রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ১৮ মাসের শাসনামলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন এনেছেন, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নিয়ে তিনি যত বেশি সমালোচিত হয়েছিলেন, গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। শীর্ষ বৈঠকের ফলাফল পুরোটা তাঁর পক্ষে না গেলেও তিনি যে বৈরী একটি দেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে রাজি হয়েছিলেন, এটি ছিল নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনা ম্লান হয়ে গেছে ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্তে, যেখানে তিনি চীনসহ ইউরোপীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করেছেন। এর মধ্য দিয়ে চীন ও ইউরোপের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাহীনতার একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এর আগে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিরোধ চরমে ওঠে। গত ৮ ও ৯ জুন কানাডার লা মালবেয়িতে (কুইবেক) এই জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন (৪৪তম) অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে স্বাক্ষর করেনি। এমনকি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্পর্কেও তিনি বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে শীর্ষ সম্মেলনটি পরিণত হয়েছে জি-৬+১ হিসেবে। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সনাতন মিত্রদের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছে, তা প্রমাণিত হলো। ট্রাম্পের শাসনামলে তাই দুটি বিষয় এখন লক্ষ রাখার মতো। এক. চীন ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’, তা দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাবে? দুই. উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যে ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে কোরীয় উপদ্বীপ আদৌ পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে কি না? এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নয়া অভিবাসননীতি, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা অবৈধ অভিবাসীদের শিশুসন্তানদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পৃথক করে অন্যত্র নিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে তিনি যে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করেছেন, তা বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। আরো এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। চীন এর জবাবে পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এশিয়ার শেয়ারবাজারে এর প্রভাব পড়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেন, চীন অবৈধভাবে মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। ট্রাম্পের মতে, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে এই ঘাটতি কমবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে আগামী ৬ জুলাই থেকে তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার সমমূল্যের ৮১৮টি চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। পরবর্তী সময়ে আরো এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপরও (মোট পাঁচ হাজার কোটি ডলার) অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। এর পরিমাণ ২৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ হাজার কোটি ডলার। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানীকৃত কৃষিপণ্য (সয়াবিন), গাড়ি ও সামুদ্রিক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর কথা বলছে। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ট্রাম্প আরো বলেছেন, বেইজিং যদি মার্কিন পণ্যে শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরো শুল্ক বসাবে। স্পষ্টতই বড় ধরনের বাণিজ্যিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে চীন ও ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। এর ফলে চীনের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। বলা ভালো, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপিত শুল্ক থেকে ইইউ, কানাডা ও মেক্সিকো এত দিন অব্যাহতি পেয়ে আসছিল। জুন মাসের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র ইইউভুক্ত দেশগুলোর ইস্পাত রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ এবং অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে চীনের পাশাপাশি ইইউয়ের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করল। ইইউ এখন মার্কিন পণ্যের (হেভি মোটরসাইকেল, মদ ইত্যাদি) ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ইইউয়ের পক্ষ থেকে ডাব্লিউটিওতে (WTO) অভিযোগ দাখিল করার কথাও বলা হয়েছে। জুন মাসে কানাডায় যে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল। এখন এই বাণিজ্য যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, তাহলে ভারতের মতো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে ভারতের ক্ষতি যথাক্রমে তিন কোটি ১০ লাখ ডলার ও ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে শুধু যে চীন ও ইইউতে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে তা নয়, বরং বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায়ও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এই যে পরিবর্তন—এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব আসরে অনেকটা ‘একাকী’ করে দিয়েছে। শুধু বাণিজ্যসংক্রান্ত নীতিই নয়, বরং পারমাণবিক ইস্যুতে ইরান সমঝোতা প্রত্যাখ্যান, সিরীয় যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১২ জুন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে ট্রাম্প একটি ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হলেও এ বৈঠক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিম জং উনকে ‘স্বপ্ন’ দেখিয়ে এসেছেন যে উত্তর কোরিয়া একটি সম্পদশালী দেশে পরিণত হবে; কিন্তু তা আদৌ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো সফলতা বয়ে আনতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন আছে। কেননা কিম বেশি মাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুর ‘সামিট’-এর পরপরই কিম ছুটে গেছেন চীনে, বৈঠক করেছেন শি চিনপিংয়ের সঙ্গে। এখন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী সংলাপে প্রভাব ফেলবে। চীন তার স্বার্থে উত্তর কোরিয়াকে ব্যবহার করতে পারে। সিঙ্গাপুর ‘সামিট’ নিঃসন্দেহে বড় উদ্যোগ। এতে সফলতা কম। সন্দেহ বেশি। এখন পরবর্তী সময়ের কর্মশালা নিয়ে আলোচনা চলছে। ট্রাম্প একটি ঝুঁকি নিয়েছেন—তিনি ব্যর্থও হতে পারেন। বিখ্যাত ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের সর্বশেষ সংখ্যার (১৬-২২ জুন) কাভার স্টোরি হচ্ছেন Kim Jong Un। অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং বিজয়ী হয়েছেন! টাইমসের ২৫ জুনের কাভার স্টোরিও এই শীর্ষ বৈঠক নিয়ে—The Riskiest Show on Earth. পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ ‘শো’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিম জং উনকে ‘স্বপ্ন’ দেখিয়েছেন একটি সম্পদশালী দেশে পরিণত হওয়ার। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ নেই। ২০০৬ সালের পর থেকে উত্তর কোরিয়ার রপ্তানির ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে। খাদ্য ঘাটতির কারণে ৪১ শতাংশ উত্তর কোরিয়ার নাগরিক অপুষ্টির শিকার। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য—দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় যেখানে ৩৯ হাজার ৪০০ ডলার, সেখানে উত্তর কোরিয়ার মাত্র এক হাজার ৭০০ ডলার। এসব বিষয় যদি বিবেচনায় না নেওয়া হয়, তাহলে উত্তর কোরিয়ায় অসন্তোষ থাকবেই। তাই অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর। যদি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ‘সমঝোতাটি’ ব্যর্থ হয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য হবে একটি দুঃখজনক ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্র গত ১৯ জুন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, জাতিসংঘের এই সংস্থা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। অর্থাৎ সরাসরিভাবে বলা যায়, সংস্থাটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাজ করছে! এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ইসরায়েলের পক্ষেই অবস্থান নিল না, বরং একটি স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে অবস্থান নিল। একসময় যুক্তরাষ্ট্রকে অভিহিত করা হতো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। কিন্তু ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এ ভূমিকা এখন পরিত্যক্ত। সারা বিশ্বের মতামত ও জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করেছেন। তাঁর মিত্ররাও তাঁকে এ ব্যাপারে সমর্থন করেনি। ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হচ্ছে জেরুজালেম। এখন ট্রাম্প এর বিরোধিতা করলেন। এতে একদিকে তাঁর প্রশাসন যে বেশি মাত্রায় ইসরায়েলমুখী তা যেমন প্রমাণিত হলো, ঠিক তেমনি আরব বিশ্বে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও হারালেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এ মুহূর্তে আলোচিত অন্য একটি বিষয় হচ্ছে, ইরান সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার। এতে পারস্য উপমহাসাগরে এক ধরনের পারমাণবিক প্রতিযোগিতার জন্ম হলো। ১২ জুন পর্যন্ত সময় ছিল ট্রাম্পের কাছে। কিন্তু এর আগেই তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। তিনি যে এই কাজ করবেন, সে ব্যাপারে অনেক আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি এই চুক্তি মানেন না। এখানে বলা ভালো, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো একরকম আতঙ্কে ছিল। তাদের সবার ধারণা ছিল, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে। আর ইরান যদি শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলে, তাহলে তা এ অঞ্চলে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। এ লক্ষ্যেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক আলোচনা শুরু করে। দেশগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন। একমাত্র জার্মানি বাদে বাকি দেশগুলোর সবাই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। পরমাণু চুক্তি আলোচনায় জার্মানিকে নেওয়া হয়েছিল এ কারণে যে জার্মানির সঙ্গে তেহরানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কেননা ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে জার্মানি। জার্মান ফার্ম সিমেন্স এ খাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছিল। প্রায় ৫০টির মতো জার্মান ফার্ম ইরানে কাজ করত। এটি বিবেচনা করেই ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি আলোচনায় জার্মানিকে নেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৫ সালে একটি পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করেছিল। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যে ইরানের সম্পদ ‘ফ্রিজ’ করা হয়েছিল, তা ‘ওপেন’ করে দেওয়া হয়। ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও শুরু হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় যাত্রীবাহী বিমানের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ কেনারও সুযোগ পায় ইরান। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য খুলে দিয়েছিল। ইরান চুক্তির বাধ্যবাধকতা মেনে চলছিল। কিন্তু এখন সেই চুক্তি বাতিল হলো একরকম। চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না থাকায় চুক্তিটি এখন বাহ্যত অকার্যকর। কিন্তু ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করে খুব কি লাভবান হলেন? সেখানে এরই মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এবং ইরান ও ইসরায়েল এক ধরনের ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এতে ইসরায়েল লাভবান হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়নি।
জুন (২০১৮) মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে বহির্বিশ্বে আরো বিতর্কিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের প্রবেশাধিকার ঠেকাতে সীমান্তে ছোট ছোট সন্তানকে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পৃথক করে অন্যত্র অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এ রকম ৯৬১টি ক্যাম্পের খবর দিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম। ট্রাম্প গত ৮ এপ্রিল তাঁর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছেন। এর আওতায় শিশুদের পৃথক করা হচ্ছে। মেক্সিকো সীমান্তজুড়ে, ১৭টি রাজ্যজুড়ে শতাধিক শিশু বন্দিশিবিরগুলোতে রয়েছে, যাদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পৃথক করা হয়েছে। তাঁর এ সিদ্ধান্তে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক প্রশাসনিক আদেশবলে শিশুদের পৃথক করা বন্ধ করেছেন। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, (২০ জুন) এরই মধ্যে যে দুই হাজার ৩০০ শিশুকে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পৃথক করা হয়েছে, তারা শিগগিরই তাদের মা-বাবার সঙ্গে মিলিত হতে পারছে না। কেননা এর সঙ্গে একটি আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। শুধু নিজ দেশের অভিবাসীদের বিরুদ্ধেই যে ট্রাম্প কঠোর হয়েছেন তা নয়, বরং অতি সম্প্রতি তিনি জার্মানির অভিবাসননীতিরও সমালোচনা করেছেন। এতে  জার্মানির সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটেছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। দেশটির যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। গত ১৮ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তাঁর আগের প্রেসিডেন্টরা কখনোই নেননি। এসব সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে বিশ্বে উজ্জ্বল করেনি।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Kalerkontho
25.06.2018

এ বাণিজ্য যুদ্ধে কে জয়ী হবে?



