তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের’ ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে, যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতিতে বলা হয়েছেÑ পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ, জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগসুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া এবং তিস্তায় পানি না পাওয়া এখন আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এই দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন আমাদের বিষয় নয়। আমাদের নেতৃত্ব বিষয়টিকে হালকাভাবে নেননি। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারোর সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খাড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরে কাউনিয়া পীরগাছা কুড়িগ্রামের রাজার হাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারীÑ এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু-দেশের মন্ত্রিপর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির শতকরা ৮০ ভাগ দু-দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। মমতা ব্যানার্জি এই পানি চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদীর পানি এককভাবে তিনি ব্যবহার করতে পারেন না। তিনি নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে (প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর, ২০১৭ সালের এপ্রিল) নতুন একটি ‘ফরমুলা’ দিয়েছিলেন। তিনি তোসা ও জলঢাকাসহ চারটি নদীর নাম বলেছিলেন, যেখান থেকে পানি নিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করা যায় বলে মনে করেন। বাংলাদেশে তোসা ও জলঢাকা নদী দুধকুমার ও ধরলা নামে পরিচিত। মমতার ওই বক্তব্য মূলত ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামান্তর। আগেই উল্লেখ করেছি, মমতা ঢাকায় এসে অভিযোগে করেছিলেনÑ বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ-ই হচ্ছে মমতা! তবে একটা সমস্যা আছেÑ প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের জানিয়েছিলেন, মমতার সম্মতি নিয়েই তিস্তা চুক্তি হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই ‘সম্মতি’ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আরও একটা ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ। এই ব্যারাজ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল, তা হচ্ছে রাজবাড়ীর পাংশায় একটি স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল, যেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় একটি রিজার্ভিয়ার নির্মাণ করা হবে, যাতে বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখা যায়। এই পানি শুল্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যাবে। এক্ষেত্রে ভারতের সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতার প্রশ্ন ছিল। দুটি চীনা কোম্পানি এবং জাপান এ খাতে ২ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের তথা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২ দশমিক ৯০ ট্রিলিয়ন লিটার পানি ধরে রাখার কথা। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও ছিল। এতে ভারতও উপকৃত হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পাংশায় যে ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, তা তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। তবে একটি উপযুক্ত স্থান দেখার জন্য তিনি মমতা ব্যানার্জির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যৌথ উদ্যোগের কথাও বলেছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি পানি ধরে রাখার জন্য নদী ড্রেজিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০১৭ সালে দুই প্রধানমন্ত্রী যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন, তার ৪১ নম্বর ধারায় গঙ্গা ব্যারাজের কথা বলা হয়েছিল। সেখানে দু-দেশের সমন্বয়ে একটি ‘যৌথ কারিগরি টিম’ গঠন করার কথাও বলা হয়েছিল। এই ‘যৌথ কারিগরি টিম’ এর ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশ সফর করবে এবং বাংলাদেশে তারা একটি সমীক্ষা চালাবে; কিন্তু সেই সমীক্ষা আজও চালানো হয়নি। এ কারণে পানি নিয়ে সংকট বাড়ছে। শুল্ক মৌসুম আসছে। তিস্তায় পানি থাকবে না। এটা বাংলাদেশে একটি বড় সংকট তৈরি করবে।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান মাত্র ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও ২০৫০ সালে ভারত দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। সুতরাং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভারতকে আরও উদার হতে হবে। ভারত যদি আরও উদার না হয়, তাহলে উপাঞ্চলিক সহযোগিতার যে বড় সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে। ‘কবি’ নরেন্দ্র মোদি (তার দুটি কবিতার বই আছে) ঢাকায় এসে বলেছিলেন, পাখি কিংবা বায়ুর কোনো সীমান্ত নেই। তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’ আমাদের জন্য অনেক বড় কিছু। ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণাপত্রে যে ৬২টি দফা আছে, তাতে অনেক ভালো ভালো কথা আছে। এখন দেখার পালা কতটুকু তা বাস্তবায়িত হয়। শুধু আশ্বাস বাংলাদেশিদের মন ভারতে পারবে না। ভারতীয় নেতাদের ‘মাইন্ড সেটআপে’ পরিবর্তন দরকার। যদি সেটি না হয়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এই পানি অর্থাৎ তিস্তার পানিই কী হতে যাচ্ছে দু-দেশের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তি? পানি নিয়ে মমতা রাজনীতি করছেন। এটা এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট। ভারতীয় গণমাধ্যমও মমতার এই অবস্থানকে সমর্থন করছে না। এখন মোদির বক্তব্যই আমাদের ভরসা। নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার আর নয়াদিল্লিতে মোদি সরকারের আমলেই তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান হবে। মোদির কাছে আছে সংবিধানের ২৫৩ নম্বর ধারাটি, যে ধারাবলে বিদেশের সঙ্গে যে-কোনো চুক্তি তিনি করতে পারেন। এক্ষেত্রে কোনো রাজ্য সরকারের সমর্থন তার প্রয়োজন নেই। এখন এটাই আমাদের ভরসা। পশ্চিমবঙ্গ যদি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি অব্যাহত রাখে, তাহলে হয়তো মোদি এ ধারাটি ব্যবহার করেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করবেন। ২০১১ সালে চুক্তির একটি খসড়া তো দুই সরকারের কাছেই আছে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।
Daily Alokito Bangladesh
25.02.2018