রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত্

গেল সপ্তাহে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ ক’টি সংবাদ ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব আজ বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন-এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। আমাদের পরিবেশমন্ত্রীও ছিলেন সেই দলে। আল গোর অ্যান্টার্কটিকা থেকে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন, যার বাংলা অনুবাদ ছাপা হয়েছে কোনো কোনো পত্রিকায়। দ্বিতীয় সংবাদটি নাসার একটি গবেষণা, যা প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তা পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যে। তৃতীয়ত, ক্রিশ্চিয়ান পেনেটি একটি বই লিখেছেন, ঞত্ড়ঢ়রপ ড়ভ ঈযধড়ং : ঈষরসধঃব পযধহমব ধহফ ঃযব ঘব িবেড়মত্ধঢ়যু ড়ভ ঠরড়ষবহপব, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ দিকটা তুলে ধরা হয়েছে। বইটি গেল বছরের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপীই একটি আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে প্রতিবছর শীর্ষ সম্মেলন (কপ সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনও। বছর শেষ হলেই বিশ্বের দৃষ্টি থাকে ‘কপ’ সম্মেলনের দিকে। ফটো সেশনের মধ্য দিয়ে ওই সম্মেলন শেষ হয়, আর আমরা অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী সম্মেলনের জন্য। কোপেনহেগেন, কানকুন কিংবা ডারবান ‘কপ’ (কমিটি অন্য দ্য পার্টিস) সম্মেলন শেষ হয়েছে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই। কার্বন-ডাই-অক্সাইড তথা গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা জরুরি। ‘কপ’ সম্মেলনে বারবার এ কথাটা উচ্চারিত হলেও ধনী দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছে না। ধনী দেশগুলোর, যারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বেশি ছড়ায়, তাদের ভূমিকাকে ক্রিশ্চিয়ান পেনেটি আখ্যায়িত করেছেন ঈষরসধঃব ঋধংপরংস হিসেবে। নাসা (ঘঅঝঅ) তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১১ সাল ছিল গত ১৩২ বছরের ইতিহাসে নবম উষ্ণ বছর। গড়ে তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নাসা আশঙ্কা করছে গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গলে যায় তা হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই অবিলম্বে কার্বন-ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। আল গোর তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতোমধ্যে চার কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর প্রশ্ন রেখেছেন, অ্যান্টার্কটিকায় যে বরফ আছে তা দ্রুত গলা শুরু করলে কী যে হবে? এ প্রশ্ন শত প্রতিনিধির মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে কোপেনহেগেন, কানকুন আর ডারবানে। ডারবান ‘কপ’ সম্মেলন শেষে যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। আগামী বছর থেকে এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হবে এবং ২০২০ সাল থেকে ওই চুক্তিটি কার্যকর হবে। তবে একটি গ্রিন ফান্ড গঠনের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলো রাজি হয়েছে। এই ফান্ডের পরিমাণ হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এই ফান্ড যাত্রা শুরু করবে। বিশ্বব্যাংক এই ফান্ডের ব্যবস্থাপনার তদারকি করবে।
ডারবান সম্মেলনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে প্রতিবছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষপর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ইতোমধ্যে জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটো পরবর্তী আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেছে। সুতরাং বোঝাই যায়, একধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে একেক গ্রুপের একেক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি, তার মাঝে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেক্স-১-এর অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ ৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উদ্গিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপারের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাত্ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিন হাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে এই হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত-এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এই দুটি দেশের কাছ থেকে কমিটমেন্ট আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুটি দেশই বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে এই শতাব্দীতে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত আবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়-তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯৯০ সালের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭ শতাংশ, জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তা ছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তত্কালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমেই থেকে গিয়েছিল।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলে উপকূলের মানুষ অনত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের টহরাবত্ংধষ ঘধঃঁত্ধষ চবত্ংড়হ হিসেবে ঘোষণা করা দাবি জানিয়েছিল।
ডাববান সম্মেলনে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গেছে মাত্র আড়াই মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর হয়নি। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু ডারবানে তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফোরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি। কপ সম্মেলনে আসলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে ‘অনেক আশার কথা’ শুনিয়ে সম্মেলন শেষ হয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্বকে নিয়ে। এখন চীন ও ভারতও একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাস করলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তাতে করে বাড়বে দরিদ্রতা। এই যুক্তি ফেলে দেওয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। চলতি বছর কাতারে এ সম্মেলন হবে। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারে অগ্রগতি কতটুকু হবে, বলা মুশকিল।
আমাদের পরিবেশমন্ত্রী আল গোরের সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে, এটা বিশ্ববাসীকে জানাতেই আল গোর আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। আল গোর নিজে তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ ২ থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর ফলে প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, তাদের পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে লোনা পানির আগ্রাসন। ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ২ কোটি কৃষক পেশা হারিয়ে শহরে আশ্রয় নেবে-এমন আশঙ্কাও করেছেন আল গোর। মিথ্যা বলেননি তিনি।
বিশ্বের উষ্ণতা যদি হ্রাস করা না যায়, তা হলে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো যে তাদের অস্তিত্ব হারানোর ঝুঁকির মুখে থাকবে, তা নয়। বরং বিশ্ব ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করছে দুর্ভিক্ষ (আফ্রিকা), অকালে বন্যা (থাইল্যান্ড), প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ব্রাজিল) কিংবা জলোচ্ছ্বাস (বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র)। জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে, যা গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে। ‘আরব বসন্ত্ত’র পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খাদ্য সঙ্কট দায়ী বলে মন্তব্য করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ঋড়ত্বরমহ চড়ষরপু ম্যাগাজিনে (বেড়ঢ়ড়ষরঃরপং ড়ভ ভড়ড়ফ, গধু-ঔঁহব ২০১১)। ক্রিশ্চিয়ান পেনেটি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যাতে প্রতিবছর মারা যাবে ৩ লাখ মানুষ। ২০৩০ সাল নাগাদ মারা যাবে ৫ লাখ মানুষ। বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে লাখ লাখ মানুষ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্সের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৭০০ মিলিয়নে। তাই বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসের ব্যাপারে একটি চুক্তি অত্যন্ত জরুরি।
দৈনিক সকালের খবর,১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
তা রে ক  শা ম সু র  রে হ মা ন
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)aol.com

জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান চিত্র

আমাদের পরিবেশমন্ত্রী খুব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। অনেক বাঘা বাঘা নেতা যখন গাড়িতে পতাকা তুলতে পারেননি, তখন ড. হাছান মাহমুদ পতাকা তুলেছেন গাড়িতে। প্রথমে ছিলেন পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী। এখন পূর্ণমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব যে বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি যখন এন্টার্কটিকায়, ঠিক তখনই বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারটি আরো পোক্ত হয়েছে। তিনি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। বোধ করি, তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এন্টার্কটিকা সফরে গেলেন বেশ কয়েকজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে। আল গোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই টিমের। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরকে এখন বিশ্ববাসী জানে একজন পরিবেশবিদ হিসেবে। বই লিখে, ডকুমেন্টারি তৈরি করে তিনি জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
ডারবানে কপ-১৭ সম্মেলনে যখন কোনো চুক্তি হলো না, তখন আশঙ্কার মধ্যে বাস করছে বিশ্ববাসী, বিশেষ করে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো। এটা উপলব্ধি করেই আল গোর একটি সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০৭ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারস থেকে রওনা হন দক্ষিণ মেরুর দিকে। সেখানে অবস্থান করেন ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ব্যক্তি ড. হাছান মাহমুদ এখানে আমন্ত্রিত হননি। আমন্ত্রিত হয়েছেন বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে। কেননা, সারা বিশ্ব জানে বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তাঁরা হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (Christian Penenti) তাঁর সদ্য প্রকাশিত হওয়া গ্রন্থ Tropic of Chaos : Climate Change and the New Geography of Violence (2011) এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরো উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন, অর্থাৎ দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। তাই আল গোর যে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রীকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন_এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে যেটি অবাক করার বিষয়, তা হচ্ছে পরিবেশমন্ত্রী এন্টার্কটিকায় গেলেন বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে দু-দুটি ঘটনায় পরিবেশ যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন পরিবেশমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই! তাঁর নিজ দেশের পরিবেশ আজ বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সেখানে পরিবেশমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি_বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী তৎপর! এতে করে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হলো? 
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পরিবেশমন্ত্রী ছবি তুলে কিংবা আল গোরের অটগ্রাফ নিয়ে নিজের বাচ্চাদের খুশি করবেন (বাচ্চারা স্ট্যাম্প আর অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে) কি না জানি না, কিন্তু তাতে বাংলাদেশের খুব একটা উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। বিদেশে সম্মেলনে অংশগ্রহণের চেয়ে পরিবেশমন্ত্রীর উচিত যেসব কারণে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে, তা রোধ করা।
অতিসম্প্রতি দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে। এক. তিতাস নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধের ছবি ছাপা হয়েছে কোনো কোনো পত্রিকায়। শুধু তাই নয়, তিতাসসহ আরো ছোট ছোট ১৮ নদীতেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে ভারতীয় ১৪০ চাকার যান এই নদী অতিক্রম করতে পারে। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে এবং হাইকোর্ট নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি কেন সংবিধান ও আইন পরিপন্থী হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, সে ব্যাপারে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং মহামান্য হাইকোর্ট এ ব্যাপারে যখন একটি রুল ইস্যু করেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পরিবেশমন্ত্রী অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ। একটি পিএইচডি ডিগ্রি তাঁর আছে। শুনেছি মন্ত্রী হয়েও নাকি কোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছেন কিছুদিন (বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাঁর 'অবস্থান'কে ব্যবহার করতে চেয়েছে!)। পরিবেশসংক্রান্ত দেশি, বিদেশি আইন তাঁর জানার কথা। মাননীয় মন্ত্রী, দয়া করে কি জানাবেন পৃথিবীর কোথাও এভাবে নদীতে বাঁধ দিয়ে কোনো নদীর 'মৃত্যু' ঘটানো হয়েছে কি না? কোনো একটি দৃষ্টান্ত যদি দিতে পারেন, আমি নদীতে বাঁধ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আপনার পাশে এসে দাঁড়াব। মাননীয় মন্ত্রী, আমার জানতে ইচ্ছে করছে, জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ কিংবা জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ কি তিতাস নদীর বাঁধ দেওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করে? বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় আপনি সোচ্চার! কানকুন, ডারবান কিংবা এরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আপনি গেছেন। পরিবেশ রক্ষায় ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া টাকার (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার) ব্যাপারে আপনি সন্তুষ্ট নন। আরো টাকা চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু তিতাসকে হত্যা করে আমরা নিজেরই (এর জন্য বিদেশিরা দায়ী নয়) যে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম, তার কী হবে? দুই. বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে চার মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার_সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা_তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশ কাঠি ও সাতমারি মৌজায় এক হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অঙ্াইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতিমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে গোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছি। মাননীয় মন্ত্রী, এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সরকারের সিদ্ধান্ত আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, জানি। কিন্তু একজন বিবেকবান মন্ত্রী হিসেবে আপনি যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলার জন্য আন্তর্জাতিক আসরে যান, যখন সুদূর এন্টার্কটিকায় জনমত সৃষ্টি করার জন্য যান, তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। কেননা, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় আপনি যথেষ্ট তৎপর নন। তিতাস নদীকে আমরা 'হত্যা' করতে চলেছি। সুন্দরবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। খুলনার দাকোপ, কয়রা আর পাইকগাছায় আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা দুই বছরেও সমাধান করতে পারিনি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যখন দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন, আপনার গর্ব অনুভব করারই কথা। কিন্তু ২০১২ সালের এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স সূচকে (ইপিআই) বাংলাদেশকে যখন ১৩২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ু দূষণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন আপনার এন্টার্কটিকা 'সফর' নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ কি এর কোনো যৌক্তিকতা আছে? বলা ভালো ইপিআই পরিচালিত হয় দি ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং কলাম্বিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক।
'দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণকারী' একটি দেশের একজন পরিবেশমন্ত্রী অ্যান্টার্কটিকা সফরে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য আদৌ কোনো 'সম্মান' বয়ে আনতে পেরেছেন কি? বরং তিতাস 'হত্যা'র মতো ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে রামপাল থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াও প্রয়োজন।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman@acl.com

দেখতে চাই পুলিশ সত্যিই পারে

সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনী ও সাগর সরোয়ারের হত্যাকাণ্ডের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আজ কোথায়? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘রাজনীতি’ হোক, এটা আমি চাই না। কিন্তু এই ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার যে গ্যারান্টি, সে ব্যাপারে তো নিশ্চিত হতে পারছি না। মৃত্যু একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষকে মারা যেতে হয়। মানুষের জšে§র পর ধীরে ধীরে মানুষ বড় হয়, শরীরের বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জšে§র পর পরই মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে। এ জন্যই ধর্মে বলা হয়েছে ‘প্রতিটি মানুষকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে’। কিন্তু এ কেমন মৃত্যু? মধ্য ত্রিশের সরোয়ারের এ জীবন আরও প্রলম্বিত হতে পারত। কিন্তু হল না। মেঘের জীবন আরও ‘মধুর’ হতে পারত। এখন থমকে গেল সবকিছু।
এই ঢাকা শহরে স্বামী-স্ত্রীকে ‘খুন’ করে পালিয়ে যাবে খুনিরা, তা কি আমাদের কাম্য? এ পরিস্থিতিতে কি রাজধানীতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলব? না, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এ ধরনের পরিস্থিতিকে আমি স্বাভাবিক বলতে পারছি না। ঢাকা শহরে ৪১টি থানা হয়েছে। গত ১১ ফেব্র“য়ারি সারা জাতি যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জানল রুনী-সরোয়ারের হত্যাকাণ্ডের খবর, ঠিক ওই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ পালন করছে তাদের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ঢাকা শহরে মানুষ বেড়েছে। বেড়েছে থানা। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদের আইজি এখন ‘থ্রিস্টার জেনারেল’। পদমর্যাদা বেড়েছে। তিনি এখন সচিবই নন শুধু, সিনিয়র সচিব। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, পুলিশ বাহিনী আরও ৫টি সিনিয়র সচিবের ‘পদ’ পাবে। সে সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের পদমর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। যেখানে গ্রিসের মতো একটি ইউরোপের দেশ ব্যয় সংকোচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেবাখাতে সরকারি ব্যয় কমানো হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানো হয়েছে, সেখানে আমরা বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক সংকটের সময়, সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি দিলাম। সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হল। আমরা গ্রিসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুই শিখলাম না!
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে আমি ঢাকা শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বিচার করব না। কিন্তু এটা কি একটা বড় ধরনের ঘটনা নয়? যখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেন, তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলা যাবে না। কিন্তু গত এক মাসের ঘটনা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলতে আমি বাধ্য হব যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, বাসায় গৃহকর্ত্রী খুন হচ্ছে, ব্যাংক থেকে অথবা ব্যাংকে যাওয়ার পথে লাখ লাখ টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছেÑ কিন্তু পুলিশ কোন কূলকিনারা করতে পারছে না।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি একাধিকবার পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করেছেন। আমি এতে দোষ দেখি না। বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরাও আপনার মতো কথা বলতেন। ওই চেয়ারে বসলে বোধহয় এভাবেই কথা বলতে হয়! কিন্তু আমি তো আস্থাটা রাখতে পারছি না। আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। গত ৯ ফেব্র“য়ারি র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল যখন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, তখন আমি হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারি না। একের পর এক স্বর্ণের দোকানে লুট হবে, ব্যাংক থেকে উত্তোলিত টাকা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ এই প্রবণতা রোধ করতে পারছে না, তখন র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কীভাবে বলেন, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা? তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন। এগুলো অবশ্যই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অস্বাভাবিক এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
মানুষ তার বাড়িকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে। এখন সেখানেও মানুষ নিরাপদ নয়। সেখানে ঢুকে রুনী ও সাগরকে খুন করা হল। এই ‘ডাবল মার্ডার’-এর পেছনে কী মোটিভ কাজ করেছে, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব গণমাধ্যমের কাছে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সমাজকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য এটি। যদিও তিনি উল্লেখ করেননি এই অস্থিতিশীল শক্তি কারা? একদিকে বিএনপি যখন তাদের ১২ মার্চের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব যখন ‘অস্থিতিশীলতার’ প্রশ্ন তোলেন, তখন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তার এই বক্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই বক্তব্যকে হালকাভাবে নিতে চাই না। নিশ্চয়ই তিনি বুঝে-শুনে ‘সমাজে অস্থিতিশীলকারীদের’ সঙ্গে রুনি-সাগরদের হত্যার একটা মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি খুশি হব যদি তিনি তদন্তকারীদের কাছে এই ‘অস্থিতিশীলকারী’দের নাম-ধাম প্রকাশ করেন।
রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক একটি হত্যাকাণ্ড বলে আমার মনে হয় না। প্রথমত, কিলাররা ভাড়া করা কিলার নয়। এরা অপেশাদার। যদি রুনী বা সাগরের কোন প্রতিবেদনের কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করার কথা। এক্ষেত্রে তা হয়নি। খুনিরা অপেশাদার। ফরেনসিক রিপোর্টেই তা প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত, খুনিরা গ্রিল কেটে ঢোকেনি। তারা বাইরে থেকে মূল দরজা দিয়েই ঢুকেছে এবং রুনীর পূর্ব পরিচিত। পূর্ব পরিচিত ছাড়া তিনি তাদের ঘরে ঢুকতে দিতেন না। খুনিরা প্রথমে খুন করে রুনীকে, পরে অপেক্ষা করে সাগরের জন্য। সাগর এলে তাকেও খুন করে। তৃতীয়ত, খুনের কারণ কী? কোন পেশাগত দ্বন্দ্বÑ সম্ভবত না। কোন ব্যবসায়িক স্বার্থÑ সেটাও সম্ভবত না। পারিবারিক কোন দ্বন্দ্ব, টাকা-পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত কোন দ্বন্দ্বÑ এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। একমাত্র ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রহরিরাই সঠিক তথ্য দিতে পারবেন ওই বাড়িতে রাতে কারা কারা এসেছিল। চতুর্থত, এটা কোন ডাকাতি নয়। ডাকাতি হলে ঘরের কিছু জিনিস খোয়া যেত। আর ডাকাতরা সাধারণত ‘খুন’ করে না। পুলিশ এখন অনেকগুলো ‘থিউরি’ নিয়ে এগুতে পারে। তবে এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিলেও কয়েকজনকে আটক করা ছাড়া পুলিশ কোন সুখবর দিতে পারেনি।
রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীর জন্য অনেক কিছু করেছে। এখন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজন ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হবেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের (এসআই) দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০১২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীকে সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ বাহিনী চলে, সেই জনগণের কাছে পুলিশের আস্থা এতে কতটুকু বাড়বে? নানা কারণে পুলিশ আজ বিতর্কিত। সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনার মধ্যে দিয়ে পুলিশের ‘সাফল্য’ কতটুকু নিহীত ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এতে করে পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়নি, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘তদবির’ করে আসছিলেন, তাদের জন্য ১০টি ‘সচিব পদ’ সৃষ্টি করা হোক। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার কাছে এর যুক্তি তুলে ধরেছেন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে কী নেই, এই বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ সচিব পদ’ সৃষ্টির ঘোষণার একদিন আগে দৈনিক যুগান্তরে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল (সারা দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল), তাতে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুগান্তর যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ১ হাজার ২৮০টি, ক্রশফায়ার হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৫০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের ৭ হাজার ১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কি আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীর জন্য কোন আশার সংবাদ? শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি এ সংবাদে খুশি? আমরা সাধারণ আমজনতা, আমরা এ ঘটনায় খুশি নই। পুলিশ বাহিনী এখন ‘পাঁচজন সচিব’ পাবে। তাতে করে আমাদের আমজনতার লাভ কী হল? সচিব পর্যায়ের পদ সৃষ্টি করে সম্মান বাড়ানো যায় না। তবে আমি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (যার আইজি হওয়ার কথা ছিল) ফণীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের অনেক ব্যর্থতা আছে। থানায় প্রকৃত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মামলা কিংবা জিডি নিতে চায় না। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বাড়ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহারও হচ্ছে।’ ফণীবাবুর এই বক্তব্য (পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে) পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। জানি না আইজিপি হলে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন কীনা? তবুও তাকে সাধুবাদ জানাই সত্য কথা বলার জন্য।
রুনি ও সাগরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমি শংকায় থাকি। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি আমি চাই। একজন সাংবাদিক, যিনি এ দেশের সুশীল সমাজের একটা অংশ, তার নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে। রুনী ও সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করলে দোষীরা পার পেয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বটা আজ বেশি। তার মন্ত্রণালয় ঠিকমতো চলছে, এটা বলা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই পুলিশের প্রশংসা করুক, আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। এটা ভালো নয়। কাম্যও নয়। আমরা অবিলম্বে রুনি ও সাগরের হত্যাকারীদের গ্রেফতার দেখতে চাই। দেখতে চাই পুলিশ সত্যিই ‘পারে’।
 অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিবেশীর কারণে দূর দেশেও ক্ষুণ্ন ভাবমূর্তি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দু\'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে \'দোষ\' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাংলাদেশি যুবক হাবিবুর রহমানকে উলঙ্গ করে অত্যাচারের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাবিবুর রহমানের ঘটনাটি বহুল আলোচিত। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের দৃশ্য সম্প্রচারিত হলে তাতে খোদ ভারতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর রুল জারি করে। ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দু ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানায়। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাবিবের ওপর অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করেছে। ইতিমধ্যে হাবিবকে অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর পরপরই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। অতীতেও বিএসএফের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও হত্যা, অপহরণ ও অত্যাচারের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। আরও দুঃখজনক খবর হচ্ছে, হাবিবুরের অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যখন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিল, তখন আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বলেছিলেন, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। সব কাজ ফেলে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও সরকার মনে করে না। তার এই বক্তব্য ২১ জানুয়ারি এভাবেই ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তার এভাবে কথা বলা শোভন হয়নি। নিশ্চয় \'সব কাজ ফেলে\' রাষ্ট্র সীমান্ত সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকবে না। কিন্তু একজন নাগরিক সীমান্তে আক্রান্ত হলে এটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দু\'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে \'দোষ\' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা।
বিএসএফের নির্যাতন আজ চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হাবিবুর রহমানের ওপর নির্মম অত্যাচারের রেশ কাটতে না কাটতে গত ২৬ জানুয়ারি ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে বাংলাদেশি আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিএসএফ এই সুযোগটি নিচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারতকে একের পর এক সুযোগ দেওয়ার পরও বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি বাংলাদেশিদের লাশ। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্বের নিদর্শন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিকার অর্থেই ভারত বাংলাদেশকে একটি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে কি-না_ সেটা এখন বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন নানা কারণে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশের এই জনগোষ্ঠী ভারতের জন্য বিশাল একটা \'বাজার\'। ভারত দেখবে তাদের স্বার্থ। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে বলে আশ্বাস দিলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আদৌ সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। দিলে হাবিব বা লেবু হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত এক যুগে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০৬ জন বাংলাদেশি। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে। শ্রীলংকার সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও শ্রীলংকার সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু কোনো একটি সীমান্তে কি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনও হয়েছে? চোরাকারবারের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কম নয়। তাহলে ওই সব সীমান্তে ভারত হত্যাকাণ্ড চালায় না কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আসলে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাঁটাতারের বেড়ায় যখন কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল, সেদিন এর প্রতিবাদ করতে সাহস পর্যন্ত পাননি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। এই \'ব্যর্থতা\' বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাই আমরা মনে করি। কিন্তু এই \'বন্ধুত্ব\' এখন যেন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_ তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে দ্রুত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে (ড. মসিউর রহমান) একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এর কাজ চলছে। অর্থাৎ এখানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি তাগিদ। একই দিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা আদৌ ভারতীয় মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়নি এবং অনুমোদিতও হয়নি। কেননা এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিজেপির আপত্তি রয়েছে। এর অর্থ কী? চুক্তি হলো, কিন্তু তা কার্যকর করল না ভারত। কিন্তু আমরা নদীকে \'হত্যা\' করে বাঁধ দিয়ে ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে পৃথিবীর কোথাও নদীতে বাঁধ দেওয়া হয় এটা চিন্তাও করা যায় না। কোনো আইনই এই \'নদী হত্যা\'কে সমর্থন করে না। অথচ আমরা করলাম। আমাদের স্বার্থ এতে কী? দুঃখ লাগে এ কারণে যে, কোনো \'মন্ত্রী\' সাহস করে \'নদী হত্যা\' বন্ধের কথা বললেন না। কোথায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী?
আজ যখন তরুণ হাবিবুর রহমানের উলঙ্গ ও বিএসএফ কর্তৃক অত্যাচার ও নির্যাতনের ভিডিও দেখি, তখন ভাবি_ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কি পারবে একজন চীনা নাগরিক কিংবা \'চিরশত্রু\' একজন পাকিস্তানি নাগরিককে এভাবে পেটাতে? সেই সাহস কি তাদের আছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সাহস তারা পায় কোথায়? আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিই বিএসএফকে এই \'সাহস\' জুগিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। সীমান্তে এখন লাশের মিছিল। কিন্তু ক্ষমতাবান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যখন বলেন, রাষ্ট্র এটা নিয়ে চিন্তিত নয়, তখন হিসাবটা ঠিক মেলে না। সৈয়দ আশরাফ পড়াশোনা করা মানুষ। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ছিলেন। তার বিদেশিনী স্ত্রীও থাকেন ব্রিটেনে। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ইত্যাদি অনেকের চেয়ে তার ভালো জানার কথা। রাষ্ট্র জনগণের অধিকারকে কতটুকু নিশ্চয়তা দেয় এবং যা সংবিধানের লিপিবদ্ধ, সে সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ ভালোই জানেন। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার কথা। তখন একজন হাবিবুর রহমান, একজন আবদুল লতিফ লেবুর \'হত্যাকাণ্ড\' তাদের অধিকার খর্ব করে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য একরকম ঔদ্ধত্যের শামিল। তার এই বক্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং অপরাধও।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

পালোমার মৃত্যু কি আমাদের কিছু ভাবায়

সিদরাতুল মুনতাহা পালোমার মৃত্যু কী আমাদের কিছু শেখায়? গত ২ ফেব্রুয়ারি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট পালোমোর মৃত্যুর পর আমার কাছে এ প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পালোমো নেই; কিন্তু সব কিছুই চলছে আগের মতো। পালোমার মতো মৃত্যু আমাদের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশের দু'জন গুণী মানুষ চলচিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬ মাস আগে, ১৩ আগস্ট। সেদিন সারাদেশের মানুষ কেঁদেছিল। ১৩ আগস্ট ওই ঘটনার পর কত মানুষ সড়ক ও মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন, তার পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। শুধু সংবাদপত্রগুলো আমাদের মাঝে মধ্যে জানিয়ে দেয় দু'একটি মৃত্যুর কথা। গত ১০ নভেম্বর যারা সংবাদপত্র পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন এক দম্পত্তির মৃত্যুর খবর। চিকিৎসক লোপা ও প্রকৌশলী মনোয়ারের ছবি। সড়ক দুর্ঘটনায় তারা নিহত হয়েছেন। বেঁচে আছে তাদের ছোট্ট সন্তান নুহাদ। নুহাদ মৃত্যু কি বোঝে না। কিন্তু যখন বলে 'বাবা কবরে শুয়ে আছে', তখন বাবা হিসেবে বুকটা আমার ভেঙে যায়। কে দায়িত্ব নেবে ছোট্ট নুহাদের? নৌপরিবহন মন্ত্রী শ্রমিকদের নেতা। তাদের নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন। তিনি বলেছিলেন, বাস চালকদের 'ঘাতক' বলা যাবে না। তারা সেবক। তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও প্রখ্যাত এক ইতিহাসবিদকেও তিনি হুমকি দিয়েছিলেন এই 'ঘাতক'দের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। তার নেতৃত্বাধীন শ্রমিকরা নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা মেরেছিল। সেই ছবি ছাপাও হয়েছিল পত্র-পত্রিকায়। ঘাতক বাস চালকদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন নৌমন্ত্রী। কিন্তু ছোট্ট নুহাদ তার সমবেদনা পেল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাহিদ সুলতানা, কিংবা গৃহবধূ চাঁদনীকে যখন ঘাতকরা মেরে ফেলে, এখন নৌপরিবহনমন্ত্রী র্নিবিকার। তার 'সেবক'রা দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছে নৈরাজ্য। মহাসড়কগুলোকে কেউই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। মন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে পরিবহন শ্রমিকরা যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন মন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! এর নাম কী রাজনীতি? এই রাজনীতিতে কী জনগণের মঙ্গল নিহিত রয়েছে? আমি নিত্যদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাভার-ঢাকা মহাসড়কে চলাচল করি। নিত্যদিন আমি প্রত্যক্ষ করি চালকরা ওভারটেক করছে। বেপোরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি রঙ সাইডে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। হেমায়েতপুর, সভার বাজারেও সেই একই চিত্র। ট্রাফিক পুলিশের কাজটি হচ্ছে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা। তারা তা করছে না। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হেমায়েতপুর বাজারে দেখলাম দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন (তিনি কী তখন বখশিশ আদায় করছিলেন!)। সাভার বাজারে সেই পুরনো দৃশ্য_ রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ, নির্বিকার। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন না। একটু সামনে গেলেই একটা বাস, দেখলাম সেখানে সেই প্রতিযোগিতা_ কে কার আগে যাবে! কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ দৃশ্য আমাকে সপ্তাহে একাধিক দিন দেখতে হয়, কেননা এ রুট ধরেই আমি আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করি। উপযাচক হয়ে অতীতে একাধিক দিন সাভার এলাকায় দায়িত্ব পালনরত সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। না, কিছুই হয়নি। কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল দু'দিন আগেও, তেমনটিই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেই ওভারটেকিং, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন না করা ভুল পথে চালকদের গাড়ি চালানো, সব কিছুই আগের মতো। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-আরিচা রোডের এ ছিল দৃশ্য। এই মহাসড়কে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল দুমাস আগে যেখানে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো, আন্দোলন হল, সেখানে এতটুকুও সচেতন হলেন না যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা। ওই মৃত্যু তাদের এতটুকুও স্পর্শ করেনি। আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি? আর কত নিবন্ধ লিখলে আমরা সচেতন হব? মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঘাতক বাসচালক জাকির হোসেন যখন ডিবি অফিসে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান তিনি নির্দোষ, তখন সত্যি সত্যিই আমার ভাবতে কষ্ট লাগে আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি! ঘাতক চালক জাকির হোসেনের কথার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যের। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী একা 'আবিষ্কার' করেছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকও দায়ী।
আমরা বার বার বলে আসছি মহাসড়কে নিয়মিত টহল দেওয়ার কথা। গত ২০ নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে আমরা কিছুটা উৎসাহিত হয়েছিলাম; কিন্তু এই উৎসাহ আমরা কতদিন ধরে রাখতে পারব, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। দীর্ঘদিন পর হাইওয়ে পুলিশের বোধ হয়, কিছুটা টনক নড়ছিল। ২১ নভেম্বর তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নেমেছিলেন 'দায়িত্ব পালন' করতে। সেই সংবাদটিই পত্রিকাগুলো ছেপেছিল পরদিন। 'দায়িত্ব পালন' করতে গিয়ে হাইওয়ে পুলিশ ওইদিন ২৫টি গাড়িকে জরিমানা করেছিল। শতাধিক গাড়িও আটক করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। এ জন্য গাজীপুর জোনের পুলিশ কর্মকর্তাদের আমি স্বাগত জানাই। মহাসড়কে যদি পুলিশি অভিযান চলে, তাহলে 'ঘাতক' বাস চালকরা কিছুটা সতর্ক হয়ে যাবে। মহাসড়কে গাড়িতে গাড়িতে প্রতিযোগিতার প্রবণতা কিংবা ওভারটেকিংয়ের মানসিকতা তারা পরিহার করতে পারবেন। বাস চালকদের মাঝে একটা ভয় থাকবে সবসময়। যে কারণে তারা নিয়ম মতো গাড়ি চালাবেন। হাইওয়ে পুলিশে এই কাজটি শুধু একদিনের জন্য সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং এটা নিয়মিত করতে হবে। আমিনবাজার থেকে আরিচা পর্যন্ত নিয়মিত টহল দিতে হবে। সেদিন অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর টহল সীমাবদ্ধ ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে। এখন এ টহল দিতে হবে সাভার বাজারে। এখানে গাড়ি চালকরা বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোক-ওঠানো-নামানোর কাজটি সম্পন্ন করে। আশপাশে টহল পুলিশ ডিউটি করলেও ওই বিষয়টি তাদের চোখে পড়ে না। অভিযোগ আছে বাসচালকরা সাভার বাাজরে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশদের নিয়মিত 'মাসোহারা' দেন, যে কারণে মূল রাস্তায় গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি করে বাসচালকরা যখন যাত্রী ওঠান, তখন দূরে দাঁড়ান ট্রাফিক পুলিশ তা অবলোকন করেন মাত্র। গত ৭ ফেব্রুয়ারিও এ ছিল চিত্র। এ কারণেই টহল পুলিশের সাভার বাজারে উপস্থিত থাকা খুবই প্রয়োজন। মূল রাস্তা থেকে বাজারটি সরিয়ে দেওয়াও প্রয়োজন। ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মহাসড়কের পাশে কোনো বাজার থাকতে পারবে না। ওই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতেই সাভার বাজারটি সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাতে করে এখানে যানজট অনেক কমে যাবে। প্রতিটি গাড়িতে একটি বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা জরুরি, যাতে করে ভুয়া ড্রাইভারদের চিহ্নিত করা যায়। বিদেশে এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডব্রেকার থাকতে হবে। কিছু দূর পর পর গতি নিয়ন্ত্রণ মেশিন থাকতে হবে, যা হবে অটোমেটিক। প্রতিটি গাড়ির গতির পরিমাণ তাতে রেকর্ড হবে এবং অতিরিক্ত গতির জন্য চালককে ফাইন গুনতে হবে। এসব ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নৌমন্ত্রীর ভূমিকা এখানে মুখ্য; কিন্তু তা না করে নৌপরিবহনমন্ত্রী যখন পরিবহন শ্রমিকদের উসকে দেন, তাতে করে তার ভূমিকা বিতর্কিত হয়। কোনো সমাধান তাতে হয় না। বরং এতে করে 'ঘাতকরা' আরো উৎসাহিত হয়। একটি মৃত্যু তাদের কাছে বড় কিছু নয়; কিন্তু পালোমার বাবা-মায়ের কাছে এ মৃত্যু অনেক বড়। চিরদিনের জন্য তারা একা হয়ে গেলেন। নৌ পরিবহনমন্ত্রীর অতিপ্রিয় 'সেবকরা' যখন মনোয়ার দম্পতি ও গৃহবধূ চাঁদনীকে হত্যা করে পালিয়ে যায়, তখন সংবাদপত্রে মন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। এ মৃত্যু মন্ত্রীকে এতটুকুও ছুয়ে যায়নি। আমাদের দুঃখ আমরা হত্যাকারী কোনো বাস চালককেই বিচার করতে পারিনি। এই সমাজ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি। কোনো সভ্য সমাজে এভাবে কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘাতকদের পাশে এসে দাঁড়ান না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা তা দেখলাম। মন্ত্রী ঘাতকদের নিয়ে রাজনীতি করেন। একজন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর কিংবা চিকিৎসক-প্রকৌশলী দম্পতির চেয়ে একজন ঘাতক তার কাছে অনেক বড়। আমার দুঃখটা এখানেই_ আজ যখন ক্ষমতাবান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যুক্তি দেখান 'এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট' তখন আমার কষ্ট হয়। যেখানে তার পালোমার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা, সেখানে তিনি উপহাস করলেন পালোমোর মৃত্যুকে নিয়ে। অন্য কোনো দেশ হলে সৈয়দ আশরাফকে তার ওই বক্তব্যের জন্য পদত্যাগ করতে হতো। বাংলাদেশ বলে কথা। 'ঘাতক'দের নিয়ে রাজনীতি করেন মন্ত্রীরা। পালোমার মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেয়; কিন্তু ঘাতক বাসচালককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেয় না।
 ড. তারেক শামসুর রেহমান
 অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরব বিশ্বে বড় পরিবর্তনের সূচনা

আরব বিশ্ব কি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি পরিবর্তনের সূচনা করতে যাচ্ছে? হোসনি মোবারক-পরবর্তী মিসরে সাধারণ নির্বাচনে কট্টর ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির বিজয় এ কথাই প্রমাণ করে যে মিসরের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। যদিও এই পরিবর্তন শুধু মিসরেই আসেনি, বরং প্রায় প্রতিটি আরব দেশেই এই পরিবর্তন আসছে। তিন দফা নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় ৪৯৮টি আসনের সংসদে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতৃত্বে গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স পেয়েছে ২১৬টি আসন। তাদের নিজস্ব আসন ২১৬, শতকরা ৪৫ দশমিক ২ ভাগ ভোট। অপরদিকে কট্টরপন্থী সালাফিস্ট হিসেবে পরিচিত আল নুর পেয়েছে ১০৯টি আসন। দলটির নেতৃত্বে গঠিত ইসলামিক অ্যালায়েন্স পেয়েছে ১২৫টি আসন। শতকরা ২১ দশমিক ৮ ভাগ ভোট পেয়ে আল নুর দলটির অবস্থান দ্বিতীয়। ধর্মনিরপেক্ষবাদী তথা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অবস্থান খুবই খারাপ। এই নির্বাচনী ফলাফলের মধ্য দিয়ে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করার দায়িত্ব অর্পিত হবে ইসলামপন্থীদের হাতে। মিসরের রাজনীতির জন্য এটা একটা বড় পরিবর্তন।
মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনটা প্রথম শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। সেখানে ২৩ বছরের শাসক জয়নুল আবেদিন বিন আলির পতনের পর প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তাতে বিজয়ী হয়েছে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা পার্টি। ২১৭ আসনের সংসদে তারা পেয়েছে ৮৯টি আসন। এই ইসলামপন্থী দলটি ধর্মনিরপেক্ষ একটি দলের সঙ্গে মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে ইতোমধ্যে। নির্বাচনে বিজয়ী তিনটি দলের মাঝে সেখানে যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে এন্নাহদার নেতা হামদি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক পার্টির মুনসেফ মারজুকি প্রেসিডেন্ট আর এত্তাকাতুল দলের মুস্তাফা বিন জাফর হয়েছেন স্পিকার। ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মরক্কোয়। সেখানে অতি সম্প্রতি যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তাতে ইসলামপন্থী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বিজয়ী হয়েছে। যদিও দলটি এককভাবে বিজয়ী হতে পারেনি। অনেকটা তিউনিসিয়ার মতোই একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হতে যাচ্ছে মরক্কোতে। তিউনিসিয়ায় যেমন ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা একটি প্ল্যাটফরমে একত্রিত হয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে যাচ্ছে, ঠিক তেমনটি হতে যাচ্ছে মরক্কোতে। এখানে ইসলামপন্থীরা এককভাবে বিজয়ী হয়েছে সত্য (৩৯৫ আসনের ১২০টিতে বিজয়ী), কিন্তু জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে ঐক্য করতে হয়েছে ইন্ডিপেনডেন্স পার্টি ও সোস্যালিস্ট ইউনিয়ন অব পপুলার ফোর্সের সঙ্গে। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতা আবদেলইয়া বারকিরানে হয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। মিসরও এখন সেদিকে যাচ্ছে। ইয়েমেনের অবস্থাও অনেকটা তেমনি।
মিসর তথা মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীদের এই বিজয় পশ্চিমা বিশ্বে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, বলা মুশকিল। তবে ইসলামপন্থীদের এই উত্থান তেলআবিব ও ওয়াশিংটনে যে উত্কণ্ঠার সৃষ্টি করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়ামস বার্নস মিসরে ইসলামিক ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর অর্থ পরিষ্কার-যুক্তরাষ্ট্র ব্রাদারহুডের রাজনীতি নিয়ে আরও কিছু জানতে চায়। বিশেষ করে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, সে ব্যাপারে ব্রাদারহুড নেতাদের মনোভাব কী-এটা জানা ওবামা প্রশাসনের জন্য জরুরি। মিসরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বড় স্বার্থ রয়েছে। ব্রাদারহুডের উত্থান ওই স্বার্থে আঘাত হানুক, এটা ওয়াশিংটন চাইবে না। মিসরের খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে নিয়েও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ওবামা প্রশাসন। এই মুহূর্তে সর্বস্তরে ব্যাপক সম্পর্ক গড়ে না তুললেও ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে ‘সীমিত’ সম্পর্ক গড়ে তুলবে ওয়াশিংটন।
এক সময় ধারণা করা হয়েছিল আরব বিশ্বে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতনের পর সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইসলামপন্থীদের উত্থান কি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে? সমস্যা আছে ইসলামিক উগ্রপন্থীদের নিয়ে। উত্তর আফ্রিকার মাগরেবভুক্ত অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল অষ-ছধবফধ রহ ঃযব ওংষধসরপ গধমযত্বন (অছওগ)। ২০০৭ সালে আলজেরিয়াতে এরা গঠন করেছিল ঝধষধভরংঃ ত্ড়েঁঢ় ভড়ত্ চত্বধপযরহম ্ ঈড়সনধঃ (ঝেচঈ)। ঝেচঈ আলজেরিয়াতে এখনও সক্রিয়। আর লিবিয়াতে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়াতে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে। আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ফ্রিডম হাউস ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে জরিপ চালিয়েছিল, তাতে তিউনিসিয়ার অবস্থান ছিল ১৪৪, মিসরের ১৩৮ আর লিবিয়ার ১৫৮। লিবিয়ায় প্রয়াত কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস কারও নেই। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত দীর্ঘ সময় কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। দেশটিতে গণতন্ত্র চর্চার কোনো ইতিহাসও নেই। গাদ্দাফি নিজে সরকারিভাবে প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তার উপাধি ছিল ‘বিপ্লবের নেতা’। অথচ ‘বিপ্লব’ হয়েছিল সেই ১৯৬৯ সালে। কোনো সংবিধানও ছিল না। সংসদের আদলে ছিল ‘জেনারেল পিপলস কংগ্রেস’, যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হতো। কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বও ছিল না সেখানে। রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে এখন সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? আরব বিশ্বে এর বাইরে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনে গণতন্ত্র সূচকে অবস্থান ১২৫ ও ১৪৬। বাহরাইনের অবস্থান ১২২। রাজতন্ত্র শাসিত দেশগুলোতেও গণতন্ত্র সূচক আশাব্যঞ্জক নয়। এই যখন পরিস্থিতি তখন মরক্কো থেকে এসেছে একটি আশাব্যঞ্জক খবর। বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সেখানে সংস্কারের কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে তিনি সেখানে পরিবর্তন এনেছেন। তরুণ এই রাজা ক্ষমতায় আছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। তুলনামূলক বিচারে আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চেয়ে মরক্কোর অবস্থা অনেক ভালো। গণতন্ত্র ইনডেক্সে ১৬৭টি দেশের মধ্যে মরক্কোর অবস্থান ১১৬। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ১৯৬টি দেশের মধ্যে দেশটির অবস্থান ১৪৬। এখন গণভোটে সংবিধানে কিছু পরিবর্তনের পক্ষে রায় হয়েছে। এবং আগামীতে যদি সেখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনীতির জন্য তা হবে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সম্ভবত বাদশাহ মুহম্মদ পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। তাই আগেভাগেই তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন দেখতে হবে তিনি কতটুকু আন্তরিক। তবে একটা ভালো দিক হচ্ছে মরক্কোতে বড় ধরনের কোনো গণঅভ্যুত্থানের এখনও সৃষ্টি হয়নি। মিসর কিংবা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি সেখানে এখনও সৃষ্টি হয়নি। তার আগেই বাদশাহ মুহম্মদ-৬ সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন। তিনি নিজের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন ইতোমধ্যে।
‘আরব বসন্ত’কে সামনে রেখে এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এক. লিবিয়া ইরাকের মতো পরিস্থিতি বরণ করবে কি না? অর্থাত্ ইরাকের মতো আত্মঘাতী বোমাবাজির সংস্কৃতির জন্ম হবে কি না? ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী অবতরণ করেছিল এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এখন লিবিয়ার পরিস্থিতি পুরোপুরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তা বলা যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বোমাবর্ষণের পর মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উত্খাত করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ৪১ বছর। এই দীর্ঘ ৪১ বছরে তিনি লিবিয়ায় নতুন ধরনের এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন। এখন সেখানে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম হতে যাচ্ছে। তবে সেখানে ইসলামিক কট্টরপন্থীদের উত্থান নিয়ে শঙ্কা আছে। দুটো সংগঠনের কথা জানা যায়, যাদের দিকে নজর থাকবে অনেকের। এ দুটো সংগঠন হচ্ছে অষ-ঔধসধধ ধষ সঁয়ধঃরষধয নর ষরনুধ এবং খরনুধ ওংষধসরপ ঋরমযঃরহম মত্ড়ঁঢ় (খওঋ)ে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে ক’টি সংগঠনকে আল কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে চিহ্নিত করেছিল, তার মাঝে খওঋ’ের নামও ছিল। এদিকে দ্রুত অবনতি ঘটছে সিরিয়ার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় আছেন ২০০০ সাল থেকে। তার ছোট ভাই সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের কমান্ডার। লিবিয়ার পর সেখানেও পরিবর্তন আসন্ন। ইসলামপন্থীরাও সেখানে শক্তিশালী। সিরিয়ায় তুরস্কের একটা প্রভাব থাকবে। তিউনিসিয়ার প্রভাব সিরিয়ায় পড়তে পারে। ‘আরব বসন্ত’-এর পর তিউনিসিয়া এবং মিসরে ইসলামিক (মডারেট) শক্তিগুলো নতুন উদ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে। মিসরে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ও নির্বাচনে বিজয়ী ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাও দেখার বিষয় অনেকের। শুধু তাই নয়, পুরনো দল ডধভফ পার্টিও সক্রিয় হয়েছে। ইতোমধ্যে সংবিধান প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান যে সামরিক জান্তা ক্ষমতা পরিচালনা করছে, তারা চাচ্ছেন নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর একটা প্রতিনিধিত্ব থাকুক। শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এই চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কি না, এটা দেখার বিষয়।
আরব বিশ্বের তরুণ সমাজ এই ‘বিপ্লব’কে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু নতুন যে সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে তাদের কোনো স্বীকৃতি বা ভূমিকা নেই। ফলে এদের আশাভঙ্গ হয়েছে এবং তাদেরকে যদি আবার রাজপথে আন্দোলনে নিয়ে আসে, আমি অবাক হব না। ওই তরুণ সমাজ আরব বিশ্বে একটি শক্তি। আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা ৪৬ ভাগ হচ্ছে তরুণ, তিউনিসিয়ায় ২৭ ভাগ, লিবিয়ায় ৪০ ভাগ, মিসরে ২৬ ভাগ, সিরিয়ায় ২০ ভাগ, জর্দানে ৩৯ ভাগ, বাহরাইনে ২৫ ভাগ আর মরক্কোতে ১৬ ভাগ। এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। আরব বিশ্বে গোষ্ঠীতন্ত্র একটি ফ্যাক্টর। দেখা গেছে নিজস্ব গোষ্ঠী তথা গোত্রের লোকদের নিয়েই ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। গাদ্দাফির পেছনে ছিল তার গোত্রের লোকরা। সিরিয়ায় ‘আলাবি’ গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট বাসারের ক্ষমতার অন্যতম উত্স। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত বেন আলি তার পরিবার ও গোত্রের লোকদের নিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। বাহরাইনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছেন। বাহরাইনের শাসক হামাদ বিন ইসা আল খলিফার (১৯৯৯ সাল থেকে যিনি ক্ষমতায়) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা দমন করতে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের উদ্যোগে সৌদি সেনাবাহিনী বাহরাইনে প্রবেশ করেছিল এবং আন্দোলন নস্যাত্ করে দিয়েছিল। এটা একটা নতুন উপাদান। ইয়েমেনেও এই কাউন্সিল উদ্যোগ নিচ্ছে। এখানেও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে। স্পষ্টতই আরব বিশ্ব একটা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের উত্খাত করে সেখানে আদৌ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। মিসরে ইসলামপন্থীরা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মডেল যে মিসরে চালু করবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেখানে ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হতে যাচ্ছে। তবে কট্টরপন্থীরা মিসর সংসদে বিজয়ী হওয়ায় একটা শঙ্কা থেকেই গেল। একই সঙ্গে রয়ে গেল সেনাবাহিনীর প্রশ্নটিও। তাই মিসর যে আগামীতে আলোচনায় থাকবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
তা রে ক  শা ম সু র  রে হ মা ন
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)aol.com

পুলিশের মর্যাদা বাড়ল কতটুকু

গেল ৩০ জানুয়ারি দুটি বড় ধরনের ঘটনার ছবি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। একটিতে আইজিপিকে তিন তারকা জেনারেলের সমান পদমর্যাদা দেয়া হয়েছে। পদমর্যাদার র‌্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই ছবি ছাপা হয়েছে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে। এ র‌্যাংক ব্যাজ পুলিশ বাহিনীর জন্য সম্মানের ও মর্যাদার। দ্বিতীয়টিতে দেখা যাচ্ছে, দু’জন পুলিশ সদস্য টেনেহিঁচড়ে উলঙ্গ লিমনের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে। গণমিছিলে অংশ নেয়া লিমন পুলিশের গুলিতে নিহত হন চাঁদপুরে। দুটি ঘটনার ছবি। আর দুটি ঘটনার বিষয়বস্তুই পুলিশকে নিয়ে। নিঃসন্দেহে আইজিপিকে র‌্যাংক ব্যাজ পরানোর ছবিতে প্রতিটি পুলিশ বাহিনীর সদস্য খুশি হয়েছেন। ঠিক তেমনি কি খুশি হয়েছেন যখন পুলিশ সদস্যরা উলঙ্গ লিমনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান, তা দেখে? এ ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা কি বাড়ল? শুধু লিমন কেন, বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের ডাকা গণমিছিলে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন চারজন। লিমন, আবুল হোসেন গাজী, রুবেল ও আবুল কাশেম। পরদিন রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন আরও একজন, শফিকুল ইসলাম, যিনি জামায়াতে ইসলামীর কর্মী। শফিকুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়েও মিথ্যাচার করেছে পুলিশ। প্রতিটি সংবাদপত্র যেখানে বলছে, শফিকুলের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে, সেখানে রাজশাহী মহানগরীর পুলিশ কমিশনার এম ওবায়দুল্লাহ কী করে বলেন, শফিকুলের মৃত্যু হয়েছে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলির কারণে? শফিকুলের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু একজন রাজনৈতিক কর্মীর এ মৃত্যু তো কারোরই কাম্য নয়।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবে। পুলিশের দায়িত্ব সেখানে আইনশৃংখলা বিঘিœত হয়েছে কিনা, তা দেখা। তাই বলে গুলি করে মানুষ হত্যা? পুলিশ কি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে দিন দিন? পুলিশ কি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে? সাংবাদিকরা এ প্রশ্নটি করেছিলেন আইজিপিকে। জবাবটা সাংবাদিকদের জানাই ছিল। পুলিশ যখন মৃত লিমনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়, আমি এ দৃশ্যের সঙ্গে বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাবিবুর রহমানের পেটানোর দৃশ্যের কোন অমিল খুঁজে পাই না। বিএসএফের ওই ‘ভূমিকা’ ফাঁস করে দিয়েছিল ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। সারা বিশ্ব এর নিন্দা করেছিল। একপর্যায়ে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষমা চাইতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। ভারতীয় গণতন্ত্রের এটা একটা উজ্জ্বল দিক। রাজনীতিকরা দায়বদ্ধ। এ ধরনের ঘটনায় অনেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছেনÑ ভারতে এর দৃষ্টান্ত একটি নয়, অনেক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে পাঁচ পাঁচটি জীবন ঝরে পড়ল, আর আমাদের ‘থ্রিস্টার জেনারেল’ আইজিপি একটু দুঃখ প্রকাশ তো করলেনই না, বরং বললেন, ‘গণমিছিলকারীদের হামলায় কিছুসংখ্যক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন’ (আমার দেশ)। কী যুক্তি দিলেন আমাদের আইজিপি! মৃতদেহের প্রতি যে সম্মান, তাও দেখায়নি পুলিশ। অথচ জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পুলিশ চলে। আইজিপি নিশ্চয়ই ভালো করে জানেন, সংবিধান একজন নাগরিককে কী কী অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে’। ৩২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের’ কথা। সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার কথা। এ ক্ষেত্রে একজন লিমন, একজন আবুল হোসেন গাজী যখন গণমিছিলে অংশ নেন, তখন সংবিধান তাকে এ অধিকার দেয়। কিন্তু গুলি করে হত্যা করে লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে শুধু একজন মৃত ব্যক্তির প্রতি অসম্মানই প্রদর্শন করা হয় না, বরং এটা পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয়। পুলিশের মর্যাদা তাতে বাড়ে না, বরং কমে।
এ রাষ্ট্র তো পুলিশ বাহিনীকে অনেক কিছু দিয়েছে। আইজিপি ‘থ্রিস্টার জেনারেলের’ সম্মান পেয়েছেন। তার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে পরিবর্তন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজনকে ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদা দেয়া হবে। এমনিতেই পুলিশ বাহিনীতে সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি, যে সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য পেশায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ ‘ভালো ছাত্র হওয়ার’ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তিনিও এ সুযোগ-সুবিধা পান না। রেশনের কথা না হয় নাইবা বললাম। আমরা ধরে নেই পুলিশের চাকরির ‘চাপ’ বেশি, কাজ বেশি, ঝুঁকি বেশি। সুতরাং তারা একটু সুযোগ-সুবিধা বেশিই নিক, ক্ষতি কী? কিন্তু সেবা কি আমরা পাচ্ছি ঠিকমতো? পুলিশ কি জনগণের প্রতি আদৌ দায়বদ্ধ? মিটিং-মিছিলে গুলি কেন হবে? সেখানে আদৌ শান্তি-শৃংখলা অবনতির মতো ঘটনা ঘটেনি। রাজশাহীতে তো নয়ই। আইজিপি দুঃখ প্রকাশ না করলেও, তিন দিন পর দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এতে অবশ্য কিছুটা রক্ষা। কিন্তু আইজিপি যখন পুলিশ অফিসারকে দিয়েই লক্ষ্মীপুরের ঘটনার, অর্থাৎ গুলিবর্ষণের ঘটনার তদন্ত করান, তখন ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর আস্থা রাখতে পারি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু আরও খুশি হতাম যদি তিনি একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতেন। যারা অনলাইনে সংবাদপত্র পাঠ করেন, তারা দেখে থাকবেন রাজশাহী মহানগরীর পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য একজন পাঠকও সমর্থন করেননি। ময়নাতদন্ত রিপোর্টও প্রত্যাখ্যান করেছেন পাঠকরা। পুলিশ প্রশাসন এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। পুলিশের প্রতি আমাদের যে আস্থার জায়গা, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বটে যে জড়িতদের বিচার করা হবে, কিন্তু এই বিচার কি অতীতে হয়েছে? তবুও আমরা আস্থা রাখছি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। ধরে নিচ্ছি মন্ত্রীবাহাদুররা সত্য কথাই বলেন। আর সে কারণে দোষী ব্যক্তিদের বিচার হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার সত্যতা যাচাই হবে দু’মাস পর। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। আরও একটা কথা, বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাদের ১০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কথাটার পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। তবে কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা যে হয়েছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এটা ভালো নয়। সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার জন্য এ প্রবণতা কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামে বলেছেন একটি ‘সংলাপ’-এর কথা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণের স্বার্থে ‘সংলাপটা’ জরুরি। যদিও ‘সংলাপ’-এর ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। রাষ্ট্রপতি অতি সম্প্রতি একটি ‘সংলাপ’ করেছেন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে। বিএনপি তাতে অংশ নিয়েছে। এটি ছিল একটি ভালো দিক। কিন্তু ওই ‘সংলাপ’ কোন ফল বয়ে আনতে পারেনি।
পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নাগরিক মারা যাওয়ার পর পুলিশের প্রতি আমার আস্থার জায়গাটা যেন কেমন ফিকে হয়ে আসছে। পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারে রয়েছে আমার একটা দুর্বলতা। আমার অনেক প্রিয় মানুষ, কেউ ছাত্র, কেউ আমার পাঠক আজ পুলিশ বাহিনীতে। ওদের প্রতি আস্থাটা ধরে রাখতে চাই। ‘থ্রিস্টার জেনারেল’-এর মর্যাদা, আইজিপি সাহেব, আপনার সম্মানকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। কিন্তু পুলিশের শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা, দায়বদ্ধতা আর সেবার বিষয়টি আপনি যদি নিশ্চিত করতে পারেন, মানুষ আপনাকে মনে রাখবে। গুলি করে মানুষ মারা গেলে এর বদনামের ভাগিদার আপনিও হবেন। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গুলি করে দমন করা হয় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কেন গুলি করবে? প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে বিরোধ আছে। নিউইয়র্কে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আন্দোলন ১৩৮ দিন পার করেছে ৩ ফেব্র“য়ারি। আন্দোলনকারীদের জুকোট্টি পার্ক থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রতি গুলি ছোড়া হয়নি। মিসরের রাজধানী কায়রোতে দীর্ঘ ১৮ দিন অবস্থান করে মিসরবাসী যে ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করেছিলেন, সেখানে কি গুলিবর্ষণ করেছিল পুলিশ? হ্যাঁ, সিরিয়াতে আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা গেছে সত্য, কিন্তু সিরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলানো যাবে না। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছি। গণতন্ত্র সহিষ্ণুতা শেখায়। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে শেখায়। কিন্তু পুলিশ যদি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তাহলে গণতন্ত্রের ভিতটা দুর্বল হয়ে যায়। বিরোধী দলের গণমিছিল যদি শান্তি-শৃংখলা বিঘিœত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করত, সেই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশ ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারত। টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, জলকামান, রাবার বুলেট ইত্যাদি পুলিশ তো হরহামেশাই ব্যবহার করে। তাহলে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর আর রাজশাহীতে গুলি হল কেন? এ প্রশ্ন আমি সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে করব না। কিন্তু উলঙ্গ লিমনের চ্যাংদোলা ছবি যখন দেখি, তখন ‘থ্রিস্টার জেনারেল’-এর র‌্যাংক ব্যাজ পরা আইজিপি সাহেবের ছবি আমার কাছে মূল্যহীন মনে হয়। আমি দুঃখিত, আমি খুশি হতে পারলাম না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তি প্রসঙ্গে এরশাদের মন্তব্য

মহাজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে ঢাকাকে এক করা হবে। গত ২৭ জানুয়ারি আইডিইবি মিলনায়তনে 'লোকাল গভর্নমেন্ট ফর দ্য বেটার রুরাল লাইফ অ্যান্ড সাস্টেইন্যাবল ডেভেলপমেন্ট : কনটেক্সট অ্যান্ড ইন্টারভেনশন' শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেছেন। দৈনিক যায়যায়দিন-এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে গত শনিবার। গত ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে 'স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন সংশোধনী) বিল-২০১১ পাস হয়েছে। সংসদে এই বিলটি পাস হওয়ার পর ঢাকা এখন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণে দুভাগে ভাগ হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ডিসিসির বিভক্তির প্রতিবাদে গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে। শুধু তাই নয়, অব্যাহতিপ্রাপ্ত ডিসিসির মেয়র সাদেক হোসেন খোকা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন। হাইকোর্ট সরকারকে এই সিদ্ধান্ত কেন বাতিল করা হবে না, তা জানাতে ৪ সপ্তাহ সময়ও দিয়েছেন। তারপরও যা বাস্তবতা তা হচ্ছে সরকার ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের জন্য দুজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে। বলতে দ্বিধা নেই সরকারের সমর্থক বেশকিছু বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বও ঐতিহ্যম-িত ঢাকার এই বিভক্তিকে মেনে নেননি। সভা-সেমিনারে তারা এর সমালোচনা করেছেন। এখন করলেন এইচএম এরশাদ। এই বিভক্তির ফলে এখন ডিসিসির দক্ষিণে পড়েছে ৫৬ ওয়ার্ড, আর উত্তরে পড়েছে ৩৬টি। এর ফলে আয়-ব্যয়ের দিক দিয়ে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কেননা ডিসিসির বেশি আয় হয় দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। এখন বিভক্তির ফলে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে ৭০ শতাংশ। আর উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে মাত্র ৩০ শতাংশ। এর ফলে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব কম আমলে সেখানে কর্মচারীদের বেতনভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা সমস্যা হবে। একই সালে উত্তর অঞ্চলের মানুষ সিটি করপোরেশনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এমনকি আগামীতে দুই মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আর আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে করে ওই দ্বন্দ্ব যদি সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয় তাতে আমি অবাক হব না। আমরা জানি, সিটি করপোরেশনের একটা বড় কাজ হচ্ছে স্থানীয় বাজার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও নয়: নিষ্কাশন, বর্জ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু ডিসিসির বিভক্তির ফলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। লোকবলের অভাব হেতু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এখন দুটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে। ফলে সরকারের খরচও বাড়বে। কেননা দ্বিতীয় মেয়রের জন্য অফিস তৈরি, জনবল নিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সরকারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে ওই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরদের সঙ্গে বিশেষ করে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সঙ্গে মেয়রের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে, যা কিনা করপোরেশনের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি এ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে, অর্থনীতির এ মন্দার যুগে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিলুপ্ত ঘোষিত ডিসিসিতে ছিলেন, তাদের কেউ কেউ নতুন সৃষ্ট কোনো একটি সিটি করপোরেশনে যোগ দিতে চাইছেন না। তাদের ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাদের কেউ উচ্চ আদালতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করতে পারেন। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রান্সফারের বিষয়টি একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাদের পেনশানের ব্যাপারটিও এর সঙ্গে জড়িত। সরকার যেভাবে সীমানা চিহ্নিত করে 'সিটি করপোরেশন উত্তর' ও সিটি করপোরেশন দক্ষিণ করেছেন তাও আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। ভুক্তভোগী যে কোনো নাগরিক ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের প্রতিকার চাইতে পারেন। উচ্চ আদালতের যে কোনো সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সিটি করপোরেশনের বিভক্তি সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হওয়ার ফলে সরকার দুটি সিটি করপোরেশনে দুজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে। সরকার ৯০ দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেবে। এখানে নানা জটিলতায় (মামলা-মুকদ্দমা, প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা (আমলা) নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন। সরকার এমনিতেই ডিসিসির নির্বাচন দিতে পারেনি। আধুনালুুপ্ত ডিসিসির মেয়র খোকা ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি। যে সমস্যার জন্য সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি, সেই সমস্যা থেকে যাবে। ফলে ডিসিসির বিভক্তি কোনো কাজে আসবে না। প্রশাসকরাও নানা কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্তটি ওই আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। পদ্মা সেতু অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে এখন ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্ত দাতা সংস্থাটির সঙ্গে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাতে পারে। ডিসিসির বিভক্তি নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এই কাজটি করা। কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করবে এই ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকরা। ডিসিসির বিভক্তি কোনো সমাধান নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর, বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কলকাতার মতো শহরে একজনই মেয়র আছেন। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মেয়রের কর্মকা- অনেক ব্যাপক। প্রশাসনিক এলাকাও অনেক বড়। সেখানে একজন মেয়র যদি বিশাল এক এলাকার কর্মকা- পরিচালনা করতে পারেন তাহলে ঢাকার একজন মেয়র পারবেন না কেন? আসলে ডিসিসির বিভক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক। বলা হয় ক্ষমতাসীন দলে একাধিক মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদের খুশি করার জন্যই মূলত এই বিভক্তি। এর মধ্যদিয়ে মেয়রের মর্যাদাও ছোট করা হলো। সাবেক মেয়র একজন কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। তিনি প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করতেন। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করবেন। এর মধ্যদিয়ে দুই মেয়রের মর্যাদাকে একধাপ নিচে নামানো হলো। সিটি করপোরেশন দক্ষিণ করেছেন তাও আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। ভুক্তভোগী যে কোনো নাগরিক ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের প্রতিকার চাইতে পারেন। উচ্চ আদালতের যে কোনো সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সিটি করপোরেশনের বিভক্তি সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হওয়ার ফলে সরকার দুটি সিটি করপোরেশনে দুজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে। সরকার ৯০ দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেবে। এখানে নানা জটিলতায় (মামলা-মকদ্দমা, প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা (আমলা) নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন। সরকার এমনিতেই ডিসিসির নির্বাচন দিতে পারেনি। আধুনালুুপ্ত ডিসিসির মেয়র খোকা ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি। যে সমস্যার জন্য সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি, সেই সমস্যা থেকে যাবে। ফলে ডিসিসির বিভক্তি কোনো কাজে আসবে না। প্রশাসকরাও নানা কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্তটি ওই আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। পদ্মা সেতু অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে এখন ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্ত দাতা সংস্থাটির সঙ্গে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাতে পারে। ডিসিসির বিভক্তির নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এই কাজটি করল। কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করবে এই ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকরা। ডিসিসির বিভক্তি কোনো সমাধান নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর, বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কলকাতার মতো শহরে একজনই মেয়র আছেন। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মেয়রের কর্মকা- অনেক ব্যাপক। প্রশাসনিক এলাকাও অনেক বড়। সেখানে একজন মেয়র যদি বিশাল এক এলাকার কর্মকা- পরিচালনা করতে পারেন তাহলে ঢাকার একজন মেয়র পারবেন না কেন? আসলে ডিসিসির বিভক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক। বলা হয় ক্ষমতাসীন দলে একাধিক মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদের খুশি করার জন্যই মূলত এই বিভক্তি। এর মধ্যদিয়ে মেয়রের মর্যাদাও ছোট করা হলো। সাবেক মেয়র একজন কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। তিনি প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করতেন। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করবেন। এর মধ্যদিয়ে দুই মেয়রের মর্যাদাকে একধাপ নিচে নামানো হলো। একটি করপোরেশনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের বিকল্প কিছু নেই। অনেক বড় বড় সিটি করপোরেশন মেট্রোপলিটান গভর্নমেন্ট হিসেবে পরিচালিত হয়। নাগরিক সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় (পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি) এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের আওতাধীন থাকে। ফলে একদিকে যেমনি এক ধরনের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকরা নূ্যনতম সুবিধাও নিশ্চিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে এসব বিষয়াদিতে নগর প্রশাসনের করার কিছুই নেই। শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নগর প্রশাসনের ভূমিকা এখানে শূন্য। তাই ডিসিসির বিভক্তি কোনো সমাধান নয়। ডিসিসিকে ঠিক রেখে এটাকে 'মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট' হিসেবে উন্নীত করা উচিত ছিল। আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ঢাকার সাবেক মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ ওই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট' ধারণার পক্ষে ছিলেন। অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও এমনটি চেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আগামী ১০০ বছরের ঢাকাকে চিন্তা করে এখনই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেষে কেরানীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিচালিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা উচিত। এটা না করে ডিসিসিকে ভাগ করে ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। প্রায় সোয়া কোটি লোক বাস করে এই ঢাকা নগরীতে। জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জ্যাম, হকারদের ফুটপাত দখল, বিদ্যুৎ সঙ্কট, শিশুদের খেলার মাঠের অভাব, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা এ নিয়ে যে ঢাকা মহানগর এই মহানগরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এ মুহূর্তে এটাই জরুরি। এটাই প্রায়োরিটি। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত। কিন্তু এদিকে নজর না দিয়ে সরকার যখন ডিসিসিকে ভাগ করে দুটো সিটি করপোরেশন গঠন করে এখন প্রশ্ন উঠছে বৈকি। রিট আবেদনের সময় ড. কামাল হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। তিনি সংবিধান লঙ্ঘনের যে প্রশ্নটি তুলেছিলেন আদালত তা বিবেচনায়ও নিয়েছে। সংবিধানের ৫(১) ধারায় বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাজধানী হবে ঢাকা। এখন রাজধানী হবে কোনটি_ ঢাকা উত্তর, না ঢাকা দক্ষিণ। আমরা জানি না চূড়ান্ত বিচারে আদালত কী রায় দেবেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে ডিসিসির বিভক্তি নিয়ে জটিলতা আরো বাড়ল। জানুয়ারিতে সরকার ৩ বছর পার করেছে। সরকারের হাতে সময় আছে মাত্র দুই বছর। কিছু কাজ এখনো বাকি। ইতোমধ্যেই সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিরোধী দল সাতটি বিভাগীয় শহরে রোডমার্চ সম্পন্ন করেছে। বড় কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে ডিসিসির বিভক্তির পরিপ্রেক্ষিতে হরতালও হয়ে গেল। আগামীতে আরো বড় কর্মসূচি দেবে বিএনপি। এতে করে সরকারের শরিকরাও আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। এইচএম এরশাদের এই বক্তব্য হতাশারই প্রতিধ্বনি। এ মুহূর্তে ডিসিসির বিভক্তির প্রয়োজন ছিল না। তবুও ডিসিসি ভাগ হয়েছে। যদিও এটাকে মেনে নেয়া ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো বিকল্পও নেই। ২০১২ সাল আমাদের জন্য যে কোনো সুখবর বয়ে আনবে না, তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। দৈনিক যায় যায় দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ড. তারেক শামসুর রেহমানঅধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রসঙ্গ ইভি এম পদ্ধতি

বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট কারচুপি সম্ভব নয়, জাল ভোট প্রদান ও সিল মেরে নির্বাচনও সম্ভব নয়। যারা ভোট চুরি করে নির্বাচন করতে চায়, এটা তাদের জন্য খুব খারাপ হবে। দৈনিক ডেসটিনিতে তার এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবেই (২৯ জানুয়ারি)। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত ২৮ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সার্ভার স্টেশন উদ্বোধন করে এ বক্তব্য দেন। তিনি এই বক্তব্যটি দিলেন এমন একসময় যখন চলতি সপ্তাহেই পুরো নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে, যারা সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের একটি তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। শুধু তাই নয়, তার এ বক্তব্য আসলে এমন এক সময় যখন দিলি্লর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যন্ত্রটি টেম্পারপ্রুফ নয়। অর্থাৎ ইভিএম দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় দিলি্লর হাইকোর্টের এই রায়ের সংবাদও ছাপা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াতের মতো ব্যক্তিত্ব নিশ্চয়ই এই সংবাদটি পাঠ করে থাকবেন। কিন্তু তারপরও তিনি যখন ইভিএমের পক্ষ যুক্তি দেখান, তখন তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! আধুনিক প্রযুক্তি অবশ্যই আমরা চাই। কিন্তু যে প্রযুক্তি নিয়ে খোদ উন্নত বিশ্বেই প্রশ্ন আছে, সেখানে এই মুহূর্তে এই প্রযুক্তিতে না গেলেই আমরা ভালো করতাম। ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখ ইভিএম তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে ব্যয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধান বিরোধী দলসহ বেশ কটি রাজনৈতিক দল যেখানে ইভিএমের বিরোধিতা করছে, সেখানে এই মুহূর্তে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তে না গেলেও পারতাম। ইভিএমের আগে প্রয়োজন দশম সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা। সার্চ কমিটির ব্যাপারে বিরোধী দল আপত্তি করেছে। ফেব্রুয়ারিতেই ইসি পুনর্গঠন করতে হবে। সংশোধিত সংবিধানে ৫ম নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে অতিরিক্ত আরো দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লঙ্ঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য; কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোনো নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরো দুজনের বসার জায়গাও নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। যেখানে বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্র সাধন চলছে, সেখানে দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। কিন্তু সংবিধান এখন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনো চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করাতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। ওই প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে 'নিরপেক্ষ সরকার' বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই 'নিরপেক্ষ সরকার' এর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারো কোনো ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে এরা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে বিদায়ী সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা একটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষ হয়ত ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনো মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবেন কীভাবে? দেখা গেল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন) সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘি্নত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের আইডিয়া বিক্রি করার লোকের অভাব নেই। কনসালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের এক বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। তার এই 'বিশেষজ্ঞ' জ্ঞানের জন্য ইসি থেকে তিনি কত টাকা নিয়েছেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক 'বিশেষজ্ঞ'। এখন জানান দিল দিলি্লর হাইকোর্ট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোনো ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকায়ও সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন? জার্মানিতে আইন করে ইভিএম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতেও তা ব্যবহৃত হয় না। ইউরোপের অনেক দেশ, যেখানে শতকরা একশ ভাগ শিক্ষিত এবং প্রযুক্তি বিদ্যায় আমাদের চেয়ে উন্নত, সেখানেও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হয় না। প্রযুক্তির ভালো দিক যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে খারাপ দিকও। আমাদের সমাজে আমরা শতকরা একশ ভাগ এখনো প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারিনি। কম্পিউটার ব্যবহারের দিক থেকেও পিছিয়ে আছি। আজ যুক্তরাষ্ট্রের মতো শতকরা একশ ভাগ প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তথ্যগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ সেই পর্যায়ে এখনো উন্নীত হয়নি যে, আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরো বাড়লে এবং পরস্পরের অতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
বিদায়ী সিইসিসহ দুজন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা, দুজন বেসামরিক একজন সামরিক। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনো নেই। জনগণের পাল্স্ তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে আঘাত করে নয়, বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে, জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন, অন্যরা ১২টি) বিএনপিকে নয়া নির্বাচন দিতে হয়। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ওই নির্বাচন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধু একটি সংকটের মাঝেই ঠেলে দেবে না, বরং বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা 'সংলাপ' শুরু করা ও তার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনো অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোটের দেশব্যাপী গণমিছিল, চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে, চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত এ কারণে যে, দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব খুব শিগগির আমরা অনুভব করব। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। যার ফলে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, যার পরিমাণ এখন প্রায় ১২ ভাগ। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তথা আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সংকটের গভীরতা বাড়বে, যা কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
এই যখন পরিস্থিতি তখন ইভিএম নিয়ে একটি ঐকমত্যে পেঁৗছান প্রয়োজন। বিদায়ী কমিশনারের অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগির আমরা একজন নয়া সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পাব। ইভিএমের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিক_ আমরা এটাই চাইব। সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিষয়টি দেখতে হবে অত্যন্ত সহনশীলতার দৃষ্টি দিয়ে। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ইভিএম নিয়ে নানা মত আছে। বিরোধিতাও আছে। এক্ষেত্রে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়

যুক্তরাষ্ট্রে গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কা

বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের মাঝে আলোচিত হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণঅভ্যুত্থান কী আসন্ন? গত ৩১ জানুয়ারি নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন যখন তার ১৩৫ দিন অতিক্রম করে, তখন সঙ্গত কারণেই এই ধারণাটা বদ্ধমূল হয়, যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে অনলাইন সংবাদপত্রের, যারা প্রতিদিনের কর্মসূচি পেঁৗছে দিচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দারা, বিশেষ করে আরব বিশ্বের বাসিন্দারা এই ম্যুভমেন্ট থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন আমেরিকার মতো একটি পুঁজিবাদী সমাজে যখন এ ধরনের একটি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'? এই ম্যুভমেন্ট কী যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবে? কিংবা ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শোষিত মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' কী ঠিক তেমনি অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে পুঁজিবাদী বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবে? এই প্রশ্ন বড় বেশি করে আলোচিত হবে ২০১২ সালে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অসমতা, দরিদ্রতা, আর বৈষম্যই সেখানে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম দিয়েছে নিউইয়র্কে এই আন্দোলনের জন্ম হলেও, তা ছড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে একই সঙ্গে এই আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছে ইউরোপের তরুণ সমাজ ইতিহাস সাক্ষী দেয়, এই অসমতা আর বৈষম্যের কারণেই ফরাসি বিপ্লবের জন্ম হয়েছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছিল যদিও চরিত্রগত দিক থেকে ফরাসি বিপ্লব আর রুশ বিপ্লব এক ছিল না

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল, পুঁজিবাদী সমাজের মঙ্গল আনতে পারে (?) যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোন অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সে কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৯৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভাগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্ট্রিগলিৎনের মতে, শীর্ষে থাকা এই ৯ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে পধংড়সঢ় পধঢ়রঃধষরংস। অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছেন তারা গ্রাজুয়েশন করার পর চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ ২০১০ সালে কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের ্তুপষধহ ধিংঃধমব্থ বা শ্রেণী যুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'গুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণ এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বিখ্যাত ঞযব পড়সসঁহরংঃ সধহরভবংঃড় গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন ্তু...ধ ভরমযঃ ঃযধঃ বধপয ঃরসব বহপষড়ফ, বরঃযবৎ রং ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হধৎু ৎবপড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ংড়পরবঃু ধঃ ষধৎমব, ড়ৎ রহ ধ পড়সসড়হ ৎঁরহ ড়ভ ঃযব পড়হঃবহফরহম পষধংংবং। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিত শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজো বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে নিষ্পেষণ করতেন, বলতে পারবো না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেন চষঁঃড়পৎধপু হিসেবে, অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখছেন, Increasingly, wealth concentrated in the financial sector। Politicians faced with the rising cast of campaigns, were driven एवर deeper into the pockets of wealthy backers. এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিক শ্রেণীর হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় ্তুইরষষরড়হধরৎব ভৎরবহফষু্থ। ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরো সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্টে' এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded, occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course ।মার্কস যেখানে বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন Moral human course| এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণীবৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও, দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ, আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮, আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে ওইসব দেশেও 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' এর জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। মানবিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট'কে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিত শ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবকে সংঘটিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জেডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকের এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী একটি পরিবর্তন আনছেন। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি না, জানি না; কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এই পরিবর্তন সমাজকে কতটুকু বদলে দেবে বলা মুশকিল। রাশিয়ায় বিপ্লবের পর সমাজ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৭০ বছর দেখা গেল সেখানে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষমতা ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আশির দশকের শেষের দিকে আমি পূর্ব ইউরোপে এই বৈষম্য দেখেছি। রাশিয়ায়ও এই বৈষম্য আমার চোখে পড়েছিল। মাওজে ডং একবার বলেছিলেন, পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দাও। তেং সিয়াও পিং পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেননি। কিন্তু অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। পবিরর্তন সেখানে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিবর্তন আসছে? যেভাবে আমেরিকার সমাজ বিকশিত হচ্ছে, সেভাবে আর বিকশিত হবে না। পরিবর্তন সেখানে আসবেই। একসময় মার্কসবাদীরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এখন তারা সশস্ত্র পথ পরিত্যাগ করে (নেপালি মাওবাদীরা) সমাজে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। এটা একটা নতুন দিক। বিপ্লবের ধরন বদলে গেছে। একুশ শতকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে এক নতুন ধরনের বিপ্লব। আর যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণঅভ্যুত্থান এই বিপ্লবের নতুন একটি মাত্রা দেবে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত


গত ২৫ জানুয়ারি সকালের খবর পত্রিকায় প্রথম পাতায় যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তাতে করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের কয়েক সশস্ত্র কর্মী হাতে বঁটি নিয়ে ছাত্রলীগেরই অপর পক্ষকে ধাওয়া করছে। কোনো কোনো পত্রিকায় কাটা রাইফেল হাতে ছাত্রলীগ কর্মীর ছবিও ছাপা হয়েছে। এই যে ছবি, এই ছবি কী বলে? জগন্নাথ একসময় যখন কলেজ ছিল, তার একটি ‘চরিত্র’ ছিল, যা উচ্চ শিক্ষার পরিবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ছাত্রনেতাদের দাপটে শিক্ষক, অধ্যক্ষ কিংবা স্থানীয় জনগণ ছিল অসহায়। ‘ভর্তি বাণিজ্য’ ছিল অর্থ অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। একসময় জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হল, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। একটি নতুন বিশ্ববদ্যালয় অনেক সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে এবং ছাত্ররাজনীতি যে পর্যায়ে চলে গেছে, তা যদি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনা না যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার সেই পুরনো ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তথাকথিত ‘ছাত্ররাজনীতি’ অতীতে জগন্নাথ কলেজের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। কালিমালিপ্ত করেছিল। আজ কলেজ থেকে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বঁটি কিংবা কাটা রাইফেল হাতে যে ছাত্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা দেখে নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে নানা সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২৭ (৪) ধারাটি সাম্প্রতিককালে একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ওই ধারায় বলা হয়েছিল, সরকার অবকাঠামো খাতে অর্থ বরাদ্দ করবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। এটা আইন এবং সংসদে তা পাস হয়েছে। কিন্তু ২৭ (৪) ধারাটি বাতিল করার জন্য ছাত্ররা কিছুদিন আগে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিল। তাদের যুক্তি নিজস্ব আয়ে নয়, বরং সরকারকেই সব খরচ বহন করতে হবে। সরকার নীতিগতভাবে রাজিও হয়েছে। হয়তো খুব শিগগিরই আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে পাব। নতুন প্রতিষ্ঠিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই (জগন্নাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমিল্লা) সমস্যা রয়েছে। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পষ্টতই একটি পার্থক্য রয়েছে। জগন্নাথ পুরনো বিধায় আইনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঁচ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেওয়া হয়েছিল ১০ বছরের সময়সীমা। কেননা জগন্নাথ পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, বাকি দুটো নতুন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় (কলেজ) হিসেবে জগন্নাথের যে আর্থিক ভিত্তি ছিল, নতুনদের তা ছিল না। সুতরাং কুমিল্লা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (ত্রিশাল) বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এককাতারে মেলানো যাবে না।
এখানে ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তারা জেনেশুনেই ভর্তি হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা জেনেশুনেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। উপাচার্য মহোদয় ভালো করেই জানেন আইনে কী লেখা আছে। ২৭ (৪) ধারা নিয়ে আন্দোলন হল। ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর করল। দায়ভার তো উপাচার্যকে নিতেই হবে! ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে তার উচিত ছিল ছাত্রদের নিবৃত করা। গাড়ি ভাঙচুর কোনো সমাধান নয়। গাড়ি ভাঙচুর করলেই সরকার অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে না। কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর হল, মানুষের ভোগান্তি হল, সাধারণ মানুষ দোষ দিল ছাত্রদের। জগন্নাথ কলেজের একটি ‘ঐতিহ্য’ ছিল, যা ওই কলেজটিকে বারবার বদনামের ভাগীদার করেছে। ওখানে ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল চাঁদাবাজি। ছাত্র ভর্তির পেছনে লাখ লাখ টাকা আয় করত ছাত্রনেতারা। সেখানে আবার সরকারি ও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের ‘সহাবস্থান’ ছিল কে কতটি ‘সিট’ পাবে, তা অলিখিতভাবে তৈরি করাই থাকত। অধ্যক্ষ মহোদয়রা কখনই ওই চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। আজ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু ওই সংস্কৃতির কি পরিবর্তন হয়েছে? আমার মনে হয় না। আগের মতো ছাত্র ভর্তিতে চাঁদাবাজি হয়তো হয় না। কিন্তু কিছু যে হয় না, এর গ্যারান্টি কে দেবে?
আইনে বলা হয়েছে নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহ করা। এটা সম্ভব। এজন্য দরকার ডায়নামিক নেতৃত্ব। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপাচার্যরা যদি দায়িত্ব না নেন, তাহলে এভাবে বারবার ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেবে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় যে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে, তা প্রমাণ করেছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ। এখানে তারা নিজেদের শুধু ব্যয় নির্বাহই করেন না, উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে তারা প্রচুর অর্থও জমা দেন। উদ্যোগটা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সম্ভাবনা আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। গুরুত্বের গলদ ছিল। যেসব বিষয়ের চাহিদা রয়েছে, সেসব বিষয় যদি চালু করা হতো, তাহলে ছাত্ররা টাকা-পয়সা দিয়েই পড়ত। তা না করে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় চালু করে, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং ব্যবসা প্রশাসন, মিডিয়া স্টাডিজ কিংবা আইটি ক্ষেত্রে বিভাগ চালু করলে, ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যেত। এখনও সেই সুযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্ভব। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি আছে। এ দেশের বেসরকারি খাত এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে উত্সাহিত হবে। অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে’ পরিণত করেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পুঁজি খাটাবেন, যদি তাদের উত্সাহিত করা হয়। এজন্য বড় প্রয়োজন উদ্যোগের। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা জগন্নাথে উপাচার্য হয়েছেন, তারা কখনও এ দিকটা ভাবেননি। তারা অনেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মতো চাকরি করে গেছেন। তারা এটা কখনও ভাবেননি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটা এক অর্থে সরকারি, অন্য অর্থে বেসরকারি। তৃতীয়ত, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ‘বিনিময় প্রোগ্রাম’ চালু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমির মান বাড়ানো সম্ভব। সেই সঙ্গে আর্থিক ভিত্তিও শক্তিশালী করা যায়। উদ্যোগটাই হল আসল। এই উদ্যোগের বড় অভাব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান, তাদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, এটা গত পাঁচ বছরে কেউ কখনও চিন্তা করেননি। এখন অহেতুকভাবে সরকারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বিব্রত হয়েছিলেন। তার বিব্রত হওয়ারই কথা। তাকে এখন চাপের মুখে রেখে আইন পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। আইনটি পাস হয়েছিল সংসদে এবং পরিবর্তন যদি করতেই হয়, তাহলে তা করতে হবে সংসদে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান ও অবকাঠামো উন্নয়নে যে সাহায্য দিয়েছিল, তার অন্যতম শর্ত ছিল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে, তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারবে না কেন?
আরও একটা কথা। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই এখন উচিত তাদের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও এই আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা যায়। অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ করা উচিত। এটা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংক থেকে আমরা আর কোনো আর্থিক সাহায্য পাব না। বিশ্বব্যাপীই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধারণা বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টির মতো। আরও হবে। এক্ষেত্রে সরকার সকল অর্থ বহন করবে তা হয় না। এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্যও নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
এভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে অরাজকতা সৃষ্টি করা হবে, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হবে, রামদা হাতে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য গড়ে তুলবে, এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। আজ শুভবুদ্ধির মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। ১৫০ জন কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। রামদা আর বঁটি হাতে সন্ত্রাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরদিনের জন্য বহিষ্কার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে যাক, আমরা তা চাই না। ওই কাটা রাইফেল আর বঁটি আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাই স্বাভাবিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিকশিত হোক
দৈনিক সকালের খবর,১ ফেব্রুয়ারি ২০১২.
ড.তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com