রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

উপমহাদেশে আবারও অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা

সাম্প্রতিক সময়ে চিরবৈরী দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ফেব্র“য়ারি মাসে ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর পর পাকিস্তানে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতে গত ১৪ মার্চ দিল্লিতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার সোহেল মাহমুদকে ইসলামাবাদ ফিরিয়ে নিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা অনেকদিন থেকেই লক্ষ করছেন ভারত ও পাকিস্তান একধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। সামরিক শক্তির নিরিখে বিভিন্ন দেশের ওপর চালানো সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারত এ মুহূর্তে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ। অস্ত্র ও বাহিনীর নিরিখে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের পর ভারতের অবস্থান।পাক কূটনীতিকরা ভারতে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ ইসলামাবাদের। গেল সপ্তাহে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার জেপি সিংকে তলব করেছিল পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রণালয়। এর পরপরই পাকিস্তান দিল্লি থেকে তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে নিল। এ ঘটনা দু’দেশের সম্পর্ককে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেল।
পাকিস্তানের অবস্থান ১৩তম। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’ ২০১৭ সালের বিশ্ব সামরিক সক্ষমতার যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে এই চিত্র পাওয়া গেছে। দেশ দুটো প্রতিরক্ষা বাজেটও বাড়িয়ে চলেছে। যেখানে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ৫১ বিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮৭ বিলিয়ন, চীনের ১৬১ বিলিয়ন), সেখানে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট ৯ বিলিয়নের কাছাকাছি।
কাশ্মীরের উরিতে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের মাঝে গুলিবিনিময় হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত এক সেমিনারে বলেছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। পাকিস্তান এই বক্তব্যকে ‘অলীক কল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
উপরে উল্লিখিত প্রতিটি সংবাদের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের প্রশ্নটি জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে দু’দেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভারত ভালো চোখে দেখছে না। চীন পাকিস্তানে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। এটাকে ভারত একধরনের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছে। ভারত মহাসাগরে চীন তার নৌ তৎপরতা বাড়াচ্ছে। সর্বশেষ মালদ্বীপের ঘটনাবলীতে ভারত যাতে নাক না গলায়, সে ব্যাপারে চীন ভারতকে হুশিয়ার করে দিয়েছে। মালদ্বীপে একটি চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের কথাও শোনা যাচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানেও চীন একটি ঘাঁটি করতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে পাকিস্তান চীনের মুদ্রা ব্যবহার করবে- এমন একটি সংবাদও ছাপা হয়েছে অতি সম্প্রতি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৬১টি দেশ নিয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) নামে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তাতে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশীদার। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে’ ৬টি অর্থনৈতিক করিডোর আছে।
এর একটি হচ্ছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর। এই করিডোর চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে ভারত মহাসাগর ঘেঁষা পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে। এই করিডোরে রেলপথ, স্থলপথ সংযুক্ত রয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। করিডোরটি খাসগর, গিলগিট-বেলুচিস্তান, ডেরা ইসমাইল খান ও গাওদারকে সংযুক্ত করছে। ভারতের আপত্তির কারণ, এই করিডোর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের পাশ দিয়ে গেছে।
আজাদ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণভার যে পাকিস্তানের, এটা ভারত স্বীকার করে না। ভারত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে’ যোগও দেয়নি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশ (বাংলাদেশসহ) এই ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। ভারত প্রথম থেকেই চীনের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা প্রায় ৭০ বছরের। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, ভারত মহাসাগরের ‘নিয়ন্ত্রণ’কে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের মধ্যে একধরনের ‘সূক্ষ্ম’ প্রতিযোগিতা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। ভারত মহাসাগর চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয় ভারত মহাসাগরের অনেক সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। চীন এ অঞ্চলে একাধিক নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। ঠিক তেমনি ভারতও নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ একধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন সফর করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বটে; কিন্তু যুদ্ধবাজ স্ট্র্যাটেজিস্টদের একটা মহাপরিকল্পনা রয়েছে চীনকে ভেঙে ফেলার।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে ভেঙে যাওয়ার পর চীন এখন তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেছে। তারা পুরো প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগর এলাকার নামকরণ করেছে ইন্দো-প্যাসিফিক। মার্কিন প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজিতে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।
এ ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তান যে উত্তেজনা, তার পেছনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটি ‘ভূমিকা’ রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা কতটুকু দায়ী, তা বিবেচনায় নিতে হবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তিও রয়েছে।
অতীতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কারণে দেশ দুটি তিন তিনবার পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দু’বার- ১৯৪৭-৪৮ আর ১৯৬৫ সালে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে কারগিলকে কেন্দ্র করে আরও একবার যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা কিনা জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতা দখল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
পাক-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা, আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। ভারত পরপর দু’বার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ ঘটনা পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (সিপরি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৩৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, আর ভারতের রয়েছে ১২৫টি। ২০১৭ সালে উভয় দেশ ১০টি করে ওয়ারহেড তাদের পারমাণবিক শক্তিবহরে সংযুক্ত করে। ভারত ইতিমধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে ৫টি আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল ব্যবস্থা এস-৪০০ কিনতে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই এ চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় তারা। তাহলে পরবর্তী ২৪ থেকে ৫৪ মাসের মধ্যে এসব অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর সরবরাহ শেষ হবে। ৩০ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে এ মিসাইল সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর আগে জানুয়ারিতে (২০১৮) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ভারত ৭ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এস-৪০০ ব্যবস্থা মাঝারিপাল্লার ব্যালাস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম। তাদের মতে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী এস-৪০০ এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই পাল্টে দেবে। এই মিসাইল পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক মিসাইল নসরকেও নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অস্ত্র চুক্তি নতুন নয়। তবে নিঃসন্দেহে এই চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে অন্যতম বড় চুক্তি। এর আগে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার দিয়ে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্য কিনেছিল ভারত।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের এই অস্ত্র ক্রয় পাকিস্তানকেও উদ্বুদ্ধ করবে আরও অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করতে। ফলে উপমহাদেশে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা উপমহাদেশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। অস্ত্র খাতে ব্যয় বরাদ্দ বেড়ে যাওয়ার ফলে সামাজিক খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার, আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার, আর পাকিস্তান করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানেই- ভারতে যখন কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, তখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে দেশটি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থার সম্পর্কের অভাব। এ আস্থার সম্পর্ক গত ৭০ বছরেও তৈরি হয়নি। দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো ভালো খবর নয়। গত দু’-তিন বছর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিু পর্যায়ে রয়েছে। ওই হামলায় ৫ হামলাকারীসহ ১৩ জন নিহত হয়। ভারত ওই হামলার জন্য কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লস্কর ই-তৈয়বা’ এবং ‘জয়শ-ই-মোহম্মদ’কে দায়ী করেছিল এবং এ দুটি জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছিল। ওই ঘটনার পর দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর ফিরে আসেনি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির লাহোর সফরে (১৯৯৯) এবং সাবেক পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আগ্রা সফরের (২০০১) পর দেশ দুটির কাছাকাছি আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং তাদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাকিস্তান মনে করে, ভারত বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের দিয়ে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান মদদ দিচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পাকিস্তান তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ককে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানকে শাস্তি দেয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান এখন ভারতের পক্ষে।
সব মিলিয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মাঝে একধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গেছে। চলতি বছর পাকিস্তানে নির্বাচন। আর ২০১৯ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে মোদি এটাকে তার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ‘ভারত বিরোধিতা’কে পুঁজি করে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করবে। ভারতে প্রচণ্ড পাকিস্তানবিরোধিতা রয়েছে। কট্টরপন্থীরা এখন ভারতের ক্ষমতায়। মোট ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে বিজেপি সরকার। সুতরাং বোঝাই যায়, পাকিস্তানবিরোধিতা ভারতের নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। এ মুহূর্তে পাকিস্তান তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে দু’দেশের সম্পর্কের ওপর তা প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিও এতে করে প্রভাবিত হবে। ইসলামাবাদে সার্কের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি শুধু দেশ দুটির সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। আগামীতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।
বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। একজন কট্টরপন্থী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্কে কী পরিবর্তন আসে, সেটা দেখার বিষয়। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সম্পর্কের অবনতি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।

দুটি ছবি, প্রশ্ন অনেক

