রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পালোমার মৃত্যু কি আমাদের কিছু ভাবায়

সিদরাতুল মুনতাহা পালোমার মৃত্যু কী আমাদের কিছু শেখায়? গত ২ ফেব্রুয়ারি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট পালোমোর মৃত্যুর পর আমার কাছে এ প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পালোমো নেই; কিন্তু সব কিছুই চলছে আগের মতো। পালোমার মতো মৃত্যু আমাদের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশের দু'জন গুণী মানুষ চলচিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬ মাস আগে, ১৩ আগস্ট। সেদিন সারাদেশের মানুষ কেঁদেছিল। ১৩ আগস্ট ওই ঘটনার পর কত মানুষ সড়ক ও মহাসড়কে প্রাণ হারিয়েছেন, তার পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। শুধু সংবাদপত্রগুলো আমাদের মাঝে মধ্যে জানিয়ে দেয় দু'একটি মৃত্যুর কথা। গত ১০ নভেম্বর যারা সংবাদপত্র পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন এক দম্পত্তির মৃত্যুর খবর। চিকিৎসক লোপা ও প্রকৌশলী মনোয়ারের ছবি। সড়ক দুর্ঘটনায় তারা নিহত হয়েছেন। বেঁচে আছে তাদের ছোট্ট সন্তান নুহাদ। নুহাদ মৃত্যু কি বোঝে না। কিন্তু যখন বলে 'বাবা কবরে শুয়ে আছে', তখন বাবা হিসেবে বুকটা আমার ভেঙে যায়। কে দায়িত্ব নেবে ছোট্ট নুহাদের? নৌপরিবহন মন্ত্রী শ্রমিকদের নেতা। তাদের নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন। তিনি বলেছিলেন, বাস চালকদের 'ঘাতক' বলা যাবে না। তারা সেবক। তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও প্রখ্যাত এক ইতিহাসবিদকেও তিনি হুমকি দিয়েছিলেন এই 'ঘাতক'দের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। তার নেতৃত্বাধীন শ্রমিকরা নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা মেরেছিল। সেই ছবি ছাপাও হয়েছিল পত্র-পত্রিকায়। ঘাতক বাস চালকদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন নৌমন্ত্রী। কিন্তু ছোট্ট নুহাদ তার সমবেদনা পেল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাহিদ সুলতানা, কিংবা গৃহবধূ চাঁদনীকে যখন ঘাতকরা মেরে ফেলে, এখন নৌপরিবহনমন্ত্রী র্নিবিকার। তার 'সেবক'রা দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছে নৈরাজ্য। মহাসড়কগুলোকে কেউই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। মন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে পরিবহন শ্রমিকরা যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন মন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! এর নাম কী রাজনীতি? এই রাজনীতিতে কী জনগণের মঙ্গল নিহিত রয়েছে? আমি নিত্যদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাভার-ঢাকা মহাসড়কে চলাচল করি। নিত্যদিন আমি প্রত্যক্ষ করি চালকরা ওভারটেক করছে। বেপোরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি রঙ সাইডে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। হেমায়েতপুর, সভার বাজারেও সেই একই চিত্র। ট্রাফিক পুলিশের কাজটি হচ্ছে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা। তারা তা করছে না। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হেমায়েতপুর বাজারে দেখলাম দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন (তিনি কী তখন বখশিশ আদায় করছিলেন!)। সাভার বাজারে সেই পুরনো দৃশ্য_ রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ, নির্বিকার। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন না। একটু সামনে গেলেই একটা বাস, দেখলাম সেখানে সেই প্রতিযোগিতা_ কে কার আগে যাবে! কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ দৃশ্য আমাকে সপ্তাহে একাধিক দিন দেখতে হয়, কেননা এ রুট ধরেই আমি আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করি। উপযাচক হয়ে অতীতে একাধিক দিন সাভার এলাকায় দায়িত্ব পালনরত সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। না, কিছুই হয়নি। কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল দু'দিন আগেও, তেমনটিই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেই ওভারটেকিং, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন না করা ভুল পথে চালকদের গাড়ি চালানো, সব কিছুই আগের মতো। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-আরিচা রোডের এ ছিল দৃশ্য। এই মহাসড়কে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল দুমাস আগে যেখানে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো, আন্দোলন হল, সেখানে এতটুকুও সচেতন হলেন না যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা। ওই মৃত্যু তাদের এতটুকুও স্পর্শ করেনি। আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি? আর কত নিবন্ধ লিখলে আমরা সচেতন হব? মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঘাতক বাসচালক জাকির হোসেন যখন ডিবি অফিসে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান তিনি নির্দোষ, তখন সত্যি সত্যিই আমার ভাবতে কষ্ট লাগে আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি! ঘাতক চালক জাকির হোসেনের কথার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যের। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী একা 'আবিষ্কার' করেছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকও দায়ী।
আমরা বার বার বলে আসছি মহাসড়কে নিয়মিত টহল দেওয়ার কথা। গত ২০ নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে আমরা কিছুটা উৎসাহিত হয়েছিলাম; কিন্তু এই উৎসাহ আমরা কতদিন ধরে রাখতে পারব, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। দীর্ঘদিন পর হাইওয়ে পুলিশের বোধ হয়, কিছুটা টনক নড়ছিল। ২১ নভেম্বর তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নেমেছিলেন 'দায়িত্ব পালন' করতে। সেই সংবাদটিই পত্রিকাগুলো ছেপেছিল পরদিন। 'দায়িত্ব পালন' করতে গিয়ে হাইওয়ে পুলিশ ওইদিন ২৫টি গাড়িকে জরিমানা করেছিল। শতাধিক গাড়িও আটক করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ। এ জন্য গাজীপুর জোনের পুলিশ কর্মকর্তাদের আমি স্বাগত জানাই। মহাসড়কে যদি পুলিশি অভিযান চলে, তাহলে 'ঘাতক' বাস চালকরা কিছুটা সতর্ক হয়ে যাবে। মহাসড়কে গাড়িতে গাড়িতে প্রতিযোগিতার প্রবণতা কিংবা ওভারটেকিংয়ের মানসিকতা তারা পরিহার করতে পারবেন। বাস চালকদের মাঝে একটা ভয় থাকবে সবসময়। যে কারণে তারা নিয়ম মতো গাড়ি চালাবেন। হাইওয়ে পুলিশে এই কাজটি শুধু একদিনের জন্য সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং এটা নিয়মিত করতে হবে। আমিনবাজার থেকে আরিচা পর্যন্ত নিয়মিত টহল দিতে হবে। সেদিন অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর টহল সীমাবদ্ধ ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে। এখন এ টহল দিতে হবে সাভার বাজারে। এখানে গাড়ি চালকরা বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোক-ওঠানো-নামানোর কাজটি সম্পন্ন করে। আশপাশে টহল পুলিশ ডিউটি করলেও ওই বিষয়টি তাদের চোখে পড়ে না। অভিযোগ আছে বাসচালকরা সাভার বাাজরে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশদের নিয়মিত 'মাসোহারা' দেন, যে কারণে মূল রাস্তায় গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি করে বাসচালকরা যখন যাত্রী ওঠান, তখন দূরে দাঁড়ান ট্রাফিক পুলিশ তা অবলোকন করেন মাত্র। গত ৭ ফেব্রুয়ারিও এ ছিল চিত্র। এ কারণেই টহল পুলিশের সাভার বাজারে উপস্থিত থাকা খুবই প্রয়োজন। মূল রাস্তা থেকে বাজারটি সরিয়ে দেওয়াও প্রয়োজন। ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মহাসড়কের পাশে কোনো বাজার থাকতে পারবে না। ওই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতেই সাভার বাজারটি সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাতে করে এখানে যানজট অনেক কমে যাবে। প্রতিটি গাড়িতে একটি বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা জরুরি, যাতে করে ভুয়া ড্রাইভারদের চিহ্নিত করা যায়। বিদেশে এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডব্রেকার থাকতে হবে। কিছু দূর পর পর গতি নিয়ন্ত্রণ মেশিন থাকতে হবে, যা হবে অটোমেটিক। প্রতিটি গাড়ির গতির পরিমাণ তাতে রেকর্ড হবে এবং অতিরিক্ত গতির জন্য চালককে ফাইন গুনতে হবে। এসব ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নৌমন্ত্রীর ভূমিকা এখানে মুখ্য; কিন্তু তা না করে নৌপরিবহনমন্ত্রী যখন পরিবহন শ্রমিকদের উসকে দেন, তাতে করে তার ভূমিকা বিতর্কিত হয়। কোনো সমাধান তাতে হয় না। বরং এতে করে 'ঘাতকরা' আরো উৎসাহিত হয়। একটি মৃত্যু তাদের কাছে বড় কিছু নয়; কিন্তু পালোমার বাবা-মায়ের কাছে এ মৃত্যু অনেক বড়। চিরদিনের জন্য তারা একা হয়ে গেলেন। নৌ পরিবহনমন্ত্রীর অতিপ্রিয় 'সেবকরা' যখন মনোয়ার দম্পতি ও গৃহবধূ চাঁদনীকে হত্যা করে পালিয়ে যায়, তখন সংবাদপত্রে মন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। এ মৃত্যু মন্ত্রীকে এতটুকুও ছুয়ে যায়নি। আমাদের দুঃখ আমরা হত্যাকারী কোনো বাস চালককেই বিচার করতে পারিনি। এই সমাজ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি। কোনো সভ্য সমাজে এভাবে কোনো মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘাতকদের পাশে এসে দাঁড়ান না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা তা দেখলাম। মন্ত্রী ঘাতকদের নিয়ে রাজনীতি করেন। একজন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর কিংবা চিকিৎসক-প্রকৌশলী দম্পতির চেয়ে একজন ঘাতক তার কাছে অনেক বড়। আমার দুঃখটা এখানেই_ আজ যখন ক্ষমতাবান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যুক্তি দেখান 'এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট' তখন আমার কষ্ট হয়। যেখানে তার পালোমার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা, সেখানে তিনি উপহাস করলেন পালোমোর মৃত্যুকে নিয়ে। অন্য কোনো দেশ হলে সৈয়দ আশরাফকে তার ওই বক্তব্যের জন্য পদত্যাগ করতে হতো। বাংলাদেশ বলে কথা। 'ঘাতক'দের নিয়ে রাজনীতি করেন মন্ত্রীরা। পালোমার মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেয়; কিন্তু ঘাতক বাসচালককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেয় না।
 ড. তারেক শামসুর রেহমান
 অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment