রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

উচ্চশিক্ষায় ভর্তি সংকট নিরসনে একটি প্রস্তাব

দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে সেপ্টেম্বরে। কিন্তু তার আগেই উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। অতীতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে যত না প্রশ্ন উঠেছিল, এবার উঠেছে তার চেয়ে বেশি। কারণ প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছিল, তা পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ও ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এবার পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেছে, যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, এত বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে যে, তাদের অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। তৃতীয়ত, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও কোনো অদৃশ্য কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট-বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। মন্ত্রী মহোদয় বারবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রেটিংয়ের কথা বললেও তা হয়নি। ফলে বিভ্রান্তিতে থাকছেন অভিভাবকরা। চতুর্থত, অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কোন কোন সেক্টরে আমাদের কত গ্রাজুয়েট দরকার, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএর মতো বিষয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে এবং তারা এখন বেসরকারি খাতে ভদ্র কেরানিতে পরিণত হচ্ছে। পঞ্চমত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে আমরা দেশে একটি সার্টিফিকেট কারখানা তৈরি করেছি। এখান থেকে শুধু সার্টিফিকেটই দেয়া হয়। কলেজগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ কেউ কখনও নেয় না। ষষ্ঠত, মানসম্মত শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।এবার এইচএসসি পাস করেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী। প্রতি আসনে এবার লড়বে ১০০ শিক্ষার্থী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৭০ হাজার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কলেজগুলোতে অনার্সে আসন সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৮০ হাজার। ৩৮টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে আসন রয়েছে ৪ হাজার। বুয়েটের আসন ১ হাজার। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এখন অংকটা করে দেখা যেতে পারে কতজন শিক্ষার্থী এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। দেশে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭টি। আর ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে ৩৫টিতে। চট্টগ্রাম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় এখনও চালু হয়নি, অথচ এর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র বিদ্যায় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এটি চালু করতে হবে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারেই ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও ভালো শিক্ষকমণ্ডলী রয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রয়েছে বিপুল এক তারুণ্য শক্তি। তারা আমাদের সম্পদ। এই সম্পদকে আমরা যদি ব্যবহার করতে পারি, তাহলে দেশের চেহারা বদলে যাবে। এজন্য চাই সঠিক নীতি। সঠিক দিকদর্শন। আমাদের নীতিনির্ধারকরা ব্যাপারটি কতটুকু উপলব্ধি করেন, আমি নিশ্চিত নই। দেশে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা ভালো দিক। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগকে নস্যাৎ করেছেন কিছু ভিসি, যারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের যোগ্যতা ও শিক্ষাদানের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোথাও কোথাও এমনসব বিভাগ খোলা হয়েছে, যেখানে পড়ানোর মতো যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগ খোলা হবে, এর কোনো মানে নেই। আর সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বা চিকিৎসাশাস্ত্র চালু হবে না, এটাও কোনো যুক্তি হতে পারে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কিছুদিন আগে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ চালু হয়েছে। নিঃসন্দেহে এজন্য কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ পেতে পারে। জাবিসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং এবং প্রকৌশল বিদ্যা-সংক্রান্ত বেশকটি বিভাগ চালু করা সম্ভব। জাবির অবকাঠামোগত সুবিধা আছে। এ সুবিধাটুকু কাজে লাগানো যায়। নীতিনির্ধারকরা নিুোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারেন।১. নতুন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। তবে প্রস্তাবিত রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করতে হবে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় চিকিৎসা বিদ্যা, নার্সিং এবং প্রকৌশল বিদ্যা চালু করতে হবে। এখানে কোনো কোটা থাকবে না। কোটা পদ্ধতি বৈষম্য সৃষ্টি করে; ২. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা (খেলোয়াড়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, উপজাতি ইত্যাদি) রয়েছে। কোটার কারণে উচ্চশিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। সরকার কোটার পরিবর্তে বিভিন্ন কোটার জন্য চাকরি নির্ধারণ করে দিতে পারে; ৩. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় শিফট চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যারা অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি হতে পারেনি, তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্বিতীয় শিফটে ভর্তি হতে পারে। এজন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। শিক্ষকরা কিছু সম্মানীর বিনিময়ে দ্বিতীয় শিফটে ক্লাস নিতে রাজি থাকবেন। এ ক্ষেত্রে বিকালে শূন্য ক্যাম্পাস কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে দ্বিতীয় শিফটের জন্য অতিরিক্ত ভর্তি ও মাসিক ফি চালু করা যেতে পারে; ৪. দ্বিতীয় শিফটের জন্য যে বিষয়গুলোর চাহিদা রয়েছে, সেসব বিষয় চালু করতে হবে। যেমন আইটি, অর্থনীতি, বিবিএ, ভাষা বিজ্ঞান (বিভিন্ন ভাষা), আর্কিটেকচার ইত্যাদি। দ্বিতীয় শিফটের জন্য অনার্স কোর্স চালু করার প্রয়োজন নেই। দুবছর মেয়াদি গ্রাজুয়েশন কোর্স, মাস্টার্স কোর্স, সার্টিফিকেট কোর্স, শর্ট কোর্স ইত্যাদি চালু করা যেতে পারে; ৫. বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, শাহজালাল) দ্বিতীয় ক্যাম্পাস চালু করা যেতে পারে। একজন শিক্ষক তার নিজ ক্যাম্পাসে ক্লাস নেয়ার পর প্রচুর সময় পান। এ সময়টুকু তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে ক্লাস নিয়ে কাটাতে পারেন। সরকার বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেয়ার জন্য তাদের সহযোগিতা নিয়ে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস চালু করতে পারে; ৬. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দিয়ে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭ জন বীর শহীদের নামে ৭টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সুবিধা হল, ৭টি বিভাগীয় শহরেই ৭টি পুরনো ও ঐতিহ্যমণ্ডিত কলেজ আছে এবং ওই সব কলেজে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকও রয়েছেন। যেমন- সিলেটের এমসি কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, খুলনার আজম খান কমার্স কলেজ ইত্যাদি। এসব কলেজে একাধিক বিষয়ে বর্তমানে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে এবং ল্যাব সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। বর্তমান কাঠামোয় কলেজগুলোতে নিয়মিত কোনো ক্লাস হয় না। কলেজ পর্যায়েই শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট কোচিংয়ে। ফলে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বাকুশা মার্কেটের নোটনির্ভর। আমি পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস না করেও পরীক্ষা দিচ্ছে এবং পাস করে সার্টিফিকেট পাচ্ছে। সারা বছর ঘর-সংসার আর শাশুড়ির খেদমত করে একজন গৃহিণী যখন অনার্স ও মাস্টার্স সার্টিফিকেট নিয়ে নিচ্ছে, তখন এ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে আমার কষ্ট হয়। জেলা পর্যায়ে একটি বড় কলেজে গিয়ে দেখেছি শিক্ষকরা কলেজে ক্লাস নেন না, বাসায় প্রাইভেট পড়ান। অনার্স পর্যায়ে একজন ছাত্র প্রাইভেট পড়ে, এটা আমি ভাবতেও পারি না। গত ২৫ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল একটি তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটি হচ্ছে, দুই পরীক্ষকের পরিবর্তে এক পরীক্ষক পদ্ধতি প্রবর্তন। তাহলে কি ভিসি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করতে যাচ্ছেন? দুই পরীক্ষকের বিধান দীর্ঘদিনের। এটা করা হয় এজন্য যে, মূল্যায়নটি যেন সঠিক হয়। এমনিতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ভিসির এটা না জানার কথা নয়। এখন অনার্স পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থী যা লিখল, তার সঠিক মূল্যায়ন কী হবে? গৎবাঁধা একটা নম্বর দেবেন পরীক্ষক, আর সেটাই চূড়ান্ত হবে। ভিসি যুক্তি দেখিয়েছেন, পরীক্ষকের সময়ক্ষেপণের। এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি কীভাবে শিক্ষার মান বাড়াবেন, শিক্ষকরা যাতে নিয়মিত ক্লাস নেন সে পন্থা উদ্ভাবন করবেন, তা না করে এক পরীক্ষককে দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। এতে করে তথাকথিত সার্টিফিকেটধারীর সংখ্যা আরও বাড়বে।শিক্ষামন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি এ দেশে মানসম্মত শিক্ষা চান, নাকি সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থী চান। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাকে ভাবতে হবে। প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারব না। আমরা ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। শত শত অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির চাকরির সংস্থান হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে পারিনি। শিক্ষামন্ত্রী প্রায়ই এই কোয়ালিটি এডুকেশন নিয়ে কথা বলেন। শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তুতারা মন্ত্রীকে কী বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিয়েছেন? মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, সুবিধাবাদী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তিনি সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও বিশেষজ্ঞরা তাকে কোনো জ্ঞান দিতে পারবেন না। সরষের মধ্যে ভূত থাকলে ওই ভূত তাড়ানো যায় না।৭০ হাজার ৬০২ জন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী গর্ব করতেই পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, তাদের অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারবে না। কেন? এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই জানা আছে মাননীয় মন্ত্রীর। উচ্চ মাধ্যমিকের উত্তরপত্র খুব সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা যায়, কিন্তু এতে ছেলেমেয়েদের আমরা কী ক্ষতি করলাম, এ দিকটা আমরা কেউই ভেবে দেখিনি। ওরা যখন ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে না, যখন মেডিকেল বা বুয়েটে পড়ার সুযোগ পাবে না, তখন ওদের মানসিক অবস্থা কী হবে, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? সবাই ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে না। ওখানে পড়ার খরচ অনেক। উপরন্তু কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গিবাদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই বিষয়টি জানেন। সুতরাং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা যেহেতু বেড়েছে, সেহেতু ওদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়ার দায়িত্বও অনেকটা সরকারের। তাই নিদেনপক্ষে ৪টি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফট চালু করা হোক। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের বিষয়টিও সরকার বিবেচনায় নিতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রশ্নে একটি জাতীয় সংলাপ আহ্বান করতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদদের নিয়েও (দলবাজ নয়) একটা সংলাপ করতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রী আমলানির্ভর মতামত থেকে বের হয়ে আসবেন, এ প্রত্যাশাই করি। Daily Jugantor 01.09.14

পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার আছে অনেক

 পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত টিকে গেল বলেই মনে হচ্ছে। ইমরান খান আর তাহিরুল কাদরির যৌথ আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিলে একটা গুজবের জন্ম হয়েছিল যে সেনাবাহিনী সেখানে ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে। কিন্তু নওয়াজ শরিফের সঙ্গে জারদারির বৈঠক বদলে গেল দৃশ্যপট। জারদারি সমর্থন করলেন নওয়াজ শরিফকে। অথচ পাকিস্তানের ইতিহাস বলে পিপলস পার্টি, জারদারি যার কো-চেয়ারম্যান, আর নওয়াজ শরিফ যিনি মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান, এ দুটি বড় দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বে বারবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। নওয়াজ শরিফ দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বেনজির ভুট্টোও ছিলেন দুবার প্রধানমন্ত্রী। তবে কেউই তাদের টার্ম পূর্ণ করতে পারেননি। নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়েছিল। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ প্রায় নয় বছর। তারপর মোশাররফের পদত্যাগ জারদারি তথা পিপিপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। পিপিপি তার পাঁচ বছরের টার্ম পূর্ণ করার পরই নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় আসেন গেল বছর। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু মাত্র ১৬ মাসের ব্যবধানে পাকিস্তান আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠল। কিন্তু এ আন্দোলনে পিপিপি নওয়াজ শরিফবিরোধী অবস্থানে যায়নি। বরং দুর্বল অবস্থানে থেকেও শরিফকে সমর্থন করেছে। বলা হয় সেনাবাহিনীই ইমরানের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে। সেনাবাহিনী তো সেখানে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি। গণতান্ত্রিক শক্তিকে কোনোদিনই বিকশিত হতে দেয়নি এ সেনাবাহিনী।
বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে রয়েছে দুজন পূর্ণ জেনারেল, ২১ জন লে. জেনারেল, আর ১৫০ জন মেজর জেনারেল। নৌবাহিনী আর বিমান বাহিনীর হিসাব না হয় নাইবা দিলাম। এই বিপুল প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি শক্তি। এ শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন 'পেট্রোনাইজ' করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়া হয় তার একটা বড় অংশ যায় সেনাবাহিনীর কাছে। পরোক্ষভাবে এই সাহায্যের মধ্য দিয়ে পাক-সেনাবাহিনীকে 'পেট্রোনাইজ' করে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাতে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়া, ঋঅঞঅ অঞ্চলে উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যর্থতা ও এর রেশ ধরে ওই অঞ্চলে অব্যাহত ড্রোন বিমান হামলা ইত্যাদির কারণে দু'দেশের সম্পর্ক এখন নিম্নস্তরে রয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন গেল বছর এসেছিল উচ্চ আদালতের রায়। অপসারিত হয়েছিলেন গিলানি। আর রাজা আশরাফের অবস্থাও ছিল নড়বড়ে। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে অতীতে কখনই কোনো রাজনৈতিক সরকার সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারেনি। একদিকে যেমনি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসতা ও আস্থাহীনতা, অন্যদিকে ছিল অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের অভিলাস। বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের যাত্রা পথকে আরো পিচ্ছিল করে দিয়েছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর কোনো কোনো সিদ্ধান্ত বড় ধরনের সঙ্কটের জন্ম দিয়েছিল পাকিস্তানে। এখানে বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটা অদৃশ্য সম্পর্ক রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতির পেছনেও ছিল বিচার বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে একটি হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তার পর পরই শুরু হয় ইসলামাবাদ অভিমুখে ইমরান-কাদরির লং মার্চ। আপাতত নওয়াজ কিছুটা রক্ষা পেয়েছেন বটে। কিন্তু অচিরেই তিনি দুর্নীতিসহ নানা জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে যেতে পারেন। নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। সেই মামলা পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই বিচার বিভাগ এ ধরনের বিচার কার্যক্রম শুরু করবে না। সম্ভবত তারা অপেক্ষা করবে আরো কিছুদিনের জন্য। পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী কী কলকাঠি নাড়ায় তাও দেখার বিষয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচার বিভাগের একটা 'সখ্য' রয়েছে।
তবে নওয়াজ শরিফের মূল সমস্যা হচ্ছে অর্থনীতি। পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা খুবই শোচনীয়। প্রায় ১৮০ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৩ ভাগ। বৈদেশিক রিজার্ভে যা আছে তা দিয়ে মাত্র দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। বাজেট ঘাটতির হার শতকরা ৮ ভাগ। বেকার সমস্যা প্রবল। বিনিয়োগের পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। জাতিসংঘের ঐউজ (ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ জবঢ়ড়ৎঃ) অনুযায়ী ১৮৬ দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ৪৬-এ। বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪-এ। তুলনামূলক বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। বয়স্কদের মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগই অশিক্ষিত। পাখতুনখোয়া প্রদেশ কিংবা ঋঅঞঅ এলাকায় শিশু, বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এমনকি দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ করাচি শহরের চার ভাগের একভাগ শিশু স্কুলে যায় না। তবে পাঞ্জাব প্রদেশে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। আইএমএফের সঙ্গে প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি নিয়ে আলোচনা আটকে আছে। সরকারের জন্য এটা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তা এখন মানতে বাধ্য হবে সরকার। বিনিয়োগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ ঘাটতি। ১৫ বছর আগেও পাকিস্তান ছিল বিদ্যুতে সারপ্লাজ। তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। বিদ্যুতের লোডশেডিং এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার পাকিস্তানে। দিনের বেশিরভাগ সময়েই বিদ্যুৎ থাকে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, অসমতা ইত্যাদি নানা সমস্যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থাকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। এদিকে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নয়া সরকারকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। পাকিস্তান-ইরান গ্যাস পাইপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ- আপত্তি রয়েছে। পাকিস্তান তার জ্বালানি সঙ্কট মেটাতে ইরান থেকে গ্যাস আমদানি করা সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তাতে আপত্তি রয়েছে। এমনিতেই পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে অব্যাহত ড্রোন বিমান হামলা এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি করেছে। বিগত সরকার এই ড্রোন বিমান হামলা বন্ধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নয়া সরকারের জন্য বিষয়টি হবে বেশ স্পর্শকাতর। কেননা এই ড্রোন হামলা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি জনমত তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারণায় ইমরান খান ড্রোন বিমান গুলি করে ফেলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের তেমন উন্নতি হয়নি। গেল বছর পাকিস্তানের কারাগারে একজন ভারতীয় বন্দির মৃত্যুকে (যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর এজেন্ট ছিলেন) কেন্দ্র করে এই সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটেছিল। একই সঙ্গে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে উন্নয়ন ঘটালেও খোদ বেলুচিস্তানে এর ছোঁয়া লাগেনি। বরং বেলুচিদের অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। বেলুচিস্তানে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে, যারা 'স্বাধীন বেলুচ রাষ্ট্রের' জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে। এই বেলুচিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন নানা প্রশ্নের মুখে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বেলুচিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। বেলুচিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ইরানি প্রদেশ সিসতান বেলুচিস্তানের। অন্যদিকে বেলুচিস্তানের গাওডারে রয়েছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। চীন এই বন্দরটি নির্মাণ করে দিয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গাওডারের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এমনকি সিসতান বেলুচিস্তানের সঙ্গে একত্রিত হয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন বিচিত্র কিছু নয়। ভারত মহাসাগরের জ্বালানি সরবরাহ লাইন নিশ্চিত রাখা কিংবা তেহরানের কেন্দ্রীয় সরকারকে 'চাপে' রাখার কাজে এই বেলুচিস্তান আগামী দিনে বাইরের শক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনেকেরই মনে থাকার কথা বেলুচিস্তানের গভীর মরুভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানঘাঁটি ছিল। ২০১২ সালে পাকিস্তান এটি বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার এটাও একটা কারণ। নওয়াজ শরিফের সমস্যা তাই অনেক।
বেশ কিছুদিন আগে পাকিস্তান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন আইন প্রণেতারা। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলীয় নেতারা মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি 'বস্নাক হোল'-এর মতো। অর্থাৎ তারা যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে পাকিস্তান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। এটা সেই 'বস্নাক হোল'-এর মতো, যার কোনো শেষ নেই। মার্কিন কংগ্রেসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে ডেমোক্রেট দলীয় গ্রে অ্যাকারম্যান কিংবা রিপাবলিকান দলীয় ড্যানা রোহরাব্যাচারের মতো ব্যক্তিত্ব যখন পাকিস্তান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। মার্কিন আইন প্রণেতারা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন ২০১৩ সালে মে মাসে কংগ্রেসের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক একটি প্যানেলে আমন্ত্রিত হয়ে। মার্কিন আইন প্রণেতাদের এই মন্তব্য যখন ওয়াশিংটনে নীতি-নির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে ঠিক তখনই নওয়াজ শরিফের সরকার একটি ঝুঁকির মুখে পড়ল।
এটা ঠিক এই সঙ্কটে নওয়াজ শরিফের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পিপিপি। পিপিপির সমর্থন না পেলে হয়তো পরিস্থিতি আজ অন্যরকম হতে পারত। নওয়াজ শরিফের পতনও হতে পারত। তা হয়নি। এটা পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য একটি ভালো দিক। একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে তাদের পাঁচ বছরের টার্ম পূরণ করতে দেয়া উচিত। কিন্তু তা না করে আন্দোলনের নামে সরকারের পতন ঘটানো কোনো ভালো লক্ষণ হতে পারে না। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে পিপিপি ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে একটি সমঝোতাও গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য একটি ভালো খবর। দুটি বড় শক্তি যখন এক হয় তখন অসাংবিধানিক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
ইমরান খানকে সামনে ঠেলে দিয়ে সেনাবাহিনী মূলত একটা 'চেষ্টা' চালাল। কিন্তু পিপিপি পাশে এসে দাঁড়ানোয় সেনাবাহিনীর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। এ 'আন্দোলন' থেকে এটাই বড় পাওয়া। ইমরান খান ভুল করেছেন। খুব দ্রুত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব দলের ঐক্য তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। নিশ্চয়ই এ 'আন্দোলন' থেকে সবাই শিখবেন। ইমরান খানের যেমনি শেখার আছে, ঠিক তেমনি শেখার আছে নওয়াজ শরিফেরও।
Daily Jai Jai Din01.09.14

পাকিস্তান নিয়ে গল্পটা আবারও শুরু

পাকিস্তান নিয়ে গল্পটি আবারও শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশটির রাজনৈতিক সংকটে দেখা করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সঙ্গে। কী কথা হয়েছে দুজনের সঙ্গে, জানার কোনো উপায় নেই। তবে একটা বড় ফাঁড়া তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না, তা নিশ্চিত নই। তিনি দেখা করেছিলেন পিপিপির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারির সঙ্গেও। এতে কিছুটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলো। জারদারি সমর্থন করেছেন নওয়াজ শরিফকে। যুক্তি- সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা। যুক্তিটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু নওয়াজের ‘বিপদ’ কেটে গেছে- এটি বলা যাবে না। এটি তো একটি সোজা হিসাব- কত বিপদে পড়লে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করেন! সেটি নওয়াজ শরিফ করেছেন। পাকিস্তান নিয়ে আমাদের দেশে কিংবা খোদ পাকিস্তানে যারা লেখালেখি করেন, তারা অনেক ‘তত্ত্ব’কে এখন সামনে নিয়ে এসেছেন। এক. ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির ইসলামাবাদ ঘেরাও আন্দোলনের পেছনে ছিল সেনাবাহিনী। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- নওয়াজ শরিফকে চাপে রেখে সুবিধা আদায় করে নেওয়া। এ স্ট্র্যাটেজিতে একটু ভুল ছিল- বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন সেনাবাহিনী নিশ্চিত করতে পারেনি। পিপিপি বা জামায়াত- কেউই ইমরান খানের আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। ফলে সরকারের পতন হয়নি। দুই. পর্দার অন্তরালে থেকে কলকাঠি নাড়িয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। মোশাররফ এখন অন্তরীণ। তার বিচার হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে নওয়াজকে উৎখাত করেই জেনারেল মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৯ বছর ছিলেন ক্ষমতায়। নওয়াজ শরিফ ক্ষমতা পেয়ে যখন ‘বদলা’ নিতে চাইলেন, সেনাবাহিনীর একটি অংশ এর বিরোধিতা করল। তাই ওই অংশের ‘ষড়যন্ত্র’-এর’ ফলেই মাঠে নামলেন ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি। তিন. পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে একটি শক্তি চাচ্ছে, পাকিস্তানে একটি তৃতীয় শক্তির জন্ম হোক। অর্থাৎ মুসলিম লীগ (নওয়াজ শরিফ) এবং পিপলস পার্টি পিপিপির (জারদারি) বাইরে একটি শক্তি- যারা এ দুটি বড় দলের বাইরে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করবে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো। কিন্তু তা এ মুহূর্তে সফল হয়নি। এ মুহূর্তে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রাধান্য পেল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তা কতদিনের জন্য? আপাতত নওয়াজ শরিফ টিকে আছেন বটে কিন্তু নিঃসন্দেহে এই সংকট থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। বলা ভালো, গত বছরের ১১ মের নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ বিজয়ী হওয়ার পর গত ৪ জুন ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে দু’দুবার তিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু একবারও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ১৯৯০ ও ১৯৯৭- দু’দুবারই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি সেনাবাহিনীর কাছে তিনি কখনোই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পেছনে ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু এবার? তিনি কি পারবেন তার ৫ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে? এ প্রশ্নের জবাব এ মুহূর্তে দেওয়া কঠিন। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়, এর ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। জেনারেল রাহিলকে নিয়ে তার ভয় অনেক। ২০১৩ সালে নভেম্বর জেনারেল রাহিল নয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন। কোনো নয়া সেনাপ্রধান পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই তার সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সম্পর্ক কেমন হয়, সে ব্যাপারটির প্রতিই দৃষ্টি থাকবে অনেকের। নওয়াজ শরিফের জন্যও এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। তার আস্থাভাজন জেনারেল তিনি খুব কমই পাবেন সেনাবাহিনীতে। দুজন পূর্ণ জেনারেল ও ২১ জুন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের মধ্যে তিনি রাহিলকে বেছে নিয়েছিলেন। এখন রাহিলই তাকে চোখ রাঙালেন। কিয়ানির মতোই একজন পাঞ্জাবি জেনারেল যে সেনাবাহিনীর স্বার্থ দেখবে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই এমন কথা ইতোমধ্যে চাউর হয়ে গেছে, বর্তমান সেনাপ্রধান অথবা সেনাবাহিনী যা চাইবে, এর বাইরে যেতে পারবেন না প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর আগামীতে প্রভাব বিস্তার করবে, তা হচ্ছে পাকিস্তানপন্থী তালেবানের সঙ্গে সরকারের সংলাপ ও সংলাপের ভবিষ্যৎ, ভারতের সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী এখন যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন, সেনাবাহিনীর স্বার্থ যাতে বিঘিœত না হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। এক্ষেত্রে সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। সিভিল প্রশাসনকে ক্ষমতায় রেখেই সেনাবাহিনী তাদের প্রভাব অব্যাহত রাখবে।পাকিস্তানের জন্য সমস্যা এখন অনেক। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে গত নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল, তা এখন বিতর্কিত হলো। পাকিস্তানে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধানের ২০তম সংশোধনী এনে সেখানে পরবর্তী নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। সাবেক বিচারপতি মীর হাজার খান খোসো এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেন। তারা সাফল্যের সঙ্গে এই সংসদ নির্বাচন (১৪তম) পরিচালনা করলেও (২০১৩) পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রেখে গেছেন বিভিন্ন প্রশ্ন। বিশেষ করে যে জঙ্গিবাদ পাকিস্তানের অস্তিত্বকে এখন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে, সরকার এই জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে এখন কী পদক্ষেপ নেবে? ৩টি প্রধান জঙ্গি সংগঠনের কথা বলা যায়, যাদের কর্মকা- আজ আন্তর্জাতিক পরিসরেও ব্যাপক সমালোচিত- তেহরিক-ই-তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও জইসই মোহম্মদ। এর মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও জইসই মোহম্মদ পাকিস্তানের বাইরে ভারতে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে হামলার জন্য এ দুই জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করা হয়। এ দুটো সংগঠনের তৎপরতার কারণে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নত হয়নি। অন্যদিকে তেহরিক-ই-তালেবান বেশিমাত্রায় আফগানিস্তানের তালেবান দ্বারা প্রভাবিত। তারা পাকিস্তানের ভেতরেই তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইসলামবিরোধী রাজনীতিকদের হত্যা, জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলা- তাদের অন্যতম কর্মকা-। নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান সংলাপের প্রস্তাব করেছিলেন। ওই সংলাপ আদৌ অনুষ্ঠিত হয় কি না, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। বর্তমান প্রধান বিচারপতি নিজাম-উল-মুলকের ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। ইসলামাবাদে অবস্থানকারীদের উৎখাতের নির্দেশ দিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বোর্ড সবার দৃষ্টি কেড়েছে। কিন্তু অতীত বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহম্মদ চৌধুরী একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মোশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি ফিরেও এসেছিলেন। বিচার বিভাগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক পুরনো। তাই বিচার বিভাগের ভূমিকার দিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টি থাকবেই। পাকিস্তানের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আরও দুটো কারণে সেনাবাহিনী নওয়াজ শরিফকে চাপের মুখে রাখবে। প্রথমটি দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, দ্বিতীয়টি বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা খুবই শোচনীয়। প্রায় ১৮০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৩ শতাংশ। বৈদেশিক রিজার্ভে যা আছে, তা দিয়ে মাত্র দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সাম্প্রতিক রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। বাজেট ঘাটতির হার ৮ শতাংশ। বেকার সমস্যা প্রবল। বিনিয়োগের পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। জাতিসংঘের ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ জবঢ়ড়ৎঃ (ঐউজ) অনুযায়ী ১৮৬ দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ১৪৬-এ। বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২। তুলনামূলক বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। বয়স্কদের মধ্যে ৫৫ শতাংশই অশিক্ষিত। পাখতুনসোয়া প্রদেশ কিংবা ঋঅঞঅ এলাকায় শিশু, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের স্কুলে না যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এমনকি দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ করাচি শহরের ৪ ভাগের ১ ভাগ শিশু স্কুলে যায় না। তবে পাঞ্জাব প্রদেশে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। আইএমএফের সঙ্গে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি নিয়ে আলোচনা আটকে আছে। সরকারের জন্য এটি হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তা এখন মানতে বাধ্য হবে সরকার। বিনিয়োগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ ঘাটতি। ১৫ বছর আগেও পাকিস্তান ছিল বিদ্যুতে সারপ্লাস। তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। বিদ্যুতের লোডশেডিং এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার পাকিস্তানে। দিনের বেশিরভাগই বিদ্যুৎ থাকে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, অসমতা ইত্যাদি সমস্যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থাকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। এদিকে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নওয়াজ শরিফ সরকারকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাকিস্তান-ইরান গ্যাস পাইপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ- আপত্তি রয়েছে। পাকিস্তান জ্বালানি সংকট মেটাতে ইরান থেকে গ্যাস আমদানি করা সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এতে আপত্তি রয়েছে। এমনিতেই পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে অব্যাহত ড্রোন হামলা এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করেছে। বিগত সরকার এই ড্রোন হামলা বন্ধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নয়া সরকারের জন্য বিষয়টি হবে বেশ স্পর্শকাতর। কেননা এ ড্রোন হামলা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি জনমত তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারে ইমরান খান গুলি করে ড্রোন ফেলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের তেমন উন্নতি হয়নি। গত বছর পাকিস্তানের কারাগারে ভারতীয় এক বন্দির মৃত্যু (যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট ছিলেন) কেন্দ্র করে এ সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছিল। একই সঙ্গে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে উন্নয়ন ঘটলেও খোদ বেলুচিস্তানে এর ছোঁয়া লাগেনি। বরং বেলুচদের অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনী দিয়ে তাদের জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। বেলুচিস্তানে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে- যারা স্বাধীন বেলুচ রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে। ওই বেলুচিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে। সম্প্রতি বেলুচিস্তানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। বেলুচিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ইরানি প্রদেশ সিসতান বেলুচিস্তানের। অন্যদিকে বেলুচিস্তানের সাওদারে রয়েছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। চীন এ বন্দরটি নির্মাণ করে দিয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাওদারের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এমনকি সিসতান বেলুচিস্তানের সঙ্গে একত্র হয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন বিচিত্র কিছু নয়। ভারত মহাসাগরে জ্বালানি সরবরাহ লাইন নিশ্চিত রাখা কিংবা তেহরানের কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘চাপে’ রাখার কাজে এই বেলুচিস্তান আগামী দিনে বাইরের শক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সুতরাং পাকিস্তান নিয়ে গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। গত বছর নির্বাচন হয়েছে বটে কিন্তু তা পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি। নওয়াজ শরিফের ক্ষমতায় থাকার কথা ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তবে মাত্র ১৬ মাসের মাথায় সরকার উৎখাতের আন্দোলন শুরু হলো। অনেক ‘খেলোয়াড়’ এখন রাজনীতির মাঠে। সুতরাং নওয়াজ শরিফের দিনগুলো আগামীতে যে সুখের হবে- এটি মনে করার কারণ নেই। লাহোর হাইকোর্ট ইতোমধ্যে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন! তাহিরুল কাদরি আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের ৩১ এমপির পদত্যাগ স্পিকার গ্রহণ করেছেন। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হলো। তাহলে কি পাকিস্তান কোনো বিকল্প প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছে? ‘হত্যা মামলা’য় অভিযুক্ত হয়ে কি নওয়াজ সরে দাঁড়াচ্ছেন? তাই বলছিলাম, পাকিস্তান নিয়ে গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। পর্দার অন্তরালে থেকে গুটি চালাচ্ছে অন্য কেউ। Daily Amader Somoy 31.08.14

পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতার কথা

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের সংকট নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে উৎখাতের জন্য প্রধান বিরোধী দল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ ও ধর্মীয় নেতা তাহিরুল কাদরীর আওয়ামী তেহরিক একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। গত ২০ আগস্ট তারা হাজার হাজার সমর্থককে নিয়ে ইসলামাবাদের ‘রেড জোন’ এলাকায় প্রবেশ করে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেছে। এই আন্দোলনের পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও সেনাবাহিনীও জড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরীকে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য সমন জারি করেছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, যাতে সরকার ও বিরোধী দল একটা সমাধানে উপনীত হতে পারে। সর্বশেষ ঘটনায় ইমরান খানের দলের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। পাকিস্তানের এই সংকট গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। হঠাৎ করেই যেন এই সংকটের সৃষ্টি হলো। গেল বছর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেখানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। নির্বাচন নিয়ে তখন কোনো কথা হয়নি। নওয়াজ শরীফ একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। হঠাৎ করেই ইমরান খান ‘ভোট কারচুপি’সহ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এর মাঝে অন্যতম একটি দাবি হচ্ছে নওয়াজ শরীফের পদত্যাগ ও নয়া নির্বাচন। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরীফের (পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী) পদত্যাগ ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার। নওয়াজ শরীফ ইমরানের সঙ্গে আলোচনায় রাজি থাকলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। পাকিস্তানে এই সরকারবিরোধী আন্দোলনের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফের সম্ভাব্য একটি ভূমিকা আবার সামনে চলে এসেছে। পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি ইমরান খানকে দিয়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, এমন কথাও উঠেছে। অথচ নওয়াজ শরীফের আমলেই জেনারেল রাহিল সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। গোষ্ঠীতন্ত্র পাকিস্তানে কত শক্তিশালী এটা আবারো প্রমাণিত হলো। নওয়াজ শরীফ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তারপরও বিরোধী দলের অসাংবিধানিক আন্দোলনের মুখে পড়তে হলো নওয়াজ শরীফকে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল। থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতাও খুব ভালো নয়। সেখানেও নির্বাচিত একটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল বিরোধী দল। এমনকি বিরোধী দল পার্লামেন্ট, সরকারি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল তখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছিল। একই সঙ্গে সংবিধান স্থগিত করা হয়েছিল এবং সেনাপ্রধান জেনারেল প্রাইউথ নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। এর আগে ৬ মাস ধরেই সেখানে সংকট চলে আসছিল। এই সংকট আরো গভীর হয় যখন গত ৭ মে ২০১৪ দেশটির সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বরখাস্ত করেন। মূলত সংকটের শুরু ২০১৩ সালের অক্টোবরে, যখন ইংলাকের বড় ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দায়মুক্তির বিল সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই বিল নিয়ে দেশে বড় বিতর্কের জন্ম হয়। নভেম্বরে সংসদের নি¤œকক্ষে দায়মুক্তি বিলটি পাস হলেও উচ্চকক্ষে বিলটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। দায়মুক্তি বিলের প্রতিবাদে ব্যাঙ্ককে লক্ষাধিক লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই থেকে থাইল্যান্ডে দিনের পর দিন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। এমনকি বিক্ষোভকারীরা শহরের রাস্তাঘাট দখল করে অবস্থান করে আসছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী ইংলাক একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ক্ষমতাসীন হয়ে থাই পার্টি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিল। প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। যারা থাইল্যান্ডের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতার কারণেই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। ইতিহাস বলে ১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল আর সর্বশেষ (১১তম) সেনা অভ্যুত্থান হয় ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। তবে ওই সেনা অভ্যুত্থানের একটি ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। সাবেক ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান জেনারেল সোনধি বুজিয়ারাত সিনন এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। অতীতে দেখা গেছে, সেনানায়করা রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি দল গঠন করেন। কিন্তু সোনধি তা করেননি। তিনি একটি নির্বাচনের আয়োজন করেন। কিন্তু নির্বাচন সেখানে কোনো রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যার তত্ত্বাবধান করেন জেনারেল সোনধি, তাতে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন সামাক সুন্দরাভেজ। কিন্তু তিনি বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। তিনি পদত্যাগ করেন। তার পরিবর্তে পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সোমচাই ওয়াংসোয়াত। সুন্দরাভেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি সিনাওয়াত্রার খুব ঘনিষ্ঠ। তিনি দায়িত্ব নিলে প্রায় ৩ মাস বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন দখলসহ সরকার উৎখাতের আন্দোলন করে আসছিল। এর নেতৃত্বে ছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেও বিক্ষোভ দমন করতে পারেননি। ওই সময় সেনাপ্রধান বুসরাং নিয়মপ্রাদিতের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের একটা সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত ওই সময় কোনো সেনা অভ্যুত্থান হয়নি। তবে সেনাপ্রধানের চাপে প্রধানমন্ত্রী সোমচাই ওয়াংসোয়াত পদত্যাগ করেছিলেন এবং বিরোধী দল নেতা অভিজিত ভেজাজিভার নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি কখনো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সিনাওয়াত্রার থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছি। কিন্তু সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) গঠন করে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং বিজয়ী হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ৪৮০টি আসনের মাঝে পিপিপি ২৩২টি আসন পেয়েছিল। পিপিপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তারা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। পিপিপি যেহেতু জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়েছিল ও জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল, সেহেতু তাদের টার্ম পূরণ করতে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচনের এক বছর পরপরই শুরু হয়েছিল সরকার উৎখাতের আন্দোলন। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন-আর তা হচ্ছে সাংবিধানিক আদালতের ভূমিকা। সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী সুন্দরাভেজকেও অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। ইংলাককেও অযোগ্য ঘোষণা করেছিল এই আদালত। থাইল্যান্ডের রাজনীতি কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা, যারা ‘রেড শার্ট’ ধারী হিসেবে পরিচিত। থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ হলে তারা সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টির ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরে তারা সিনাওয়াত্রার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বে গঠন করে গয়ে থাই পার্টি। এরা লাল শার্ট পরিধান করে বিধায় তাদের আন্দোলনকে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে সিনাওয়াত্রার বিরোাধতা ‘ইয়োলো শার্ট’ এর ব্যানারে সংগঠিত, যে কারণে তারা ‘ইয়েলো শার্ট’ আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচিত। এভাবেই থাইল্যান্ডের রাজনীতি ‘লাল শার্ট আর ‘হলুদ শার্ট’ এর মাঝে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ইংলাক এভাবেই ‘রেড শার্ট’ আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। এটা সত্য, জনগণের ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ ছিল ভাইয়ের (থাকসিন সিনাওয়াত্রা) ছত্রছায়ায় তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন। থাকসিন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের শীর্ষ ধনীদের একজন। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তার দেশে আসাও নিষিদ্ধ। ফলে ইংলাক যখন ভাইকে দায়মুক্ত দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদে একটি বিল আনেন, তখন তা বিতর্কের জন্ম দেয়। এটা স্পষ্ট যে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই দায়মুক্তির বিরোধী। থানসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গেও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভালো ছিল না কখনো। ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার জন্ম হলেও সেনা অভ্যুত্থান হয়নি এবং সেনাবাহিনী ক্ষমতাও ধরে রাখেনি। সম্ভবত সেনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন যে সেনা অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রচণ্ড ‘চাপ’-এর মুখে থেকেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখেনি। তারা সরকার পরিবর্তন করিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু ক্ষমতায় যায়নি। এখন ২০১৪ সালে এসে জেনারেল প্রাইউথ-এর ভূমিকা ও সম্ভাব্য একটি দল গঠন করে ক্ষমতা পরিচালনা করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে সেনা অভ্যুত্থান ও দীর্ঘদিন তাদের ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম থেকে আশির দশকে পৃথিবীর একাধিক দেশে (আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য) সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সেনা শাসকরা যথেষ্ট জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন (মুস্তাফা কামাল তুরস্কে, নাসের মিসরে, পেরেন আর্জেন্টিনায় কিংবা শ্যাভেজ, ভেনিজুয়েলা)। নব্বই দশকের পর থেকেই এই প্রবণতা কমতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এর কোনো সমর্থনও নেই। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে ৪টি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়, যা সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী প্রথম ক্ষমতা দখল করে ১৯৩২ সালে। সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ফি বুন ১৯৩২ সালে ক্ষমতা দখল করে গঠন করেছিল ‘সেরি মানাংখাছিলা’ পার্টি। ১৯৫৭ সালে জেনারেল ফি বুনের পতন ঘটলে তার দলেরও বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৫৭ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন জেনারেল সারিত, গঠন করেছিলেন ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি।’ ১৯৬৩ সালের নির্বাচনে নতুন একটি দল ‘ইউনাইটেড থাই পিপলস পার্টি’ গঠিত হয়েছিল। আর্মি কমান্ডাররা এ দলের সদস্য ছিলেন। তবে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে গঠিত কোনো রাজনৈতিক দল পরিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে কিনা সে ব্যাপারে সমাজ বিজ্ঞানীদের মাঝে দ্বিমত আছে। মূলত এক ধরনের ‘প্রেট্রোনাইজেশন’ ও ক্ষমতায় সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখে। যেমন ইন্দোনেশিয়ায় জেনারেল সুহার্তো গোসফার পার্টি গঠন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন (১৯৬৫-১৯৮১)। সেনাবাহিনীর সেখানে সরাসরি সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকত। এখন অবিশ্যি গোলকাপের কাঠামোয় বড় পরিবর্তন এসেছে। মিসরেও বারেবারে সেনা নেতৃত্ব দল গঠন করেছেন, যার সঙ্গে সনাতন রাজনৈতিক দলের কোনো মিল ছিল না। নাসের, সাদাত কিংবা মোবারক সবাই এক একটি দলের ছত্রছায়ায় তাদের ক্ষমতা ধরে রাখাকে নিয়মসিদ্ধ করে নিয়েছিলে। ২০১১ সালে আরব বসন্ত সেখানে একটি পরিবর্তন ডেকে আনলেও মিসর আবারো পুরনো দিনে ফিরে গেছে। জেনারেল সিসি শুধু নাসের সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের পদঙ্ক অনুসরণ করছেন। একটা দলও তিনি করবেন! থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী মূলত একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠেছে। ব্যবসা, আমদানি-রফতানির একটা সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা (মিসরে এটা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবে)। আর সম্ভবত সিনাওয়াত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্বটা এখান থেকেই শুরু। কেননা টেলি কমিউনেশন খাতসহ বেশ কিছু খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সিনাওয়াত্রা পরিবার। ফলে সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক কখনই সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। এখানে সিনাওয়াত্রার একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন জনপ্রিয়। তিনি সাধারণ মানুষের উন্নয়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থান, সাধারণ মানুষের মানোন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ফলে তিনি নিষিদ্ধ হলেও তার সমর্থকদের (লাল শার্ট আন্দোলন) সাধারণ মানুষ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। অন্যদিকে ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনকারীরা, যারা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ব্যানারে সংগঠিত এবং যাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সখ্য রয়েছে বলে ধরা হয়, তারা মূলত অভিজাততন্ত্র, ধনী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে স্পষ্টতই থাই রাজনীতি দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। এখন জেনারেল প্রাইউথ তথাকথিত একটি পার্লামেন্টের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। কিন্তু পাকিস্তানে কী হবে? সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফকে কী উৎখাত করবে? ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানে কোনো অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবে না। এতে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে যুক্তরাষ্ট্র নওয়াজ শরীফের পেছনে আছে। পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে মিলটা এখানেই। সেনাবাহিনী উভয় দেশেই শক্তিশালী। উভয় দেশেই সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতার অভাবে গণতান্ত্রিক ধারা সেখানে ব্যাহত হচ্ছে। পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এখন দেখতে হবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিনা। থাকসিন সিনাওয়াত্রা যেমনি সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, ঠিক তেমনি নওয়াজ শরীফও সেনাবাহিনীর পছন্দের পাত্র নয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নওয়াজ শরীফকেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল। তারপর দীর্ঘদিন জেনারেল মোশাররফ পাকিস্তানি শাসন করেছে। আজ পাকিস্তান তেমনি এক পরিস্থিতির মুখোমুখি। Daily Manobkontho 26.08.14

ব্রিকস ব্যাংক কি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হতে পারবে?

যারা আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা সাম্প্রতিক দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে গভীরভাবে দৃষ্টি রেখেছেন। এর একটি হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আর্জেন্টিনার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি গত ১৫-১৭ জুলাই ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। এই দুটি ঘটনার সঙ্গে একটা মিল আছে- আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ফোরামে আলোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পাল্টা আরেকটি বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা কখনও জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়নি। এবারই প্রথম ব্রিকসের নেতারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। অনেকের মনে থাকার কথা, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ও অর্থ সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে এটাও সত্য, অন্যান্য প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়নি। এখন ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী ব্রিকসের সদস্য ৫টি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) রাষ্ট্রদূতদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ব্রিকস ব্যাংকের সদস্যপদ পেতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন। বাংলাদেশ একই সঙ্গে চীনের প্রস্তাবিত এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে। ব্রিকস ব্যাংক কিংবা এআইআইবির ব্যাপারে এখনও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে এআইআইবি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আগামী অক্টোবরে আসতে পারে, এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছে।ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটি আপাতত ৫ হাজার কোটি ডলারের মূলধন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। ভারত এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে। ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় হবে চীনের সাংহাইয়ে। ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত যে কিছুটা হলেও বিশ্বব্যাংককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, তা গেল সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের ভারত সফরের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। মি. কিম ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। কিমের সঙ্গে আলোচনার পর অরুণ জেটলি বলেছিলেন, ভারত মনে করে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। ভুলে গেলে চলবে না, চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই তার স্থান। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের (আইসিপি) মতে ভারত জাপানকে হটিয়ে দিয়ে ২০১১ সালে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। অথচ ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল।আইসিপি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করে। তাদের রিপোর্ট থেকেই জানা যায়, ২০১১ সালে বিশ্ব ৯০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে। তবে এর মোট উৎপাদনের অর্ধেকই নিু ও মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশগুলো থেকে আসে। আইসিপির প্রধান পর্যবেক্ষণ হল, বিশ্বের ১২টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের ৬টিই মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশের অন্তর্গত। ১২টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ সম্মিলিতভাবে উৎপাদন করে বিশ্ব অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ। আর বিশ্বের ৫৯ শতাংশ লোক এই ১২টি দেশে বসবাস করে বলে আইসিপি তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। ক্রয়ক্ষমতার অসমতা (পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি- পিপিপি) অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৯০ হাজার ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় বিনিময় হার অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৭০ হাজার ২৯৪ বিলিয়ন ডলার। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থাকবে, মাত্র ৫টি দেশ নিয়ে গঠিত ব্রিকস কতদূর যেতে পারবে? ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা আর্জেন্টিনার মতো দেশ অদূর ভবিষ্যতে ব্রিকসে যোগ দেবে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন।বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে উন্নয়নশীল বিশ্বে। বিশ্বব্যাংক সমাজসেবা করে না। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা যে সাহায্য দেয়, এটা তাদের বিনিয়োগ। সুদসহ তারা আসল বুঝে নেয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পলিসি নিয়ে নানা কথা আছে। যারা পল ব্যারেন, রাউল প্রোবিস, গ্রাহাম হেনকক, পল সুইজি, এজি ফ্রাংক কিংবা সামির আমিনের লেখার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঋণ কেন দেয়, তাদের স্বার্থ কী এবং ঋণের বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তি কী। তাই শুধু ভারত নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বব্যাংকের সংস্কার দাবি করে আসছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে (২০১৩) প্রদত্ত ভাষণে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া ৬০ বছরের পুরনো ক্ষমতার সমীকরণের প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, বেটন উডস (১৯৪৪) সম্মেলনের পর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত। আজকে প্রধানমন্ত্রীর এই কথারই প্রতিধ্বনি করলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বকে আর্থিক সহায়তা দেয়, এটা সত্য। কিন্তু শর্ত থাকে শুধু তাই নয়, তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশেও বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা একেবারে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে বলা হলেও বিশ্বব্যাংক আর ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ এখন স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে।বিশ্বব্যাংকের ঋণের সঙ্গে কাঠামোগত সামঞ্জস্যের একটি কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। এটা হচ্ছে এক ধরনের সুপারিশমালা। বিশ্বব্যাংক ঋণের শর্ত হিসেবে এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের কথা বলে থাকে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যের নামে বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত আরোপ করে থাকে তা অনেকটা এ রকম : ১. গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ২. সরকারি ব্যয় হ্রাস, ৩. শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, ৪. প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, ৫. দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, ৬. জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, ৭. কর ও সুদের হার বাড়ানো, ৮. আমদানি অবাধ করা, ৯. মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশ এবং সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এখন কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় ঋণ পেয়ে থাকে। কিন্তু তাতে করে কি ঋণ গ্রহীতা দেশের অর্থনীতিতে তেমন পরিবর্তন এসেছে? কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এর জবাব দেয়া যেতে পারে। ১৯৭৭-৮৫ সময়ে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা অনুযায়ী কাঠামোগত সামঞ্জস্যের শর্তাবলী গ্রহণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, এর ফলে মাথাপিছু আয় শতকরা ২০ ভাগ কমেছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ ভাগে, সেই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। আরও একটি কথা। ঋণ দেয়া হয় সাধারণত ধনতন্ত্র কায়েম করতে এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি রোধ করতে। অনেক জাতীয়তাবাদী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে শুধু তাদের কথামতো না চলার জন্য (ইরানেয় মোসাদ্দেক ১৯৫৩ সালে, গুয়াতেমালায় আরবেনজ ১৯৫৪ সালে, ব্রাজিলে গাউলাট ১৯৬৪ সালে, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন ১৯৬৫ সালে, ঘানায় নক্রুমা ১৯৬৬ সালে, মালিতে কাইটা ১৯৬৮ সালে, চিলিতে আলেন্দে ১৯৭৩ সালে)। ১৯৭২-৭৬ সময়ে আর্জেন্টিনায় পেরনিস্টরা কিংবা ব্রাজিলে গাউলাট বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ পাননি। কেননা তাদের রাজনীতিতে পুঁজিবাদী বিশ্ব সন্তুষ্ট ছিল না। অথচ তারা যখন উৎখাত হন, তখন থেকেই এই দুদেশে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। শুধু ১৯৭৬ সালে এককভাবে আর্জেন্টিনা বিশ্বব্যাংক থেকে যত ঋণ পেয়েছে, এর আগের ২০ বছরেও দেশটি বিশ্বব্যাংক থেকে এত ঋণ পায়নি।বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই থেকে সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় কাজ করে যাচ্ছে। এতে করে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে (কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য, সরকারি সম্পদের ব্যবহার, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারি ব্যয়নীতি, বহিঃখাত, অর্থখাত সংশোধন, মানব সম্পদ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ নীতি) করণীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সেচ উপকরণ আমদানি ও বিতরণ ব্যবস্থা সহজীকরণ, আমদানির ওপর আরোপিত শর্তাবলী তুলে দেয়া ও রফতানি ভর্তুকি ব্যবস্থা বাতিল করা, ভ্যাট প্রথা প্রবর্তন, পাট, বস্ত্র, রসায়ন, ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থাকে বেসরকারিকরণ, রেলওয়ের ঘাটতি দূরীকরণ, প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হ্রাস, রফতানি বহুমুখিকরণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা, শিল্পায়ন ইত্যাদি বিষয়েও দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর বিভিন্ন সুপারিশমালা রয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছে? দারিদ্র্র্য কিংবা চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমেনি। দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে (২০০৮)। রাষ্ট্রকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় আর চক্রবৃদ্ধি হারে সেই ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে, ঋণ আর শোধ হয় না। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে এক ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮৮ টাকা, আজ সেখানে টাকার বিনিময় হার ৭৯ টাকা। ঋণের শর্ত হিসেবে আমরা টাকার মান নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু দারিদ্র্য কমেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বটে, কিন্তু এতে করে উপকৃত হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও রাজনীতিক। তথাকথিত কনসালটেন্সির নামে কিছু বুদ্ধিজীবী তথা শিক্ষকের পকেট ভারী হয়েছে মাত্র!মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক থেকে একবার ঋণ নিলে সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা যায় না। ব্রাজিল একবার ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ডিফল্টার হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক দেশটিকে আবারও ঋণ দিয়েছিল, যাতে ব্রাজিল ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। না হলে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিত। এজন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লেও বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়া অব্যাহত রাখে।আজ তাই বিশ্বব্যাংকের যে সংস্কারের কথা উঠেছে, তাতে অযৌক্তিক কিছু নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আদৌ সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেবে, এটা মনে হয় না। তাই সঙ্গত কারণেই ব্রিকস ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এর ভবিষ্যৎ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। দুই বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীন ও ভারতের মাঝে সম্পর্ক আগামী দিনে কোন পর্যায়ে দাঁড়ায়, চীনের ভূমিকা ব্যাংক পরিচালনায় কী হবে, কিংবা ঋণের ধরন কী হবে- এসবের ওপর ব্রিকস ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বলা ভালো, মোট ১০ হাজার কোটি ডলার মূলধন নিয়ে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করছে। এক্ষেত্রে চীন একাই দেবে ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিল দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার করে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা দেবে ৫০০ কোটি ডলার। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনগণ ও ২৫ শতাংশ এলাকা এ দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং তারা বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশের অধিকারী। ব্রিকস দেশগুলো বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং ব্রিকস ব্যাংকের ব্যাপারে আমাদের একটা আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর্জেন্টিনার ঋণের পরিমাণ এখন ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কে অবস্থিত বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কিরসনার সরকারের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ৩০ জুনের মধ্যে আর্জেন্টিনার ৫৩৯ মিলিয়ন (সুদ ও আসল) পরিশোধ করার কথা থাকলেও আর্জেন্টিনা তাতে ব্যর্থ হয়। আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। গত বছর ডলারের সঙ্গে পেসোর (আর্জেন্টিনার মুদ্রা) অবমূল্যায়ন হয়েছে শতকরা ৩৫ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের নীতি অনুসরণ করতে গিয়েই আর্জেন্টিনার এই দুরবস্থা।আর্জেন্টিনার এই ঘটনাটি সারা ল্যাটিন আমেরিকায় আলোড়ন তুলেছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, প্রস্তাবিত ব্রিকস ব্যাংক নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং লুটপাটের হাত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করবে। আর বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের মন্তব্য : নয়া উপনিবেশবাদের ছায়া থেকে রক্ষা করবে এই ব্যাংক। শুধু ভেনিজুয়েলা বা বলিভিয়াই নয়- চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডরসহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিটি দেশ প্রস্তাবিত ব্রিকস ব্যাংক গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা ব্রিকসের নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। এমনকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা আর্জেন্টিনাকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা করবেন।তবে ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাজটি খুব যে সহজ হবে, তা বলা যাবে না। পাঁচ উদ্যোক্তা দেশের সংসদে ব্রিকস ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, চীন-ভারত সম্পর্ক, তাদের ভেতরকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্রিকস ব্যাংক গঠনে প্রভাব ফেলবে। যেখানে চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ ভাগ (২০১৩), সেখানে ভারতে মাত্র ৫ ভাগ (২০১৩)। চীনে মাথাপিছু আয় বছরে ১১ হাজার ৮৫০ ডলার, আর ভারতে ৫ হাজার ৩৫০ ডলার। চীনে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমছে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যা অর্থনীতিকে চাপের মুখে রাখবে। ভারতে বাড়বে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা। বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় যেখানে চীনের অবস্থান ২৯তম, সেখানে ভারতের অবস্থান ৬০তম। জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ১০২তম। চীনের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক ভালো। ফলে এই দুটি বড় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, পার্থক্য ব্রিকস ব্যাংক গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে। চীনের ভূমিকা নিয়েও থাকবে প্রশ্ন। সুতরাং ব্রিকস ব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বে বড় ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারলেও সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, সেটাই দেখার বিষয়। Daily JUGANTOR 25.08.14

