তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের এক দিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এই পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরো বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! সিরিয়ার কুর্দিরা বেশির ভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা ‘পিপলস ডিফেন্স ইউনিট’ (YPG) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা-না রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেক ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অব্দি একটি শান্তি ফর্মুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়ার বিরোধীপক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি ‘হাই নেগোসিয়েশনস কমিটি’ (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ঠিক তখনই এসেছিল একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। ডাচ অনুসন্ধানকারী দল জানিয়েছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আকাশে যে মালয়েশিয়ান বিমানটি ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে ২৯৫ জন আরোহী প্রাণ হারিয়েছিল, তা রাশিয়ার মিসাইল হামলার শিকার হয়েছিল। এই প্রতিবেদন নিঃসন্দেহে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করছে যে এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিতে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ক্রিমিয়ার গণভোট (২০১৪) ও ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি পরবর্তী পরিস্থিতির কথা। ইউক্রেনে একটি রুশপন্থী সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের ‘ষড়যন্ত্র’ ও সরকার উৎখাতের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তির পরই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের ঘটনা ঘটেছিল। পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করেছিল রাশিয়া। এরপর একপর্যায়ে রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কার্যত ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল একটি ‘প্রক্সিওয়ার’—এর একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া। তখন এর সঙ্গে যোগ হলো সিরিয়ার ঘটনাবলি। সুষ্ঠুভাবে দেখলে দেখা যায়, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর পূর্ব ইউরোপে যে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দুটি দেশ জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হোক। একসময় এ দেশ দুটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদি জর্জিয়া ও ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে এই দেশ দুটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যাবে। ফলে ‘চাপের’ মুখে রাখা যাবে রাশিয়াকে। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ (গ্যাস) (যার ওপর ইউরোপ অনেকটা নির্ভরশীল)-এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এখানে ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সীমিত যুদ্ধের (ওসেটিয়া প্রশ্নে) কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ব্ল্যাক সি’র অন্য পাশের দেশগুলো (বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ও রুমানিয়া) এরই মধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিস আগে থেকেই ন্যাটোর সদস্য। জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। তাই ইউক্রেনে একটি ‘পরিবর্তন’ প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে উৎখাতের প্রয়োজন ছিল। ২০১০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ উৎখাত হন। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র ওই অভ্যুত্থানের পেছনে মদদ জুগিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি সরকার ইউক্রেনে ক্ষমতায় রয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ক্রিমিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ইউরোপ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনটি পাইপলাইন, নর্ড স্ট্রিম, বেলারুশ, আর ইউক্রেন লাইনে এই গ্যাস রাশিয়া সরবরাহ করে পূর্ব তথা পশ্চিম ইউরোপে। যদি ‘সংকট’ আরো গভীরতর হয়, তাহলে রাশিয়া এই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ (?) করে দিতে পারে, যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস (পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাস রিজার্ভ রাশিয়ায় অবস্থিত)। মজার কথা, বেলারুশ আর ইউক্রেন আবার রাশিয়ার গ্যাস নিয়ে নিজেরা রিজার্ভ গড়ে তুলছে। তারা আবার এই গ্যাস পশ্চিম ইউরোপে বিক্রিও করে। ২০০৯ সালে এই ‘গ্যাস বিক্রি’র বিষয়টি নিয়ে বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল এবং একপর্যায়ে রাশিয়া বেলারুশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘গ্যাসওয়ার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে এক ধরনের ‘প্রক্সিওয়ার’ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলেও রাশিয়া তথাকথিত এই ‘নিরাপত্তাকে’ দেখছে তার নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামেও অভিহিত করেছেন।
এখন সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে দুটি বড় পক্ষ—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফ বলছে, সিরিয়া পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে ২০০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পুনর্গঠনকাজে সহযোগিতা দিতে রাজি, কিন্তু আসাদকে ক্ষমতায় রেখে নয়। ইরাকের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখেছিলাম। ইরাক পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছিল মার্কিন কম্পানিগুলো। একজন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বার্থ এখানেই—দুই লাখ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ‘কাজ’ মার্কিন কম্পানিগুলোকে পাইয়ে দেওয়া। তাই যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না, আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হোক। আবার মাইনাস আসাদ ফর্মুলায় রয়েছে রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের আপত্তি! সর্বশেষ ঘটনায় আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন দৃশ্যপটকে বদলে দিল। তাই সিরিয়ার শান্তি আলোচনা এখন কোন দিকে যায়, সেদিকেই লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily Kalerkontho
31.01.2018