এ বাণিজ্য যুদ্ধে কে জয়ী হবে?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে বিশ্ব রাজনীতিতে একের পর এক যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’।
ট্রাম্প চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে যে নির্দেশ জারি করেছেন, তা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্প ওইসব দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার নির্দেশ দিলে ওই দেশগুলোও একই পথ অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে।
ফলে একধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ অব্দি ওই দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায়ও প্রভাব ফেলবে। এবং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশও এ ‘যুদ্ধের’ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত বেশ কয়েক মাস ধরেই এ বাণিজ্য যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছিল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা চলে আসছিল।
কিন্তু কোনো পক্ষই কোনো সমাধানে আসতে পারছিল না। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমে চীনা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের নির্দেশ দেন।
একইভাবে ইইউর ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। চীন ও ইইউ একই কাজ করে। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, তা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। আরও ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চীন এর জবাবে পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এশিয়ার শেয়ারবাজারে এর প্রভাব পড়ে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেন চীন অবৈধভাবে মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
ট্রাম্পের মতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে এ ঘাটতি কমবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে আগামী ৬ জুলাই থেকে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার সমমূল্যের ৮১৮টি চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে।
পরবর্তীকালে আরও ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্যের ওপরও (মোট ৫ হাজার কোটি ডলার) অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। এর হার শতকরা ২৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ হাজার কোটি ডলার।
চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত কৃষি পণ্য (সয়াবিন), গাড়ি ও সামুদ্রিক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানের কথা বলছে। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি।
ট্রাম্প আরও বলেছেন বেইজিং যদি মার্কিন পণ্যে শুল্ক বসানোরা সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আরও শুল্ক বসাবে। স্পষ্টতই বড় ধরনের বাণিজ্যিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে চীন ও ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। এর ফল স্বরূপ চীনের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
বলা ভালো, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপিত শুল্ক থেকে ইইউ, কানাডা ও মেক্সিকো এতদিন অব্যাহতি চেয়ে আসছিল। জুনের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইইউভুক্ত দেশগুলোর ইস্পাত রফতানিতে ২৫ শতাংশ ও অ্যালুমিনিয়াম রফতানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করে।
এর মধ্য দিয়ে চীনের পাশাপাশি ইইউর সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করল। ইইউ এখন মার্কিন পণ্যের (হেভি মোটরসাইকেল, মদ ইত্যাদি) ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। ইইউর পক্ষ থেকে ডব্লিউটিও (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)তে অভিযোগ দাখিল করার কথাও বলা হয়েছে।
জুনে কানাডায় যে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে এ বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল। এখন এই বাণিজ্যযুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, তাহলে ভারতের মতো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপের কারণে ভারতের ক্ষতি যথাক্রমে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে শুধু চীন ও ইইউতে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে তা নয়, বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায়ও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ তাতে কি যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারবে? বিষয়টি অত সহজ নয়। কিন্তু ট্রাম্পের উপদেষ্টারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোঝাচ্ছেন যে, তারা এ ‘যুদ্ধে’ বিজয়ী হতে পারবেন।
পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে পণ্য ক্রয় করে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের। আর চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কেনে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ৩৭০ বিলিয়ন ডলার। এ ঘাটতি বাড়ছেই।
ট্রাম্প অনেকদিন থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন, চীনা পণ্যের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে মানুষ বেকার হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে কি এই বেকার সমস্যার সমাধান কিংবা বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব?
একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখন চীনা ল্যাপটপে সয়লাব। এটি সস্তা ও মানসম্মত। এখন যুক্তরাষ্ট্র শতকরা ২৫ ভাগ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার কথা বলছে। এর ফলে চীনে তৈরি ল্যাপটপের দাম বেড়ে যাবে।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন ভোক্তারা। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কোনো ল্যাপটপ তৈরি করে না। সেখানে সব চীনা পণ্য। এমনকি ল্যাপটপের খুচরা যন্ত্রাংশ আসে চীন থেকে। আইফোনের কথা ভাবুন। যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন যথেষ্ট জনপ্রিয়।
এ আইফোন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৈরি করে চীন। এখন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে আইফোনের দামও বেড়ে যাবে। শুধু ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদির কথা কেন বলি, তৈরি পোশাক, জুতা, খেলনা, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ঘরে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি- সব আসে চীন থেকে।
চীন এক বিশাল মার্কেট গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রে। আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট থেকে নিউ ম্যাক্সিকো স্টেট পর্যন্ত যেখানেই গেছি, সর্বত্রই দেখেছি চীনা পণ্য। ‘ডলার শপ’গুলো মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয়। এসব ‘ডলার শপ’ চীনা পণ্যে ভর্তি।
মধ্য আয়ের মার্কিন নাগরিকদের কাছে চীনা পণ্য জনপ্রিয়। এখন সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহৃত পণ্যে শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হলে এবং তাতে দাম বেড়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষই।
চীন রাশিয়া কিংবা ইরানের মতো নয় যে চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে দেশটি তাতে নতি স্বীকার করবে। চীনা অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনা অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিনের বড় ক্রেতা। একইসঙ্গে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেক গম, শূকরের মাংস, গরুর মাংস, মাছ আমদানি করে (চীন মোট ৬০০টির ওপর পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে থাকে)।
চীনের এ হিসাবটা এ রকম : সয়াবিন ১৩ মিলিয়ন ডলার, গাড়ি ১২ মিলিয়ন ডলার, পেট্রোলিয়াম ৩ মিলিয়ন, কেমিক্যালস ২ মিলিয়ন ডলার, কটন ২ মিলিয়ন, গম, বাদাম, মাছ ইত্যাদি ১ মিলিয়ন ডলার। এখন চীনও এসব পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কথা বলছে।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন না কিনে তা ব্রাজিল থেকে কিনতে পারে। গম ও ভুট্টা কিনতে পারে আর্জেন্টিনা থেকে। মাংসও নিতে পারে সেখান থেকে।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা যদি চীনা বাজার হারিয়ে ফেলেন, তাহলে এ বাজার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকরা কোথায় পাবেন? প্রকারান্তরে তো তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
চীনের পথ ইইউ, কানাডা ও মেক্সিকোও অনুসরণ করতে পারে। তখন? প্রশাসনের ওপর তখন কি কৃষকরা প্রেসার খাটাবেন না? রাজনীতিকরা তখন ট্রাম্পের ওপর প্রেসার খাটাবেন। কংগ্রেসও প্রেসিডেন্টকে ‘চাপ’ দেবে।
চীনকে হালকাভাবে নেয়া ট্রাম্প প্রশাসনের ঠিক হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বড় কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থ রয়েছে চীনে। আমাজন, ওয়ালমার্ট, জিএমের মতো কোম্পানি যেসব পণ্য মার্কিন নাগরিকদের কাছে বিক্রি করে, সেসবের বলতে গেলে পুরোটাই আসে চীন থেকে।
অ্যাপলের পণ্য তৈরি হয় চীনে। অন্যদিকে জিএম গাড়ির কথাই ধরা যাক। এটা মার্কিন গাড়ি প্রতিষ্ঠান। জিএম গাড়ি যেখানে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয় ৩০ লাখ, সেখানে ৪০ লাখ গাড়ি বিক্রি হয় চীনে।
এখন জিএম চীনে তার ব্যবসা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। চিন্তা করুন স্টারবাক্স কফি, কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড, কিংবা শেরাটন, হিল্টনের হোটেল চেইনগুলো চীনে ব্যবসা করছে। এ ব্যবসা এখন বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকবে।
এরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে চীনে। চীন যদি ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তাহলে এ ধরনের ব্যবসায় ক্ষতি হবে। ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ক্ষতি তো ওরা সহজে মেনে নেবে না।
এসব মার্কিন ব্যবসায়িক কর্পোরেট হাউসগুলোর ক্ষতির মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ক্ষতি। Rare Earth Element (REE)-এর কথা অনেকেই জানেন না। ১৭টি দুষ্প্রাপ্ত ধাতু (scandium, lanthanum, cerium, samarium, terbium, lutetium ইত্যাদি) জঊঊ হিসেবে পরিচিত।
এসব ধাতু শুধু চীনেই পাওয়া যায়। হাইব্রিড কার, এমআরই মেশিন, মিসাইল তৈরিতে এসব ধাতু ব্যবহার হয়। মার্কিন অস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরিতে এসব ধাতু ব্যবহার করে।
এখন যদি চীন জঊঊ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাতে সামরিক বাহিনী তথা অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিশ্বের বড় সামরিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারী লবি এটা মেনে নিতে চাইবে না।
বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। বিশ্বে শীর্ষ অস্ত্র উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
অস্ত্র উৎপাদনে তারা চীনা ম্যাটেরিয়ালসের ওপর নির্ভরশীল। বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এ অস্ত্র উৎপাদনকারী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
আরও একটা কথা। ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে ঋণী। ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত এ ঋণের পরিমাণ ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ ঋণের পরিমাণ জাপান থেকে নেয়া ঋণের (১ দশমিক ০৪ ট্রিলিয়ন ডলার) চেয়ে বেশি। এ ঋণ দিন দিন বাড়ছেই।
এই ঋণ যুক্তরাষ্ট্র কমাতে পারছে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে আরও বেশি জড়িয়ে যায়, তাহলে চীনের ঋণ একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে।
আসলে চীনের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা চীন তার মুদ্রার (ইউয়ান) মান কমিয়ে মোকাবেলা করতে পারবে। ২৫ ভাগ হারে যুক্তরাষ্ট্র কর আরোপ করলে ১৫ ভাগ হারে মুদ্রার মান কমিয়ে দেবে চীন।
তাতে প্রতিক্রিয়া হবে কম। চীনের জনগণ অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করতে জানে, যা হয়তো আমেরিকান জনগণের জন্য মোকাবেলা করা কঠিন।
সুতরাং অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, তা চূড়ান্ত বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে না। ক্রিস কানথান নামে একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সব দেশের সঙ্গেই একধরনের ‘বাণিজ্য ঘাটতি’ সৃষ্টি করে।
কেননা বাণিজ্য ঘাটতি না হলে ডলার বিশ্ব মুদ্রায় পরিণত হবে না। আর বিশ্ব মুদ্রায় পরিণত না হলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্বশক্তি হিসেবেও টিকে থাকা সম্ভব হবে না (Nation of Change, June 20, 2018)।
এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। চীন, ইইউ ও কানাডার সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু বিষয়টি যে খুব সুখের হবে, তা মনে হয় না।
Daily Jugantor
30.06.2018

কিউবায় আদৌ কি পরিবর্তন আসবে


আন্তর্জাতিক রাজনীতির ডামাডোলের মধ্য দিয়ে গত ২ জুন কিউবায় একটি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কিউবার পার্লামেন্ট একটি বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়ে সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রোকে সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার প্রধান করা হয়েছে। গত ১৮ এপ্রিল (২০১৮) ক্যাস্ত্রো ৮৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার ছেড়ে দেন তার চেয়ে ২৮ বছরের ছোট মিগেল ডিয়াজ-ক্যানালের হাতে। তখন থেকেই বলা হচ্ছিল যে কিউবা কি তার কট্টরপন্থি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ধরে রাখবে, নাকি অর্থনীতিতে সংস্কার আনবে? অর্থনীতিতে সংস্কার আনতে হলে সংবিধানে কিছুটা পরিবর্তন আনা দরকার। আর সে লক্ষ্যেই কিউবার সংসদ একটি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু রাউল ক্যাস্ত্রোকে কমিশনের প্রধান, আর বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা ও বিপ্লবী জোসে রামোন মাকাদো ভেন্টুরাকে (৮৭ বছর বয়স) কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না, তা-ই নির্দেশ করে। তবে অর্থনীতিতে কিছু কিছু পরিবর্তন হতে পারে বলে পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো আভাস দিচ্ছে। আর্টেমিসা ও মায়াকেবিউ প্রদেশে স্থানীয় সরকার পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে একটি পাইলট প্রজেক্ট আছে। সংবিধান পরিবর্তন এনে এর বৈধতা দেওয়া হবে, রাষ্ট্রীয় শীর্ষপর্যায়ের নেতারা দুই টার্মের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না এবং নেতাদের বয়স নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবেÑ এমন কথা ক্যাস্ত্রো এর আগে সংসদে বলেছিলেন। এখন সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। আর বড় ধরনের পরিবর্তন যদি না আসে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
রাউল ক্যাস্ত্রোর ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া কিংবা মিগেল ডিয়াজ ক্যানেলের ক্ষমতা গ্রহণ নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। কোন পথে এখন হাঁটবে কিউবা? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের কি আদৌ উন্নতি ঘটবে? মিগেল ডিয়াজ ক্যানেল ক্যাস্ত্রো অনুসৃত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন কতটুকুÑ এসব প্রশ্ন এখন বারবার উচ্চারিত হবে। বারবার আলোচিত হতে থাকবে। তবে এটা বলতেই হয়, মিগেল ডিয়াজ ক্যানেল রাউল ক্যাস্ত্রোর খুব ঘনিষ্ঠজন। ব্যক্তি এখানে একটি ফ্যাক্টর। তিনি রাউল ক্যাস্ত্রোর প্রভাবের বাইরে যেতে পারবেন না। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম মিত্র। স্নায়ুযুদ্ধকালীন কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বলা হয়েছিল, কিউবা কি আদৌ অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারবে? কেননা কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এক্ষেত্রে তখন বলা হয়েছিল, কিউবা অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারবে না। কিউবার কমান্ড অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কিউবার অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি সত্য; কিন্তু অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দুটি বড় সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। চীন ও ভিয়েতনাম এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাদের অর্থনীতিতে বাজার অর্থনীতির বেশকিছু মৌলিক ‘এলিমেন্ট’ প্রবেশ করেছে। ব্যক্তিগত খাত, বিদেশি বিনিয়োগ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, শেয়ারবাজার ইত্যাদি এখন এই দুটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা এখন অর্থনৈতিক এই বিবর্তনকে বলছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। তাতে তারা ফলও পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। চীনের অর্থ ও উৎপাদনসামগ্রী এখন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। এক্ষেত্রে কিউবায়ও কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে চীনের মতো অতটা ব্যাপক নয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অনেক দিন ধরেই চাচ্ছে, কিউবা আরও ‘উন্মুক্ত’ হোক। কিন্তু কিউবার নেতৃত্বে এখনও সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেননি। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনও সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের আরও সুযোগ রয়েছেÑ বিশেষ করে ট্যুরিজম খাতে। এই খাত কিছুটা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেইন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে ডলার বাণিজ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান-আমেরিকানরা এখন নিয়মিত কিউবায় ডলার পাঠাচ্ছে। কিউবায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এতদিন ভেনিজুয়েলা থেকে যে স্বল্পমূল্যে জ্বালানি পেত, তা এখন আর আগের মতো আসছে না। কিউবায় তেমন একটা বিনিয়োগও আসছে না। মার্কিন বিনিয়োগ বলতে গেলে বন্ধের কোঠায়। সবচেয়ে বড় কথা, কিউবা-আমেরিকা সম্পর্কে তেমন উন্নতি ঘটছে না। একটি বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। তিনি কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি নিজে হাভানায় গিয়েছিলেন। হাভানায় ফের মার্কিন দূতাবাস খোলা হয়েছিল। তিনি অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি কিউবাকে রাষ্ট্র পরিচালিত সন্ত্রাসবাদের তালিকা থেকে বাদ দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বদলে দিলেন সবকিছু। তিনি দাবি জানালেন কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়নের।
কিউবার বড় সমস্যা তার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইএর অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অব পিগ্স’ নামে পরিচিত। বলাবাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর, ১৯৬২ সালের অক্টোবরে কিউবা সংকট একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, এটা বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ অবরোধ আরোপ করেছিল, যাতে সমুদ্রপথে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র কিউবায় সরবরাহ করা না হয়। ওই সমুদ্র অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন ওই সমুদ্র অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা যুদ্ধ করে আসছিল। এতে কিউবার অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু প্রবল ‘চাপ’ এর মুখে থেকেও কিউবা তার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমনকি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে কিউবা ছিল একটি আদর্শ। পৃথিবীর যেখানেই শোষণ হয়েছে, অত্যাচার হয়েছে, সেখানেই ফিদেল ক্যাস্ত্রো আর কিউবার নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণদের মাঝেও চে গুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ত্রো ছিলেন সমান জনপ্রিয়। শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই দুই ব্যক্তিত্ব বারবার আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
কিউবার বিপ্লবের এত বছর পর সেখানে এই প্রথম শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে এমন একজনের কাছে, যিনি ক্যাস্ত্রো পরিবারের বাইরে। ক্যাস্ত্রো পরিবারের সদস্যরা কিউবায় আছেন। তাদের সন্তানরা কেউ সেনাবাহিনীতে, কেউ পার্টিতে। কিন্তু রাউল ক্যাস্ত্রো এদের কাউকে সামনে নিয়ে আসেননি; নিয়ে এসেছিলেন মিগেল ডিয়াজ কানেলকে। ৮৬ বছর বয়স হয়েছিল রাউল ক্যাস্ত্রোর। তিনি ইচ্ছে করলে আরও কিছুদিন থাকতে পারতেন। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছেÑ রাউল একসময় চিন্তা করেছিলেন, তিনি আরও দু-টার্ম থাকবেন (৫ বছর করে) এবং এরপর মিগেল ডিয়াজ দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন। দু-বছর আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ২০১৮ সালের এপ্রিলের পার্লামেন্ট অধিবেশনেই তিনি পদত্যাগ করবেন এবং করলেনও তা-ই। ফিদেল ক্যাস্ত্রো জীবিত থাকাকালে রাউল ক্যাস্ত্রো তার পাশাপাশি থেকেছেন। ফিদেল তাকেই উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। যদিও এটা ঠিক, কিউবার বিপ্লবে রাউল ক্যাস্ত্রোরও একটি ভূমিকা ছিল। কিন্তু মিগেল ডিয়াজ কানেল বিপ্লবে অংশ নেননি। তার পরও রাউল ক্যাস্ত্রোই তাকে বেছে নিয়েছিলেন। এখন যে প্রশ্নটি পশ্চিমাবিশ্বে উঠেছে, তা হচ্ছেÑ মিগেল ডিয়াজ কানেল কি রাউলের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবেন, কিংবা সংস্কারের ব্যানারে তিনি কতটুকু ‘কমিটেড’ হবেন? রাউল ক্যাস্ত্রো বিদায় নিয়েছেন বটে; কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী ও পার্টিপ্রধান হিসেবে তিনি আছেন ২০২২ সাল পর্যন্ত। এর অর্থ নয়া প্রেসিডেন্ট মিগেল রাউল ক্যাস্ত্রোর প্রভাবের বাইরে যেতে পারবেন না। তিনি যদি আরও বেশি সংস্কারের উদ্যোগ নেন, সে ক্ষেত্রে রাউলের সমর্থনের তার প্রয়োজন হবে। রাউল ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে থেকে যাচ্ছেন। এটাও ঠিক আছে। এই মুহূর্তে তিনি যদি পার্টিপ্রধান হিসেবেও পদত্যাগ করেন, তাহলে পার্টিতে কোন্দল দেখা দিতে পারে। পার্টির জন্য তা কোনো ভালো খরব নয়। প্রকাশ্যে পার্টির ভেতরকার কোনো দ্বন্দ্বের খবর আমরা জানি না। পার্টিতে যারা সিনিয়র, যারা কিউবার বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ বেঁচে আছেন সত্য। এরা সংস্কারের ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন। রাউল ক্যাস্ত্রোর মেয়ের জামাই (যিনি সেনাবাহিনীর জেনারেল) সম্পর্কেও পশ্চিমাবিশ্বে একটা কথা বলা হয়, যিনি উচ্চাকাক্সক্ষী ও ক্ষমতালিপ্সু! যদিও তার অতি আগ্রহের কথা সংবাদপত্রে কখনোই প্রকাশিত হয়নি। এর অর্থ পরিষ্কার, মিগেল ডিয়াজ কানেল দু-টার্মের (১০ বছর) জন্য ক্ষমতায় এলেন। দুটি বিষয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণÑ এক. যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষমতাবদলকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে এবং কিউবার ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির আদৌ পরিবর্তন হবে কি না? দুই. কিউবার আরও বেশি অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে এই মুহূর্তে নিয়ে যাবে কি না? কিউবার ব্যাপারে ওবামা প্রশাসন একটি ‘নরম’ অবস্থানে গিয়েছিল। রিপাবলিকানদের চাপের মুখেও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার। তিনি নিজে কিউবায় গিয়েছিলেন। কিন্তু কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার যে উদ্যোগ, তা তিনি নিতে পারেননি। এখন ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে পুরো উল্টো পথে হাঁটছেন। রাউল ক্যাস্ত্রো সম্পর্কেও তিনি নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। তার দাবি কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন। তিনি চান কিউবা আরও বেশি উন্মুক্ত করে দিক। এটা বোধহয় কিউবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আরও বেশি তথাকথিত গণতন্ত্রায়নের অর্থ হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা কমানো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে সুযোগ করে দেওয়া। কিউবার নয়া নেতৃত্ব এটি করবে বলে মনে হয় না। ফলে কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যে পর্যায়ে রয়েছে, সে রকমই রয়ে যাবে। তবে ধীরে ধীরে সংস্কারের পথে যেতে হবে কিউবাকে। এটা ছাড়া কিউবার কোনো বিকল্প নেই। রিফর্ম ছাড়া কিউবার সঙ্গে পশ্চিমাবিশ্বের সম্পর্ক উন্নত হবে না। কিউবার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। কিউবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা জগদ্বিখ্যাত। দক্ষ জনশক্তি কিউবা গড়ে তুলতে পারে, যা কিউবার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে। পশ্চিম ইউরোপে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। এটি পূরণ করতে পারে কিউবা। এখন সত্যিকার অর্থেই দেখার পালা, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাউল ক্যাস্ত্রো সংবিধানে কতটুকু পরিবর্তন আনেন? হ
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
25.06.2018

শুধুই একটি ফটোসেশন?




গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উনের মধ্যকার শীর্ষ বৈঠক সফল হয়েছে নাকি ব্যর্থ হয়েছে তা নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, এটা সত্য উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের এটা প্রাথমিক অগ্রগতি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে বলেছেন, তিনি আর উত্তর কোরিয়াকে ‘পারমাণবিক হুমকি’ মনে করেন না। ট্রাম্প এক সময় যাকে ‘রকেটম্যান’ আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেননি, শীর্ষ বৈঠকের পর সেই কিম জং উনের তিনি প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘শিগগিরই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ শুরু করবে উত্তর কোরিয়া।’ আর কিম তার প্রত্যুত্তরে বলেছেন, ‘আমরা শান্তির লক্ষ্যে কাজ করব।’ সব মিলিয়ে প্রশ্ন একটাই- উত্তর কোরিয়া কি আদৌ তার পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করবে? সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করবেন? কিংবা উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু আস্থায় নিতে পারবে এখন?