দুটি ছবি ছাপা হয়েছে কলকাতার জনপ্রিয় সংবাদপত্র আনন্দবাজারে। প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে, ত্রিপুরায় সদ্য ক্ষমতাচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত বাসা ছেড়ে দিয়ে দলীয় কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের কোনো বাড়ি নেই, ব্যাংকে প্রচুর টাকা নেই, যা দিয়ে তিনি বাসা ভাড়া দেবেন। তাই স্ত্রীকে নিয়ে নিঃসন্তান মানিক সরকার আশ্রয় নিয়েছেন পার্টির গেস্ট হাউসে। চার-চারবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। একটি দৃষ্টান্ত বটে। দ্বিতীয় ছবিটিও ছাপা হয়েছে আনন্দবাজারে। হাজার হাজার কৃষকের মিছিল মহারাষ্ট্রে। ১৮০ কিলোমিটার হেঁটে, লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে কৃষকরা এই লংমার্চ শুরু করেছিল ৬ মার্চ নাসিক থেকে। শেষ করল মুম্বাই এসে দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে ১২ মার্চ। কৃষকদের দাবি তাদের ঋণ মওকুফ, ফসলের ন্যায্য দাম, ‘লাঙল যার জমি তার’ ইত্যাদি। তাদের অভিযোগ, বুলেট ট্রেন ও সুপার হাইওয়ের নামে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দুটি ছবির সঙ্গে এক জায়গায় মিল আছে—আর তা হচ্ছে সিপিআইএমের নাম। ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন সিপিআইএম ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু নির্বাচনে তারা হেরে গেছে। মানিক সরকার সিপিআইএমের পলিটব্যুরোর সদস্য। আর মহারাষ্ট্রে ওই সিপিআইএমই কৃষকদের সংগঠিত করে ‘লংমার্চ’-এর আয়োজন করেছিল। প্রথমে পশ্চিম বাংলা, পরে ত্রিপুরায় বাম রাজনীতি যখন পরিত্যক্ত হলো, যখন সাধারণ মানুষ ভোটে বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করল, ঠিক তখন প্রায় ৫০ হাজার কৃষকের লংমার্চ নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেবে—বাম রাজনীতি তাহলে আদৌ শেষ হয়ে যায়নি? এটাই এখন মুখ্য আলোচিত বিষয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন, ভারতে বাম রাজনীতির ধারা কি শেষ হয়ে গেল? নাকি বাম রাজনীতি আরো উজ্জীবিত হলো? এটা স্বীকার করতেই হবে—‘মোদি ম্যাজিক’ ভারতে কৃষকদের স্পর্শ করতে পারেনি। এখানে মোদি ব্যর্থ। কিন্তু সারা উত্তর ভারতে, বিশেষ করে ত্রিপুরায় তরুণ প্রজন্মকে এটা আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এই তরুণ প্রজন্মের কাছে যেতে পারেনি সিপিআইএম। বিশ্বব্যাপীই তো এখন দক্ষিণপন্থী একটা প্রবণতা রয়েছে। ইউরোপের দিকে তাকান—সেখানে একটা দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আর বাম রাজনীতি? এই বাম রাজনীতিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। চীনকে এখন আর মার্ক্সবাদী রাষ্ট্র বলা যাবে না। ভিয়েতনাম ‘দই মই’ গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন এনেছে ব্যাপক। এর প্রভাব ভারতে লাগাটাই স্বাভাবিক। এখানে পরিবর্তন আসবে—এটাই স্বাভাবিক। একসময় কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে বিবেচনা করা হতো। সেই বাম রাজনীতির প্রতি মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সাত বছর আগে সিপিএম জনগণের ভোট পায়নি পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৮ সালে পেল না ত্রিপুরায়। তাহলে কী কেরালায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? মোদির টার্গেট তো এখন কেরালা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন ‘শুভবুদ্ধির’ রাজনীতিকে গ্রাস করছে। একসময় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য ছিল একটি ‘মডেল’। সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এখন ভারতে একরকম পরিত্যক্ত! এর বড় প্রমাণ ত্রিপুরার নির্বাচনে সিপিআইএম এবং একই সঙ্গে কংগ্রেসের ভরাডুবি।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন মোদি এখন ভারতকে? অতি সম্প্রতি আরো একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে ভারতীয় পত্রপত্রিকায়। সংবাদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গেল বছর অত্যন্ত গোপনে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছেন। তাদের কাজ হচ্ছে ভারতের ইতিহাসকে নতুন করে লেখা এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে তা সংযোজন করা। কমিটির মূল কাজ হচ্ছে এটা প্রমাণ করা, ভারতের মাটিতে প্রথম যাঁরা বসবাস করতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রাচীন যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায়, তা আসলেই বাস্তব, কোনো ‘মিথ’ বা পৌরাণিক কোনো কাহিনি নয়। কে এন দিক্ষীত এই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় এই কমিটি কাজ করছে, যার বাজেট ৪০০ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায় হিন্দুত্ববাদকে পুঁজি করে মোদি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণীও পার হতে চান। তাই নতুন করে ইতিহাস লেখা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে মোদি ধারণ করেছেন এবং তা প্রমোট করছেন। কিন্তু সামাজিক খাতে মোদির জমানায় অগ্রগতি কতটুকু? নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তো প্রায়ই বলেন, সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো কোনো খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের  চেয়েও ওপরে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতের  চেয়েও এগিয়ে আছে। মিথ্যা বলেননি অমর্ত্য সেন। বিশ্বব্যাংকের কতগুলো পরিসংখ্যান আমরা উল্লেখ করতে পারি, যাতে ভারতের সামাজিক চিত্রের একটি দিক ফুটে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে (২০১৬) দেখা গেছে—ভারতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন দরিদ্র, সাতটি গরিব রাজ্যে শতকরা ৬২ জন ভারতীয় বসবাস করে, ৪৫ শতাংশ মানুষ বাস করে অতি দরিদ্রতম রাজ্যগুলোতে, ৮০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ বাস করে গ্রামে, সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে (৬০ মিলিয়ন) উত্তর প্রদেশে। এরপর বিহারে (৩৬ মিলিয়ন), মধ্য প্রদেশে (২৪ মিলিয়ন), ওড়িশায় (১৪ মিলিয়ন), ঝাড়খণ্ডে (১৩ মিলিয়ন), ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে (১০ মিলিয়ন)। দারিদ্র্যের হার আদিবাসীদের মধ্যে বেশি—৪৩ শতাংশ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২১ শতাংশের আছে টয়লেট সুবিধা, ৬১ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধা আর মাত্র ৬ শতাংশ সুযোগ পায় কলের পানির। এই যে পরিসংখ্যান—এই পরিসংখ্যান কী বলে? এর বাইরে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যার খবরও আমরা জানি। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনি বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এমন জনগোষ্ঠীর কাছে ‘মোদি ম্যাজিক’ পৌঁছেনি। এদের উন্নয়নে মোদির কোনো কর্মসূচি নেই। মোদি বলেছিলেন, ‘মানিক’ ছেড়ে হীরার কথা! স্পষ্টতই তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন মানিক সরকারকে হটানোর। হীরা বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন
 Highways (H), I-way (I), Roadway (R) I Airway (A)| অর্থাৎ উন্নয়ন। উন্নয়নের ‘বটিক’ তিনি খাওয়াচ্ছেন অশিক্ষিত কোটি কোটি মানুষকে। এটা সত্য, সাতবোন রাজ্যগুলোতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। ত্রিপুরায় এসে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি আর Smart phone দেওয়ার! মোদির উন্নয়ন পরিকল্পনার এই হচ্ছে ছবি! কিন্তু যেটা খারাপ খবর, তা হচ্ছে ত্রিপুরায় নির্বাচনের পর সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। তা পরে ছড়িয়ে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায়ও। এই প্রবণতা আমাদের কোনো ভালো খবর দেয় না।
আসলে যা বাস্তবতা তা হচ্ছে বাম রাজনীতিতে সংস্কারটা প্রয়োজন ছিল। মার্ক্স একুশ শতকের রাজনীতিকে চিন্তা করেননি। তিনি যে সময় তাঁর দর্শন লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তখন তাঁর কল্পনায় একুশ শতকের এই পৃথিবী ছিল না। বাম রাজনীতিকে নতুন আলোতে দেখতে হবে। গরবাচেভ চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। পুরো সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে গিয়েছিল। গরবাচেভের ব্যর্থতার কারণেই রাশিয়ায় আজ মাফিয়ানির্ভর এক রাজনীতির জন্ম হয়েছে। পুঁজি সেখানে এখন একটি ফ্যাক্টর। কালো টাকা আর পুঁজি—পুতিনের ক্ষমতার অন্যতম উৎস। চীনের দিকে তাকান? তেং-জিয়াও পিং এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সমাজতত্ত্ব আর বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে নতুন এক অর্থনৈতিক দর্শনের তত্ত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলাফল? চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে এক নম্বর অর্থনীতিতে পরিণত হবে। চীনের অর্থনীতি এখন আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ধীরে ধীরে চীন এক নয়া উপনিবেশ শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। একসময় চীন অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করত না, এখন করে। উদাহরণ মালদ্বীপ। এটাই ঔপনিবেশিক শক্তির চরিত্র। পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে নিয়ে একধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাই শি চিনপিংকে তারা ‘নয়া চীনা সম্রাট’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। ভিয়েতনামেও পরিবর্তন এসেছে। কিউবায়ও আসবে। এপ্রিলে কিউবায় ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশন। ওই অধিবেশনেই রাউল কাস্ত্রো-পরবর্তী নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে। নয়া নেতা দায়িত্ব নেবেন। সেখানেও সীমিত পরিসরে সংস্কার শুরু হয়েছে। এই সংস্কারকে তারা বলছে ‘লিনিইয়েমিয়েনটস’  (Lineamientos)| বাংলা ভাষায় এর অর্থ একধরনের সংস্কার। তাদের ভাষায় এটা ‘আপডেট’। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে তারা একটু উন্নত করতে চায়। এই ‘আপডেট’ কিংবা সংস্কার কিউবায় কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে, তা হয়তো আমরা আজ থেকে ২০ বছর পর আলোচনা করতে পারব। ‘বিড়াল সাদা কী কালো তা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় বিড়াল ইঁদুর মারে কি না’—তেং জিয়াও পিংয়ের এই উক্তি নিয়ে প্রথম দিকে বিতর্ক ছিল। আজ সবাই স্বীকার করেন, চীনে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। কনফুসিয়াস দর্শনের মূল কথা হচ্ছে, ব্যক্তি তথা পারিবারিক সমৃদ্ধি। এই ধারণা তেং গ্রহণ করেছিলেন। ফলে একসময় যে কনফুসিয়াস চীনে নিষিদ্ধ ছিল, এখন সেই কনফুসিয়াস চীনে সমাদৃত। চীনে তাঁর স্ট্যাচুও আছে এখন। তবে এটাও সত্য, এই সংস্কার চীনে বৈষম্য তৈরি করেছে। মানবিক মূল্যবোধগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। গণিকাবৃত্তি চীনে এখন স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আগামী ২০ কিংবা ৩০ বছর পর হয়তো মানুষ চীনকে নিয়ে নতুন করে লিখবে। কিন্তু চীন ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, ব্যক্তির উন্নতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এই রাজনীতি ত্রিপুরায় বাম রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেনি। মোদি চীন থেকে অর্থ নিয়ে গুজরাটকে একটি ‘মডেল রাজ্য’ বানিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিম বাংলার উন্নয়নের জন্য ছুটে গেছেন চীনে। সুযোগ ছিল ত্রিপুরার আর কেরালার। কিন্তু মানিক সরকাররা এদিকে যাননি। মানিক সরকার সৎ মানুষ। তাঁর মধ্যে কোনো বাহুল্য নেই। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাও নেই। বাড়ি-গাড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মানুষ সুখী ছিল না। তরুণ প্রজন্ম খুশি ছিল না। তাদের ‘অ্যাড্রেস’ করতে পারেননি মানিক সরকাররা। কিন্তু মোদি-অমিত শাহ্রা পেরেছেন। আশা দিয়েছেন। ‘গল্প’ শুনিয়েছেন। এই গল্প শুনিয়ে মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মোদির গায়ে ১০ লাখ টাকা দামের স্যুট উঠেছিল, কিন্তু মহারাষ্ট্র, বিহার, ছত্রিশগড়ের কৃষকরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাই কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। মহারাষ্ট্রে কৃষকদের লংমার্চ এ কথাই প্রমাণ করে।
ভারতে বাম রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল। অনেক পুরনো এই দলটি হারিয়ে যাবে নিশ্চয়ই এটা মনে হয় না। তবে যা দরকার, তা হচ্ছে নয়া নেতৃত্ব ও নয়া রাজনীতি। ত্রিপুরায় প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু বাম সরকার এই সম্পদ উত্তোলন (গ্যাস) করতে ও উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেখানে সমগ্র ভারতে সপ্তম পে স্কেলে বেতন দেওয়া হতো, সেখানে ত্রিপুরায় বেতন দেওয়া হতো চতুর্থ পে স্কেলে। মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের দিকে দৃষ্টি দেয়নি বাম সরকার। মানিক সরকারের একটা ব্যক্তি ইমেজ আছে। তাঁর সততা ও ‘ভালোমানুষি’ অ্যাটিচ্যুড একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জন্য কোনো ‘মডেল’ হতে পারে না। তাই পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ত্রিপুরায় বাম রাজনীতিকে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে না নিলেও মহারাষ্ট্রে হাজার হাজার মানুষের লংমার্চ প্রমাণ করে বাম রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা এখনো আছে। সাধারণ মানুষের আস্থা এখন বামফ্রন্ট কতটুকু ব্যবহার করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