ইসলামিক স্টেট আল কায়েদা ও আরব বিশ্বের চলমান রাজনীতি

অনেকগুলো কারণে আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক রাজনীতি আজ আলোচিত। প্রথমত, ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও এর নেতা কর্তৃক সমগ্র মুসলিম বিশ্ব নিয়ে একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা। দ্বিতীয়ত, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা এবং এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি। তৃতীয়ত, ইরাকের কুর্দিস্তানের সিনজার পর্বতমালাসংলগ্ন সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সাম্প্রদায়কে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অব্যাহত মার্কিন বিমান হামলা। প্রেসিডেন্ট ওবামা জানিয়েছেন, এই বিমান হামলা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইতোমধ্যে আইএসের জঙ্গিরা প্রায় ৭০০ ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করেছে। চতুর্থত, ইরাকে ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতার মুখে মালিকি সরকারের পতন ঘটেছে। সেখানে হায়দার আল আবাদির নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই সরকার ইরাককে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পঞ্চমত, আরব বসন্ত গোটা আরব বিশ্বে যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়ায় জঙ্গি তৎপরতা সেই সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছে। তবে যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, তা হচ্ছে মুসলমান বিশ্বে এখন জঙ্গি তৎপরতার নেতৃত্ব দেবে কে- আল কায়েদা নাকি ইসলামিক স্টেট? আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আল কায়েদার তৎপরতা থেমে থাকেনি। বরং আরব বিশ্বে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আল কায়েদার জঙ্গিরা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আল কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা, আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরের, আল কায়েদা ইন ইরাক কিংবা আল গামা আল ইসলামিয়া (মিসর), আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া) প্রভৃতি সংগঠনের নাম ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় এসেছে, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত। এদের তৎপরতা যখন সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটল ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অভিযোগ আছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখন এদের সঙ্গে আল কায়েদার জঙ্গিদের সম্পর্ক কী দাঁড়াবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। সঙ্গত কারণেই তাই আরব বিশ্বের চলমান রাজনীতি এই মুহূর্তে আলোচনার অন্যতম বিষয়। এই মুহূর্তে আরব বিশ্বে আলোচিত বিষয় একটি- আর তা হচ্ছে জনৈক আবু বকর আল বাগদাদি কর্তৃক খিলাফতের আহ্বান ও নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণা। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের গৃহযুদ্ধের সূত্র ধরে আবির্ভূত হয়েছে ‘দি ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট’ (আইএসআইএস) নামে একটি সংগঠন। তাদের বর্তমান নাম ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এরা সুন্নি সাম্প্রদায়ভুক্ত। সিয়া প্রভাবাধীন ইরাকে এরা শুধু ক্ষমতাসীন সরকারকেই উৎখাত করতে চায় না, বরং ইরাক ও সিরিয়া নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রটি পরিচালিত হবে সম্পূর্ণভাবে আদি ইসলামিক শাসনব্যবস্থার আদলে। ইতোমধ্যে ইরাকের একটা বিশাল অংশ আইএসের গ্যারিলারা দখল করে নিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল শোধনাগারটিও দখল করে নিয়েছে এই জঙ্গিরা। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইরাকে ক্ষমতাসীন সাবেক মালিকি সরকারকে সাহায্যে ওবামা প্রশাসন এগিয়ে আসেনি। শুধু তাই নয়, আইএসের আগ্রাসন ঠেকাতে ইরাকে পুনরায় সেনা পাঠাতেও অপারগতা প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীপ্রধান। সেখানে কিছু মার্কিনি সেনা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তা করা হয়েছে শুধু মার্কিন দূতাবাস ও দূতাবাস স্টাফদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। বিমান হামলা চালানো হয়েছে বটে। তবে তা একটি সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য। সারা মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বজুড়ে ইসলামিক জঙ্গিবাদের উৎখাত নতুন কোনো ঘটনা নয়। আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন আরব বিশ্বে, বিশেষ করে ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়ায় তৎপর। ‘আল কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরের’, ‘সালফিস্ট গ্রুপ ফর প্রিচিং অ্যান্ড কমম্যাট’ কিংবা লিবিয়ায় ‘ইসলামিক ফাইটিং গ্রুপ’, ‘আবদেল হাকিম বেলহাদন গ্রুপ’, সিরিয়ায় আল নুসরা ফ্রন্ট নিয়ে আমি ইতোপূর্বে এই প্রবন্ধের শুরুতে আলোকপাত করেছি। কিন্তু আইএসের উত্থান একেবারেই নতুন এবং সংগঠনটির খিলাফতের আহ্বানও নতুন একটি বিতর্কের মাত্রা দিয়েছে। ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি তথা আরব বিশ্বের রাজনীতি এখন এই খিলাফতের ধারণাকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখানে বলা ভালো সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী ইসলামি জঙ্গিবাদের যে বিস্তার ঘটেছে, তাতে কখনো সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে একটি খিলাফতের কথা বলা হয়নি। আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ওমর জিহাদের ডাক দিয়েছেন বটে, কিন্তু কোনো ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। তাদের মূল টার্গেট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য। কিন্তু এখন আইএসের উত্থান ও আবু বকর আল বাগদাদির খিলাফতের ঘোষণা পুরো দৃশ্যপটকে বদলে দিল। অনেকগুলো প্রশ্ন এখন আছে। এক. এই খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান কতটুকু ধর্মসম্মত? কিংবা এর বাস্তবতা কতটুকু? দুই. আইএসের আসল উদ্দেশ্য কী? তিন. মার্কিন তথা পশ্চিমা বিশ্ব এই আহ্বানকে এখন কোন চোখে দেখবে? তাদের ভূমিকা কী হবে? চার. সনাতন আরব বিশ্বে, বিশেষ করে সৌদি আরবে এর প্রতিক্রিয়া কী? যারা আরব বিশ্বের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তারা জানেন খিলাফতের ধারণা বেশ পুরনো। এখন আর আরব বিশ্ব খিলাফত নিয়ে কেউ কথা বলেন না। তথাকথিত জিহাদের ডাক দিয়ে আল কায়েদার জন্ম হয়েছিল। এরা জড়িত ছিল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মঘাতী বোমারু তৈরি করা, সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করা, প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার নাম আর যাই হোক ইসলাম নয়। আমাদের দেশে যারা ইসলাম প্রচার করার জন্য এক সময় আরব দেশ থেকে এসেছিলেন, তারা এভাবে ইসলাম প্রচার করেননি। একে-৪৭ রাইফেল হাতে নিয়ে আর পুঁজিবাদের প্রতীক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে দিলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। এ কারণেই ওসামা বিন লাদেনের কর্মকা- বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। যেহেতু তিনি অন্যায় করেছেন এবং অভিযুক্ত, সেহেতু তার বিচার হওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের বিচার তো হচ্ছে। যারা বসনিয়া, রুয়ান্ডা কিংবা কসোভোতে গণহত্যা চালিয়েছিল, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার হচ্ছে। লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডায় যারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদেরও বিচার হচ্ছে। চার্লস টেলর কিংবা রুয়ান্ডার সাবেক প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আজ বিচারের মুখোমুখি। পানামার নরিয়েগাকে যুক্তরাষ্ট্র পানামা থেকে ধরে নিয়ে এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জেল থেকে এখন তাকে পানামার জেলে পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী ইউরোপে ‘অপরাধ’ করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধ সংঘটিত করা, শান্তি বিঘিœত করা। ১৯৪৫ সালে গঠিত International Military Tribunal (Nurenburs)-এ তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছিল। বিচার তাদেরও হয়েছিল, যারা দূরপ্রাচ্যে (Far East) অপরাধ সংঘটিত করেছিল। ১৯৪৬ সালে গঠিত হয়েছিল International Military Tribunal for Far East (Japan)। জাপানি যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেনও তো একই ধরনের অপরাধ করেছেন- মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধ ও হত্যাকা-। এর জন্য উপযুক্ত জায়গা ছিল হেগে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে তাকে তার অপরাধের জন্য ‘বিচার’ করা যেত। তা না করে যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডো পাঠিয়ে তাকে হত্যা করল। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের হত্যা অনুমোদন করে না। এমনকি কোনো দেশের সীমান্ত লংঘন করাও আন্তর্জাতিক আইনে ‘অপরাধ’। International law association 2010 সালের আগস্টে হেগে একটি আইন অনুমোদন করেছিল। তাতে বলা হয়েছে,Calls on all state to observe carefully the distinction between situations of armed conflict as defined in international law and situation of peace in developing and carrying out policies involving the use of lethal force, detention and trials, asylum obligation, and other relevant state action. European court of Human rights (ECHR) ১৯৯৫ সালে সংঘটিত একটি ঘটনার রায় দিয়েছিলেন, যে ঘটনার সঙ্গে ‘বিন লাদেনের’ ঘটনার অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। মামলাটি ছিল ম্যাককেন (Mc cann) বনাম যুক্তরাজ্য- এই মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন IRA সদস্যরা। যাদের জিব্রালটারে হত্যা করেছিল ব্রিটিশ ঝঅঝ বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল SAS সদস্যরা বোমা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঊঈঐজ তখন রায় দিয়েছিলেন IRA উচিত চিল তাদের গ্রেপ্তার করা। যদি সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টা করতেন, তাহলে তারা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারতেন। এখন লাদেনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কি সে রকম দাঁড়াল না? লাদেন নিরস্ত্র ছিলেন। জিব্রালটার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত এলাকা নয়। পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ। সেই স্বাধীন দেশের সীমানায় অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ করে একজন ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করা অপরাধ ও স্থানীয় তথা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের শামিল। Inter American courtও বলছেন, সন্ত্রাস দমনের নামে অস্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহারের বৈধতা দেওয়া যায় না (আইনের অধ্যাপক Mary O’connell (Notre dame)-এর প্রবন্ধ The bin laden aftermath : abbottabad of international law, AFPAK channel, 4 may)। যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ নিক গ্রিফ লন্ডনের গার্ডিয়ানে ঠিক এ প্রশ্নটিই তুলেছিলেন যে, লাদেনের হত্যাকা- আইনসম্মত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকর্মী জিওফ্রে বরাটসনের মতো অভিযোগ সাবেক পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফেরও। এর খারাপ দিকটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যাকে ‘শত্রু’ মনে করবে, তাকে হত্যা করতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা জাতিসংঘ সনদ ৪.১ ও ৪.৪-এর পরিপন্থী, যেখানে ‘সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তা’র কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এই ভূমিকা বিশ্বে পুনরায় স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে বাধ্য। লাদেন নিঃসন্দেহে বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। তিনি ইসলাম ধর্মকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন অনেকেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু ইসলাম ধর্মকে তিনি নতুন এক ‘ব্র্যান্ড’-এ উপস্থাপন করেছেন, যা সন্ত্রাসী ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। এটা ইসলাম নয়। কোটি কোটি মানুষ, যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তারা এই সন্ত্রাসী কর্মকা-কে বরং ঘৃণাই করবেন। তবে ভেবে দেখতে হবে, ওসামার উত্থান কেন হল। অনেক গবেষক মনে করেন, ওসামার উত্থানের পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের বিকল্প। ওসামা সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে ‘বিকল্প’ উপস্থাপন করেছিলেন (Niall Ferguson-এর প্রবন্ধ Foreign Affairs, april 2005) বিশ্বায়নের বিকল্প হচ্ছে ইসলাম কিংবা মিসরের প্রখ্যাত প-িত সাঈদ কুতুব (Sayyid Qutb)-এর ব্যাখ্যা Islam is the solution(ইসলামই একমাত্র সমাধানের পথ) মতবাদে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কিছুটা আস্থা খুঁজে পেলেও ওসামা যেভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে ইসলামকে উপস্থাপন করেছেন, সে ব্যাপারে আপত্তি উঠেছিল খোদ মুসলিম বিশ্ব থেকেই। ওসামা মূলত ছিলেন ‘ওয়াহিবজম’-এর প্রবক্তা। এরা সালাফি বা আদিপন্থী হিসেবেও পরিচিত। সৌদি রাজপরিবার এই ওয়াহিবজম মতবাদে বিশ্বাসী (১৭০৩ সালে জন্ম নেওয়া মুহম্মদ ইবন আবদ আল ওয়াহাব ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন)। ‘ওয়াহিনী’ মতবাদে জিহাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ওসামা বিন লাদেন মূলত ওয়াহিনী মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে যে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম সন্ত্রাসবাদকে যে সমর্থন করে না- মুসলিম বিশ্ব এটা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যার পরিণামে ৯/১১-এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, তা লাদেনের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ (Bush Doctrine) ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নতুন এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন (Preemtive attack- শত্রুর আঘাত করার আগেই শত্রুকে আঘাত করে শেষ করে দেওয়া। দৃষ্টান্ত ইরাক)। আর ওবামা এটাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন (Humanitarian Intervention, লিবিয়া)। মনে রাখতে হবে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এ টার্গেট করা হয়েছে মুসলমানদের। শুধু মুসলমানদেরই সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে। ইহুদি সন্ত্রাসীদের টার্গেট করা হয়নি। কিংবা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই প্রেসিডেন্ট ওবামার দেওয়া সর্বশেষ সিদ্ধান্তটিও বিতর্ক সৃষ্টি করবে। ইহুদি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান না পাঠিয়ে তিনি পাঠালেন ইরাকে! বিশ্ব এক জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই আইএসের জন্ম দেওয়া হয়েছে। বলে রাখা ভালো, আইএস কিন্তু হামাসের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি। বরং হামাসের বিরোধিতা করেছে। এখন সুন্নি জঙ্গিদের উত্থান কী পুনরায় মার্কিন সেনা ইরাকে মোতায়েনের পথ প্রশস্ত করবে- সেটাই দেখার বিষয়। Daily AMADER SOMOY 23.08.14

মন্ত্রীর কথায় কতটুকু আস্থা রাখা যায়

হাসানুল হক ইনু জাসদের সভাপতি এবং বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী। তার আমলেই প্রণীত হলো জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪। এই নীতিমালা শুধু সংবাদপত্র কর্মীরাই সমালোচনা করেননি, সুধী সমাজের একটা বড় অংশের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিএনপি এই নীতিমালার সমালোচনা করেছে। এর মধ্যে রাজনীতি আছে ধরে নিলেও সুধী সমাজের সমালোচনাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? নীতিমালা বিতর্কিত হওয়ায় খুব সঙ্গত কারণেই আলোচনা এখন তথ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। এই নীতিমালা প্রণয়নে তার ভূমিকা কি ছিল কিংবা তিনি কতটুকু প্রভাব খাঁটিয়েছিলেন, এর ব্যাখ্যা হয়তো আমরা কোনোদিনই পাব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই নীতিমালার ভালো, মন্দ সবকিছুর জন্য তথ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সম্প্রতি তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।’ শুধু তাই নয় তিনি এমন কথাও বলেছেন যে, ‘সম্প্রচার মাধ্যমকে একটি গতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছে। এটা গণমাধ্যম জগতে নতুন দিন উšে§াচনকারী পদক্ষেপ। বিকাশমান সম্প্রচার জগত গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে। বহুবাদ ও বৈচিত্র্য বজায় থাকবে।’ তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য সংবাদকর্মীদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা সংবাদকর্মীদের বক্তব্যের মধ্যে থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদকর্মীদের একটা বড় অংশই মনে করেন সংবাদপত্র ও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যই এই নীতিমালা। মন্ত্রী সাহেব যুক্তি দেখিয়েছেন এটা কোনো আইন নয়। এই নীতিমালার ভিত্তিতেই আইন প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু নীতিমালাটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট একটা নির্দেশনা অর্থাৎ বলে দেয়া হচ্ছে মিডিয়ায় কোনটা যাওয়া উচিত, আর কোনটা যাওয়া উচিত নয়। নীতিমালার প্রতিটি লাইনে, অনুচ্ছেদে এক ধরনের নির্দেশনা আছে। মুক্ত তথ্য প্রবাহের যুগে রাষ্ট্র এই কাজটি করতে পারে না। এই নীতিমালা শুধু সংবিধানের সঙ্গেই সাংঘার্ষিক নয় বরং একই সঙ্গে তথ্য অধিকার আইনেরও বরখেলাপ। সাধারণত অতীতে আমরা দেখেছি দেশে যখন সামরিক আইন জারি হয়, তখন তথ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন এই ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করবে? এটা তো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে মানুষ এমনটা প্রত্যাশা করে না। ইতোমধ্যে নীতিমালা নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তা খুব আশার কথা নয়। যাদের জন্য এই নীতিমালা করা, তারাই যদি এই নীতিমালা প্রত্যাখান করেন, তাহলে এই নীতিমালার গ্রহণযোগ্যতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন এবং নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে দ্বিতীয়তবার চিন্তা করবেন। নীতিমালা গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকরী হয়েছে। ইতোমধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। টক শোগুলো ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়ে গেছে এক রকম। সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত বেশ ক’জন শিক্ষক তথা বুদ্ধিজীবীকে ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। বেশ ক’জন অধ্যাপক রয়েছেন, যারা টিভি টক শোতে বেশ জনপ্রিয়, তাদের এখন আর টক শোতে দেখা যায় না। তারা নিজেরাই অভিযোগ করেছেন, তারা টিভিতে ‘নিষিদ্ধ’! যদিও আমি নিজে দু’একজন সঞ্চালককে ফোন করে জানতে চেয়েছি মূল বিষয়টি আসলে কী? তারা আমাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এটা তো ঠিক টক শোগুলোতে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি এখন বেশি। এটা অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে। একটা সিন্ডিকেট এই টক শোগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে যদি চলে, তাহলে টক শোগুলো অচিরেই তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে! আমি বেশ কিছু লেখাতে বলার চেষ্টা করেছি টক শোগুলো হচ্ছে গণতন্ত্র চর্চার বিকল্প মাধ্যম। যেহেতু সংসদ সঠিকভাবে কাজ করছে না। বিগত সংবাদগুলোতে বিরোধী সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ এক রকম ছিলই না। বর্তমান সংসদ (দশম) যারা বিরোধী দলে আছেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং দলীয় প্রধানই যুক্তি তুলে ধরেছেন। সংসদে বর্তমানে কোনো জাতীয় ইস্যু আমি আলোচিত হতে দেখিনি। কোনো জাতীয় ইস্যু যদি আলোচনা না হয়, তাহলে জাতি দিকনির্দেশনা পাবে কীভাবে? তাই টক শোগুলো জনপ্রিয়। ওখানে বিশেষজ্ঞরাই আলোচনায় অংশ নেন। বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন। সরকারের নীতির সমালোচনা করার অর্থ সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া, যাতে সরকার সংশোধিত হতে পারে। এটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। টক শোতে দেখেছি কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা সরকারের সব সিদ্ধান্তেই হ্যাঁ বলেন। এমন কি কেউ কেউ সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল ওই কমিটিতেও ছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য তারা প্রেসক্লাবের গোলটেবিল আলোচনায় সোচ্চার থাকেন। অথচ কমিটিতে বসেই তারা মিডিয়ার স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধ করার সব ব্যবস্থা পাকা করলেন। এমনকি তিনজন ব্যক্তি ছিলেন, যারা বেসরকারি টিভি চালান। তারা কমিটিতে থেকে কী করলেন! একজন সম্পাদকও ছিলেন। ওই কমিটিতে থাকার সময় তার ভূমিকা কি ছিল? কেন তারা সবাই নীতিমালা প্রণয়নের সময় তাদের আপত্তির কথা জানালেন না? নিদেনপক্ষে তারা ‘জোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারতেন। তাহলে আজ তাদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু কমিটিতে থেকে সবাই নীতিমালা প্রণয়ন করলেন, কোনো আপত্তি জানালেন না। অথচ আজ মিডিয়াতে তারা উল্টো সুরে কথা বলছেন। তাই আজ যখন মন্ত্রী মহোদয় নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি মিথ্যা বলেন না। আমি এটা বিশ্বাস করি কমিটির সদস্যরা যদি ন্যূনতম ভূমিকা পালন করতেন, তাহলে নীতিমালাটি এভাবে প্রণীত হতো না। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে সশস্ত্রবাহিনীকে মিডিয়ায় ‘ভূমিদস্যু’ বলা শুধু অপরাধই নয় বরং তা রাষ্ট্রদ্রোহেও শামিল। আমাদের মাঝে অনেক অবিবেচক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা এ ধরনের কথাবার্তা বলে কোনো কোনো মহলের বাহবা পেতে চান। তাদের জন্যই এই নীতিমালা। এটা সমর্থনযোগ্য। তবে নীতিমালায় এ সংক্রান্ত অপরাধে কি শাস্তি হবে, তা বলা হয়নি, তা বলা হবে আইনে। আমার ধারণা সরকার সব মতামতকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েই একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করবে, যারা আইনের খসড়াটি তৈরি করবেন। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা কখনো কোনো ভালো কাজ হতে পারে না। সংবিধান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গ্যারান্টার। ইতোমধ্যে সংবিধানে ১৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে এবং আরো একটি সংশোধনী আনার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সংবিধানের ৩৯টি অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটি আরো স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের অধিকারের কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯নং ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মতপ্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষা কবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে মধ্যে আমরা এই ৩৯নং ধারাটি লঙ্ঘিত হতে দেখি। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে ৩৯নং ধারার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, ৩৯নং ধারাবলেই একজন সম্পাদক তার মতপ্রকাশের অধিকার রাখেন। তখন সম্প্রচার নীতিমালার কোনো কোনো ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই এবং উচ্চ আদালত এর ফয়সালা করে দিতে পারেন। নতুবা বারবার এ প্রশ্ন উঠতেই থাকবে। যে জন্য সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণত সেনাবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে নেতিবাচক কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না। বরং প্রশংসার সংবাদই থাকে বেশি। সেনাবাহিনী বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে, এ কথা হরহামেশাই আমরা টক শোতে বলি। তবে হ্যাঁ, প্রতিরক্ষা বা পুলিশ বাহিনীর দু’একজন সদস্যের অপকর্ম যখন সংবাদ হয় এবং এতে যখন স্থানীয় অসন্তোষ বেড়ে যায় (নারায়ণগঞ্জের ঘটনা), তখন তা আলোচনারই দাবি রাখে। মিডিয়া তখন সে কাজটিই করে। অতীতে করেছেও। মিডিয়া সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি তার দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইন করে মিডিয়ায় এসব সংবাদ প্রকাশ ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তাহলে তা প্রকারান্তরে সমাজে কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। তবে খুব সঙ্গতকারণেই মিডিয়ায় বিশেষ করে টক শোতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া কাম্য নয়। বেসরকারি টিভির কর্মকর্তারা জানেন, কারা অহেতুক সরকারের গুণগান গেয়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন। এদের ‘বয়কট’ করাই মঙ্গল। না হলে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে না। টক শোগুলোতে শুধু সরকারের প্রশংসা বা সমালোচনাই হবে এটা কাম্য হতে পারে না। টক শো হচ্ছে একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ভালো কাজ, তথা জনমুখী নীতি গ্রহণ করার জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। শুধু সমালোচনাই যেমন কাম্য নয়, ঠিক তেমনি শুধু প্রশংসাও কাম্য নয়। একটা সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন করার আগে সরকার এটি কার্যকর করবে না, এমনটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এখন সব সমালোচনাকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে সরকার একটি আইন করুক। অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করুক। একটি ‘স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন’ গঠন করুক। তবে এটা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, শুধু মুখ চেনা কিছু লোককে নিয়ে যদি এই কমিশনটি গঠিত হয়, তাহলে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। মন্ত্রী বাহাদুর বলছেন, ‘মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না।’ বরং মিডিয়াকে নাকি তার ভাষায় ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবের’ বাইরে রাখা হবে। মন্ত্রীর কথা সত্য হোক। যদি তার কথার সত্যতা তিনি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞ হাসানুল হক ইনু দেশের একজন যোগ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন। আমরা সেই দিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। Daily MANOBKONTHO 19.08.14

