রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত


গত ২৫ জানুয়ারি সকালের খবর পত্রিকায় প্রথম পাতায় যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তাতে করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের কয়েক সশস্ত্র কর্মী হাতে বঁটি নিয়ে ছাত্রলীগেরই অপর পক্ষকে ধাওয়া করছে। কোনো কোনো পত্রিকায় কাটা রাইফেল হাতে ছাত্রলীগ কর্মীর ছবিও ছাপা হয়েছে। এই যে ছবি, এই ছবি কী বলে? জগন্নাথ একসময় যখন কলেজ ছিল, তার একটি ‘চরিত্র’ ছিল, যা উচ্চ শিক্ষার পরিবেশের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ছাত্রনেতাদের দাপটে শিক্ষক, অধ্যক্ষ কিংবা স্থানীয় জনগণ ছিল অসহায়। ‘ভর্তি বাণিজ্য’ ছিল অর্থ অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। একসময় জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হল, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। একটি নতুন বিশ্ববদ্যালয় অনেক সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে এবং ছাত্ররাজনীতি যে পর্যায়ে চলে গেছে, তা যদি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনা না যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার সেই পুরনো ঐতিহ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তথাকথিত ‘ছাত্ররাজনীতি’ অতীতে জগন্নাথ কলেজের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। কালিমালিপ্ত করেছিল। আজ কলেজ থেকে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু বঁটি কিংবা কাটা রাইফেল হাতে যে ছাত্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা দেখে নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে নানা সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২৭ (৪) ধারাটি সাম্প্রতিককালে একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। ওই ধারায় বলা হয়েছিল, সরকার অবকাঠামো খাতে অর্থ বরাদ্দ করবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। এটা আইন এবং সংসদে তা পাস হয়েছে। কিন্তু ২৭ (৪) ধারাটি বাতিল করার জন্য ছাত্ররা কিছুদিন আগে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিল। তাদের যুক্তি নিজস্ব আয়ে নয়, বরং সরকারকেই সব খরচ বহন করতে হবে। সরকার নীতিগতভাবে রাজিও হয়েছে। হয়তো খুব শিগগিরই আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে পাব। নতুন প্রতিষ্ঠিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই (জগন্নাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমিল্লা) সমস্যা রয়েছে। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পষ্টতই একটি পার্থক্য রয়েছে। জগন্নাথ পুরনো বিধায় আইনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঁচ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দেওয়া হয়েছিল ১০ বছরের সময়সীমা। কেননা জগন্নাথ পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, বাকি দুটো নতুন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় (কলেজ) হিসেবে জগন্নাথের যে আর্থিক ভিত্তি ছিল, নতুনদের তা ছিল না। সুতরাং কুমিল্লা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (ত্রিশাল) বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এককাতারে মেলানো যাবে না।
এখানে ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তারা জেনেশুনেই ভর্তি হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারা জেনেশুনেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। উপাচার্য মহোদয় ভালো করেই জানেন আইনে কী লেখা আছে। ২৭ (৪) ধারা নিয়ে আন্দোলন হল। ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর করল। দায়ভার তো উপাচার্যকে নিতেই হবে! ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে তার উচিত ছিল ছাত্রদের নিবৃত করা। গাড়ি ভাঙচুর কোনো সমাধান নয়। গাড়ি ভাঙচুর করলেই সরকার অর্থ বরাদ্দ করতে পারবে না। কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর হল, মানুষের ভোগান্তি হল, সাধারণ মানুষ দোষ দিল ছাত্রদের। জগন্নাথ কলেজের একটি ‘ঐতিহ্য’ ছিল, যা ওই কলেজটিকে বারবার বদনামের ভাগীদার করেছে। ওখানে ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল চাঁদাবাজি। ছাত্র ভর্তির পেছনে লাখ লাখ টাকা আয় করত ছাত্রনেতারা। সেখানে আবার সরকারি ও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের ‘সহাবস্থান’ ছিল কে কতটি ‘সিট’ পাবে, তা অলিখিতভাবে তৈরি করাই থাকত। অধ্যক্ষ মহোদয়রা কখনই ওই চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। আজ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু ওই সংস্কৃতির কি পরিবর্তন হয়েছে? আমার মনে হয় না। আগের মতো ছাত্র ভর্তিতে চাঁদাবাজি হয়তো হয় না। কিন্তু কিছু যে হয় না, এর গ্যারান্টি কে দেবে?