দৈনিক কালর কন্ঠ ২১ মার্চ ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফর প্রসঙ্গে দুটি কথা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে এসেছেন ১৩ মার্চ। নেপালে বাংলাদেশি বিমান বিধ্বস্ত হওয়া ও ৪৯ জন যাত্রীর মৃত্যুর কারণে সিঙ্গাপুরে প্রধানমন্ত্রী তার সফর সংক্ষিপ্ত করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে ‘ইকোনমিক কোলাবরেশন’, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সম্পর্কযুক্ত। এ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব এবং প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন। এই সফরে বিনিয়োগ ও সহযোগিতাসংক্রান্ত একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই সফরে ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জ্বালানি ও জ্বালানির বিভিন্ন খাত নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গবৈষম্য ছাড়াও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সিঙ্গাপুরকে বিনিয়োগের জন্য অনুরোধ করেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও সিঙ্গাপুরের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আসিয়ানের সেক্টোরাল পার্টনার হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও প্রধানমন্ত্রী তার সিঙ্গাপুরের প্রতিপক্ষকে জানিয়েছেন। এখানে বলা ভালো, ১৯৭৩ সালে দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছরে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান দেশটি সফর করেননি। ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন। ফিরতি সফরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন ২০০৫ সালের ২০ মার্চ। এরপর এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেলেন।
১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়া এবং মাত্র ৮৫ বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সিঙ্গাপুর অন্যতম একটি শক্তি। দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন ৩৯তম। জিডিপিতে (পিপিপি) সিঙ্গাপুর এখন ৫৩৭ দশমিক ৪৪৭ বিলিয়ন ডলারের অধিকারী। তাই সংগত কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সিঙ্গাপুরের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক ১৫০ কোটি সিঙ্গাপুরি ডলারের বেশি লেনদেন হয়। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশে অন্যতম বিনিয়োগকারী দেশও বটে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ৭৮টি প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। বিভিন্ন খাতে ৮৪ কোটি ডলার বিনিয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ৪০-৪৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন সিঙ্গাপুরে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও নিরাপত্তা খাতে প্রতিদিনই বিনিময় বাড়ছে দু-দেশের মধ্যে।
যদি সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক সিঙ্গাপুরের অনুকূলে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে, আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ প্রায় ১০ গুণ বেশি অর্থের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছিÑ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করেছিল ৮৪ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করেছিল ৮৪৭ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০১২-১৩ বছরে রপ্তানির পরিমাণ ১৫৫ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ডলার, আর আমদানির পরিমাণ ১৪২১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমদানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে নিশ্চয়ই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচিত হওয়ার কথা।
বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের সম্পর্কের আরেকটি দিক হচ্ছে, সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড বা এশিয়া-মিডলইস্ট ডায়ালগে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং, যিনি ২০০৪ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন, তিনি আমেডের কর্মকা-কে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং মূলত এই আমেডের উদ্যোক্তা। তিনি ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিশর, জর্ডান, কুয়েত ও বাহরাইনের সমন্বয়ে এই উপাঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার একটি প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোর একটা সহাবস্থান দরকার। এ অঞ্চলের মধ্যে বহু সংস্কৃতি বহমান। এসব সংস্কৃতির সঙ্গে একটি সেতুবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন গোহ চোক টং। তার চিন্তাধারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন লি সিয়েন লুং। তিনি ২০০৪ সালেই প্রস্তাব করেছিলেন বাংলাদেশের আমেডও থাকা উচিত। তখন আমেড-৮ নামে এর পরিচিত ছিল। এখন অবশ্য ৫০টি দেশ আমেডের সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ আমেডে আছে। এশিয়া অঞ্চল থেকে আছে বাংলাদেশ, ভুটান, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, চীন, কমোরোজ, জিবুতি, মিশর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জাপান, কাজাখস্তান, লাওস, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুদান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম কিংবা তুর্কমেনিস্তানের মতো দেশ। তবে সংস্থাটির যতটুকু শক্তিশালী হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। আমেড গঠনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এবং পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর যখন নির্যাতন শুরু হয়েছিল এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা ছড়ানো হচ্ছিল, তখন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে একটা সহাবস্থানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
পশ্চিমাবিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা নিরসন করে ইসলামের প্রকৃত আদর্শ ও তথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য একটি নতুন ফোরাম গঠনে সিঙ্গাপুরের উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছিল। ২০০৪ সালে ঢাকা সফররত সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই ফোরামে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। একটি উদার গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রমোট করা এবং পশ্চিমাবিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল বোঝাবুঝি বন্ধ করতে তার দেশ কাজ করবে বলে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী তখন আমাদের জানিয়েছিলেন। অনেকে তখন সন্দেহ করেছিলেন আমেড কি ওআইসির বিকল্প হতে যাচ্ছে! কিন্তু গোহ চোক টং তখন জানিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত এ সংস্থাটি কোনোভাবেই ওআইসির বিকল্প হবে না। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, ‘ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম একটি সহিষ্ণু ও উদার ধর্ম। পশ্চিমাবিশ্বে ইসলাম ও সন্ত্রাসকে কখনও কখনও এক অর্থে বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান ও পদক্ষেপের কথা আমরা জানি।’ সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় দেওয়া এই বক্তব্য বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল এবং প্রশংসিতও হয়েছিল।
ভৌগোলিকভাবে একটি ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সিঙ্গাপুর আজ একটি অর্থনৈতিক শক্তি। দেশটি উন্নয়নশীল দেশের তকমা পরিত্যাগ করে আজ একটি উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। একটি ছোট দেশ, আর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল একসময় মৎস্যসম্পদÑ সেই দেশটি কীভাবে অন্য দেশের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে নিজে সম্পদশালী হয়েছে এবং বিশ্বে নিজেকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, এটা অনুকরণীয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছেÑ বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে ব্যাপারে আমরা সিঙ্গাপুুরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি। সিঙ্গাপুরের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে বাংলাদেশি শরিকদের দক্ষতার সংযোজন ঘটিয়ে বিশ্ববাজারে ভোক্তা চাহিদা মেটাতে যৌথভাবে একটি প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে অর্থনৈতিকভাবে দুটি দেশই সমভাবে উপকৃত হবে। দু-দেশের রয়েছে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সুযোগ। আর সে সুযোগ যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারলে ঢাকা ও সিঙ্গাপুর পারস্পরিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে আরও বিস্তৃত পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানো যাবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই চলতে পারে এ অর্থনৈতিক সহায়তা। আর এই সহায়তা গড়ে তোলা সহজেই সম্ভব। কারণ দুটি দেশের মধ্যে নেই কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব; বরং এর বিপরীতে রয়েছে চমৎকার পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য চমৎকার পরিবেশ রয়েছে। এখানে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম। এদের প্রশিক্ষিত করে সহজেই দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সহায়ক। এটি হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান এক বাজার। বাংলাদেশ তখন আসিয়ানমুখী। আসিয়ানে শুল্ক বাজার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সম্পর্ককে আমরা কাজে লাগাতে পারব। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ একটি বড় সংকটে আছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার এদের ফেরত নিতে টালবাহানার আশ্রয় নিচ্ছে। সিঙ্গাপুর সফরে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি নিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সিঙ্গাপুর আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য আসিয়ানভুক্ত দেশ যদি মিয়ানমারকে ‘চাপ’ দেয়, তাহলে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সহজ হবে। তাই যে-কোনো বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর সফরে প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী তার এই সফরকে সামনে রেখে দ্য স্ট্রেইটস টাইমসে একটি প্রবন্ধও লেখেন। তাতে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে সিঙ্গাপুরের নেতাদের অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মধ্যেই এই এলাকার স্থিতিশীলতা ও উন্নতি নির্ভর করছে। সিঙ্গাপুর এখন আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছে। সুতরাং দেশটি যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার বাধ্য থাকবে। আমরা চাই সিঙ্গাপুর এই কাজটি করুক। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা হচ্ছে অর্থনৈতিক সহযোগিতানির্ভর। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিঙ্গাপুর সফরের মধ্য দিয়ে দু-দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলো।

আলোকিত বাংলাদেশ ১৮ মার্চ ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে এগোচ্ছে?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে বরখাস্ত করেছেন। একইসঙ্গে সিআইএ প্রধান মাইক পম্পিওকে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে রেক্স টিলারসনের মতবিরোধের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বিশেষ করে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একমত ছিলেন না টিলারসন। এখন টিলারসনের বিদায় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে কট্টরপন্থী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মাইক পম্পিওর নিয়োগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। পম্পিও এমন এক সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন যখন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ট্রাম্পের একটি সাক্ষাৎকারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, পেন্টাগনের পক্ষ থেকে পরমাণু বোমার আকার ক্ষুদ্র করে আধুনিকায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল গত মাসে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এখন কোন দিকে পরিচালিত হবে?
ট্রাম্প একাধিক ‘টুইট’ করেছেন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে ‘রকেটম্যান’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি ইরানের সঙ্গেও তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬ জাতি যে সমঝোতা হয়েছিল, তা মানতেও অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে তার আপত্তি রয়েছে। এমনকি রাশিয়া ও চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারেও তিনি সন্দিহান। সুতরাং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু কর্মসূচি যে নতুন করে সাজাবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এমনকি তিনি পেন্টাগনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে একটি সামরিক প্যারেড আয়োজন করার। এটা ছিল একটা শোডাউন। নিদেনপক্ষে উত্তর কোরিয়া, ইরান আর রাশিয়ার প্রতি একটি পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ! এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রকে স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধকালীন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব’ বিরাজ করত, সেই মানসিকতায় আবার ফিরে আসবে যুক্তরাষ্ট্র। এ মানসিকতা আবার নতুন করে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে।
স্নায়ুযুদ্ধে অবসান হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। একটা সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির মাঝে এক ধরনের ‘যুদ্ধের’ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ওই পরিস্থিতি বহাল ছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালীন দীর্ঘ সময়ে উত্তেজনা হ্রাসে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুই পরাশক্তির কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ভোর হওয়ার আগে ‘ট্রিনিটি’ নামের বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ দুই বোমা জাপানের আত্মসমর্পণ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানকে ত্বরান্বিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে ১৯৪৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৫২ সালে ব্রিটেন, ১৯৬০ সালে ফ্রান্স এবং ১৯৬৪ সালে চীন পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায় নাম উঠিয়েছিল। পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনা (সল্ট) শুরু করে। ১৯৭০ সালের মার্চে নতুন করে আর কোনো পারমাণবিক অস্ত্রের যাতে বিস্তার না ঘটে, সে লক্ষ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সল্ট-২ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পারমাণবিক অস্ত্রের বিলোপসাধনে দেশ দুটির প্রেসিডেন্ট যথাক্রমে জর্জ বুশ ও মিখাইল গরবাচেভ কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি (স্ট্রাট) স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় স্ট্রাট-২ চুক্তি। ওই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা হয়। ১৯৯৫ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিকে (এনপিটি) ২৫ বছরের জন্য স্থায়ী রূপ দিতে জাতিসংঘে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এখানে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো এবং ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো, পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে আর উত্তর কোরিয়া ২০০৬ সালে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ক্লাবে যোগ দেয়। এর বাইরে ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও ইসরাইলের এ ব্যাপারে কোনো স্বীকারোক্তি নেই। বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বশেষ যে তথ্য (২০১৭) আমরা পাই তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৬৮০০, রাশিয়ার কাছে ৭০০০, যুক্তরাজ্যের কাছে ২১৫, ফ্রান্সের কাছে ৩০০, চীনের কাছে ২৭০, ভারতের কাছে ১২০-১৩০, পাকিস্তানের কাছে ১৩০-১৪০, উত্তর কোরিয়ার কাছে ১০-২০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। উল্লেখ্য, একটি ওয়ারহেড একাধিক পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। আরও একটি কথা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ১২২টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। এখন ৫০টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করলেই ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। তবে এ চুক্তি বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরমাণু যুদ্ধ এড়াতে সাত দশকের প্রচেষ্টার পর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বৈশ্বিক ওই চুক্তিটি হয়েছিল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশের আলোচকরা ১০ পাতার চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছিলেন। চুক্তির পক্ষে পড়েছিল ১২২টি ভোট। একটি ভোট পড়েছে বিপক্ষে। দেশটি হচ্ছে নেদারল্যান্ডস। সিঙ্গাপুর ভোটদানে বিরত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরাইল- এই ৯টি পরমাণু শক্তিধর দেশ কোনো আলোচনায় ও ভোটাভুটিতে ছিল না। জাপানও আলোচনা বয়কট করে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নতুন করে ছোট ছোট পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত এবং সিআইএ প্রধান পম্পিওর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি বিশ্বে আবারও পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রতিযোগিতাকে উসকে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তে চীন ও রাশিয়া তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মস্কো মনে করে মার্কিন পরিকল্পনা সংঘাতপূর্ণ ও যুদ্ধের উসকানিমূলক। এ ধরনের পরিকল্পনা রাশিয়াবিরোধী বলেও মনে করে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর চীন মনে করে- ‘শান্তি ও উন্নয়নে অপরিহার্য বৈশ্বিক প্রবণতা বজায় রাখা দরকার। এর বিরুদ্ধে না গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্রের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তা অনুসরণ করে চলা। আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে।’ চীনকে অযৌক্তিকভাবে পরমাণু হুমকি মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে চীনের নীতি সবসময়ই আত্মরক্ষামূলক- চীনের এটাই বক্তব্য। অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি স্পষ্টভাবেই পরমাণু অস্ত্র বিস্তাররোধী আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। পরমাণু বোমার
ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে বেশি নির্ভরশীল সে দিকটাই তুলে
ধরেছে দেশটির নিউক্লিয়ার পোস্টার রিভিউ। এনপিটি লঙ্ঘনকারী এ পদক্ষেপ মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ছোট ছোট পারমাণবিক বোমা বানানোর সিদ্ধান্ত কি একুশ শতকের তৃতীয় দশকে নতুন করে একধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্ম দেবে? এ মুহূর্তে হয়তো এটা আঁচ করা যাবে না। কিন্তু নিশ্চিত করেই বলা যায়- চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া এর পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণ করবে। উত্তর কোরিয়া অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত পাল্লার পারমাণবিক হামলার কথা বলে আসছে। এখন এই সম্ভাবনা আরও বাড়ল। ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় অ্যালিস স্টেটারের একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, পৃথিবীর ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আর সেনা মোতায়েন করা আছে ১ লাখ ৩৮ হাজার। অন্যদিকে ৯টি দেশে রাশিয়ার ২৬ থেকে ৪০টি ঘাঁটি রয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী রাশিয়া কম্বোডিয়ার ৩টি সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার জন্য কম্বোডিয়া সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। পাঠক, সিরিয়ার পরিস্থিতি স্মরণ করতে পারেন। সিরিয়ায় কুর্দি অঞ্চলে একসময় রাশিয়ার ঘাঁটি ছিল। পরবর্তী সময়ে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের আগেই সেই ঘাঁটি প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি এখনও আছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান ঘাঁটি আছে। সিরিয়ার তারতাস ও লাতকিয়া সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে রাশিয়ার নৌবাহিনী। ফলে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এক ধরনের ‘প্রতিযোগিতায়’ লিপ্ত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার- দেশ দুটি তাদের প্রভাব বাড়াতে চায়। এর বাইরে রয়েছে চীন ও ভারত। চীনকে টক্কর দিতে আফ্রিকায় (সিসিলি) সেনা ঘাঁটি গড়ছে ভারত। জিবুতিতে রয়েছে চীনা ঘাঁটি। আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ অভিন্ন। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া এক ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। ঘুরেফিরে সেই স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতায় ফিরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছে। এই মানসিকতা আরও স্পষ্ট হবে আগামীতে। ছোট পারমাণবিক বোমা বানানোর সিদ্ধান্ত এরকমই একটি সিদ্ধান্ত, যার মধ্য দিয়ে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার সম্পর্ক আরও বাড়বে। উল্লেখ্য, আকারে ছোট ও কম ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমার শক্তি ২০ কিলোটনের মতো। এ বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ভয়াবহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানের নাগাসাকি শহরে এ ধরনের বিস্ফোরণে ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর তাতেই ৭০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে, ‘যতই সীমিত হোক না কেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার যে গ্রহণযোগ্য নয়, তা রাশিয়াকে অনুধাবন করাতে এই কৌশল কাজে দেবে।’ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ ‘কৌশল’ আদৌ কোনো কাজ দেবে বলে মনে হয় না। বরং এই ‘কৌশল’ নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের
জন্ম দেবে, যার আলামত আমরা এরই মধ্যে পেতে
শুরু করেছি।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন পম্পিওর মতো একজন কট্টরবাদী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তার কঠোর মনোভাবের কথা সবাই জানে। টিলারসন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন। এখন ট্রাম্প-কিম জং উন বৈঠক আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ উত্তর কোরিয়া এ আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তা এখন থমকে আছে। ট্রাম্প প্রশাসন স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথা বলছে, যা কিনা এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধের’ সূচনা করতে পারে। চীন এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর বিরুদ্ধে দেশটি আলাদা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এখন পম্পিও কীভাবে এ ইস্যুগুলোকে ‘অ্যাড্রেস’ করবেন, তিনি ট্রাম্পকে কী উপদেশ দেবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ওবামা প্রশাসনের আমলে বিশ্বে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বিরাজ ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গত এক বছরে বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছে। এখন দেখার পালা পম্পিওর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি এটিকে
আরও উস্কে দেয় কিনা। সিনেট পম্পিওর নিযুক্তি
কনফার্ম করবে।
Daily Jugantor
16.03.2018

উত্তর-পূর্ব ভারতে গেরুয়া বিপ্লব




উত্তর-পূর্ব ভারতে গেরুয়া বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। চার বছর আগে যে গেরুয়া বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, তা এখন ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় সম্প্রসারিত হলো। অর্থাৎ বিজেপি এখন এসব রাজ্যে দলীয়ভাবে এবং শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করেছে। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা ট্র্যাডিশনালি এই এলাকা বাম ও স্থানীয় দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এরাই নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। কংগ্রেসের কিছুটা প্রভাব থাকলেও বিজেপির আদৌ কোনো প্রভাব ছিল না। কিন্তু এবার দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বদলে গেল স্থানীয় রাজনীতির ইতিহাস। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিজেপি উত্তর-পূর্ব ভারতে তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো। এটাই ‘মোদি ম্যাজিক’। ২০১৪ সালে মোদি তার ক্যারিশমা দিয়ে ভারত জয় করেছিলেন। তখন উত্তর-পূর্ব ভারতে তার কর্তৃত্ব ছিল না। এখন তা প্রতিষ্ঠিত হলো। অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে এখন বিজেপি তথা এনডিএ জোটের সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। এখন বাকি শুধু মিজোরাম। সেখানে কংগ্রেস সরকার বহাল রয়েছে। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর সেখানে যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে পু লালথানহাওলার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পার্টি (৪০ আসনের মধ্যে ৩২ আসনে বিজয়ী) বিজয়ী হয়ে লালথানহাওলার নেতৃত্বাধীন সরকার সেখানে গঠিত হয়েছিল। চলতি বছরের শেষের দিকে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। মণিপুরে (২০১৭) নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন এন বিরেন সিং। আর ২০১৬ সালে অরুণাচলের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে প্রেম খানডুর নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি (২০১৮) ত্রিপুরা, মেঘালয় আর নাগাল্যান্ডে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফল প্রকাশ করা হয় ৩ মার্চ। আর এই তিন রাজ্যেই বিজেপি ও বিজেপি জোটের শরিকরা সরকার গঠন করেছে। ত্রিপুরায় বামফ্রন্টকে পরাজিত করে বিজেপি এককভাবে বিজয়ী হয়েছে (৬০ আসনের বিধানসভায় ৪১ আসন)। আর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন বিপ্লব দেব। মেঘালয়ে কংগ্রেস এককভাবে বেশি আসনে বিজয়ী হলেও (২১) মাত্র দুটি আসন নিয়ে বিজেপি তার মিত্র ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করেছে। এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর নাগাল্যান্ডে বিজেপি-এডিপিপি জোট (৩০ আসন) সরকার গঠন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নেফিয়ু রিও। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের পতন। এই প্রথমবারের মতো বামদের হটিয়ে বিজেপি সেখানে সরকার গঠন করেছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামফ্রন্ট সেখানে ক্ষমতায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সেখানে রাজ্য সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন ১৯৯৮ সাল থেকে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৮ সময়টা একেবারে কম নয়। তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ত্রিপুরায় পরপর চারবার বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চমবার তিনি ব্যর্থ হলেন বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় নিতে। অত্যন্ত সাধাসিধে ও ‘গরিব’ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। বলা হয় অরুণাচল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (কংগ্রেস দলীয়) গেগং আপাং ছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী। দু-দফায় (১৯৮০-১৯৯৯, ২০০৩-২০০৭) তিনি ২৪ বছরর ক্ষমতায় ছিলেন। একজন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে মানিক সরকারের পরিচিত রয়েছে। বোধকরি তিনি একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যার কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। তিনি নিজে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন না। ব্যাংকে তার জমানো কোনো ব্যালেন্সও নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেতন পেতেন মাসে ২৬ হাজার ৩১৫ রুপি। কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো টাকাটা তিনি পার্টি ফান্ডে দান করতেন। তবে পার্টি থেকে তিনি মাসে ৫ হাজার রুপি ভাতা পেতেন, যা দিয়ে তার সংসার চলত (ডেকান হেরাল্ড)। এ ধরনের একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তার নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট হেরে গেল কেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের। তাহলে কি ত্রিপুরার মতো রাজ্যে, যেখানে বামফ্রন্ট অন্যতম শক্তি হিসেবে সমাজে বিদ্যমান ছিল, নতুন প্রজন্ম কি সেই শক্তির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলল? এ প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হবে এবং নিশ্চয়ই সিপিএম নেতারা এসব বিষয় নিয়ে ভাববেন। সেই সঙ্গে আরও একটা কথাÑ একসময় বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প ভাবা হতো। সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর কলকাতায় ক্ষমতায় থেকে একটি বিকল্প রাজনীতি উপহার দিয়েছিল ভারতে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর কেরালায় বাম রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি ছিল। জনগণের ভোটে তারা বারবার ক্ষমতাসীন হয়েছেন; কিন্তু ২০১১ সাল থেকেই ছন্দপতন শুরু হয়েছে। প্রথমে গেল পশ্চিমবঙ্গ। এককভাবে মমতা ব্যানার্জি সিপিএম তথা বামফ্রন্টবিরোধী অবস্থান নিয়ে সেখানে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছিলেন। এখন ৭ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ত্রিপুরায়। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এই ধারাবাহিকতায় কেরালায়ও কি বাম সরকারের পতন ঘটবে? কেরালায় নির্বাচন হবে তিন বছর পর। সেখানে সিপিএম নানা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারায়েই ভিজয়ান অসুস্থ। গত ২৫ মে ২০১৬ সেখানে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বামফ্রন্ট ১৪০ আসনের বিধানসভায় ৯২টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন ভিজয়ান। যারা কেরালার রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন কেরালার রাজনীতি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সিপিএমের নেতৃত্বে বাম ফ্রন্ট আর ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস। বারবার এদের মাঝে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনেও (২০১৫) বিজেপি এখানে সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০১১ সালের ১৮ মে সেখানে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন অউমেন চান্ডি। আবার এর আগের নির্বাচনে (২০০৬) বিজয়ী হয়েছিল বামফ্রন্ট। এর অর্থ পরিষ্কার, ক্ষমতার পালাবদল ঘটে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মাঝে। বিজেপি এখানে আদৌ ফ্যাক্টর নয়। এই বিজেপি ত্রিপুরায় আদৌ ফ্যাক্টর ছিল না। ১৯৮৩ সালের পরিসংখ্যান বলে, ত্রিপুরায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল ০.০৬ ভাগ, আর ২০১৩ সালের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র ১.৫৪ ভাগ। এই বিজেপিই এবার (২০১৮) ভোট পেল ৪১.২০ ভাগ। অর্থাৎ এখানে ‘মোদি-ম্যাজিক’ কাজ করেছে। সুতরাং বিজেপির পরবর্তী টার্গেট যে কেরালা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে পাঠকদের আরও কিছু তথ্য দিই। প্রখ্যাত বাম নেতা নামবুদ্রিপাদ ছিলেন কেরালার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালের বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে)। আবার কংগ্রেস নেতা করুণাকরণ ও এ কে এটনিও ছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী। কোরালা বারবার ভারতের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করেছে। তাই প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক, কেরালায় সিপিএমের বিকল্প কি বিজেপি হতে পারবে?
এটা বলতে দ্বিধা নেই, ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদি-ম্যাজিক’ ভারতজুড়ে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মানুষ মোদির কথায় সেদিন আশ্বাস রেখেছিল। বিজেপিকে তিনি বিজয়ী করে দিল্লির মসনদে বসিয়েছিলেন। এরপর এক কঠোর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল। একসময় মানুষ বিজেপির নাম জানত না। এখন জানে। এটা মোদির সাফল্য, এটা বলতেই হবে। ইতোমধ্যে বিজেপি ভারতব্যাপী কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় যে বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাম রাজনীতি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। অতি কঠোর হিন্দুত্ববাদ এখন দখল করেছে সে জায়গা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ‘জয়যাত্রা’ থেমে গেছে। হিন্দুত্ববাদই এখন একুশ শতকের ভারতের মূল রাজনীতি! সত্তর দশকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী প্রচ- জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ছিলেন। এখন সে স্থান দখল করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে এখন বিজেপি ক্ষমতায়। মোদি-অমিত শাহ জুটির এখন দরকার আটটি রাজ্যÑ পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিলনাড়–, মিজোরাম। দিল্লি ও পদুচেরি, যা কেন্দ্রশাসিত, সেখানেও ‘গেরুয়া শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি। এসব রাজ্যে কোথাও কংগ্রেস, আর কোথাও আঞ্চলিক দলগুলো ক্ষমতায়। কংগ্রেস নতুন নেতৃত্বে এসেছে। রাহুল গান্ধী এখন কংগ্রেসের সভাপতি। কিন্তু মোদির বিকল্প হিসেবে তিনি এখনও নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তার ব্যর্থতা সেখানেই। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নির্বাচনের ফলই এর বড় প্রমাণ।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির ফলে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। ত্রিপুরায়ও কি আসামের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? আসামে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের যাদেরকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে! আসাম সরকার ইতোমধ্যে নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার একটা সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এখন ত্রিপুরায় বিপ্লব দেবের সরকার কি একই নীতি অবলম্বন করবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের প্রায় সবাই দেশ শত্রুমুক্ত হলে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কেউ কেউ থেকে গিয়েছিলেন বৈকি। এরা পশ্চিমবঙ্গে কোনো ঝুঁকির মুখে নেই। কেননা মমতা ব্যানার্জি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আসামে ও ত্রিপুরায় এখন বিজেপি সরকার।
তারা এসব ‘বাঙালি’কে ফেরত পাঠাতে চায়। তবে এখানে একটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিজেপি ভারতে থাকতে দিতে চায়, মুসলমানদের নয়। ফলে বিপ্লব দেবের মতো লোকও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন, যার বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুরের কচুয়া থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। তার কোনো সমস্যা না হলেও মুসলমানদের সেখানে সমস্যা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরায় নির্বাচনের আগে বিজেপি সেখানকার আদিবাসীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এখন বিপ্লব দেবের সরকার কি তা বাস্তবায়ন করবে? এ ধরনের কোনো উদ্যোগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সেখানেও পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে পারে। তৃতীয়ত, ত্রিপুরায় বিজেপির বিজয়ের পর সেখানে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। এটা একটা ভিন্ন মেসেজ দিল। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নিজে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ। আরএসএসের ছত্রছায়ায় যিনি বেড়ে উঠেছেন, তিনি কি এখন এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দেবেন? সুতরাং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন’ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর জবাব আমরা শুধু আগামীতেই দিতে পারব।
Daily Alokito Bangladesh
11.03.2018

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবর্তন ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে?

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি ও বিজেপি শরিকদের বিজয় কি ভারতের রাজনীতির জন্য কোনো নতুন বার্তা বয়ে আনল? ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো বিজেপির সরকার গঠন, মেঘালয়ে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও সরকার গঠন করতে না পারা, নাগাল্যান্ডে বিজেপি মিত্রদের সরকার গঠন সর্বভারতব্যাপী রাজনীতির জন্য নতুন একটি বার্তা। আর এ বার্তাটি হচ্ছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লির মসনদে বসে যে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ সূচনা করেছিলেন, তা এখন প্রায় পূর্ণ করার পথে নরেন্দ্র মোদি। সেই সঙ্গে আরও একটি বার্তা মোদির সমর্থকরা দিলেন। বিজেপির উত্থান এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ত্রিপুরায় একটি সাম্প্রদায়িক ও ‘বামবিরোধী’ রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। বুলডোজার দিয়ে লেনিনের স্ট্যাচু ভেঙে ফেলা, বামপন্থী সমর্থকদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ যে ‘রাজনীতির’ জন্ম দিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ এ দৃশ্য আগে কখনও দেখেনি। উগ্রপন্থীরা ত্রিপুরায় বাম রাজনীতির এতটুকু চিহ্নও রাখতে চায় না। বিজেপি পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতকে বাম ও কংগ্রেসশূন্য করতে চায়।
ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২১টিতে বিজেপি ও তার সমর্থকরা ক্ষমতায়। পুরো ২৯ রাজ্যেই বিজেপি তার গেরুয়া ঝান্ডা ছড়িয়ে দিতে চায়। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের জুটির এখন দরকার আরও আটটি রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু ও মিজোরাম। দিল্লি ও পন্ডিচেরির দিকেও হাত বাড়িয়েছে বিজেপি। তাদের টার্গেট এসব রাজ্যে বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় কেন্দ্রে সরকার গঠন করা। এ লক্ষ্যেই বিজেপি কাজ করছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির কোনো অস্তিত্ব ছিল না কয়েক বছর আগেও। উত্তর-পূর্ব ভারতে আঞ্চলিক দলগুলোর প্রভাব বেশি। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের প্রভাবও বেশি ছিল। এদের প্রভাব কমাতে বিজেপি গঠন করেছিল নর্থ-ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিজেপির অন্যতম কৌশলবিদ হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে। সেই সঙ্গে বিজেপির সিনিয়র নেতারা নির্বাচনপূর্ব সময়কালে ব্যাপকভাবে এ অঞ্চল সফর করেন। স্থায়ী বন্ধুকে বাদ দিয়ে নতুন বন্ধু খোঁজা ও হর্স ট্রেডিংয়ের কৌশল অবলম্বন করে বিজেপি এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব সম্প্রসারিত করল। এজন্যই দেখা যায়, মেঘালয়ে (মোট আসন ৬০) কংগ্রেস সর্বোচ্চ আসনে (২১ আসন) বিজয়ী হয়েও মাত্র ২ আসন পেয়ে বিজেপি ১৯ আসন নেয়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছে। নাগাল্যান্ডেও বিজেপি ও এনডিপিপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। ত্রিপুরায়ও বিজেপি ও আদিবাসীদের সংগঠন পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরার (পিএফটি) সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। পিএফটিকে মন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীর পদও দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অরুণাচল, আসাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর ও ত্রিপুরায় এখন বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হল।
তবে বলতে দ্বিধা নেই, সবচেয়ে অবাক হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ত্রিপুরায়। এই প্রথমবারের মতো বামদের হটিয়ে বিজেপি সেখানে সরকার গঠন করেছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামফ্রন্ট সেখানে ক্ষমতায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সেখানে রাজ্য সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন ১৯৯৮ সাল থেকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮, সময়টা একেবারে কম নয়। তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ত্রিপুরায় পরপর চারবার বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল; কিন্তু পঞ্চমবার তিনি ব্যর্থ হলেন বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় নিতে। অত্যন্ত সাদাসিধে ও ‘গরিব’ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। বলা হয় অরুণাচল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (কংগ্রেস দলীয়) গেগং আপাং ছিলেন দীর্ঘ সময়ের মুখ্যমন্ত্রী। দু’দফায় (১৯৮০-১৯৯৯, ২০০৩-২০০৭) তিনি ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। একজন সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে মানিক সরকারের পরিচিতি রয়েছে। বোধকরি তিনি একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যার কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। তিনি নিজে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেন না। তার কোনো ব্যাংক ব্যালেন্সও নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেতন পেতেন মাসে ২৬ হাজার ৩১৫ রুপি। কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরো টাকাটা তিনি পার্টি ফান্ডে দান করতেন। তবে পার্টি থেকে তিনি মাসে ৫ হাজার রুপি ভাতা পেতেন, যা দিয়ে তার সংসার চলত (ডেকান হেরাল্ড)। এ ধরনের একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তার নেতৃত্বে বামফ্রন্ট হেরে গেল কেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের। তাহলে কি ত্রিপুরার মতো রাজ্যে, যেখানে বামফ্রন্ট অন্যতম শক্তি হিসেবে সমাজে বিদ্যমান ছিল, নতুন প্রজন্ম সেই শক্তির ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলল? এ প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হবে এবং নিশ্চয়ই সিপিএম নেতারা এসব বিষয় নিয়ে ভাববেন।
সেই সঙ্গে আরও একটা কথা। একসময় বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প ভাবা হতো। সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর কলকাতায় ক্ষমতায় থেকে একটি বিকল্প রাজনীতি উপহার দিয়েছিল ভারতে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর কেরালায় বাম রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি ছিল। জনগণের ভোটে তারা বারবার ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কিন্তু ২০১১ সালে ছন্দপতন শুরু হয়। প্রথমে গেল পশ্চিমবঙ্গ। এককভাবে মমতা ব্যানার্জি সিপিএম তথা বামফ্রন্টবিরোধী অবস্থান নিয়ে সেখানে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটান। সাত বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ত্রিপুরায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধারাবাহিকতায় কেরালাতেও কি বাম সরকারের পতন ঘটবে? কেরালায় নির্বাচন হবে তিন বছর পর। সেখানে সিপিএম নানা অন্তর্™^ন্দ্বে জড়িয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারায়েই ভিজয়ান অসুস্থ। ২৫ মে, ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বামফ্রন্ট ১৪০ আসনের বিধানসভায় ৯২টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। যারা ভারতীয় রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন কেরালার রাজনীতি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট আর ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস। বারবার এদের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনেও (২০১৬) বিজেপি এখানে সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০১১ সালের ১৮ মে সেখানে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কংগ্রেস বিজয়ী হলে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন অউমেন চাণ্ডি। আবার এর আগের নির্বাচনে (২০০৬) বিজয়ী হয়েছিল বামফ্রন্ট। এর অর্থ পরিষ্কার- ক্ষমতার পালাবদল ঘটে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মাঝে। বিজেপি এখানে আদৌ ফ্যাক্টর নয়। বিজেপি ত্রিপুরাতেও ফ্যাক্টর ছিল না। ১৯৮৩ সালের পরিসংখ্যান বলে, ত্রিপুরায় বিজেপি ভোট পেয়েছিল ০.০৬ শতাংশ, আর ২০১৩ সালের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র ১.৫৪ শতাংশ। সেই বিজেপিই এবার ভোট পেল ৪১.২০ শতাংশ। অর্থাৎ এখানে মোদি ম্যাজিক কাজ করেছে। সুতরাং বিজেপির পরবর্তী টার্গেট যে কেরালা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে পাঠকদের আরও কিছু তথ্য দেই। প্রখ্যাত বাম নেতা নামবুদ্রিপাদ ছিলেন কেরালার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী)। আবার কংগ্রেস নেতা করুণাকরণ ও একে এন্টনিও ছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী। কেরালা বারবার ভারতীয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করেছে। তাই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- কেরালায় সিপিএমের বিকল্প কি বিজেপি হতে পারবে?