এরদোগান কেন মুসলিম বিশ্বের জন্য মডেল

১১ আগস্ট তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোগানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এটা একরকম নিশ্চিত যে, তিনি একুশ শতকে মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। গাজায় মুসলমানরা যখন ইসরাইলি হামলায় মারা যাচ্ছিল, তখন অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন এরদোগান। সেখানে ওষুধ ও শিশুখাদ্য পাঠিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সৌদি আরব ও জর্ডান যখন পরোক্ষভাবে গাজায় ইসরাইলি হামলার সমর্থন করেছিল তখন কাতার ও তুরস্ক হামাসের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। এসব কারণে এরদোগানের ভূমিকা এখন মুসলিম বিশ্বে বহুল আলোচিত। ২০০৩ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে সংবিধানে পরিবর্তন এনে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে সংসদ প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করত। সাম্প্রতিক তুরস্ক যে কীভাবে বদলে গেছে, তা না দেখে বিশ্বাস করা যায় না। সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশটিতে শুধু স্থিতিশীলতাই উপহার দেননি, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দেশটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উঠতি শক্তি। তাই আমার বারবার মনে হয়েছে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুরস্ককে (মডেল হিসেবে) অনুসরণ করতে পারে। প্রথমত, দুটো দেশই মুসলিম প্রধান ও দেশ দুটোতে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ইতিহাস আছে। তুরস্কের 'জাতির পিতা' মুস্তফা কামাল পাশা। তিনি নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তার নেতৃত্বেই তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের বিলোপ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক প্রজাতন্ত্র হিসেবে জন্মলাভ করে। এর ঠিক ৩৭ বছর পর ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী জেনারেল সিমেল ওরগোলের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছিল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল এভরেন ১৯৮০ সালে। জেনারেল এভরেনের স্বাভাবিক অবস্থানের পর (১৯৮৯) সেনাবাহিনী আর ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এটা সম্ভব হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও দলটির পূর্ব নাম ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির কারণে। দলটির নেতৃত্ব অত্যন্ত সৎ ও মেধাবী। ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা এরবাকানের স্বাভাবিক মৃত্যু ও দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করে। দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ২০০২ সালের সংসদ নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ৩৪ ভাগ ভোট, আর ২০১১ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে তারা পায় ৪৯ ভাগ ভোট। এ থেকেই বোঝা যায়, দলটির জনপ্রিয়তা কত বেশি। মাঝখানে ২০০৭ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৭ ভাগ ভোট। দলটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে, এর নেতৃত্বের গাড়িতে যারা আছেন তারা কেউই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। সাবেক শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। ফলে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের ভূমিকাকে তারা সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, ইসলাম ও গণতন্ত্র যে একে অপরের পরিপূরক এবং ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়। ক্ষমতাসীন দল এটা প্রমাণ করেছে। মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। এটাই তুরস্কের ঐতিহ্য। কামাল আতাতুর্ক দেশটিকে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি তুরস্ককে একটি আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। সন্দেহ নেই তাতে তিনি সফল হয়েছেন। তবে একটি বিষয় তিনি বিবেচনায় নেননি। আর তা হচ্ছে মুসলিম ঐতিহ্য। মুসলমানদের তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে একজন ইউরোপিয়ান ভাবতেন। তুরস্কে মাদরাসার শিক্ষা ছিল। তা আতাতুর্ক নিষিদ্ধ করেছিলেন। বর্তমান সরকার সীমিত পরিসরে মাদরাসা চালু করেছে। মেয়েদের মাথায় ওড়না বা হিজাব ফিরে এসেছে। এক সময় এ ওড়না ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরা ওড়না পরতে পারত না। এখন সেই বাঁধন নেই। নিজের খুশি। কেউ পরে। কেউ পরে না। তবে ক্যাম্পাসে আমি (তুরস্ক সফর ২০১২) শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ মেয়েকেই দেখেছি স্কার্ফ ব্যবহার করে না। ইসলাম ও গণতন্ত্রকে এক করে এরদোগান যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন তুরস্কে, এটা একটা মডেল। অনেক আরব দেশ, বিশেষ করে 'আরব বসন্ত' এরপর তারা এ রাজনীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে দলটি যে পুরোপুরি ইসলামিক শাসনে বিশ্বাসী, তা বলা যাবে না। তারা যথেষ্ট আধুনিকমনস্ক। তারা অনেকটা ফাতেহউল্লাহ্ গুলেনের ভাবধারার অনুসারী (দেখুন, The Vision and Impact of Fethullah Gulen)। ২০০৮ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ফাতেহউল্লাহ্ গুলেনকে বিশ্বের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। অত্যন্ত জনপ্রিয় এ বুদ্ধিজীবী তুরস্কের নাগরিক হয়েও তুরস্কে থাকেন না। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ইসলাম যে আধুনিকমনস্ক একটি সমাজব্যবস্থা, তা গুলেনের লেখায় পাওয়া যায়। তাই তুরস্কের বাইরে ক্ষমতাসীন পার্টিকে (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) আল কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হলেও তা ধোপে টেকেনি। বরং তুরস্কের নেতৃত্ব সেই প্রথম থেকেই আল কায়দার কর্মকান্ডকে সমালোচনা করে আসছেন এবং এখনও করছেন। মানুষ এটা গ্রহণ করেছে। যে কারণে তুরস্কে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- নেই। মানুষ সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়ও দেয় না। বর্তমান সরকারের এটা একটা বড় সাফল্য। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের গতিশীল নেতৃত্বের কারণে তুরস্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সারা ইউরোপ যেখানে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে, সেখানে বিশ্ব মন্দা তুরস্কের অর্থনীতিকে এতটুকুও আঘাত করেনি। বরং ২০১০ সালে যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৯ ভাগ, তা ২০১১ সালে ১১ ভাগে উন্নীত হয়েছিল। অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তুরস্কে স্কোর সংখ্যা কম (৯.২ ভাগ)। অথচ স্পেনে ২২.৬, গ্রিসে ১৭.৬, লিথুয়ানিয়ায় ১৫.৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১ ও ফ্রান্সে ৯.৯ ভাগ। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দলটিকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। চতুর্থত, দলটির বড় সাফল্য সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রমুখী করা। ৩৬৫ জন জেনারেল আর ৭ লাখ ২০ হাজার সেনা সদস্যকে নিয়ে যে বিশাল সেনাবাহিনী তুরস্কের, ন্যাটোতে তার অবস্থান দ্বিতীয়। এ সেনাবাহিনী বরাবরই একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য 'থ্রেট' বা হুমকি। এরদোগান নিজে একটি কবিতা লিখে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি (২০০২) প্রধানমন্ত্রী প্রথমে হতে পারেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্টে আসেন। সেই সেনাবাহিনীকে তিনি গণতন্ত্রমুখী করেছেন। সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রতি 'কমিটেড'। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈরিতায় না গিয়ে, তাকে গণতন্ত্রের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে এরদোগান যে সফলতা পেয়েছেন, তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি 'মডেল'। বিশেষ করে ইরাক, তিউনেশিয়া কিংবা ইয়েমেন এ মডেল অনুসরণ করতে পারে। পঞ্চমত, তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গেল ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগ গিয়ে দাঁড়ায় ২২২ বিলিয়ন ডলার। মিসর (১৭৬ মিলিয়ন) ও ইরানের (১৭৬ মিলিয়ন) মতো দেশেও গেল বছর বড় বিনিয়োগ ছিল তুরস্কের। ক্রয় সক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার, যা যে কোনো ইউরোপীয় দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক তার বৈদেশিক নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও নানা কারণে এ সম্পর্ক এখন 'শীতল'। ন্যাটোর সদস্য হলেও সব ইস্যুতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত, তা বলা যাচ্ছে না। তবে সিরিয়া সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তুরস্ক। তুরস্কের সঙ্গে রয়েছে সিরিয়ার সীমান্ত। সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য 'মানবিক কারণে' সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তুরস্ক। সিরিয়া সঙ্কটে 'পশ্চিমা হস্তক্ষেপ' তুরস্ক সমর্থন না করলেও বাশার আসাদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিলে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে, এটাও মনে করে তুরস্ক। সেইসঙ্গে সোমালিয়ার মতো মুসলমান প্রধান দেশের সঙ্কট নিরসনে তুরস্কের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। এরদোগান নিজে সোমালিয়া সফর করে একটি মুসলমান প্রধান দেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছেন। যুদ্ধপীড়িত সোমালিয়া থেকে শত শত শিশুকে তুরস্কের বিভিন্ন স্কুলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে তুরস্ক সরকার। এর ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত আল শাহাব গ্রুপের প্রভাব সোমালিয়ায় কিছুটা হ্রাস পাবে। এরই মধ্যে মোগাদিসুতে প্রথম বিদেশি সংস্থা হিসেবে তার্কিশ বিমান লাইন সপ্তাহে দুবার তার ফ্লাইট শুরু করেছে। সোমালিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সাহায্য করছে। অন্যদিকে তুরস্কের সীমান্তঘেঁষা মুসলিম প্রধান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগ নিচ্ছে তুরস্ক। এক সময় ওই অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়েই প্রাচীন 'সিল্ক রোড' চলে গিয়েছিল। তুরস্ক এখন সেই 'সিল্ক রোড' পুনরুজ্জীবিত করছে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইছে তুরস্ক। আর এ লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকু-তিবিলিসি-সাইনহান গ্যাস পাইপলাইন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, যোগ্য নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি তুরস্ককে আজ মুসলিম বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান দিয়েছে। এক সময় মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে মুসলিম বিশ্ব স্বপ্ন দেখাত। মাহাথির-পরবর্তী মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব সেই প্রত্যাশা শতকরা ১০০ ভাগ পূরণ করতে পারেননি। এ কারণে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে এখন এরদোগানের কথা ভাবা হচ্ছে। এরদোগান সব গোঁড়ামির ঊধর্ে্ব উঠে শুধু আজ তুরস্ককেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, বরং মুসলিম বিশ্বের জন্যও একটা 'ইমেজ' সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি যে সঙ্কটমুক্ত, তা বলা যাবে না। কুর্দিদের নিয়ে সমস্যা আছে। সেনাবাহিনীও শতকরা ১০০ ভাগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যোগ্য নেতৃত্ব ও সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে তিনি যদি দেশটিকে পরিচালনা করেন, তাহলে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হবেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার বিজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্বের জার্নালগুলোতে তার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে এ বিষয়টিই ঘুরে-ফিরে আসছে যে, তিনিই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেবেন ২১ শতকে। তবে তুরস্ক নিয়ে ভয়টা যে নেই, তাও বলা যাবে না। বর্তমান তুরস্কের নেতৃত্বের মাঝে 'অটোমান সাম্রাজ্যের' একটা ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানেন আজকের তুরস্কের জনগোষ্ঠী একসময় মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল। তাদের বলা হত Oghuz Turks, অর্থাৎ টার্কিস ট্রাইব। এগারো শতকে এরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং এক সময় উরাল হৃদঘেরা অঞ্চল ছেড়ে আজকের পারস্যে বসবাস করতে শুরু করে। এরাই জন্ম দিয়েছিল Great Selijuk সাম্রাজ্যের। এক সময় মালোদের হাতে Selijuk সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তারপর জন্ম হয় অটোমান সাম্রাজ্যের, যা টিকে ছিল ৬২৩ বছর। এ অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল ইউরোপ পর্যন্ত। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে অটোমান সাম্রাজ্যের অবসানের মধ্য দিয়ে আজকের তুরস্কের যাত্রা শুরু। তুরস্কের রাজনীতি আজ অনেক মুসলিম দেশের জন্য একটি মডেল। অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে, বিশেষ করে আরব বিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে (ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া), সেখানে শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্কে এ ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি। ২০১২ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আমি তুরস্কের এরজুরুম শহরে গিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল (এ শহরের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন এরদোগান) শহরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলাম। তারা সবাই আমার সঙ্গে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন জঙ্গিবাদ আর ইসলাম এক নয় বরং শুদ্ধ ইসলাম চর্চায় জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের দেখেছি তারা নিয়মিত নামাজ পড়ে। রোজা রাখে। তাই সঙ্গত কারণেই তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। সারা আরব বিশ্ব যখন একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি, তখন তুরস্কের স্থিতিশীলতা সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। এজন্যই টাইম ম্যাগাজিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল ২৮ নভেম্বরের (২০১২) সংখ্যায় (Erdogan’s way). তুরস্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার (২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায়) যে রাজনীতির সেখানে জন্ম দিয়েছে, তার মূল কথাই হচ্ছে- 'ইসলাম ও গণতন্ত্র', যা কিনা এখন 'আরব বসন্ত'-পরবর্তী আরব বিশ্বের রাজনীতির মূল কথা। তিউনেশিয়া, মরক্কো কিংবা মিসরের রাজনীতি এখন 'ইসলাম এবং গণতন্ত্র'কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা মডেল। অভিযোগ উঠেছে, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কিছুটা ইসলামিক এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সচেতন নয়। অথচ আমরা পরিসংখ্যান পেয়েছি, তুরস্কের পার্লামেন্টে মহিলা এমপিদের সংখ্যা ৯ ভাগ থেকে ১৪ দশমিক ১ ভাগে বেড়েছে। কর্মজীবী মহিলাদের সংখ্যাও সেখানে কম নয়, ২৪ ভাগ (পুরুষ ৬৯.৬ ভাগ)। সেনাবাহিনী অতীতে বরাবরই তুরস্কে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। মোস্তফা কামাল পাশা নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তুরস্কের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত। এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এখন এ বিতর্কের অবসান হয়েছে। মহিলাদের হিজাব নিয়ে একটি বিতর্ক আছে (মিসেস এরদোগান নিজে হিজাব পরিধান করেন)। তবে তা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এটা এখন বাধ্যতামূলক নয়। শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশও যে বিশ্বে একটি 'মডেল' হতে পারে আজকের তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ যে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে মুসলমান বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে, তুরস্কের নেতৃত্ব সেটা প্রমাণ করেছেন। একটি ইসলামপন্থী দলও সব ধরনের প্রচারণা উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে, আজকের তুরস্কের দিকে তাকালেই এ কথাটা মনে হয়ে যায় আমার। সারা দুনিয়ায় মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে। মুসলিম বিশ্ব মানেই মনে করা হতো, একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসন (মিসর, তিউনেশিয়া, ইয়েমেন) কিংবা ক্ষমতালোভী রাজতন্ত্র (গালফভুক্ত দেশগুলো) কিংবা ইসলামিক চরমপন্থীদের উর্বর ভূমি (আফগানিস্তান, সোমালিয়া)। কিন্তু এর বাইরেও একটি ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থা যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র উপহার দিতে পারে, গত প্রায় ১৬ বছরের তুরস্কের রাজনীতি এটাই প্রমাণ করেছে। তুরস্কের ইসলামমনস্ক একটি নেতৃত্ব, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই, প্রমাণ করেছেন তারাও পারেন দেশটিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমমানে দাঁড় করাতে। এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। সরাসরি ভোটে তিনি পেয়েছেন ৫২ ভাগ ভোট। অর্থাৎ দ্বিতীয় দফা ভোটেরও আর প্রয়োজন হবে না। এর মধ্য দিয়ে পরপর দুই টার্ম অর্থাৎ প্রায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তিনি পাবেন। মাত্র ৬০ বছরে পা দেয়া এরদোগানের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত বয়সটা খুব বেশি হবে না। তবে দেখতে হবে, মুসলিম বিশ্বের জন্য তিনি কী কী করেন। বিশেষ করে গাজা পুনর্গঠন ও গাজায় অর্থনৈতিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে তিনি একটি বড় অবদান রাখতে পারেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সেটাই প্রত্যাশা করে। Daily ALOKITO BANGLADESH 19.08.14

ফিলিস্তিন সঙ্কটের মাত্রা

গাজায় শেষ পর্যন্ত আবারো একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে হামাস ও ইসরাইল। মিসরের মধ্যস্থতায় কায়রোয় বেশ কিছু দিন ধরেই একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথম দফা ৭২ ঘণ্টার একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিল উভয় পক্ষ। কিন্তু ৭২ ঘণ্টা শেষ হওয়ার পরপরই ওই যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে। এরপর আবার একটি যুদ্ধবিরতিতে গেছে উভয় পক্ষ। কিন্তু আদৌ এ যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। কেননা হামাস চায় দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হোক। তবে তার আগে ইসরাইলকে গাজা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সেই সঙ্গে গাজার বিমান ও সমুদ্র বন্দর খুলে দিতে হবে। কিন্তু ইসরাইলের কোনো সম্মতি এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না এবং এটা ঠিক ইসরাইলের সম্মতি পাওয়া না গেলে যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়বে এবং গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়বে। গাজায় যে যুদ্ধ গত এক মাসের ওপর চলে আসছিল তা ছিল একটি অসম যুদ্ধ, একতরফা যুদ্ধ। ইসরাইলি সেনারা নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে শিশু ও নারীদের হত্যা করেছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘ এ ব্যাপারে ছিল নীরব। ইসরাইলি নেতারা গাজায় গণহত্যার জন্য আজ অভিযুক্ত। এ হত্যাযজ্ঞকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সেনানায়কদের হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হবে, এটা চিন্তা করাও যায় না। আদৌ কোনো দিন এ বিচার হবে না। একাধিক কারণে এ বিচার করা যাবে না। এটা করতে হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় গণহত্যা বা এ ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা অনুসন্ধান করতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এ সম্মতি এখনো দেননি। গেল সপ্তাহে ১৭টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ) একটি খোলা চিঠিতে এ অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। মনে রাখতে হবে, আইসিসির চার্টারে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার কোনো ক্ষমতা নেই। সুতরাং আইসিসি চাইলেও নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, ১২২টি দেশ আইসিসির সদস্য। ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, সুদান, রোম চার্টারে (যার মধ্যে দিয়ে আইসিসির জন্ম) ২০০০ সালে স্বাক্ষর করলেও পরে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আইসিসির সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা দেখা কিংবা ওই রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কাজটি খুব সহজ হবে না। আইনগত জটিলতা তৈরি হতে পারে। কেননা আইসিসি সদস্যরাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ওই সংজ্ঞায় পড়ে না। যদিও ২০১২ সালে জাতিসংঘ পিএলওকে 'নন মেম্বার অবজারভার' স্ট্যাটাস দিয়েছে। এখন যদি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আইসিসিতে যোগ দেয় তাহলেই সম্ভব গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্ত করা। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের গণহত্যার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য আইসিসিকে নির্দেশ দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইহুদি লবির কারণে ওটা চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং আজকে নাভি পিল্লাই 'যুদ্ধাপরাধে'র যে কথা বলেছেন তা কাগজ-কলমেই থেকে যাবে এবং প্রমাণিত হবে আইসিসি পশ্চিমাদের স্বার্থেই কাজ করে। সার্বিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা মিলোসেভিচের বিচার হয়েছিল হেগে। বিচার হয়েছিল লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, যুদ্ধবাজ চার্লস টেলরের। এমনকি রুয়ান্ডায় হুতু-তুতসি হত্যাকা-ে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল তাদেরও বিচার হচ্ছে। কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে যারা জড়িত তাদেরও বিচার হচ্ছে। এমনকি ২০০৮ সালে কেনিয়ায় নির্বাচন-পূর্বকালে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তারও বিচার হচ্ছে। আর তাতে অভিযুক্ত হয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভাইস প্রেসিডেন্টের বিচার শুরু হয়েছে আর প্রেসিডেন্টের বিচার শুরু হওয়ার কথা আগামী মার্চে। কিন্তু ইসরাইলি নেতাদের বিচার হবে তা শুধু অসম্ভবই নয়, বরং অকল্পনীয়ও বটে। গাজায় সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত সেখানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০০ জনে। গাজা এখন এক বিধ্বস্ত নগরী। হাসপাতাল, স্কুল এমনকি জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত আশ্রয়স্থলগুলোও ইসরাইলের হামলায় পরিপূর্ণভাবে বিধ্বস্ত। ইতোমধ্যে গাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করেছে ইসরাইল। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইসরাইলি হামলায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে সিভিলিয়ানের সংখ্যা শতকরা ৭৪ ভাগ। ১৮ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত গাজায় হামাস সদস্যের সংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার। অথচ এ গাজা থেকে হামাস নেতাদের উৎখাত করতে ইসরাইল অতীতে দুবার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল, একবার শীতকালে ২০০৮-০৯ সময়সীমায় আর দ্বিতীয়বার ২০১২ সালের নভেম্বরে। কেননা আল ফাতাহ নয়, বরং হামাসকেই এখন ইসরাইলি নেতারা নিজেদের জন্য 'বড় হুমকি' বলে মনে করেন। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সংসদ নির্বাচনে হামাস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল কোনো দিনই হামাস প্রতিনিধিকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি। বরং আল ফাতাহ আর হামাসের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে হামাসকে উৎখাত করার উদ্যোগ নিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। আর সময়টা তিনি বেছে নিয়েছেন এখন, যখন ২০১৪ সালের এপ্রিলে আল ফাতাহ ও হামাস একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ সরকার যাতে গঠিত না হয় সে জন্যই এ সামরিক আগ্রাসন। ইসরাইলের এ সামরিক আগ্রাসন, গাজায় নিরীহ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের হত্যা সব আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। কোনো একটি যুক্তিতেই এ স্থল আক্রমণ গ্রহণযোগ্য নয়। ইসরাইলের যুক্তি ছিল ইসরাইল যা করছে তা তার নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার স্বার্থে এবং এ 'অধিকার' তারা রাখে। এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা গাজা অনেক দিন থেকেই একটি ইসরাইলি অবরুদ্ধ ও অধিকৃত অঞ্চল। ২০০৬ সালে হামাসের নির্বাচনে বিজয়ের পরপরই ইসরাইল গাজা অঞ্চলকে ঘেরাও করে রাখে। পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ সরবরাহ সবকিছু ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। আর বিশ্ব সংস্থা অনেক আগেই জানিয়েছিল ইসরাইলের এ 'নিয়ন্ত্রণ' যদি অব্যাহত থাকে তাহলে গাজা ২০২০ সালের মধ্যে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নাম্বার ধারায় 'আত্মরক্ষা'র সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা শুধু কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেহেতু গাজা একটি ইসরাইল কর্তৃক 'নিয়ন্ত্রিত' এলাকা এবং গাজার কোনো সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত নয় তাই জাতিসংঘের ৫১ ধারা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গাজার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে অধিকৃত অঞ্চলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন। ওই আইনে বলা হয়েছে_ অধিকৃত অঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে দখলকৃত রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের দায়িত্ব গাজার নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু উল্টো ইসরাইলি সেনাবাহিনী সাধারণ নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। হেগ কনভেনশনের ৪৭ নাম্বার ধারাও ইসরাইল লঙ্ঘন করেছে। এ ধারা অনুযায়ী অধিকৃত অঞ্চলের আকাশ, জলসীমা নিয়ন্ত্রণ ও সেই সঙ্গে জনসংখ্যা চলাচল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মুভমেন্ট অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখে ইসরাইল। তিনজন ইসরাইলি যুবকের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে ইসরাইলি ওই অভিযানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা স্বয়ং ইসরাইলি পুলিশপ্রধান বলেছেন, ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে হামাস জড়িত নয়। এমনকি হামাসের রকেট হামলা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেখা গেছে, ইসরাইলি রকেট হামলা হয়েছে প্রথমে। প্রতিটি ইসরাইলি হামলা, বিশেষ করে চলতি গাজা অভিযানে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের চরম বরখেলাপ। ইসরাইলি সেনাবাহিনী মূলত 'দাহিয়া ডকট্রিন (উধযরু উড়পঃৎরহব) অনুসরণ করে জনবসতি ধ্বংস করছে যা তারা লেবাননেও করেছিল। এ 'দাহিয়া ডকট্রিন'-এর প্রবক্তা হচ্ছেন মেজর জেনারেল গাদি আইজেনকট। তিনি শীর্ষ ইসরাইলি সেনা স্ট্রাটেজিস্ট। এখন অবসরে। এ মতবাদের মূল বিষয় হচ্ছে যেখান থেকে রকেট হামলা হবে সেখানের পুরো এলাকা ধ্বংস করে দেয়া। ২০০৬ সালে ইসরাইল এ তত্ত্ব লেবাননে ব্যবহার করেছিল। হিজবুল্লাহর সদস্যরা জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে রকেট নিক্ষেপ করত। ইসরাইল ওই এলাকাকে 'সেনা নিয়ন্ত্রিত' এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে শত্রু এলাকা ঘোষণা করে ওই এলাকা ধ্বংস করে দিত। এ মতবাদের কারণে লেবাননে প্রচুর সিভিলিয়ান এলাকা ইসরাইল সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় ২০০৯ সালে জাতিসংঘ লেবাননে বিচারপতি গোল্ডস্টোনের (দক্ষিণ আমেরিকা) নেতৃত্বে একটি 'তথ্য অনুসন্ধান' কমিটি প্রেরণ করেছিল। ওই কমিটি, যা গোল্ডস্টোন কমিটি নামে পরিচিত, ইসরাইলকে সিভিলিয়ান এলাকা ধ্বংসের জন্য দায়ী করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে ইসরাইলের কোনো বিচার হয়নি। হামাসের বিরুদ্ধে 'মানবঢাল' ব্যবহারের যে অভিযোগ রয়েছে, তারও কোনো সত্যতা নেই। সিভিলিয়ান এলাকায় অস্ত্র রক্ষায় হামাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সে অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ফলে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরাধ করেও ইসরাইল পার পেয়ে যাচ্ছে। লেবাননে গণহত্যা চালালেও কোনো ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তার বিচার হয়নি। আজও যখন গাজায় দীর্ঘ প্রায় পাঁচ সপ্তাহ ধরে ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হবে_ এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। ইতিহাস বলে, ফিলিস্তিনে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পিএলও নেতারা অনেক ছাড় দিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে পিএলও আলজিয়ার্স সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগের কথা ঘোষণা করে। ১৯৯৩ সালে পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্ম দিলেও শান্তি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানে আজও রক্ত ঝরছে। নিরীহ শিশুদের হত্যা করে ইসরাইলি নেতারা কোনো দিনই সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মন পাবে না। এ শিশুরাই বড় হয়ে একেকজন 'বিদ্রোহী' হয়ে ওঠে। হামাসের জন্ম ও গ্রহণযোগ্যতা এভাবেই বেড়েছে। ইসরাইল মূলত নতুন একটি 'মতবাদ' নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এ মতবাদের মূল বিষয় হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে গাজায় যারা বসবাস করেন, তাদের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ রেখে সেখানে তাদের বসবাস করতে বাধ্য করা। অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ যুগের সময়কার মতো, যখন মূল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে বড় বড় শহর থেকে বের করে দিয়ে তাদের জন্য ১০টি হোমল্যান্ড তৈরি করা হয়েছিল এবং হোমল্যান্ডে কৃষ্ণাঙ্গদের বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ অবশ্য ওই হোমল্যান্ডগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই ইসরাইল গাজাবাসীদের অবরোধ করে তাদের এক ধরনের 'বস্তিজীবনে' বসবাস করতে বাধ্য করলেও চূড়ান্ত বিচারে ইসরাইল তা পারবে না। একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তিচুক্তি যেমনি হামাসের জন্য মঙ্গল, তেমনি মঙ্গল ইসরাইলের জন্যও। যুদ্ধ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। তবে গাজাবাসীদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার জন্য ইসরাইলের নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হওয়া উচিত। না হলে এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটতে থাকবে এবং সাধারণ মানুষ তাতে মারা যেতে থাকবে। বিশ্বসম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তাদের দায়িত্ব শুধু এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করা নয়, বরং অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। Daily JAI JAI DIN 18.08.14

সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধান ও বিবিধ প্রসঙ্গ

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ কার্যকর হওয়ার পর অনেক প্রশ্ন এখন নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে। এক. এই নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! দুই. এর মধ্য দিয়ে সরকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়! তিন. এই নীতিমালার কী আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? চার. জনপ্রিয় টক শোগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কি না? বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের অনেক প্রশ্ন এখন উঠেছে। তবে স্পষ্টতই জাতীয় রাজনীতির মতোই এ নীতিমালার প্রশ্নেও বিএনপি ও সরকার পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। সাংবাদিক সমাজে যে দ্বিধাবিভক্তি, সম্প্রচার নীতিমালার প্রশ্নেও এই বিভক্তি স্পষ্ট। অর্থাৎ সরকার সমর্থক সাংবাদিক সমাজ ও তাদের ইউনিয়ন এই সম্প্রচার নীতিমালাকে সমর্থন করেছে। আবার বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা এর বিরোধিতা করেছেন। তবে সুধীসমাজের একটা বড় অংশ এই সম্প্রচার নীতিমালাকে সমর্থন করেনি। অনেক কারণের জন্য এই নীতিমালাকে সমর্থন করা যায় না। এবং আমি মনে করি সরকার একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিল। বিরোধী দলের জন্য এটা একটা সুযোগ তৈরি হলো। যাঁরা ওই নীতিমালাটা তৈরি করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আমলা এবং একজন আমলার নেতৃত্বেই এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা কেন হবে? আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দল, তাদের রাজনীতির সমর্থক বুদ্ধিজীবী বা সিনিয়র সম্পাদকের তো কোনো অভাব নেই। তাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি হলো না কেন? কিংবা একজন সিনিয়র দলীয় নেতা অথবা একজন সম্পাদক এই কমিটির সভাপতি হতে পারতেন। একজন মাত্র সম্পাদককে দেখলাম কমিটির সদস্য। তিনি একা কেন থাকবেন? বেসরকারি টিভির ছিলেন তিনজন প্রতিনিধি। কেন? মাত্র দুজন শিক্ষককে দেখলাম কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে একজন আবার মাত্র সহকারী অধ্যাপক। এত বড় একটি কাজ। সেখানে আরো বেশি সংখ্যায় বিশেষজ্ঞ রাখলে ভালো হতো এবং সেটিই যৌক্তিক ছিল। আমরা ভুলে যাই আমলারা সরকারের আদেশ পালন করবেন বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মতো। তাঁরা কখনোই জাতীয় স্বার্থ দেখেন না। তাঁরা দেখেন নিজ স্বার্থ। তাঁরা মূলত 'হুকুমের দাস'। তাঁদের 'মেন্টাল মেক-আপ' এভাবেই তৈরি। ফলে একটি নীতিমালা তাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন, কিন্তু এটা যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা তাঁরা বিবেচনায় নেননি। বেসরকারি চ্যানেলের তিনজন প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত, তাঁদের করার কিছু ছিল বলেও মনে হয় না। একটি 'স্বাধীন কমিশন' গঠনের প্রস্তাব তাঁরা করেছেন বটে, তবে ওই কমিশনের মাধ্যমে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রস্তাব করলে সেটা বরং ভালো হতো। তাঁরা প্রস্তাবিত নীতিমালার একটি কাঠামো বা ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারতেন। তখন তাহলে ওই 'স্বাধীন কমিশনের' কাজটি কী হবে? কমিশনে কিছু লোকের চাকরি হবে। তাঁরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেবেন। এ ধরনের লোক পেতে সরকারের এই মুহূর্তে কোনো সমস্যা হবে না। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি থেকে শুরু করে সাবেক আমলা, সাবেক ভিসি কিংবা সিনিয়র অধ্যাপকদের অভাব এ দেশে নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কেউ কেউ অবসরের পর যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'লাখ টাকার' চাকরি করেন, তখন তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন সরকারের আরো একটা 'ডাকের' জন্য! একটা অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর পেছনে সত্যতা আছে। সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারার সঙ্গে সম্প্রচার নীতিমালার কোনো কোনো ধারা অথবা মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। আমাদের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান মোট ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু মূল সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।' এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) 'ক' ও 'খ' ধারা দুটি আরো স্পষ্ট। 'ক'তে বলা হয়েছে, 'প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের' কথা এবং 'খ'তে রয়েছে 'সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল।' অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯ নম্বর ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যে এই ৩৯ নম্বর ধারাটি লঙ্ঘিত হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে ৩৯ নম্বর ধারার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। বলার চেষ্টা করেছিলেন ৩৯ নম্বর ধারা বলেই একজন সম্পাদক তাঁর মত প্রকাশের অধিকার রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন এই সময়ের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এটা উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা সংবিধানে ৩৯ নম্বর ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯ নম্বর ধারাটি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছিল। সেদিন দেশে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ওই সিদ্ধান্তের জন্য বারবার সমালোচিত হয়েছে। আজ এত বছর পরও আওয়ামী লীগকে কথা শুনতে হয়। ২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ আরেকটি ভুল করল। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় যে ধরনের বাক্য, শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আওয়ামী লীগকে আরো একবার বিতর্কিত করল। বিশেষ করে টক শোর ব্যাপারটি বেশ স্পর্শকাতর। এটা ঠিক টক শোতে অনেকে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। কেউ কেউ নিজেকে সবজান্তা হিসেবে উপস্থাপন করেন। বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান না থাকলেও নিজেকে 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে পরিচয় দেন। উপস্থাপকদের কেউ কেউ (কোনো একটি বিশেষ চ্যানেলে) 'রাজনৈতিক এক্টিভিস্টের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কেউ কেউ আবার প্রতিপক্ষকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হন। এ ক্ষেত্রে একটি 'গাইড লাইন' পরোক্ষভাবে থাকতে পারে। গণমাধ্যমের জন্য প্রায় ৪৩টি আইনের বিধি রয়েছে। মিথ্যা, অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনের অভিযোগে এসব আইনে পরিবর্তন কিংবা সংশোধনী এনে অভিযোগের বিচার করা সম্ভব। প্রেস কাউন্সিল বাহ্যত একটি কাগুজে সংগঠন। প্রেস কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করে এর বিচারিক ক্ষমতা আরো বাড়ানো যায়। তা না করে টক শো বন্ধ অথবা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, দুজন জনপ্রিয় 'টকার'কে টক শোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন নিজে অভিযোগ করেছেন। আমি নিজে টক শোতে নিয়মিত যাই। আমার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিধিনিষেধের আশঙ্কা আমিও লক্ষ করছি। আমার এই আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটিই প্রত্যাশা করব। দেশে প্রায় ২৬টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে, যার মালিকানার পুরোটাই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। ফলে সরকারের চ্যানেল নিয়ে 'ভয় পাওয়া' অমূলক; বরং তিন-তিনটি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে করে সরকার বিতর্কিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কোনো সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজন তখন কিন্তু হয়নি এগুলো বন্ধ করার জন্য। ফলে সরকারের কাছে 'অস্ত্র' তো ছিলই! শুধু শুধু সম্প্রচার নীতিমালা করে অনাহূত 'বিতর্ক' টেনে আনা হলো কেন? এখন প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় এই আইন কার্যকর হয়েছে। টক শোগুলোতে নিষেধাজ্ঞা যে জারি হয়েছে, তা তাদের অনুষ্ঠানমালা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের দেখেই বোঝা যায়। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই চ্যানেলগুলো 'একেকটি বিটিভি'তে পরিণত হবে। আমলারা হয়তো সেটাই চান। খুশি রাখতে চান সরকারের নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু একটি বড় রাজনৈতিক দল, তারা কেন আমলাদের কথায় চলবে? বস্তাপচা নাটক আর মারদাঙ্গা বাংলা সিনেমা মানুষ কী দেখে? গভীর রাত জেগে মানুষ টক শো কেন শোনে, এটা যদি একটি রাজনৈতিক দল না বোঝে, তার চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। তাই প্রজ্ঞাপন জারি হলেও সব কিছু শেষ হয়ে গেছে- এটা আমি মনে করি না। সরকার আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা অবদি (অবশ্যই যোগ্য ও মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে) এই নীতিমালা কার্যকর করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে পারে। এতে সবারই মঙ্গল নিহিত Daily KALER KONTHO 17.08.14