আইনে বলা হয়েছে নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহ করা। এটা সম্ভব। এজন্য দরকার ডায়নামিক নেতৃত্ব। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপাচার্যরা যদি দায়িত্ব না নেন, তাহলে এভাবে বারবার ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেবে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় যে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে, তা প্রমাণ করেছে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ। এখানে তারা নিজেদের শুধু ব্যয় নির্বাহই করেন না, উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে তারা প্রচুর অর্থও জমা দেন। উদ্যোগটা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সম্ভাবনা আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। গুরুত্বের গলদ ছিল। যেসব বিষয়ের চাহিদা রয়েছে, সেসব বিষয় যদি চালু করা হতো, তাহলে ছাত্ররা টাকা-পয়সা দিয়েই পড়ত। তা না করে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় চালু করে, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং ব্যবসা প্রশাসন, মিডিয়া স্টাডিজ কিংবা আইটি ক্ষেত্রে বিভাগ চালু করলে, ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যেত। এখনও সেই সুযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সম্ভব। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি আছে। এ দেশের বেসরকারি খাত এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে উত্সাহিত হবে। অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে’ পরিণত করেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা পুঁজি খাটাবেন, যদি তাদের উত্সাহিত করা হয়। এজন্য বড় প্রয়োজন উদ্যোগের। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা জগন্নাথে উপাচার্য হয়েছেন, তারা কখনও এ দিকটা ভাবেননি। তারা অনেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মতো চাকরি করে গেছেন। তারা এটা কখনও ভাবেননি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেই অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটা এক অর্থে সরকারি, অন্য অর্থে বেসরকারি। তৃতীয়ত, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ‘বিনিময় প্রোগ্রাম’ চালু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমির মান বাড়ানো সম্ভব। সেই সঙ্গে আর্থিক ভিত্তিও শক্তিশালী করা যায়। উদ্যোগটাই হল আসল। এই উদ্যোগের বড় অভাব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যারা চালান, তাদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, এটা গত পাঁচ বছরে কেউ কখনও চিন্তা করেননি। এখন অহেতুকভাবে সরকারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় বিব্রত হয়েছিলেন। তার বিব্রত হওয়ারই কথা। তাকে এখন চাপের মুখে রেখে আইন পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। আইনটি পাস হয়েছিল সংসদে এবং পরিবর্তন যদি করতেই হয়, তাহলে তা করতে হবে সংসদে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান ও অবকাঠামো উন্নয়নে যে সাহায্য দিয়েছিল, তার অন্যতম শর্ত ছিল নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে, তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারবে না কেন?
আরও একটা কথা। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই এখন উচিত তাদের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও এই আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করা যায়। অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ করা উচিত। এটা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংক থেকে আমরা আর কোনো আর্থিক সাহায্য পাব না। বিশ্বব্যাপীই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধারণা বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টির মতো। আরও হবে। এক্ষেত্রে সরকার সকল অর্থ বহন করবে তা হয় না। এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা গ্রহণযোগ্যও নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।
এভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে অরাজকতা সৃষ্টি করা হবে, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হবে, রামদা হাতে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য গড়ে তুলবে, এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। আজ শুভবুদ্ধির মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। ১৫০ জন কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। রামদা আর বঁটি হাতে সন্ত্রাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরদিনের জন্য বহিষ্কার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে যাক, আমরা তা চাই না। ওই কাটা রাইফেল আর বঁটি আমরা দেখতে চাই না। আমরা চাই স্বাভাবিক একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিকশিত হোক
দৈনিক সকালের খবর,১ ফেব্রুয়ারি ২০১২.
ড.তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment