রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা


জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে এই জোটের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রত্যাশা থাকবেই যে জোট ক্ষমতায় গেলে তাদের জন্য কী কী করবে। ক্ষমতায় গেলে তাদের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে কিংবা অর্থনীতি কী হবে, সে ব্যাপারেও অনেকের আগ্রহ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্রন্টের এই ইশতেহারে আগামী ৫০ বছরের বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ইশতেহারে সব সাধারণ কথাবার্তা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শুধু এক জায়গায় বলা হয়েছে তিস্তা ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। এর মাধ্যমে নতুনত্ব কী পেলাম আমরা? সরকার তো তিস্তার পানিবণ্টনে ভারতের সঙ্গে ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে। তাহলে সরকারের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের পার্থক্য থাকল কোথায়? পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তিস্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যু দুটিই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমাদের ‘অ্যাপ্রোচ’ কী হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। সার্ক, বিবিআইএন, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ইত্যাদি বিষয় আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে কোনো কথা লেখা নেই এসংক্রান্ত বিষয়ে। অর্থনীতি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি বলা হচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে আমাদের কোন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন, সে ব্যাপারে মহাপরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের এক বিশাল তরুণ প্রজন্ম রয়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম একটি ‘শক্তি’। এই তরুণ প্রজন্মকে আমরা প্রশিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বিদেশে রপ্তানিও করতে পারি। জাপানে ও ইউরোপে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। এ দেশগুলো এখন তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করবে। আমরা তাদের ‘অভাব’ পূরণ করতে পারি। কিন্তু সে জন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ার উদ্যোগ। আমাদের দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তরুণ বেকার সৃষ্টি করছে। এরা জাতীয় উন্নয়নে কোনো সমাধান রাখতে পারছে না। বিশেষ বিশেষ খাতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আইটি খাতে বিদেশে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। নার্সিং পেশার চাহিদা বিদেশে ব্যাপক। মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টও দরকার। এই খাতগুলো বাহ্যত উপেক্ষিত। প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা কোনো সমাধান নয়। বরং প্রতি জেলায় প্রতিটি কলেজকে টেকনিক্যাল কলেজে ধীরে ধীরে উন্নীত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে প্রযুক্তিগত বিদ্যা, বায়োটেকনোলজি, কৃষি, আইটি—এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতিটি বিভাগে একটি করে টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষা আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। দক্ষ জনশক্তিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং ঐক্যফ্রন্ট একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা জাতিকে জানাতে পারত। কিন্তু ইশতেহারে তা নেই।

নির্বাচনের যখন বাকি আছে মাত্র কয়েকটি দিন, তখন ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এবং সেই সঙ্গে বামফ্রন্ট ও জাতীয় পার্টি এক এক করে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল হলেও ঐক্যফ্রন্টের বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। তবে সংগত কারণেই ঐক্যফ্রন্ট আর আওয়ামী লীগের ইশতেহার নিয়ে আলোচনা হবে বেশি। ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—প্রতিহিংসা নয়, জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য, আর এই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠায় একটি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’  (Truth and reconciliation) কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, সংসদে ডেপুটি স্পিকারের পদটি বিরোধী দলকে দেওয়া, সরকারি চাকরিতে (পুলিশ ও সেনাবাহিনী বাদে) কোনো বয়সসীমা না থাকা, শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার, দুর্নীতি রোধে যথাযথ ব্যবস্থা, বিচারবহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ, বিভাগীয় সদরে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা, ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ, নির্বাচনে মনোনয়নব্যবস্থায় ন্যূনতম ২০ শতাংশ নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা, মোবাইল ফোনের কলরেট কমানো, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান থাকা, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন, সমতার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, আলোচনার মাধ্যমে তিস্তা ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, বঙ্গোপসাগর থেকে ভূমি উদ্ধারের ব্যবস্থা ইত্যাদি। ফ্রন্টে ইশতেহারে আছে ৩৫ দফা ও ১৪ প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই আবার বিএনপির ইশতেহারেও আছে।
তবে এটা ঠিক, ইশতেহারে কিছু ভালো কথাও আছে। দুই টার্মের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না—এটি ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট দুই টার্মের বেশি থাকতে পারেন না। এমনকি ইউরোপের অনেক দেশে দল হেরে গেলে দলের নেতা যিনি নেতৃত্বে থাকেন কিংবা যাঁর নেতৃত্বে দল নির্বাচনে যায়, দল হেরে গেলে তিনি নেতৃত্ব ছেড়ে দেন। দৃষ্টান্ত ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি সিস্টেম। দুই টার্মের বেশি কেউ ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। চাকরিতে (সরকারি) বয়সসীমা তুলে দেওয়ার ঘোষণাও ভালো। প্রচলিত ব্যবস্থায় পিএসসির মাধ্যমে যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, প্রায় ক্ষেত্রেই তাঁদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ্ব বদলে যাচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি না থাকায় আমরা অন্য দেশের সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশনে’ আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পারি না। তাই পরিচালনায়, বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার প্রথার বাইরে গিয়ে বেসরকারি খাত থেকে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র এটা অনুসরণ করে। সম্প্রতি মোদি সরকারও ভারতে এটি চালু করেছে। নারীদের সংরক্ষিত কোটা কমিয়ে আনার প্রস্তাবও ভালো। পশ্চিমবঙ্গ কিংবা নরডিক দেশগুলোর দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ জন্য সংসদে প্রধান বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার, একাধিক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের পদ দেওয়া যেতে পারে। ফ্রন্টের প্রস্তাবে তা আছে। একটি  Tauth and Reconciliation কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এটাও ভালো প্রস্তাব। এই কমিশন একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ইশতেহার নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে রয়েছে ২১ দফা। এই ২১ দফায় আওয়ামী লীগ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ, তরুণসমাজকে জনশক্তিতে রূপান্তর, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, নারীর ক্ষমতায়ন, নিরাপদ খাদ্য, জঙ্গিবাদ নির্মূল, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, দারিদ্র্য নির্মূল, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, কৃষিব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ, দক্ষ জনপ্রশাসন, ব্লু-ইকোনমি, নিরাপদ সড়ক, প্রবীণ কল্যাণ ইত্যাদি। অন্যদিকে বিএনপি তাদের ইশতেহারে ২২টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রেখেছে। এগুলো হচ্ছে—গণতন্ত্রকে নিত্যদিনের চর্চায় পরিণত করা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, গণভোটব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, স্বল্প সুদে শিক্ষাঋণ, বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য তহবিল গঠন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ, মসজিদের খতিবদের জন্য সম্মানী ভাতা, শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে সব ভ্যাট বাতিল, পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ বছর মেয়াদি ঋণ চালু করা, বেকার ভাতা চালু ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করবে, অন্যদিকে বিএনপির ইশতেহারে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলা হলেও বিএনপির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা হয়নি। যেহেতু ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি নির্বাচন করছে, সে ক্ষেত্রে বিএনপির আলাদা নির্বাচনী ইশতেহার দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তার পরও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইশতেহার নিয়ে কথা বলা যায়। উভয় দলের ইশতেহারেই এক ধরনের কাগুজে প্রতিশ্রুতি রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। আওয়ামী লীগ বড় দল। সরকারে আছে ১০ বছর। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, আরো পাঁচ বছর তাঁর থাকা দরকার। এ কারণে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দলটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকঋণ জালিয়াতির একাধিক সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আর জালিয়াতি বন্ধ করা যায়নি। খেলাপি ঋণের করাল গ্রাসে এখন ব্যাংকিং খাত। পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ৯৪ শতাংশ এবং অন্য ছয়টির ২০ থেকে ৩৪ শতাংশ। প্রথমবারের মতো ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ৫৮ শতাংশ। ৯ মাসে বেড়েছে ২৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ১০ কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ এখন ৬০ হাজার টাকা। অর্থনীতির এই পরিসংখ্যান সরকারের উন্নয়নের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিগত দিনগুলোতে সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাতের ওপরে। দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু দুর্নীতি রোধে সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন। বিশ্ব ধীরে ধীরে এক ধরনের আর্থিক সংকটের দিকে যাচ্ছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ দৃশ্যত বজায় রয়েছে। এতে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। আগামী সরকারের জন্য এটা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বিএনপির কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। উন্নয়ন আমাদের প্রয়োজন। সেখানে দুর্নীতি রোধ করাটা জরুরি। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে গরিব মানুষের সংখ্যাও। দলগুলোর ইশতেহারে বৈষম্য কমাতে এ ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি নেই। এ দেশে তরুণ বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এরা বেকার, অর্ধবেকার। সরকার সবাইকে চাকরি দিতে পারবে না। কোনো সরকারই তা পারে না। আগামী পাঁচ বছরে ২৮ লাখ কর্মসংস্থানের কথা বলছে আওয়ামী লীগ। জনপ্রতি দুই লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথাও বলছে আওয়ামী লীগ। এতে করে বেকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান হবে না। এ জন্য দরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষিত কর্মী গড়ে তোলা। দলগুলোর ইশতেহারে আমরা কোনো ধরনের পরিকল্পনার কথা শুনিনি। জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য এনার্জি সম্পর্কে কোনো পরিকল্পনার কথা জানায়নি।
আসলে এ ধরনের নির্বাচনী ইশতেহার আমাদের মতো দেশে নির্বাচনে তেমন প্রভাব ফেলে না। সাধারণ মানুষ দলগুলোর প্রতিশ্রুতি দেখে ভোট দেয় না। ভোট দেয় মার্কা দেখে। সুতরাং দলগুলো কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বা এতে করে সাধারণ মানুষ কতটুকু উপকৃত হবে, সে বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ খুব একটা বিবেচনায় নেয় না। তার পরও দলগুলোকে নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের ইশতেহার দিতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হলে প্রয়োজন একটি আস্থার সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সেই আস্থার সম্পর্কে রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। এ ক্ষেত্রে আস্থার সম্পর্ক যদি নির্বাচনের পরে গড়ে না ওঠে, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না।

যে বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিতে হবে


তাইফুরের আত্মহত্যা ও শান্তার খোলা চিঠির পরও পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি এখনও বেশ আলোচিত। এ রকম অনেক তাইফুর আত্মহত্যা করে। এ রকম অনেক শান্তার খোলা চিঠিও ছাপা হয়। কিন্তু আলোচনা হয় কম। এই দুই ভাইবোনের 'কাহিনী' আলোচনা হচ্ছে নানা কারণে। শান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমার ছাত্রীতুল্য ও সহকর্মী। শান্তা তার ভাই তাইফুরের আত্মহত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাইফুর ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ছাত্র। অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল সে। কিন্তু মাস্টার্সে তার ফল খারাপ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়! হতাশা থেকে তাইফুর আত্মহত্যা করে। মাস্টার্সে তার ফলাফল খারাপের জন্য শান্তা দায়ী করেছে শিক্ষক রাজনীতিকে। সে যে প্রশ্নগুলো তুলেছে (মাস্টার্সে থিসিসের সুপারভাইজার না দেওয়া, ১০ নম্বরে শূন্য দেওয়া ইত্যাদি, ক্যাম্পাস লাইভ, ১৮ জানুয়ারি)- এই প্রশ্নগুলো কি অমূলক? আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, আমরা কি এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত নই? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী হচ্ছে, কারা সেখানে শিক্ষক হচ্ছেন, কীভাবে শিক্ষক হচ্ছেন- সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাবার। তরুণ প্রজন্ম আমাদের অহঙ্কার। এরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু একজন তরুণের যখন সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়, সে তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের আত্মহত্যা কখনই কাম্য নয়। আমরা তা প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু তাইফুররা যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে, আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে তা পীড়া দেয়। আমাকেও এক ধরনের হতাশায় পেয়ে যায়। এক ধরনের দুঃখবোধও কাজ করে আমার মাঝে। আমার শ্রেষ্ঠ ছাত্রটিকেও আমি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারিনি। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষক না হয়ে তারা কেউ কেউ এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পর্যন্ত করছে। এর অর্থ, তাদের মেধা ছিল। আমরা এই সমাজ বাংলাদেশে সেই মেধার মূল্যায়ন করতে পারিনি। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা আমার ব্যর্থতা। আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। এখন তো আমাদের যাওয়ার পালা। সময় তো কম কাটল না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। কিন্তু কী রেখে যাচ্ছি আমরা? কারা শিক্ষক হবেন? কারা আগামী দিনের তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করবেন? শিক্ষামন্ত্রী নতুন। তার উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা কী, আমি জানি না। কিন্তু যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবেন, তারা শিক্ষামন্ত্রীকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন কিনা, আমার তাতে সন্দেহ। তাইফুরের আত্মহত্যার পর একজন তানিয়ার লেখাও পত্রপত্রিকায় 'প্রতিক্রিয়া' হিসেবে ছাপা হয়েছে। তানিয়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেও তানিয়া ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেনি।

দুই.

তাইফুরের আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সম্মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে এসেছে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের প্রশ্নটিও। ভালো ছাত্রটি এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য একটা 'রাজনীতি' আছে। সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে অর্থ, দলীয় আনুগত্য, বিশেষ বিশেষ এবং ক্ষমতাবান শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক। ফলে যারা এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের জড়িত করতে পারে না, তারা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা। ভালো ছাত্র হয়েও অনেকে আবার বিপথগামী হয়। শুনলে অবাক হবেন, শিক্ষক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট একক নীতিমালা কোথাও অনুসরণ করা হয় না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইউজিসি একটি নীতিমালা প্রয়োগ করলেও, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপত্তি জানিয়েছে। ফলে নীতিমালাটি বাস্তবায়িত হয়নি। এখন যা হয় তা হচ্ছে, উপাচার্য আর বিভাগের সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত (প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে)। এ ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য হলো আসল। আপনি যদি দল না করেন, তাহলে ভালো ছাত্র হয়েও আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না। ভালো ছাত্রটি সাধারণত কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকে না। অনেক সময় শুধু শিক্ষক হওয়ার জন্য তাকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করতে হয়। এই সখ্য তৈরি না হলে তার 'স্বপ্ন' স্বপ্নই থেকে যায়। একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকে বটে। কিন্তু যারা 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে থাকেন বা নিযুক্ত হন, তারা সবাই দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে তাদের 'যোগ্যতা' বড় বিষয় নয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ের 'বিশেষজ্ঞ প্যানেলে'র সদস্য মনোনীত হয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব? এই প্রশ্নটি উপাচার্যের কাছে আদৌ কোনো বিষয় বলে মনে হয়নি! এখন একজন প্রত্নতাত্ত্বিক কী করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করবেন? এ ধরনের অনিয়ম শত শত। কেউ প্রশ্ন করে না। কেননা দলীয় প্রশ্নটি এখানে বড়। শুধু তাই নয়, যিনি হয়তো পড়েছেন অর্থনীতি, তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অন্য বিভাগে। যিনি পড়েছেন লোকপ্রশাসনে, তিনি এখন উন্নয়ন অর্থনীতির শিক্ষক। এ ধরনের দৃষ্টান্ত অনেক। কীভাবে বিভাগের কিছু ক্ষমতাবান শিক্ষক তাদের বা তার পছন্দের ছাত্র বা ছাত্রীকে অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে শিক্ষক বানান কিংবা একটি সিন্ডিকেট গঠন করে কীভাবে বিশেষ ছাত্রটিকে শিক্ষক বানানোর উদ্যোগ নেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের জানিয়েছিল টিআইবি। 