বলতে দ্বিধা নেই, ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদি ম্যাজিক’ সারা ভারতে একটা বড় আলোড়ন তুলেছিল। ভারতের মানুষ মোদির কথায় সেদিন আশ্বাস রেখেছিল। বিজেপিকে তিনি বিজয়ী করে দিল্লির মসনদে বসিয়েছেন। এরপর এক কঠোর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মানুষ প্রত্যক্ষ করে। একসময় মানুষ বিজেপির নাম জানত না। এখন জানে। মোদির সাফল্য এটি, বলতেই হবে। ইতিমধ্যেই বিজেপি ভারতব্যাপী কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। একসময় যে বাম রাজনীতিকে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই বাম রাজনীতির প্রতি মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সাত বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম জনগণের ভোট পায়নি। ২০১৮ সালে পেল না ত্রিপুরায়। তাহলে কি কেরালাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? মোদির টার্গেট তো এখন কেরালা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন ‘শুভবুদ্ধির’ রাজনীতিকে গ্রাস করছে। একসময় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য ছিল একটি ‘মডেল’। সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এখন ভারতে একরকম পরিত্যক্ত! এর বড় প্রমাণ ত্রিপুরার নির্বাচনে সিপিএম এবং একইসঙ্গে কংগ্রেসের ভরাডুবি।
মোদি ভারতকে এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? অতি সম্প্রতি আরও একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে অঝওঅ ঞওগঊঝ পত্রিকায় (৭ মার্চ ২০১৮)। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গেল বছর অত্যন্ত গোপনে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছেন। তাদের কাজ হচ্ছে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে তা সংযোজন করা। কমিটির মূল কাজ হচ্ছে এটি প্রমাণ করা যে, ভারতের মাটিতে প্রথম যারা বসবাস করতে শুরু করেছিলেন, তারা মূলত হিন্দু ছিলেন। প্রাচীন যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায়, তা আসলেই বাস্তব, কোনো ‘মিথ’ বা পৌরাণিক কাহিনী নয়। কেএন দীক্ষিত এ কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আওতায় এ কমিটি কাজ করছে, যার বাজেট ৪০০ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায়, হিন্দুত্ববাদকে পুঁজি করে মোদি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণীও পার হতে চান। তাই নতুন করে ইতিহাস লেখা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে মোদি ধারণ করেছেন। এবং তা প্রমোট করছেন। কিন্তু সামাজিক খাতে মোদির জমানায় অগ্রগতি কতটুকু? নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তো প্রায়ই বলেন, সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো কোনো খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়ে ওপরে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। মিথ্যা বলেননি অমর্ত্য সেন। বিশ্বব্যাংকের কতগুলো পরিসংখ্যান আমরা উল্লেখ করতে পারি, যাতে ভারতের সামাজিক চিত্রের একটি দিক ফুটে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে (২০১৬) দেখা গেছে- ১. ভারতে প্রতি পাঁচজনের একজন দরিদ্র; ২. সাতটি গরিব রাজ্যে শতকরা ৬২ জন ভারতীয় বসবাস করে; ৩. শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ বাস করে দরিদ্রতম রাজ্যগুলোতে; ৪. শতকরা ৮০ ভাগ দরিদ্র মানুষ বাস করে গ্রামে; ৫. সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে (৬০ মিলিয়ন) উত্তর প্রদেশে। এরপরের অবস্থান যথাক্রমে বিহার (৩৬ মিলিয়ন), মধ্যপ্রদেশ (২৪ মিলিয়ন), উড়িষ্যা (১৪ মিলিয়ন), ঝাড়খণ্ড (১৩ মিলিয়ন), ছত্তিশগড় ও রাজস্থান (১০ মিলিয়ন); ৬. দারিদ্র্যের হার আদিবাসীদের মধ্যে বেশি, শতকরা ৪৩ ভাগ; ৭. দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা ২১ ভাগের আছে টয়লেট সুবিধা, ৬১ ভাগ পায় বিদ্যুৎ সুবিধা, আর মাত্র ৬ ভাগ সুযোগ পায় কলের পানির। এই পরিসংখ্যান কী বলে? এর বাইরে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকের আত্মহত্যার খবর আমরা জানি। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনী বিশ্বব্যাপীই আলোচিত। এসব জনগোষ্ঠীর কাছে ‘মোদি ম্যাজিক’ পৌঁছে যায়নি। এদের উন্নয়নে মোদির কোনো কর্মসূচি নেই। মোদি বলেছিলেন ‘মানিক’ ছেড়ে হীরার কথা! স্পষ্টতই তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন মানিক সরকারের হটানোর। হীরা বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন Highways (H), I-way (I), Roadway (R), I Airway (A)। অর্থাৎ উন্নয়ন। উন্নয়নের ‘বটিকা’ তিনি খাওয়াচ্ছেন অশিক্ষিত কোটি কোটি মানুষকে। এটা সত্য ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোতে তেমন উন্নয়ন হয়নি। ত্রিপুরায় এসে তিনি প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন প্রতিটি বাঙালি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি আর স্মার্ট ফোন দেয়ার! মোদির উন্নয়ন পরিকল্পনার এই হচ্ছে ছবি! কিন্তু যেটা খারাপ খবর তা হচ্ছে, ত্রিপুরায় এখন অব্দি সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে, যা এখন ছড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালাতেও।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে কতগুলো বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। এক. আসামে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু করেছে সেখানকার বিজেপি সরকার। ত্রিপুরায় এর একটা প্রভাব পড়তে পারে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বাঙালি সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ সেখানে থেকে যেতে পারেন। ফলে সেখানেও একটা ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হতে পারে। এই ‘বাঙালিরা’ মূলত মুসলমান এবং বিজেপি তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। দুই. নির্বাচনের আগে বিজেপি ত্রিপুরায় আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক রাজ্যের ধারণাকে সমর্থন করেছিল। এখন নতুন সরকার এ দাবি যদি মেনে নেয়, তাহলে অন্যান্য রাজ্যেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তিন. উত্তর-পূর্ব ভারত এখন বিজেপির কব্জায় চলে যাওয়ায় ‘বাংলাদেশবিরোধী’ প্রচারণা সেখানে শক্তিশালী হতে পারে। এতে করে মোদি উপ-আঞ্চলিক জোটের (বিবিআইএন) যে ধারণা প্রমোট করেছিলেন, তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন ভারতকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়
Daily Jugantor
10.03.2018

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কোন পথে



সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে একাধিক সংবাদের জন্ম হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সংস্থা স্পুটনিক (Sputnik) আমাদের জানাচ্ছে, ভারত সাফল্যের সঙ্গে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ওড়িশা রাজ্যের বালাসোরে অবস্থিত আবুল কালাম দ্বীপের ক্ষেপণাস্ত্রঘাঁটি থেকে এই পরীক্ষা চালানো হয়। অগ্নি-২ ক্ষেপণাস্ত্রটি এক হাজার ২৪২ মাইল দূরে অবস্থিত শত্রুঘাঁটিতে হামলা চালাতে সক্ষম। স্পুটনিক আমাদের আরো জানাচ্ছে যে ভারত অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছে, যা কিনা সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ও ছয় হাজার ২০০ মাইল দূরে অবস্থিত শত্রুর টার্গেটে আঘাত করতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম The wire। সংবাদের শিরোনাম! At Uri ground zero of India-Pakistan tension, Villagers are fleeing in panic। অর্থাৎ উরি সীমান্ত এলাকায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। গ্রামবাসী পালাচ্ছে। তৃতীয় আরেকটি খবর গত ২৩ ফেব্রুয়ারির। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। পাকিস্তান এই বক্তব্যকে ‘অলীক কল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। উপরোল্লিখিত প্রতিটি সংবাদের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের প্রশ্নটি জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভারত ভালো চোখে দেখছে না। চীন পাকিস্তানে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। এটাকে ভারত এক ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখছে। ভারত মহাসাগরে চীন তার নৌ-তৎপরতা বাড়াচ্ছে। সর্বশেষ মালদ্বীপের ঘটনাবলিতে ভারত যাতে সেখানে নাক না গলায় সে ব্যাপারে চীন ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। মালদ্বীপে একটি চীনা নৌঘাঁটি নির্মাণের কথাও শোনা যাচ্ছে। এমনকি পাকিস্তানেও চীন একটি ঘাঁটি করতে পারে! বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে পাকিস্তান চীনের মুদ্রা ব্যবহার করবে—এমন একটি সংবাদও ছাপা হয়েছে অতি সম্প্রতি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ৬১টি দেশ নিয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন, তাতে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশীদার। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা ওবিওআরে ছয়টি অর্থনৈতিক করিডর আছে। এর একটি হচ্ছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর। এই করিডর চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে ভারত মহাসাগরঘেঁষা পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে। এই করিডরে রেলপথ, স্থলপথ সংযুক্ত রয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। এই করিডর খাসগর, গিলগিট, বেলুচিস্তান, ডেরা ইসমাইল খান ও গাওদারকে সংযুক্ত করছে। ভারতের আপত্তিটা এ কারণেই যে এই করিডর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের পাশ দিয়ে গেছে। আজাদ কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণভার পাকিস্তানের। এটা ভারত স্বীকার করে না। ভারত ওবিওআরে যোগও দেয়নি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশই (বাংলাদেশসহ) এই ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। ভারত প্রথম থেকেই চীনের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। আর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা তো প্রায় ৭০ বছরের। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, ভারত মহাসাগরের ‘নিয়ন্ত্রণ’কে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের মধ্যে এক ধরনের ‘সূক্ষ্ম’ প্রতিযোগিতা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ভারত মহাসাগর চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয় ভারত মহাসাগরের অনেক সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। চীন এ অঞ্চলে একাধিক নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। ঠিক তেমনি ভারতও নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ এক ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন সফর করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বটে; কিন্তু যুদ্ধবাজ স্ট্র্যাটেজিস্টদের একটা মহাপরিকল্পনা রয়েছে চীনকে ভেঙে ফেলার! সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে ভেঙে যাওয়ার পর চীন এখন তার অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে! পাঠক লক্ষ করলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেছে। এর ফলে পুরো প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগর এলাকাকে এরা নাম দিয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজিতে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তান যে উত্তেজনা তার পেছনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটি ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-পাকিস্তান মধ্যকার উত্তেজনা কতটুকু দায়ী, তা বিবেচনায় নিতে হবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তিও রয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরনো। এই দ্বন্দ্বের কারণে তিন-তিনবার দেশ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে দুই-দুইবার—১৯৪৭-৪৮ সালে একবার, আর ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে কারগিলকে কেন্দ্র করে আরো একবার যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, যা কিনা জেনারেল মোশাররফকে ক্ষমতা দখল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। ভারত পর পর দুইবার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ওই ঘটনা পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সিপরির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৩৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে আর ভারতের রয়েছে ১২৫টি। ২০১৭ সালে উভয় দেশ ১০টি করে ওয়ারহেড তাদের পারমাণবিক শক্তিবহরে সংযুক্ত করে (Knoema January 23, 2018)। ভারত এরই মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে পাঁচটি আকাশ প্রতিরক্ষার মিসাইল এস-৪০০ কিনতে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই এ চুক্তি চূড়ান্ত করতে চায় তারা। তাহলে পরবর্তী ২৪ থেকে ৫৪ মাসের মধ্যে এসব অস্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সরবরাহ শেষ হবে। ৩০ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে এই মিসাইল সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এর আগে জানুয়ারিতে (২০১৮) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারত সফরের সময় ভারত সাত কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এস-৪০০ মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল বহনে সক্ষম। তাদের মতে, বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী এস-৪০০ এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাই পাল্টে দেবে। মিসাইলটি পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক মিসাইল নসরকেও নিষ্ক্রিয় করতে পারবে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই অস্ত্র চুক্তি নতুন নয়। তবে নিঃসন্দেহে এই চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে অন্যতম বড় চুক্তি। এর আগে এক হাজার ২০০ কোটি ডলার দিয়ে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্য কিনেছিল ভারত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন বলা যেতে পারে, একটি ট্যাংকের যে দাম, ওই পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রাণঘাতী অসুখবিসুখ ঠেকানোর জন্য ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ছয় রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র এক ডলার। একটি মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের (যা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছে। দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। অথচ একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড়পড়তা খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি ডুবোজাহাজের দাম ধরা হয় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে এক বছরের জন্য একজনকে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে মোটামুটি পাঁচ ডলারের মতো ব্যয় হয়। অর্থাৎ একটি ডুবোজাহাজ কেনা মানে ছয় কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। ভারত ও পাকিস্তানে দারিদ্র্য আছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারতে কৃষক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। অথচ এই দেশ দুটিতে সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ফলে উত্তেজনা থাকবেই। চির বৈরী এই দেশ দুটির মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনো ভালো খবর নয়। গত দু-তিন বছর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। ১৩ ডিসেম্বর (২০০১) ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ওই হামলায় পাঁচজন হামলাকারীসহ ১৩ জন নিহত হয়েছিল। ভারত ওই হামলার জন্য কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠী ‘লস্কর-ই-তৈয়বা’ এবং ‘জইশ-ই-মোহাম্মদ’-কে দায়ী করেছিল। এবং এই দুটি জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেছিল। ওই ঘটনার পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক আর ফিরে আসেনি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির লাহোর সফর (১৯৯৯) ও সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আগ্রা সফরের (২০০১) পর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে দেশ দুটি আরো কাছাকাছি আসবে; কিন্তু তা হয়নি। বরং দেশ দুটির মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাকিস্তান মনে করে, ভারত বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে এবং তাদের দিয়ে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করাচ্ছে! অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান মদদ দিচ্ছে—এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পাকিস্তান তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ককে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অবস্থান এখন ভারতের পক্ষে। সব মিলিয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছ
Daily Kalerkontho
08.03.2018

বিপিন রাওয়াতের মন্তব্য ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন অতিসম্প্রতি। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, ‘দেশটির (অর্থাৎ ভারতের) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদতে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে।’ একজন সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি এই মন্তব্যটি করলেন এমন এক সময়, যখন আসামে একধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছে। এই বাঙালিরা মূলত মুসলমান। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। বিজেপি মনে করে, ওইসব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে গেছেন এবং সেখানে বসবাস করছেন, যার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এর আগে বিজেপি সরকার পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। এটা সম্ভব হয়নি মমতা ব্যানার্জির কারণে। বিপিন রাওয়াতের ওই বক্তব্য ভারতীয় গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে। দ্য হিন্দু, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকায় বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যটি ‘রাজনৈতিক’। চলতি ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যাবেন। নিজের ‘রাজনৈতিক পথ’ পরিষ্কার করতেই তিনি ওই মন্তব্যটি করেছেন। বিপিন রাওয়াতের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, এটা সত্য দু-বছর আগেই আসাম সরকার নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অতিসম্প্রতি। আসাম সরকার ১ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের নাগরিকদের শনাক্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এতে কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমান সেখান থেকে বিতাড়িত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের যদি বাংলাদেশ গ্রহণ না করে, তা হলে তাদের বন্দিশালায় রাখা হবে বলে একটি পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের বন্দিশালা নির্মিত হয়েছে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন জেনারেল বিপিন রাওয়াত এ ধরনের একটি কথা বললেন। ফলে এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ সম্পর্ক একটি উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে মোদির জমানায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে উভয় সরকার। এখন তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন, কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুইটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগতে সম্মত হয়েছেন। এই বিপিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহণে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এই চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, গণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছিল। ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (ইঈওগ) হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে এক সময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তীতে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমনার); রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত); রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর; রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানামার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলাই বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। মিয়ানমারের মান্দানায় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। বিবিআইএন জোট যদি সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। পথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানিসম্পদ তথা কৃষি ও মৎস্যসম্পদ ব্যবহার করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংয়ে। কিন্তু এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে একটা বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখনও পুরোপুরিভাবে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপাক্ষিকতা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বাহুপাক্ষিতার আলোকেই রক্ষিত। ভারত এতে এখন সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু এর পূর্ণ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এ মুহূর্তে দুটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এই সমস্যা দুটিই সমাধান সম্ভব। এই সমস্যা দুটি হচ্ছে পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে, যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত এ ব্যাপারে রাজি হয়েছে।
কিন্তু বিপিন রাওয়াতের মতো ব্যক্তিত্ব যখন বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন, তখন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে থাকে বৈকি। আমরা লক্ষ করেছি, মোদি সরকার জেনারেল রাওয়াতের ওই বক্তব্যের কোনো সমালোচনাও করেনি। রাওয়াত নিজে এর ব্যাখ্যাও দেননি। এখন দেখতে হবে, আসামে মুসলমানদের ভাগ্যে কী ঘটে? সত্যি সত্যিই তাদের একটা অংশকে যদি বন্দিশালায় রাখা হয়, তাহলে দু-দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা এ অঞ্চলের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
Daily Alokito Bangladesh
04.03.2018

একটি ছবি, অনেক প্রশ্ন

একটি ছবি ছাপা হয়েছে যুগান্তরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। ছবিটির গুরুত্ব থাকলেও তা ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়। ছবিটি যুগান্তরের কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধির পাঠানো। ছবির সঙ্গে একটি ছোট্ট প্রতিবেদনও আছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে রংপুরের কাউনিয়ায় একসময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীর বুকজুড়ে বালুচর। প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘বৈশাখ মাসে নয়, ফাল্গ–নেই তিস্তার বুকজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর, আর ফসলের মাঠ। খরস্রোতা তিস্তা এখন শীর্ণ মরা খালে পরিণত হয়েছে।’ প্রতিবেদক আরও লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে একটি খালের মাধ্যমে নদী থেকে দেড় থেকে দুই হাজার কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে তিস্তা বর্তমান কঙ্কালসার ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে।’ যারা বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রবাহিত নদী নিয়ে গবেষণা করেন, তারা জানেন তিস্তা নদীর বর্তমান হাল কী। তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তিটি হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশ-ভারত মিডিয়া সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসা ভারতীয় সাংবাদিকরা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, ‘দিদিমণি পানি (জল) দেন না।’ মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকা আত্রেয়ী ও চূর্নীর পানি বাংলাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।
শুধু তিস্তার পানিবণ্টনের কথা কেন বলি, গঙ্গার পানি চুক্তি হলেও ওই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি কমে যাচ্ছে, এ ধরনের সংবাদ প্রায়ই ছাপা হয়। প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে একটি সম্ভাবনা তৈরি হলেও সেখানে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। গঙ্গা ব্যারাজটি নির্মিত হলে পানি ধরে রাখা সম্ভব হতো এবং শুষ্ক মৌসুমে এ পানি ব্যবহার করা যেত। একসময় পাংশায় এটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি উপযুক্ত স্থান দেখার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আগামীতে বাংলাদেশ যে একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরই মাঝে আরও একটি উদ্বেগজনক সংবাদ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে একথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের খরার খবর আমরা সংবাদপত্র থেকে পাচ্ছি। খরায় মৃত্যুর খবরও আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের দিকে বিশ্ব বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়বে। তখন মাত্র ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠী পানি পাবে, বাকি ৪০ ভাগের ক্ষেত্রে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে না। জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার এক রিপোর্টেও দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ পানি সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ‘ভারতের ২২ থেকে ৩২টি শহর ভয়াবহ পানি সংকটের মুখে পড়বে। কাঠমান্ডু ও করাচির মতো শহরও পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব ভালো, তা বলা যাবে না।
ভারতের ‘পানি রাজনীতির’ শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তা যখন ‘মরা খালে’ পরিণত হয় তখন একটি উদ্বেগের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল : বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত চালু করতে যাচ্ছে। স্বয়ং পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছিলেন। অথচ বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ২১নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল, ‘ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।’ কিন্তু উমা ভারতীর বক্তব্য কি ওই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? যৌথ ঘোষণায় যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব ওই রাষ্ট্রের। ভারতের এ ‘আচরণ’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা দু’দেশের সম্পর্ককে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এর ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু শুধু ‘ব্যাখ্যা চাওয়াই’ যথেষ্ট নয়। এখানে বলা ভালো, খোদ ভারতেই এ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তারা সেখানে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন।ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, অর্থাৎ হিমালয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর পানি ৩০ খালের মাধ্যমে ভারতের খরাপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এই যে মহাপরিকল্পনা, তার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৮০ সালে এ পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায়। ২০০২ সালে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও তাদের পক্ষে আছে। তবে সাম্প্রতিককালে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পেছনে কাজ করছে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে প্রচণ্ড পানির অভাব ও খরা দেখা দেয়ার বিষয়টি। কৃষক পানি পাচ্ছে না। পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সম্ভবত এটি বিবেচনায় নিয়েই ভারতের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এটি যে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে, এটি তারা বিবেচনায় নেননি। ভারতের এ পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং দু’দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে
বলা হয়, ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা ুপ্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানি ও উন্নত কৃষি ব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুর জন্য। ওই গবেষণার ফলাফলই বলে দিচ্ছে নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কীভাবে আরও বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কিনা ওইসব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছে যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কারণ ইউপি বা কেন্দ্রীয় সরকার কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটি বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সবক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এ উদ্যোগে একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে ভারত। হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯-এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিষ্কাশন অববাহিকার পানির ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেনশনটি গ্রহণ করা হয়। এ কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সবক’টি শর্তকে একইসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লেখিত নীতিমালাগুলোর আলোকে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভারত কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একইসঙ্গে জলাভূমি এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর; যা কিনা রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্ততে পরিচালিত হবে।’ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা হবে ওই চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন।
তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের পাশাপাশি টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর মোহনায় টিপাইমুখ এলাকায় একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। এ নিয়ে খোদ মনিপুরেই বিতর্ক আছে। সেখানে পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এটি নিয়ে একধরনের লুকোচুরি চলছে। বলা হচ্ছে, সেখানে কোনো বাঁধ নির্মিত হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে খুব ধীরগতিতে সেখানে কাজ চলছে। এ অঞ্চলে শেষ পর্যন্ত বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাহলে বৃহত্তর সিলেট পানিশূন্য হয়ে যাবে। খরা দেখা দেবে। সৃষ্টি হবে পরিবেশগত সমস্যা।
তাই শুধু তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা নয়, সামগ্রিকভাবে প্রাপ্য পানির সুষ্ঠু বণ্টন ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়েই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের স্বার্থেই পানি সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। ভারতের যেমন পানির প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেরও পানির প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা শুধু তিস্তা নিয়ে নয়। তাই প্রয়োজন ভারতীয় নেতাদের আন্তরিকতার। এ আন্তরিকতাই পানি সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
Daily Jugantor
03.03.2018