে বৈষম্য যখন তৈরি হয়েছে, তখন বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও কোনো সুখবর নেই। মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছে, তখন বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছেন। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি প্রযোজ্য ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। তাদের সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছে। অথচ গরিব মানুষ দিনে দিনে আরও গরিব হয়েছে। ধনী ও গরিব মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে আয়ের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসার প্রসারও বেড়েছে, যাতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীতে সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ১৪ লাখ অতিক্রম করেছে (১৪,৬০,৭৯২, ২৯ নভেম্বর)। এখন আশ্চর্যজনকভাবে বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ আরও বেড়েছে। ভারতের মতো দেশে শত কোটিপতির সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, তাদের সম্পদও বেড়েছে। কতগুলো পরিসংখ্যান দিলে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিলিয়নিয়ারদের শীর্ষে রয়েছেন জেফ বেজোস, যিনি ‘আমাজন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। ৫৬ বছর বয়সী জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৭৫.৩ বিলিয়ন ডলার, যা অনেক দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। আমাজন এই প্যানডেমিকের সময় সম্পদ বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে এই সময় তাদের আয় ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, ৫.২ বিলিয়ন ডলার ( The Verge, July 30,2020 ). শুধু আমাজনের কথা কেন বলি? বিল গেটস (মাইক্রোসফট) তার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। ধনীদের তালিকায় তার অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় অবস্থানে আছেন ওয়ারেন বাফেট (বার্কশায়ার হাথাওয়ে), তার সম্পদের পরিমাণ ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ওরাকলের লেরি এলিসন, ফেইসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, সবার সম্পদ বেড়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি মানুষ মারা গেলেও, সেখানে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা চীনের পরে (চীনে ৭৯৯ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৬২৬ জন। ভারতে ১৩৭ জন। সূত্র Statista )। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন, তেমনটি নয়। ফোর্বস যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে প্রথম ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের মধ্যে ফ্রান্সের আছে দুজন, স্পেনের একজন, মেক্সিকোর একজন। করোনাকালে ভারতেও ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। ভারতে গত ছয় মাসে নতুন ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের জন্ম হয়েছে। ভারতে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১৩৭। এই ১৩৭ জনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার। তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মুকেশ আম্বানি (৮৮২০ কোটি ডলার)। পরের অবস্থানগুলো যথাক্রমে শিব বাদার (৮৮২০ কোটি ডলার), গৌতম আদানি (১৮৬০ কোটি ডলার), রাধাকৃষ্ণ দামানি (১৫২০ কোটি ডলার)। নতুন শত কোটিপতির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তারা হচ্ছেন বিমল কুমার জ্ঞানচন্দানি, বিনি বনসল, রাধোশ্যাম গোয়েনকা প্রমুখ (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। করোনাকালে ভারতে শত কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিবিদরা সেখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে পার্থক্য আরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখছেন। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? একদিকে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে না, মৃত্যুর সংখ্যা এখনো বাড়ছে। অন্যদিকে ধনীদের সংখ্যাও বাড়ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। অথচ ভারতের অর্থনীতি ভালো নয়। ভারতে জিডিপি গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। কাজ হারিয়েছে ৪১ লাখ মানুষ (আইএলও তথ্য মতে)। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। আর্থিক সংকটের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স’ গ্রুপ গুগল, ফেইসবুকের মতো অনলাইন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ও তার মূলধন বেড়েছে। করোনাভাইরাস ভারতে ধনীদের আরও ধনী করেছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশেও করোনাকালে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে। গত মার্চ থেকে জুন (২০২০) এই চার মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৩৭ জন। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। করোনার সময় ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে (বিডিটুডে, ১৬ সেপ্টেম্বর)। আবার যুুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে ফিরে যাই। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই নভেম্বরেই দ্বিতীয় আরেকটি ‘ওয়েভ’ বা ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হেনেছে। স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা সেখানে চরমে। মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার জন্য নোয়াম চমস্কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার কলেজের প্রফেসর থমাস মাগাস্টাড্ট ২৮ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল Nations of Change এ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘Failed State , বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন করোনাকালেও যুক্তরাষ্ট্রে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে। Families of USA এর তথ্য মতে মহামারীর সময় ৫৪ লাখ মানুষ তাদের যে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল, তা হারিয়েছে। চাকরি না থাকায় অনেকেই এখন আর ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে পারছেন না। কভিড-১৯-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক রাজ চেট্টি কভিড-১৯ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন, নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের বছরে আয় ২৭ হাজার ডলারের নিচে, তাদের মধ্যে ১১ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কিন্তু যাদের আয় বছরে ৬০ হাজার ডলারের ওপরে, তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর সংখ্যা ৩ ভাগের ১ ভাগ। অধ্যাপক থমাস মাগাস্টাড্ট তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের চাকরি চলে গেছে, অথবা বেতন কমেছে, সেখানে প্রধান নির্বাহীদের বেতন বেড়েছে ৯৪০ ভাগ। চিন্তা করা যায়? এই করোনাভাইরাসকেও ব্যবসায়ীরা পুঁজি করছেন। তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করছেন। তারা আরও ধনী হয়েছেন। যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের সম্পদও বেড়েছে। আইএমএফের আশঙ্কা বিশ্ব অর্থনীতি এবার সংকুচিত হবে ৫.২ শতাংশ। কিন্তু করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ইতিমধ্যে ইউরোপে আঘাত হেনেছে। স্পেন, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড কিংবা জার্মানিতে আবার সীমিত ‘লকডাউন’ চালু হয়েছে। বার, রেস্টুরেন্ট খোলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচনের হার ৫.২ শতাংশকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশও এতে করে আক্রান্ত হবে। করোনায় বাংলাদেশের জিডিপি কমবে ০.০১ শতাংশ। এডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে ক্ষতি হবে, তার পরিমাণ ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। কিন্তু প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনায় মানুষের মাসিক আয় কমেছে ২০.২৪ শতাংশ। করোনার সময় প্রায় ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবার বা খানা কোনো না কোনোভাবে খাদ্যদ্রব্য ভোগের পরিমাণ ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় কমিয়েছে। বিবিএসের জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় বিশ্ব এখনো করোনামুক্ত হয়নি এবং করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে থাকলই। একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল নভেম্বরেই করোনা টিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু টিকা নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেননা যাদের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারা অসুস্থ হয়ে পড়ায়, টিকার ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। উপরন্তু বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই টিকা কত দিনে পৌঁছানো সম্ভব হবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন Desh Rupantor 3.12.2020

0 comments:

Post a Comment