টিআইবির তদন্তে উঠে এসেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব অনিয়মের কথা। শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছিল টিআইবি। অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ! প্রভাষকের জন্য এক রেট আবার সহকারী অধ্যাপকের জন্য আরেক রেট। এই রেটের আবার বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে পার্থক্য আছে। টিআইবির ওই প্রতিবেদন দুদক বিবেচনায় নেয়নি। বিবেচনায় নিলে অনেক উপাচার্য ও ক্ষমতাবান শিক্ষকের দুর্নীতি উঠে আসত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দুদক অনেক ভালো কাজ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই যে অনিয়ম, তা যদি দুদক তদন্ত করত, আমি খুশি হতাম। এতে করে অন্তত শিক্ষক নিয়োগে 'টাকার খেলা' বন্ধ হতো। এটা বন্ধ না হলে এই প্রবণতা বাড়বে বৈ কমবে না।

তিন.

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করা দরকার। ইউজিসি যে নীতিমালা তৈরি করেছে, তা একুশ শতকের উপযোগী নয়। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টির মতো। হয়তো আগামীতে আরও হবে। এ ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা তৈরি করা দরকার, যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। একটা সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক। সুতরাং নতুন একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার। শিক্ষামন্ত্রী নতুন। তিনি নিল্ফেম্নাক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারেন- ১. ইউজিসির অধীনে অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো একটি কমিশন গঠন করা, যার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চাহিদা জানাবে আর কমিশন সে মতে ব্যবস্থা নেবে। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে 'বিশেষজ্ঞ প্যানেল' নিযুক্ত হবে, যাতে করে প্যানেল সদস্যদের 'প্রভাবিত' করার কোনো সুযোগ না থাকে; ২. তিনটি পর্যায়ে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে- অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্ট, লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা এবং ডেমো ক্লাস। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য মার্ক নির্ধারিত থাকবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এক বছরের জন্য প্রার্থী অস্থায়ী নিয়োগপত্র পাবেন। এক বছরে তিনি একটি গবেষণাগ্রন্থ, আর্টিকেল প্রকাশ করবেন; ৩. পাস করার পরপরই কোনো প্রার্থী আবেদন করার যোগ্যতা রাখবেন না। তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে কোনো সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে নূ্যনতম এক বছর কাজ করবেন। অতঃপর যোগ্য হিসেবে আবেদন করতে পারবেন। শ্রীলংকায় এমনটি আছে আর ইউরোপে পিএইচডি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালাতেও পরিবর্তন প্রয়োজন। পদোন্নতির নীতিমালা স্বচ্ছ নয়। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া উচ্চ পর্যায়ে পদোন্নতি কাম্য নয়। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া এমনকি ভারতের মতো দেশেও চিন্তা করা যায় না। ইউরোপে শিক্ষকতায় প্রবেশের এন্ট্রি পয়েন্ট হচ্ছে পিএইচডি। একসময় ছিল, এর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন দেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নিজেরাই পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে। সুতরাং এন্ট্রি পয়েন্টে পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নিয়ে ইউজিসি একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। তাতে খুব যে সফলতা পাওয়া গেছে, তা বলা যাবে না। এতে করে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হয়নি। তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে একটি ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন, যে ফান্ড থেকে তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করার জন্য বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হবে। বেসরকারি সেক্টর থেকেও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর নামেও এই ফান্ডটির নামকরণ হতে পারে। এতে করে আমাদের তরুণ শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।


উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে ইউজিসির ভূমিকা আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম বন্ধে ইউজিসির ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু বাড়েনি শিক্ষার মান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত 'সার্টিফিকেট বিতরণ' কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী একটি কমিশন গঠন করতে পারেন, যারা একটা নীতিমালা প্রণয়ন করবে। যে নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হবে।
দৈনিক সমকাল, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

সদ্যসমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে কী পেল বিশ্ব

শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর জোট হচ্ছে জি-২০। এ জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছেÑ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। বিশ্বের জিডিপির ৯০ শতাংশ এ দেশগুলোর হাতে এবং ৮০ শতাংশ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে জি-২০-এর দেশগুলো
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুুয়েনস আয়ারসে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর স্থান হিসেবে পরিচিত জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে ২ ডিসেম্বর। বিশ্ব রাজনীতি যারা এখন নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা সবাই উপস্থিত ছিলেন বুয়েনস আয়ারসে। যেমন উল্লেখ করা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (যুক্তরাষ্ট্র), চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো, জার্মান চ্যান্সেলর মর্কেল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র কথা। শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর জোট হচ্ছে জি-২০। এ জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছেÑ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। বিশ্বের জিডিপির ৯০ শতাংশ এ দেশগুলোর হাতে এবং ৮০ শতাংশ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে জি-২০-এর দেশগুলো। জি-২০ যে বিশ্ব রাজনীতির জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য দেওয়া যায়। যেমনÑ  ৬৫ শতাংশ বিশ্বের জনগোষ্ঠী এ ১৯টি দেশে বসাবস করে। এরা কার্বন নিঃসরণ করে বিশ্বে যত কার্বন নিঃসরণ হয় তার ৭৯ ভাগ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জি-২০ দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ ৭৫ হাজার ৩৯৩ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৮৫ মিলিয়ন ডলার, চীনের ১২ হাজার ১৪ মিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে কম ২৯৪ মিলিয়ন ডলার দক্ষিণ আফ্রিকার। বিশ্ব অর্থনীতিতে এ দেশগুলোর অবদান অনেকটা এ রকমÑ চীন ১৭.৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ১৫.৫ শতাংশ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৬.৭ শতাংশ। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে রপ্তানি করেছিল ২ হাজার ৫৬০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ২ হাজার ৮০৬ মিলিয়ন ডলার। একই সময় চীন রপ্তানি করেছিল ২ হাজার ২১৩ মিলিয়ন ডলার, আর আমদানি করেছিল ২ হাজার ১৪৮ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং এ ধরনের একটি অর্থনৈতিক জোট যখন একটি সম্মেলনে মিলিত হয়, তখন তার গুরুত্ব থাকে অনেক বেশি। তাই সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল বুয়েনস আয়ারস সম্মেলনের দিকে। এ সম্মেলনটি আরও অনেক কারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ, আজভ (অুড়া) সাগরে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের তিনটি যুদ্ধ জাহাজ জব্দ ও ট্রাম্প কর্তৃক পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বাতিল, ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত অগ্রগতির প্রেক্ষিতে এ শীর্ষ সম্মেলনের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে সংগত কারণেই একটা প্রশ্ন ছিল, এ শীর্ষ সম্মেলন থেকে বিশ্ব কী পেল? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পুরো বিশ্বটাকেই এক ধরনের বদলে দিতে চাচ্ছেন। অভ্যন্তরীণভাবে তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন। আর আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন। চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে তিনি বড় ধরনের ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিল। জানুয়ারিতে তা কার্যকর হওয়ার কথা। এই শুল্ক ও পাল্টা শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। ফলে একটি ট্রাম্প-শি জিন পিং বৈঠক অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। এখন এ বৈঠকটি হলো বটে; কিন্তু তাতে লাভ কী হলো?
বুয়েনস আয়ারসে একটি সমঝোতা হয়েছে বটে; কিন্তু সেই সমঝোতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বুয়েনস আয়ারসে ট্রাম্প ও শি ঐকমত্য পৌঁছেছেন যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আগামী তিন মাস নতুন করে কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। জি-২০ সম্মেলনের আগে তৃতীয়বারের মতো চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। চীনের আরও প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্যের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হবে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী তিন মাসে যদি শুল্ক কমানোর ব্যাপারে কোনো সমঝোতা না হয়, তখন কী হবে? হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, কোনো সমঝোতা না হলে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে এ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য চীন কৃষি, জ্বালানি, শিল্পসহ বিভিন্ন পণ্যের একটি ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিমাণ কিনতে রাজি হয়েছে। তবে এটা খোলাসা করা হয়নি যে, চীন কী পরিমাণ পণ্য কিনবে। ট্রাম্প সরকার অভিযোগ করে আসছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে চীনা পণ্যের প্রবেশ উন্মুক্ত করে দিলেও চীনের বাজারে মার্কিন পণ্য প্রবেশ করতে পারছে না। চীনের এ আচরণ ন্যায়সংগত নয়। গত জুলাই থেকেই ২৫০ মিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও ১১০ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে পাল্টা প্রতিশোধ নেয়। চলতি বছর একটা বড় সময়জুড়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। এ নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্মকর্তারা দফায় দফায় মিটিং করলেও কোনো সমাধান তাতে হয়নি। এখন বুয়েনস আয়ারসে শীর্ষ বৈঠকের পর ট্রাম্প অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেছেন, একটা দুর্দান্ত বৈঠক হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য অনেক ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। আর এর প্রত্যুত্তরে চীনা বিদেশমন্ত্রী বলেছেন, ‘এর ফলে শুধুই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষই উপকৃত হতে চলেছেন তা নয়, এতে ভালো হবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিরও। এখন দেখার পালা, আগামী তিন মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক আলোচনায় অগ্রগতি কতটুকু হয়। এখানে বলা ভালো, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। অর্থাৎ চীন যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রপ্তানি করে, সেই তুলনায় আমদানি করে কম। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনে রপ্তানি করেছে ৯৩ হাজার ৩৬৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ আমদানি করেছে চীন থেকে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩১.৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ ৯ মাসে মোট ঘাটতি ৩ লাখ ১ হাজার ৩৬৮.২ মিলিয়ন ডলার। এ ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য যাচ্ছে কম। চীনা পণ্য বেশি আসছে যুক্তরাষ্ট্রে। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৬.৪ মিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করেছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৮৯৩.৬ মিলিয়ন, আমদানি করেছিল ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৭০ মিলিয়ন)। ২০১৬ সালেও ঘাটতি ছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৬.৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৮.৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালের ঘাটতি ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৭.৭ মিলিয়ন ডলার (United States Census, Foreign Trade)। ট্রাম্প ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবসায়ী। তিনি জানেন, এ বাণিজ্য ঘাটতির অর্থ কী? বাণিজ্য ঘাটতি কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এজন্যই ট্রাম্প চাচ্ছেন চীনে বেশি রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত করা, যাতে ঘাটতি কমে যায়। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বড় ঋণ রয়েছে চীনের কাছে। অর্থাৎ চীন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিল, নোট আর বন্ড কিনে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করছে। এর পরিমাণ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১.১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। মোট ৬.২ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের মাঝে চীনা ঋণের পরিমাণ শতকরা ১৮ ভাগ। চীনের পাশাপাশি জাপান, ব্রাজিল, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য থেকেও যুক্তরাষ্ট্র ঋণ নেয়। চীনের পরে জাপানের ঋণ, যার পরিমাণ ১.০৩ ট্রিলিয়ন ডলার, ব্রাজিলের ৩১৭ মিলিয়ন, আয়ারল্যান্ডের ২৯০ মিলিয়ন আর যুক্তরাজ্যের ২৭৬ মিলিয়ন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের চীনের প্রতি নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই এ নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা থাকবে। এটা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। এজন্যই চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধে আমরাও আক্রান্ত হব। ট্রাম্প বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতিতেও পরিবর্তন আনতে চান। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। 
বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বিশ্ব আসরে একক শক্তি নয়। যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে চীন দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে দাঁড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে রাশিয়াও বিশ্ব আসরে আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানে যেতে চায়। এমন এক পরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়া এক ধরনের ঐক্য গড়ে তুলছে। এ ঐক্য যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে চীনের সাহায্য ও সহযোগিতার। উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যবহার করেছিল। সিঙ্গাপুরে ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার পেছনে চীনের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব ছাড়াও দক্ষিণ চীন সাগর তথা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে কর্তৃত্বের প্রশ্নে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে দ্বন্দ্ব আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার নৌকর্তৃত্ব বাড়িয়ে চীনকে ঘিরে ফেলার একটি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেÑ এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। ফলে একুশ শতকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যায়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। 
আপাতত ৯০ দিনের জন্য কিছুটা স্বস্তি এসেছে বটে; কিন্তু সমস্যা আছে অনেক। সাইবার নিরাপত্তা কিংবা মেধাস্বত্ব আইন চীন মানছে না, এ ধরনের অভিযোগ মার্কিন প্রশাসনের অনেক দিনের। এর কী হবে? বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উরংঢ়ঁঃব-ংবঃঃষবসবহঃ প্রক্রিয়া নিয়ে ট্রাম্পের আপত্তি রয়েছে। যদি বাণিজ্য বিরোধ নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা Dispute-settlement-এর মাধ্যমে এর সমাধান করে থাকে। কিন্তু এ প্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘস্থায়ী। আর এজন্যই ট্রাম্প বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনে পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ফলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। সুতরাং একটা সমঝোতা হয়েছে বটে; কিন্তু তা রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। এজন্যই যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ম্যাগাজিন The Economist মন্তব্য করেছে এভাবে After the weekends G-20 truce, businesses were quick to breath right of relief. But this war is not over yet. এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা আপাতত স্বস্তি এসেছে; কিন্তু ‘যুদ্ধ’ এখনও শেষ হয়নি। হ

নয়া মন্ত্রিসভা ও আগামী দিনের রাজনীতি


মন্ত্রিসভা থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তাঁদের বাদ দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক—এ প্রশ্ন করাই যায়। কেননা পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পররাষ্ট্র, পরিবেশ, বাণিজ্য, অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য দক্ষ মন্ত্রী দরকার। না হলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমরা টিকে থাকতে পারব না। বর্তমান বিশ্ব অতি বেশি মাত্রায় প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বকে নানা ধরনের বিধি-বিধানের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন মন্ত্রী, যিনি মন্ত্রণালয়ের প্রধান এবং মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্ব দেবেন, তিনি যদি অভিজ্ঞ না হন, তাহলে এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তিনি বাংলাদেশকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। দুঃখজনক আরো, আমরা একটি দক্ষ আমলা শ্রেণিও তৈরি করতে পারিনি; যার ফলে অন্য দেশের সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশনে’ আমরা সফলতা অর্জন করতে পারছি না। ফলে কখনোসখনো আমাদের জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত থাকছে। এ জন্য একটি দাবি কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যে মন্ত্রিসভায় ‘টেকনোক্র্যাট’ কোটায় মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ানো উচিত, যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ বিশেষ মন্ত্রণালয়ে ‘টেকনোক্র্যাট’ কোটায় যাঁরা বিশেষ বিশেষজ্ঞ, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। নয়া মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন তাঁরা সবাই যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তাঁরা কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলো বলে দেবে। একটি ‘বড়’ মন্ত্রিসভা হয়েছে। হয়তো আগামী দিনে এই মন্ত্রিসভা আরো সম্প্রসারিত হবে। তবে অনেক উন্নত দেশ অনেক ছোট মন্ত্রিসভা নিয়েই সরকার পরিচালনা করে থাকে।

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছেন। এ নিয়ে টানা তিনবার তিনি সরকার গঠন করলেন। ২০০৮ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি দলীয় সরকার গঠিত হয়েছে। মন্ত্রিসভায় ‘চমক’ আছে। এই ‘চমক’-এর কথা আগেই বলেছিলেন ওবায়দুল কাদের। ৪৬ সদস্যের মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন এই প্রথমবারের মতো মন্ত্রী তথা প্রতিমন্ত্রী হলেন। আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা মন্ত্রী হননি। অথবা বলা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করতে পারেননি। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, শাজাহান খানদের মতো ব্যক্তিদের যখন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না তখন তাতে ‘চমক’ থাকে বৈকি! কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন একটি নেতৃত্ব সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিলেন। যে ২৭ জন প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাঁরাই আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, যাঁরাই মন্ত্রিসভা থেকে ‘বাদ’ পড়েছেন, তাঁদের কারো কারো বিরুদ্ধে ‘কিছু না কিছু’ অভিযোগ ছিল। মন্ত্রিসভায় জোট শরিকরা নেই। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপি, বিকল্পধারা, এমনকি জাতীয় পার্টি থেকেও কোনো মন্ত্রী নেওয়া হয়নি। জাতীয় পার্টি এবার বিরোধী দলে থাকছে। ফলে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম, যদিও এটি নিয়ে পার্টির ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে। তবে শিগগিরই শরিকদের প্রতিনিধি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে শরিকদের পক্ষ থেকে কারা কারা অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে।
নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে। এটি সত্য, গেল কয় বছরে তিনি যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, উন্নয়নকে তিনি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং ভোটারদের মধ্যে প্রভাব ফেলছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে ছিল, ২০১৮ সালে সেখানে তা ৭.২ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ২০১৯ সালে তা ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছবে। ওই সময় পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশের নিচে! বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (২০১৯) ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (সূত্র এডিবি, এশিয়া টাইমস, ২ জানুয়ারি)। শেখ হাসিনার সময়সীমায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালের দিকে ছিল এক হাজার ৬১০ ডলারের মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে তা এক হাজার ৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়। দারিদ্র্য (২০১৭) ২৩.১ থেকে কমে হয়েছে ২১.৮ শতাংশ (২০১৮)। আর একই সময়সীমায় অতি দারিদ্র্য ১২.১ থেকে কমে হয়েছে ১১.৩ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি, তা ভারতের অগ্রগতির চেয়ে অনেক বেশি। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে যেখানে ছিল ৪৩, সেখানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬-এ। আর স্কুলে উপস্থিতির হার বেড়েছে ১০ শতাংশ হারে। অবকাঠামো খাতে চীন থেকে ৪২ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এটি নিশ্চয়ই উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে আরো সামনের দিকে নিয়ে যাবে। তবে চীনা ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা কিংবা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। এসব দেশ চীনা ঋণ পরিশোধে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বৈদেশিক মন্ত্রণালয় আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যিনি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁকে অনেক ‘ইস্যু’ এখন মোকাবেলা করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান আমরা দেখছি না। মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক হলেও একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে হবে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। এতে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-চীন দূরত্ব বাড়ছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের জন্য আগামী দিনগুলো সত্যিকার অর্থেই কঠিন। ড. মোমেন সনাতন কূটনীতিক নন। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতা করতেন। জাতিসংঘে তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন বটে; কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশল তিনি কতটুকু রপ্ত করতে পেরেছেন আমি নিশ্চিত নই। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশের স্বার্থ আদায়ে তিনি কতটুকু সফল হবেন, এটি একটি বড় প্রশ্ন এখন। শিক্ষামন্ত্রীও নতুন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মঞ্জুরি কমিশনে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার জন্ম দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, চলতি ২০১৯ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’, যা আপাতত এক ধরনের ‘স্ট্যাটাসকো’ অবস্থায় আছে, তা যেকোনো সময় খারাপের দিকে টার্ন নিতে পারে এবং এতে বাংলাদেশের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যখন একটি নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে তখন নয়া সরকার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। তাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। রাজনীতি আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই যেকোনো বিবেচনায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে একটি ‘আস্থা ও বিশ্বাসের’ সম্পর্কে যাওয়া উচিত। আস্থা ও বিশ্বাসের অপর নামই গণতন্ত্র। এটি না থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে। বিএনপি বড় সংকটে আছে। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ হলে ক্ষতি কী? গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপিকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিলে তা প্রকারান্তরে সরকারেরই লাভ। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে ‘দূরে’ ঠেলে দিলে তা জটিলতাই সৃষ্টি করবে মাত্র। সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ—একটি আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই সঙ্গে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। হেভিওয়েট মন্ত্রীদের ‘অবসরে’ পাঠিয়ে শেখ হাসিনা একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নতুনদের জন্য। তাঁদের অনেককে আমি টক শোতে আমার সঙ্গে পেয়েছি। টক শোতে তাঁদের বরাবরই সরব উপস্থিতি ছিল। দলের পক্ষে তাঁরা টক শোতে কথা বলেছেন। সরকারপ্রধানের আস্থা অর্জন করেছেন। এখন সরকারপ্রধান তাঁদের ওপর যে ‘আস্থা ও বিশ্বাস’ রেখেছেন, তাঁদের এখন তাঁর প্রতিদান দিতে হবে। নিজেদের আগামী প্রজন্মের ‘নেতা’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সিনিয়ররা পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন—আর সেই পথে এখন তাঁদের হাঁটতে হবে। তাঁরা নিজেদের একেকজন ‘যোগ্য মন্ত্রী’ হিসেবে প্রমাণ করুন, দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবেন। আমাদের প্রত্যাশা এটিই। শুধু মন্ত্রী হয়ে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে ক্ষমতায় থাকা যায় বটে; কিন্তু এতে জনমানুষের আস্থা অর্জন করা যায় না। অতীতে কোনো কোনো মন্ত্রীকে ‘চমক’ দিতে দেখেছি। মিডিয়ায় কাভারেজ পাওয়ার আশায় একজন প্রতিমন্ত্রী সাধারণ বাসে করে সচিবালয়ে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। তাঁর সাধারণ বাসে যাত্রী হয়ে যাওয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু তিনি কি সব সময় বাসেই যাতায়াত করতেন? না, তিনি তা করেননি। একজন মন্ত্রীর বাসে যাতায়াতের প্রয়োজন নেই। তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। সুতরাং মিডিয়ায় কাভারেজ পাওয়ার আগে নিজ মন্ত্রণালয়ে তাঁর ‘যোগ্যতা’ দেখানোটাই প্রয়োজন। আশা করি, আমাদের বর্তমান মন্ত্রীরা এ ধরনের ‘চমক’ দেখাবেন না। অসংলগ্ন কথা বলে কোনো এক সাবেক মন্ত্রী সমালোচিত হয়েছিলেন। আরেকজন সাবেক মন্ত্রীর মুখে বিরোধী দলের নেত্রীর সমালোচনা ছাড়া কিছুই থাকত না। তাঁরা এখন নেই বটে; কিন্তু তাঁদের ‘অভিজ্ঞতা’ যেন নতুনদের স্পর্শ না করে! আমরা বড় বেশি অতীতমুখী। আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা দিতে এখন আর খুব বেশিদিন বাকি নেই। একটি দেশের জন্য ৫০ বছর একেবারে কম সময় নয়। তাই বর্তমান মন্ত্রিসভার ওপর আমাদের আস্থাটা একটু বেশিই। কেননা এই মন্ত্রিসভার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করবে ২০২১ সালে। তাঁদের দায়িত্বটা তাই একটু বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ২০২১ সালে আমরা দেশটিকে বিশ্বের ২০তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে চাই। বিশ্বের পরবর্তী ৯টি উন্নয়নশীল দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী ও দক্ষ মন্ত্রিসভা বাংলাদেশকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে—এটিই আমাদের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী তাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। তারা যেন এই আস্থার মর্যাদা দেয়। যদি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর আত্মতুষ্টিতে তারা ভোগে, তাহলে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না।
দৈনিক কালের কন্ঠ ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর। কিন্তু এরপর যে প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচিত তা হচ্ছে, নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি এখন কেমন হবে? বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎই-বা এখন কী? কিংবা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কেমন রাজনীতি জাতিকে উপহার দেবেন? কিছু শঙ্কা, কিছু প্রশ্ন তো আছেই! নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক হয়েছে। বিএনপিও ২০ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি জানিয়েছেন, বিএনপির নির্বাচিত সাংসদরা শপথও নেবেন না ও সংসদ অধিবেশনে যোগও দেবেন না। তারা তা দেননি। গণফোরামের নির্বাচিত দু'জন সাংসদও একই পথ অবলম্বন করেছেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তারা কি রাজনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবেন? কিংবা সংসদে না গেলে তাদের যে দাবি তিন মাসের মধ্যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন, তাতে কি সরকার রাজি হবে? প্রথমত, ঐক্যফ্রন্টের সাংসদরা দীর্ঘমেয়াদি সংসদ বয়কট করে থাকতে পারবেন না। কেননা সংবিধানের ৬৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'ভোটে জয়ী হয়ে কেউ যদি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ না নেন, তাহলে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পর তার আসনটি শূন্য হবে।' ফলে বিএনপি ও গণফোরামের সাংসদরা এই ঝুঁকি নেবেন না। পরে হলেও তারা সংসদে যাবেন এবং সংসদে ও সংসদের বাইরে থেকেই তারা তখন সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করবেন। দ্বিতীয়ত, এটা ঠিক, নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হয়েছে বটে; কিন্তু তা ছিল ত্রুটিযুক্ত। এমনটি হওয়া কাম্য ছিল না। এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার ধারণা, নির্বাচনটি ত্রুটিমুক্তভাবে হলেও আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটই বিজয়ী হতো। সরকার যে বিশাল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে মানুষ খুশি। স্থানীয়ভাবে অতি উৎসাহী কিছু লোকের কারণে আমরা একটি ভালো নির্বাচন পেলাম না। ফলে 'দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়' বলে যারা দাবি তোলেন, তাদের দাবি শক্তিশালী হলো। তৃতীয়ত, তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে বলা হয় Generation Z,, ঐক্যফ্রন্ট তাদের সমর্থন পায়নি। বিশ্বব্যাপীই Generation Z একটা ফ্যাক্টর। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হলো না। বলা ভালো, যাদের জন্ম মধ্য নব্বই ও ২০০০ সালের মধ্যে, তাদেরকেই Generation Z বলা হয় (অন্যদিকে Generation Y-এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তারাই, যাদের জন্ম ১৯৮০-৯৪ সালের মধ্যে। আর Generation X হচ্ছে ১৯৬৫-৮০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীরা)। এখন নয়া সরকারকে এই Generation Z-কে 'অ্যাড্রেস' করতে হবে। চতুর্থত, আগামী ৫ বছর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি একসঙ্গে চলতে পারবে কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। বিএনপি প্রার্থীদের পরাজয় এখন বিএনপিকে এক ধরনের বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপির যেসব হেভিওয়েট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, তারা এখন ঐক্যফ্রন্ট গঠনে তাদের লাভ-লোকসান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে বিএনপি 'বড় বিজয়', অনেকটা 'মালদ্বীপ মডেলের' স্বপ্ন দেখেছিল! মালদ্বীপে গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হেরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এ রকম স্বপ্ন যারা দেখেছিলেন, তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ফলে বিএনপির ভেতরে এই প্রশ্ন এখন শক্তিশালী হবে। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ব্যবধান বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি এখন বেশি গুরুত্ব দেবে ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিতে। পঞ্চমত, বিএনপির ভবিষ্যৎ এখন কী? বর্তমান সরকার ৫ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত থাকবে। এই সময়সীমায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা থাকবে না। খালেদা জিয়া জেলে থাকবেন এবং আমার ধারণা, খালেদা জিয়াও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নেবেন! একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি থেকে 'জিয়া পরিবার'-এর দৃশ্যমান 'মাইনাস' ঘটল! আগামীতে রাজনীতিতে খালেদা জিয়া কোনো বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেননা, খালেদা জিয়ার বয়স তখন গিয়ে দাঁড়াবে ৮০ ছুঁই ছুঁই। খালেদা জিয়া মওলানা ভাসানী নন যে, শেষ বয়সে এসে তিনি গর্জে উঠবেন। আগামী পার্লামেন্টেও (দ্বাদশ) খালেদা জিয়ার থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত। তিনি আসতে পারবেন না। এখন তিনি যেভাবে দল চালাচ্ছেন, সেভাবে আগামীতে তিনি দল চালাতে পারবেন বলে মনে হয় না। এর বাইরে বিএনপিতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। মির্জা ফখরুল নিজে তার এলাকায় (ঠাকুরগাঁও) বিজয়ী হতে পারেননি। তিনি খালেদা জিয়ার সংসদীয় আসনে বগুড়া থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। দলে তার চেয়ে সিনিয়র নেতারা রয়েছেন। তার নেতৃত্ব তারা মানবেন না। একটি 'যৌথ নেতৃত্ব'-এর কথা বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু তা কাজ করবে না। বিএনপির এই সংকট অতীতের সব সংকটের চেয়ে বেশি। অতীতে বিএনপি একাধিকবার ভেঙেছে। কিন্তু জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেই বিএনপি 'বড়' হয়েছিল। দলটির জনসমর্থনও বেড়েছিল। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। উপরন্তু বিএনপি ও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। সংসদ যদি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, আমি অবাক হবো না! উচ্চ আদালতের নির্দেশেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ভূমিকাও এখন বহুল আলোচিত। জাতীয় পার্টি ১৪ দলীয় জোটে না থাকলেও মহাজোটের শরিক। মহাজোটের ব্যানারেই তারা নির্বাচন করেছে। জাতীয় পার্টির মাঝে দুটি ধারা অনেকদিন থেকেই বহমান। একটি সরকারে যোগ দেওয়া, অপরটি বিরোধী দলে থাকা। দশম জাতীয় সংসদে বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি একটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে; অন্যদিকে সরকারেও যোগ দিয়েছে। একটি বড় দলের জন্য এটা কখনও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকার বেশি মাত্রায় এককেন্দ্রিক হয়ে যায়। গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আক্ষেপ করেছেন একাদশ জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায়। ঐক্যফ্রন্টের ৭ জনকে নিয়ে যেমন শক্তিশালী বিরোধী দল হয় না, ঠিক তেমনি জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকলেও তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।

নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অভিনন্দন শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটা সত্য, গত ক'বছরে তিনি যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, উন্নয়নকে তিনি যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তাতে করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং ভোটারের মাঝে প্রভাব ফেলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ শতাংশের কিছুটা ওপরে ছিল, ২০১৮ সালে সেখানে তা ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ২০১৯ সালে তা ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছবে। ওই সময় পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (২০১৯) ভারতের প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (সূত্র- এডিবি, এশিয়ান টাইমস, ২ জানুয়ারি)। শেখ হাসিনার সময়সীমায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১৬ সালের দিকে ছিল ১৬১০ ডলারের মতো। কিন্তু ২০১৮ সালে তা ১৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়। দরিদ্রতা (২০১৭) ২৩.১ শতাংশ থেকে কমেছে ২১.৮ শতাংশে (২০১৮)। আর একই সময়সীমায় অতি দরিদ্রতা কমেছে ১২.১ শতাংশ থেকে ১১.৩ শতাংশে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি তা ভারতের অগ্রগতির চেয়ে অনেক বেশি। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে যেখানে ছিল ৪৩, সেখানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬-এ। আর স্কুলে উপস্থিতির হার বেড়েছে ১০ শতাংশ হারে। অবকাঠামো খাতে চীন থেকে ৪২ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের উন্নয়ন ক্রিয়াকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে। তবে চীনা ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। এসব দেশ চীনা ঋণ পরিশোধে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। 

নয়া সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিগত সরকারের আমলে অনেক মন্ত্রী তাদের দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিল। এখন একটি দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা চাই, যারা তাদের দক্ষতা ও মেধা দিয়ে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়রদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত। বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, আইটি তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। মঞ্জুরি কমিশনে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার জন্ম দেওয়ার প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও একটি নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, চলতি ২০১৯ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্র 'বাণিজ্যযুদ্ধ', যা আপাতত এক ধরনের 'স্ট্যাটাসকো' অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় খারাপের দিকে টান নিতে পারে এবং এতে করে বাংলাদেশের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যখন একটি নেতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে, তখন নয়া সরকার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। তাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। রাজনীতি আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই যে কোনো বিবেচনায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে একটি 'আস্থা ও বিশ্বাসের' সম্পর্কে যাওয়া উচিত। 

'আস্থা ও বিশ্বাস'-এর অপর নামই গণতন্ত্র। এটি না থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে। বিশ্ব বড় সংকটে আছে। এমতাবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে 'রাজনৈতিক সমঝোতা' হলে ক্ষতি কী? গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপিকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিলে তা প্রকারান্তরে সরকারেরই লাভ। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে দূরে ঠেলে দিলে তা জটিলতাই সৃষ্টি করবে মাত্র। 
০৮ জানুয়ারি ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও প্রসঙ্গ কথা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচনে সহিংসতা, ১৬ জন মানুষের মৃত্যু, ড. কামাল হোসেন কর্তৃক এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় রেখে গেছে কিছু প্রশ্ন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। অতীতের কোনো আমলেই আওয়ামী লীগ এত বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়নি। এটা আওয়ামী লীগের জন্য যেমন একটি রেকর্ড, তেমনি শেখ হাসিনার জন্যও একটি রেকর্ড, যিনি জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নির্বাচনের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন সংসদে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে, সে ব্যাপারেও এরই মধ্যে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিরোধী দলের রাজনীতি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে দলীয় ব্যবস্থার তথা জোটের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল, আর বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দল) জন্ম হয়েছিল, এই নির্বাচন তা ভেঙে দিয়েছে। বিএনপির পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বেগম জিয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক ময়দানে ড. কামাল অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও নির্বাচনের পর তাঁর ভূমিকা এখন সংকুচিত হয়ে যাবে। সংসদে ঐক্যফ্রন্টের বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ দায়িত্ব আবারও পেতে যাচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী জাতীয় পার্টি। সংসদে না থাকায় ড. কামালের ভূমিকা এখন গৌণ। সংসদে ঐক্যফ্রন্টের নেতা এখন মির্জা ফখরুল। সুষ্ঠু একটি নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা, তাতে কমিশন শতভাগ সফল হয়েছে বলা যাবে না। মন্ত্রীদের প্রটোকল নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা, জাল ভোট প্রদান ও সহিংসতা রোধে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। উপরন্তু নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইসির ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাংবিধানিকভাবে ইসির ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছিল, তা ইসি পালন করতে পারেনি। এ দেশে সহিংসতা নির্বাচনী সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু এবারে যেন এই সহিংসতার মাত্রাটা একটু বেশি। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার খবরই বেশি। তবে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাঁদের নির্বাচনী ক্যাম্পও আক্রান্ত হয়েছে। এ দেশের রাজনীতিতে এরশাদের জাতীয় পার্টি একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনপ্রাপ্তির দিক দিয়ে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি একই ভূমিকা পালন করবে। তবে দলটির আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরতা তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এরশাদের ব্যক্তিগত ইমেজ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘তাঁর অসুস্থতা’, সিএমএইচে থাকার সঙ্গে আরো যোগ হয়েছিল তাঁর সিঙ্গাপুরে ‘চিকিৎসাগত কারণে’ অবস্থান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দল পরিচালনার ক্ষমতা এরশাদ অনেকটাই হারিয়েছেন! এর ফলে দল বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। অন্যদিকে দেশে ইসলামিক শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়া, ক্ষমতাসীন জোটে তরিকত ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্তি ও নির্বাচনে দুটি আসন দেওয়া, জামায়াতে ইসলামীর বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ২৬ আসনে অংশ নেওয়া এ কথাই প্রতিধ্বনিত করে। উপরন্তু হেফাজতে ইসলামের মতো একটি ধর্মীয় সংগঠনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া কিংবা একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামপন্থীদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। তবে নির্বাচনে তারা ভালো করেনি।
নির্বাচনে অবৈধ টাকা লেনদেনের ‘খবর’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উৎপাটন করেছিল। অভিযোগ করা হয়েছে, ১৫০ কোটি টাকা নির্বাচনের আগে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য বিদেশ থেকে এসেছে। এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা র‌্যাব উদ্ধার করেছে। বিদেশ থেকে টাকা এসেছে—এ দাবি র‌্যাবের। নিঃসন্দেহে এ ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছিল। সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সেনাপ্রধান নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইন এইড টু সিভিলিয়ান পাওয়ারের আওতায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও সহিংসতা বন্ধে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। তবে সেনাবাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে কিছু উদ্বেগ আমরা লক্ষ করেছি। ‘বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠ নজর রেখেছিল জাতিসংঘ’—জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। নির্বাচনে ভোটারদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে এবং তাদের বাধাহীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দল ও বিচারিক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেসে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের খবরও দিয়েছিল কাগজগুলো। এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণ করে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে বহিঃশক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল। তবে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় একরকম ‘হস্তক্ষেপ’ কি না—এ প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। দুটি বড় দলই একাধিকবার ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়েছিল পরস্পরবিরোধী অভিযোগ করার জন্য। এটা আমাদের রাজনৈতিক দীনতা। বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের ‘রাজনীতি’ যদি থাকত, তাহলে আমাদের বিদেশিদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
নির্বাচনের আগে আর্থিক বিশৃঙ্খলার বিষয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড়িয়ে গেলেও (কন্যাশিশুর স্কুলে যাওয়া, মাতৃমৃত্যু হার কমানো), আর্থিক খাতে অনিয়ম চোখে লাগার মতো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ৯টি ব্যাংকের চার হাজার ২৭০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। এর মধ্যে সংকটে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণই তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশ থেকে পাচার হয়েছে ছয় লাখ কোটি টাকা, অথচ বিনিয়োগ এসেছে মাত্র এক লাখ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, দুর্নীতির কারণে এটি হয়েছে। পাওয়ার সেক্টরে এক বছরে ১১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে—এটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। এসব ক্ষেত্রে সরকারের নির্লিপ্ততা চোখে লাগার মতো। গ্রামে নগর সুবিধা সম্প্রসারণের কথা বলছে আওয়ামী লীগ। এটি একটি নতুন দিক। এতে করে যেন গ্রামের যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, তা ধ্বংস না হয়। গ্রামকে গ্রামের মতোই রাখা উচিত। তবে গ্রামের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। কৃষিজমি সংরক্ষিত রাখা দরকার। কৃষিজমিতে এখন বাড়িঘর হচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট আইন নেই। মানুষ বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রামে সুদবিহীনভাবে গৃহঋণ দেওয়া যেতে পারে, যাতে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায়। এর ফলে কৃষিজমিতে বসতবাড়ি করার প্রবণতা কমে যাবে। ব্লু ইকোনমির ধারণাটিও ভালো।
অন্যদিকে বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের। আওয়ামী লীগ বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করবে। এই সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু এর জন্য এ দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বব্যাপী এক তরুণ প্রজন্মের উত্থান ঘটেছে, যাদের বলা হচ্ছে Generation-z (যারা বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৩২ শতাংশ)। এই প্রজন্ম আধুনিক প্রযুক্তিমনস্ক ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে দেশে দেশে পরিবর্তন আনছে। বাংলাদেশে এবার আড়াই কোটি ভোটার (মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার) নতুন ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এরাই Generation-z-এর প্রতিনিধি, যাদের জন্ম মধ্য-নব্বই ও মধ্য-২০০০ সালের মধ্যে, তারাই Generation-z নামে পরিচিত (অন্যদিকে Generation-y-এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তারাই, যাদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যে। Generation-x ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী)। এই Generation-z বাংলাদেশে একটি ফ্যাক্টর। এদের ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে। যে সরকারই এখন ক্ষমতায় যাবে, তারা ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভিশন-২০২১ তৈরি করেছে, যেখানে দারিদ্র্যসীমার মাত্রা ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। Generation-z-কে তাই আস্থায় নিতে হবে। Generation-z-ই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। নয়া সরকারকে এখন এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। নির্বাচন না হলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন বয়কট কোনো সমাধান হতে পারে না। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে কোনো ‘সুবিধা’ ঘরে তুলতে পারেনি। তাই বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। এটিই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। আমাদের সংবিধানে বলা আছে জনগণই রাষ্ট্রের ‘মালিক’। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মালিকরা তাদের প্রতিনিধিদেরই নির্বাচিত করেছে। তবে স্পষ্টতই দেখা গেছে, এবার নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী মহাজোটের বাইরে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং কোথাও কোথাও বিজয়ী হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হওয়ায় জাতীয় পার্টি আবারও বিরোধী দলে থাকবে বলেই আমার ধারণা। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি এবার মন্ত্রিসভায় থাকবে কি না, কিংবা এরশাদের ভূমিকা এবার কী হবে, সেটাও দেখার বিষয়। সত্যিকার অর্থে জাতীয় পার্টি যদি বিরোধী দলে থাকে, সেটা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ ডিসেম্বর এক টেলিকনফারেন্সে বলেছিলেন, নির্বাচনে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের দিন বিশৃঙ্খলা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকের বক্তব্য আমরা দেখেছি, যেখানে তাঁরা বলেছেন তাঁরা নিজেদের ভোট দিতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা রোধ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল নির্লিপ্ত।
নির্বাচনে যা-ই ঘটুক না কেন, এখন তাকাতে হবে সামনের  দিকে। বিরোধী দলের সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। সংসদে যখন সরকারি দল বেশি আসন পায়, তখন সর্বত্র সরকারি দলের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়। এটা সব সময় ভালো হয় না। একাদশ সংসদে বিরোধী দলের, বিশেষ করে বিএনপির আসন কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়ার নামই গণতন্ত্র। আওয়ামী লীগ এই কাজটি করুক, সংসদে বিরোধী দল কথা বলুক, সংসদীয় রাজনীতি আরো বিকশিত হোক—এটিই আমাদের প্রত্যাশা।