বিষয়টি অত সহজ নয়। প্রকাশ্যে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়া সীমান্তে কোনো যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেবে না। কিন্তু খোদ শীর্ষ মার্কিন কমান্ডারদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে মৃদু আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে।
কেউ কেউ এমন প্রস্তাবও করেছেন যে, মহড়ার স্থান অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যেতে পারে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, উত্তর কোরিয়া তার কাছে রক্ষিত পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করলেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তো পারমাণবিক বোমা রয়ে যাচ্ছে! এই পারমাণবিক বোমা কি উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে না?
এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি ‘বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম’ তত্ত্ব প্রয়োগ করবেন? ‘বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম’ হচ্ছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক ধরনের গ্যারান্টি। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে বিধায় এটি ‘বুদাপেস্ট মেরোরেন্ডাম’ নামে পরিচিত।
এতে ইউক্রেনের এনপিটি (Treaty on the Non-Proliferation of Nuclear Weapons) চুক্তি স্বাক্ষরের বিনিময়ে ৫টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ (রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্স) ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। এ গ্যারান্টির ফলে ইউক্রেন তার কাছে যে পারমাণবিক সমরাস্ত্র ছিল, তা রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিল।
‘বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামে’ ইউক্রেনকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে- ১. ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হবে, ২. ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালিত হবে না, ৩. ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে না, ৪. যদি কোনো পারমাণবিক শক্তি দ্বারা ইউক্রেন ভবিষ্যতে আক্রান্ত হয়, তাহলে নিরাপত্তা পরিষদ (জাতিসংঘ) ইউক্রেনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, ৫. দেশটির বিরুদ্ধে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হবে না।
এখন উত্তর কোরিয়াকেও কি এ ধরনের আশ্বাস দেয়া হবে? যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে চারটি জিনিস সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে : ১. শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ২. কোরীয় পেনিনসুলায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দেশ দুটো একসঙ্গে কাজ করবে, ৩. উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে, ৪. কোরীয় যুদ্ধে নিহত সেনাদের দেহাবশেষ চিহ্নিত করা হবে এবং যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের দেহাবশেষ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করবে।
এর বাইরে নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সামরিক অনুশীলন স্থগিত ঘোষণা করেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিসটফ লিখেছেন, ‘It sure looks as if President Trump was hoodwinked in Singapore’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কলা দেখানো হয়েছে।
এ ধরনের মন্তব্য কী ইঙ্গিত বহন করে? সহজ করে বললে যা বলা যায় তা হচ্ছে, একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব বেশি কিছু আদায় করতে পারেননি। ট্রাম্প বলেছেন বটে উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কবে নাগাদ এ কাজটি উত্তর কোরিয়া সম্পন্ন করবে, তার কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
এমনকি যৌথ ঘোষণাপত্রেও কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এতে করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সন্তুষ্ট হবে বলে মনে হয় না। উত্তর কোরিয়া ইউরেনিয়াম ও প্লুটেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করবে (যা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়), এমন কোনো কথা যৌথ ইশতেহারে নেই।
অথচ ইরানের সঙ্গে যে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল, যা ট্রাম্প সম্প্রতি বাতিল ঘোষণা করেছেন, তাতে শতকরা ৯৮ ভাগ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করতে ইরান দায়বদ্ধ ছিল। উত্তর কোরিয়ার কাছে যেসব আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, সেসবও ধ্বংস করার ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর ফলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না।
পারমাণবিক পর্যবেক্ষকরা আদৌ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন কিনা, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। পরমাণু পরীক্ষা যে বন্ধ হবে, সে ব্যাপারেও কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই।
ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও তার মিত্রদের মাঝে এক ধরনের হতাশা থাকতে পারে। ট্রাম্প নিজে কংগ্রেসে তার সমর্থকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেয়েও ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের সমঝোতায় কেন গেলেন?
যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আমি লক্ষ করছি, সমঝোতার ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলো খুব সন্তুষ্ট নয়। ১২ জুনের শীর্ষ বৈঠকের পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি নিয়ে এখনও লেখালেখি হচ্ছে। কোন পথে যাবে এই সম্পর্ক? আমি ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসরণ করেছি।
ট্রাম্প কিমের প্রশংসা করেছেন একাধিকবার। বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো।’ কিমকে ‘ভালো মানুষ’ বলতেও দ্বিধা করেননি ট্রাম্প। কিন্তু কিমের বক্তব্য লক্ষ করলে দেখা যাবে তিনি কখনোই ট্রাম্পের প্রশংসা করেননি।
ট্রাম্প কিম জং উনকে হোয়াইট হাউসে দাওয়াত দেয়ার কথাও বলেছেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল এবং যা এখনও বর্তমান, তা প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বা প্রতিশ্রুতি কোনোটাই দেননি ট্রাম্প। ফলে উত্তর কোরিয়ার নেতারা কতটুকু আশ্বস্ত হয়েছেন, বলা মুশকিল।
শুধু চীন ও রাশিয়া বলেছে, জাতিসংঘের এখন উচিত উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়া। কিন্তু ট্রাম্পের সমর্থন ও উদ্যোগ ছাড়া এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সফল হবে না।
বস্তুত দু’জনেরই অতীত আছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার। যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতির একটি সমঝোতা হয়েছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ১০ বছরের জন্য স্থগিত রাখার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এ চুক্তিটি করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে ছয় জাতি আলোচনা চলে দীর্ঘদিন। উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এই ছয় জাতি গঠিত। আলোচনা চলে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
২০০৭ সালে একটি সমঝোতায়ও উপনীত হয়েছিল উত্তর কোরিয়া। এর ফলে উত্তর কোরিয়া তার ণড়হমনুড়হ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করার এবং পারমাণবিক পর্যবেক্ষকদের উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শনেরও অনুমতি দিয়েছিল।
বিনিময়ে উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে উত্তর কোরিয়া মহাশূন্যে একটি স্যাটেলাইট পাঠানোর উদ্যোগ নিলে (যা ব্যর্থ হয়েছিল) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এর সমালোচনা করে।
নিরাপত্তা পরিষদের অভিযোগ ছিল- এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে নিন্দা জানালে উত্তর কোরিয়া ২০০৯ সালের এপ্রিলে ছয় জাতি আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
কাজেই এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। ১২ জুন উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র কিছু ‘কমিটমেন্টের’ কথা বলেছে বটে; কিন্তু তা তারা কতটুকু রক্ষা করবে, সেটাই প্রশ্ন এখন। বড় প্রশ্ন হচ্ছে আন্তরিকতার। যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু আন্তরিক হবে, সে প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কারণ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি তার নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তত্ত্বগতভাবে উত্তর কোরিয়া যদি তার সব পারমাণবিক বোমা ও স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়, তা কি তার নিরাপত্তাকে একটি হুমকির মুখে ঠেলে দেবে না?
ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠকের পর বিশ্বে যত পারমাণবিক বোমা রয়েছে, তার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে। তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেখানে ৬ হাজার ৪৫০টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে (২০১৮), সেখানে উত্তর কোরিয়ার আছে মাত্র ১০-২০টি (SIPRI year book, ২০১৮)। উত্তর কোরিয়ার এই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ভারত (১৩০-১৪০টি) ও পাকিস্তানের (১৪০-১৫০টি) চেয়ে অনেক কম।
এর অর্থ হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং দেশ দুটি এ অঞ্চলে যে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে, উত্তর কোরিয়া কোরিয়া উপদ্বীপে সে ধরনের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করছে না! তত্ত্বগতভাবে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আওতায় দেশটি রয়ে যাচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তাহীনতা এখন কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে, সন্দেহ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে ‘বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামে’ অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। এটি একটি ‘মডেল’ হতে পারে। উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রেখে কোনো সমঝোতাই আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য দু’দেশের মধ্যে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এগিয়ে নেয়া জরুরি। কারণ ইতিমধ্যে বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। সনাতন মিত্রদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তাই একটি বড় ধরনের বিজয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দরকার।
উত্তর কোরীয় নেতাকে আস্থায় নিতে ট্রাম্প শীর্ষ বৈঠকের আগে তাকে ফোনে একটি ভিডিও দেখিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো সংবাদপত্র আমাদের আভাস দিচ্ছে। ট্রাম্প ব্যবসায়ী। তিনি কিমকে বুঝিয়েছেন উত্তর কোরিয়া যদি ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যায়, তাহলে এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে দেশটি।
বড় বড় আকাশছোঁয়া হোটেল হবে, সি-বিচগুলো উন্নত হবে, বদলে যাবে দেশটির অর্থনীতি। দুই কোরিয়া একত্রিত হলে উত্তর কোরিয়া প্রকারান্তরে উপকৃত হবে। উত্তর কোরিয়ার ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়ে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়ার ২.০২ (২০১৭) ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি দুই কোরিয়া একত্রিত হওয়ার পর বিশাল এক অর্থনীতিতে পরিণত হবে, যা চীনকে ছাড়িয়ে যাবে।
KTX বুলেট ট্রেন, যা বর্তমানে সিউলের (দক্ষিণ কোরিয়া) সঙ্গে প্যারিসের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছে, তা উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে, এবং তা বদলে দেবে উত্তর কোরিয়াকে। একটা ভিডিও তৈরি করে এনেছিলেন তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতাকে বোঝানোর জন্য। কিম তাতে কতটুকু উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কিংবা ট্রাম্প কতটুকু সফল হয়েছেন, তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
দু’নেতার বৈঠকের পর এখনও হিসাব-নিকাশ চলছে। এখনও পরবর্তী কর্মশালা নিয়ে আলোচনা চলছে। ট্রাম্প একটি ঝুঁকি নিয়েছেন- তিনি ব্যর্থও হতে পারেন। বিখ্যাত ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের সর্বশেষ সংখ্যার (১৬-২২ জুন) কভার স্টোরি হচ্ছে করস Kim Jong won, অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং বিজয়ী হয়েছেন। টাইমসের কভার স্টোরিও এই শীর্ষ বৈঠক নিয়ে- The Riskiest Shwo on Earth। পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শো।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিম জং উনকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ নেই। ২০০৬ সালের পর থেকে উত্তর কোরিয়ার রফতানির শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে। খাদ্য ঘাটতির কারণে শতকরা ৪১ ভাগ উত্তর কোরীয় নাগরিক অপুষ্টির শিকার। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক- দক্ষিণ কোরিয়ায় মাথাপিছু আয় যেখানে ৩৯,৪০০ ডলার, সেখানে উত্তর কোরিয়ায় মাত্র ১,৭০০ ডলার। এসব বিষয় যদি বিবেচনায় না নেয়া হয়, তাহলে উত্তর কোরিয়ায় অসন্তোষ থাকবেই।
তাই অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর। এই শীর্ষ বৈঠকটি একটি ‘ফটোসেশনের’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যদি সত্যিকার অর্থে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
23.06.2018

কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রসঙ্গ



উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির একটি ‘সমঝোতা’ হয়েছে। গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে যে ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তাতে এই ‘সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই নেতা একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন এবং ওই ‘সমঝোতায়’ কিছু প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। ফলে যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছেÑ ওই সমঝোতাকে কেন্দ্র করে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কতটুকু সম্ভব? আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘সমঝোতা’ আর চুক্তি এক নয়। একটি সমঝোতা হয়েছে; কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। ফলে কোনো পক্ষই ওই ‘সমঝোতা’ মেনে চলবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে একটা প্রশ্ন থাকলই। তবে এই ‘সমঝোতা’কে কেন্দ্র করে আগামীতে কোনো চুক্তি হবে কি না, তা নির্ভর করছে দুই পক্ষের আন্তরিকতার ওপর। 
ওই ‘সমঝোতায়’ সুনির্দিষ্টভাবে চারটি ‘কমিটমেন্টের’ কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দুই পক্ষ অঙ্গীকার করেছে, তারা সমঝোতায় উল্লিখিত শর্তগুলো পালন করবে। এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় এবং আইনপ্রণেতারা ওই সমঝোতায় উল্লেখিত অঙ্গীকারগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি খুব কম মার্কিন মিডিয়া দেখেছি, যেখানে ওই সমঝোতার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রশংসা করা হয়েছে। বরং বলা হয়েছে, ট্রাম্প কিম জং উনের কাছ থেকে তেমন কিছু আদায় করতে পারেননি। ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠক নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সময়ের দাবিদার। যেভাবে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ‘বাগ্যুদ্ধ’ তথা পারমাণবিক হামলা ও পাল্টাহামলার হুমকি দিয়ে আসছিল, সে পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের একটি শীর্ষ বৈঠক দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করবে। কিন্তু ওই শীর্ষ বৈঠক রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। ওই প্রশ্নগুলো বারবার আলোচিত হতে থাকবে। 
কিম জং উনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই বৈঠক ১৯৭২ সালে চীনা নেতা মাও সে তুংয়ের সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের মধ্যকার শীর্ষ বৈঠকের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই সময় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছিল চরমে। এমনই এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন উদ্যোগ নিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার। ‘চরম শত্রু’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে মাও সে তুং সেদিন কোনো চিন্তা করেননি। এর পরের ইতিহাস সবাই জানে। ১৯৭২ সালের ওই শীর্ষ বৈঠকের পর চীন-মার্কিন সম্পর্ক বিশ্বরাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। আজ পরিস্থিতি অনেকটা সেরকমই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই বিশ্বরাজনীতিতে একা হয়ে পড়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে ট্রাম্পের বর্তমান ভূমিকা শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে তার বন্ধুদের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়েছে। সর্বশেষ জি-৭ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। জি-৭ সম্মেলনের শেষে গৃহীত ইশতেহারে যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করেনি। ট্রাম্পের একগুঁয়েমির কারণে বাকি ছয়টি দেশ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এমনকি কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো সম্পর্কে ট্রাম্প যেসব কথা বলেছেন, তা কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। ফলে ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে দিন দিনই বিতর্ক বাড়ছে। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এই অবনতির পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে ইউরোপের স্টিলের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত। চীনের স্টিলের ওপরও অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছে। পরিণামে চীনও মার্কিনি পণ্যের ওপর কর আরোপ করেছে। ফলে চীন-মার্কিন সম্পর্কের কিছুটা হলেও অবনতি হয়েছে। এমনকি অভ্যন্তরীণভাবেও তিনি সমস্যায় আছেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রুশ হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তার ভূমিকা কী ছিল, এটা নিয়ে তাকে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হবে। সব মিলিয়ে এ-ই যখন পরিস্থিতি, তখন বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তার এ ধরনের একটি শীর্ষ বৈঠকের প্রয়োজন ছিল। ট্রাম্প সেটা করলেন। মাত্র ছয় মাস আগেও যাকে তিনি ‘রকেটম্যান’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, নিউক্লিয়ার বাটন তার কাছে আছে, তা তিনি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন এ ধরনের কথাবার্তা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল, সেই ট্রাম্পই কী করে হঠাৎ করে বদলে গেলেন এবং কিম জং উনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন, বোঝা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। তার একটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য আছে, এটা বোঝা যায়। কেননা সিঙ্গাপুর বৈঠক শুরু হওয়ার আগে তিনি কিম জং উনকে মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও দেখিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো সংবাদপত্র আমাদের আভাস দিচ্ছে। ট্রাম্প ব্যবসায়ী। ট্রাম্প কিমকে বুঝিয়েছেন উত্তর কোরিয়া যদি ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যায়, তাহলে এই অঞ্চলে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে দেশটি। বড় বড় আকাশছোঁয়া হোটেল হবে, সিবিচগুলো উন্নত হবে, বদলে যাবে দেশটির অর্থনীতি। দুই কোরিয়া একত্রিত হলে উত্তর কোরিয়া প্রকারান্তরে উপকৃত হবে। উত্তর কোরিয়ার ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি (জিডিপি) ডাবল বা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়ার ২.০২ (২০১৭) ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি দুই কোরিয়া একত্রিত হওয়ার পর বিশাল এক অর্থনীতিতে পরিণত হবে, যা চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। KTX  বুলেট ট্রেন, যা বর্তমানে সিউলের (দক্ষিণ কোরিয়া) সঙ্গে প্যারিসের সরাসরি সংযোগ রয়েছে, তা উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে এবং তা বদলে দেবে উত্তর কোরিয়াকে। একটা ভিডিও তৈরি করে এনেছিলেন তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে বোঝানোর জন্য। এখন কিম কতটুকু উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কিংবা ট্রাম্প কতটুকু সফল হয়েছেন, তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। দুই নেতার বৈঠকের পর যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ৪টি জিনিস সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ১. শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া কমিটেড, ২. কোরীয় পেনিনসুলায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দেশ দুটি একসঙ্গে কাজ করবে, ৩. উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে, ৪. কোরীয় যুদ্ধে নিহত সেনাদের দেহাবশেষ চিহ্নিত করা এবং যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের দেহাবশেষ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে দু-দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। এর বাইরে নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সামরিক অনুশীলন স্থগিত ঘোষণা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিসটফ লিখেছেন, ÔIt sure looks as it president Trump was hoodwinked in SingaporeÕ বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কলা দেখানো হয়েছে! এ ধরনের মন্তব্য কী ইঙ্গিত বহন করে? সহজ করলে বললে যা বলা যায়, তা হচ্ছেÑ একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব বেশি কিছু আদায় করতে পারেননি। ট্রাম্প বলেছেন বটে উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ কবে নাগাদ এ কাজটি উত্তর কোরিয়া সম্পন্ন করবে, তার কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এমনকি যৌথ ঘোষণাপত্রেও কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এতে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সন্তুষ্ট হবে বলে মনে হয় না। উত্তর কোরিয়া ইউরোনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করবে (যা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়), এমন কোনো কথা যৌথ ইশতেহার নেই। অথচ ইরানের সঙ্গে যে ছয়-জাতি পারমাণিবক চুক্তি হয়েছিল, যা ট্রাম্প সম্প্রতি বাতিল ঘোষণা করেছেন, তাতে শতকরা ৯৮ ভাগ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করতে ইরান কমিটেড বা দায়বদ্ধ ছিল। উত্তর কোরিয়ার কাছে যেসব আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা ধ্বংস করার ব্যাপারেও উত্তর কোরিয়া কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর ফলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না। পারমাণবিক পর্যবেক্ষকরা আদৌ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। নিউক্লিয়ার টেস্ট যে বন্ধ হবে, সে ব্যাপারেও কোনো সুস্পষ্ট কমিটমেন্ট নেই।
ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ও তার মিত্রদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা থাকতে পারে। ট্রাম্প নিজে কংগ্রেসে তার সমর্থকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। সংগত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠবে, কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেয়েও ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের সমঝোতায় কেন গেলেন? 
যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আমি লক্ষ করছি, মিডিয়া এবং টিভি চ্যানেলগুলো সমঝোতার ব্যাপারে খুব সন্তুষ্ট নয়। ১২ জুনের সাক্ষাৎকারের পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি নিয়ে এখনও লেখালেখি হচ্ছে। কোন পথে যাবে এই সম্পর্ক? আমি ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসরণ করেছি। ট্রাম্প কিমের প্রশংসা করেছেন একাধিকবার। বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো।’ কিমকে ‘ভালো মানুষ’ বলতেও দ্বিধা করেননি ট্রাম্প। কিন্তু কিমের বক্তব্য লক্ষ করলে দেখা যাবে, কিম কখনোই ট্রাম্পের প্রশংসা করেননি। ট্রাম্প কিম জন উনকে হোয়াইট হাউজে দাওয়াত দেওয়ার কথাও বলেছেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ওপর যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল এবং যা এখনও বর্তমান, তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বা প্রতিশ্রুতি কোনোটাই দেননি ট্রাম্প। ফলে উত্তর কোরিয়ার নেতারা কতটুকু আশ্বস্ত হয়েছেন, বলা মুশকিল। শুধু চীন বলেছে, জাতিসংঘের এখন উচিত উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া। কিন্তু ট্রাম্পের সমর্থন ও উদ্যোগ ছাড়া অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্প ও কিম দুজনের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ‘মিল’ আছে। দুজনই অনেকটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের। এক্ষেত্রে কিম একটু বেশি ক্ষ্যাপাটে। দেশের ভেতরে ক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের কাউকে যদি একটু সন্দেহ হয়, কিম তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। নিজের আপন কাকাকে, সৎভাইকে ‘খুন’ করা তার জন্য ছিল স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অন্যদিকে ট্রাম্পও অনেকটা এই মানসিকতার। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনও তিনি মানতে চান না। জি-৭ সম্মেলনে তিনি যেভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে আঘাত করে মন্তব্য করেছেন, অশালীন বাক্য ব্যবহার করেছেন, তা কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে আশা করা যায় না। ফলে একটি ‘ফটোসেশন’ হয়েছে, প্রাপ্তি শূন্য। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভবিষ্যতে আর দক্ষিণ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে কোনো সামরিক মহড়া হবে না। কিন্তু স্পষ্ট করেননি দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়োজিত ৩২ হাজার মার্কিন সেনা তিনি প্রত্যাহার করে নেবেন। এই সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ায় সদ্য মোতায়েনকৃত ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও তিনি প্রত্যাহার করে নেননি। 
ঐতিহাসিক সিঙ্গাপুর সমঝোতার একদিন পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, তিনি আশা করছেন আগামী আড়াই বছরের মধ্যে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করা সম্ভব হবে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এ মুহূর্তে আর উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক হুমকি বলে মনে করেন না। এসব বক্তব্য আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু ভবিষ্যৎই বলে দেবে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কতটুকু সম্ভব হয়েছে। 
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
19.06.2018

ট্রাম্প-কিম ঐতিহাসিক বৈঠক কী পেল বিশ্ব?



প্রিন্টমন্তব্য()

গত সোমবার সিঙ্গাপুরের দক্ষিণের রিসোর্ট দ্বীপ সেন্টোসার ক্যাপিলা হোটেলে ঐতিহাসিক ট্রাম্প-কিম বৈঠকের পর যে প্রশ্নটি এখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা করেছেন, তা হচ্ছে এই বৈঠক থেকে কী পেল বিশ্ব? অনেক প্রশ্ন এরই মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে এবং চটজলদি এর কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল এই ঐতিহাসিক ‘সামিট’-এর দিকে। কয়েক মাস আগেও যা ছিল অসম্ভব, তা সম্ভব করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। কোরীয় যুদ্ধের অবসানের পর বোধ হয় এটাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেখানে উত্তর কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৈঠক করলেন। উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটি আত্মপ্রকাশের পর এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতা একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করলেন। কিন্তু এই বৈঠক আদৌ কি কোনো ফল বয়ে আনবে, নাকি শুধু একটি ‘ফটোসেশনের’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
প্রায় ঘণ্টাখানেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আর কিম জং উন একান্তে কথা বলেছেন শুধু তাঁদের দোভাষীদের নিয়ে। পরে যোগ দেন দুই দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বৈঠকের পর ট্রাম্প বললেন, ‘বৈঠক খুব ভালো হয়েছে। সব সমালোচনা, অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক দারুণ।’ আর কিমের স্বীকারোক্তি ‘আমরা শান্তির লক্ষ্যে কাজ করব।’ তবে দিনটি যে সহজ ছিল না, এ কথাটা জানাতেও কিম ভুল করেননি। মিডিয়ায় খবর হয়েছে কিম বলেছেন, ‘অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে আজ এই আলোচনার টেবিলে বসেছি।’ মূল বিষয় ছিল একটিই—উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বলে যে ‘শিগগিরই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ শুরু করবে উত্তর কোরিয়া।’ প্রশ্নটি সেখানেই—কোরীয় উপদ্বীপ কি সত্যি সত্যি একটি পরমাণু বোমামুক্ত অঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে? ট্রাম্প ও কিম দুজনই সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে ‘একটি বড় সমস্যার সমাধান হলো।’ দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নতির জন্য আগামী দিনে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরের কথাও বললেন দুই নেতা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের মূল টার্গেট ছিল একটিই—উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিপূর্ণ ধ্বংস। কেননা যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এই পারমাণবিক অস্ত্র তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। গেল বছরের শেষের দিকে উত্তর কোরিয়া একের পর এক আন্তর্মহাসাগরীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পর দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের বিবাদে জড়িয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ে দেশটি গুয়ামে (যুক্তরাষ্ট্র) পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি দিয়েছিল। পেন্টাগনের সিনিয়র জেনারেলরা নিশ্চয়ই এটি ভুলে যাননি। সুতরাং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যেকোনো আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের এটিই অগ্রাধিকার ছিল উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করবে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া কি তা করবে? বর্তমান বিশ্বে আটটি দেশ রয়েছে, যারা ঘোষিত পারমাণবিক শক্তি। এর বাইরে ইসরায়েলকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ইসরায়েল উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক দেশ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেনি। ইতিহাস বলে, ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম দেশ; যে দেশটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আর কোনো দেশ তা করেনি। এখন উত্তর কোরিয়া কি তা করবে? যুক্তরাষ্ট্রের একজন পারমাণবিক গবেষক ও ইতিহাসবিদ, যিনি নিউ জার্সির স্ট্রেভেনস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সঙ্গে জড়িত, তিনি বলেছেন উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে এ রকম না-ও ঘটতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই উত্তর কোরিয়ার ও তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয় দেশই শত্রু দেশ দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় ছিল বা রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে মোতায়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও এমনটি ছিল। সত্তর ও আশির দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনামলে দেশটি এমন সব দেশ দ্বারা ‘হুমকির’ মুখে ছিল, যারা দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাকামীদের পেছনে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিউবানদের উপস্থিতি ছিল আফ্রিকায়। ফলে একপর্যায়ে দক্ষিণ কোরিয়া তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। কিন্তু এই কর্মসূচি যে আদৌ প্রয়োজন ছিল না, এ কথা বর্ণবাদী আমলের প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক পরে স্বীকারও করেছিলেন। ফলে একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করে। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে যেটি বড় সমস্যা, তা হচ্ছে তার নিরাপত্তাহীনতা। উত্তর কোরিয়া মনে করে তারা এক ধরনের ‘আগ্রাসনের’ মুখে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন বিশাল মার্কিন বাহিনী উত্তর কোরিয়ার জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করেছে। এখন দুই কোরিয়ার মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এতে বরফ কি গলবে? একটি আস্থার সম্পর্ক কি সৃষ্টি হবে? উত্তর কোরিয়া এরই মধ্যে একটি পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বলেন,  ‘শিগগিরই উত্তর কোরিয়া পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ শুরু করবে’ তখন একটি প্রশ্ন থাকে বৈকি যে উত্তর কোরিয়াকে কী আশ্বাস দেওয়া হয়েছে? মার্কিন কর্মকর্তারা এর আগে স্পষ্ট করেই বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে না। এটি কি উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? যত দিন দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সেনা থাকবে তত দিন উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। সুতরাং প্রশ্নটি সেখানেই, ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে সিঙ্গাপুরে কী নিশ্চয়তা দিলেন? জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও একটি ফ্যাক্টর। এই দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের কথা হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই উত্তর কোরিয়া নিরাপত্তা চাইবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কিভাবে, এটি একটি বড় প্রশ্ন। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সংকট রয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা কয়লা উত্তর কোরিয়ার জ্বালানির অন্যতম উৎস। কিন্তু এখন এতে ভাটা পড়েছে। জাতিসংঘ নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে চীন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য সংকটও রয়েছে। সমঝোতার একটি ভিত্তি হবে উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ করা। নিঃসন্দেহে ট্রাম্প-কিম আলোচনায় এ প্রশ্ন উঠেছে। এটি বলতেই হবে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন অনেক বদলে গেছেন। যিনি কয় মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি কিভাবে হঠাৎ করে বদলে গেলেন? তাঁর ওপর সত্যি করেই কি আস্থা রাখা যায়? কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের পর মার্কিন সংবাদপত্রে আমি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ‘Trump-Kim statement offers scant concrete evidence to backup North Korea’s pledge to complete denuclearization.’ এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব। পরিপূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। ওয়াশিংটন পোস্টের মন্তব্য, ট্রাম্প-কিম বৈঠকের সাফল্য নির্ভর করে আগামী দিনে দুই পক্ষের আলোচনায় কী ফলাফল পাওয়া যাবে তার ওপর। নিউজ উইক মন্তব্য করেছে এভাবে, Art of Deal : Is Kim Jong Un Beating  Trump at His own Game? কিম জং উনের কূটচালে কি হেরে গেলেন ট্রাম্প?  বৈঠকের পর শেনক্রোচার যে প্রবন্ধটি নিউজ উইক ম্যাগাজিনে লেখেন, এতে তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন, The summit is a huge win for Kim Jong Un—কিমের জন্য বড় বিজয়। আসলেই কি এটা কিম জং উনের জন্য বড় বিজয়? বৈঠকের পর যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে চারটি জিনিস সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে : ১. শান্তি ও উন্নতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া কমিটেড; ২. কোরীয় পেনিনসুলায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দেশ দুটি একসঙ্গে কাজ করবে; ৩. উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে; ৪. কোরীয় যুদ্ধে নিহত সেনাদের দেহাবশেষ চিহ্নিত করা এবং যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের দেহাবশেষ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। এর বাইরে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সামরিক অনুশীলন স্থগিত ঘোষণা করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিসটফ লিখেছেন, It sure looks as if President Trump was hoodwinked in Singapore—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কলা দেখানো হয়েছে! এ ধরনের মন্তব্য কী ইঙ্গিত বহন করে? সহজ করে বললে যা বলা যায়, তা হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে বটে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব বেশি কিছু আদায় করতে পারেননি। ট্রাম্প বলেছেন বটে উত্তর কোরিয়া পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে কাজ করবে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কবে নাগাদ এই কাজটি উত্তর কোরিয়া সম্পন্ন করবে তার কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এমনকি যৌথ ঘোষণাপত্রেও কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এতে  দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সন্তুষ্ট হবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়া ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করবে (যা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়), এমন কোনো কথা যৌথ ইশতেহারে নেই। অথচ ইরানের সঙ্গে যে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল, যা ট্রাম্প সম্প্রতি বাতিল ঘোষণা করেছেন, তাতে ৯৮ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল বা ধ্বংস করতে ইরান কমিটেড বা দায়বদ্ধ ছিল। তৃতীয়ত, উত্তর কোরিয়ার কাছে যেসব আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তা ধ্বংস করার ব্যাপারেও উত্তর কোরিয়া কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর ফলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে না। চতুর্থত, পারমাণবিক পর্যবেক্ষকরা আদৌ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। নিউক্লিয়ার টেস্ট যে বন্ধ হবে, সে ব্যাপারেও কোনো সুস্পষ্ট কমিটমেন্ট নেই।
ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ও তার মিত্রদের মাঝে এক ধরনের হতাশা থাকতে পারে। ট্রাম্প নিজে কংগ্রেসে তাঁর সমর্থকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন। সংগত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠবে, কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেয়েও ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের ‘সমঝোতায়’ কেন গেলেন?
আসলে ট্রাম্প বড় ধরনের সংকটে আছেন। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি এখন প্রশ্নের মুখে। ইউরোপের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে চীনের স্টিলের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি বিবাদে জড়িয়ে গেছেন। সদ্য সমাপ্ত জি-৭ সম্মেলনেও যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে গেছে। জি-৭ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ট্রাম্প স্বাক্ষর করেননি। এমনই এক পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক আসরে তাঁর ইমেজ বৃদ্ধি করার। আর এই কাজটিই তিনি করেছেন সিঙ্গাপুরে কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করে। একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে। ভালো ফটোসেশন হয়েছে। নিয়ম রক্ষার্থে যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কোরিয়ান পেনিনসুলায় উত্তেজনা হ্রাস পাবে কি না কিংবা এ এলাকা একটি শান্তির এলাকায় পরিণত হবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলই।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Kalerkontho
14.06.2018

ভারতে গেরুয়া ঝড়ে দমকা হাওয়া!




 ১০ জুন ২০১৮, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতে গেরুয়া ঝড়ের দমকা হাওয়ায় সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি ও বিজেপি মিত্রদের বিজয়ে ভারতজুড়ে ‘গেরুয়া বিপ্লব’ (অর্থাৎ বিজেপির বিজয়) সম্পন্ন হওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, কর্নাটকের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ে তাতে প্রথম ধাক্কা লাগে। মে মাসের শেষদিকে চারটি লোকসভার উপনির্বাচন ও ১১টি বিধানসভার উপনির্বাচন সম্পন্ন হয়। তাতে বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি। এসব উপনির্বাচনে বিজেপিবিরোধী স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। বিজেপির পরাজয় চিন্তায় ফেলে দিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন। বিজেপির জন্য এটা একটা মেসেজ। কর্নাটক বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েও কোনো সরকার গঠন করেনি। বরং অত্যন্ত কম আসন পাওয়া স্থানীয় দলকে (জনতা-সেক্যুলার) সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই নির্বাচনের পর কুমারাস্বামী যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন সেই অনুষ্ঠানে কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী সব দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনাটি তৈরি হয়েছে তা হল, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিবিরোধী সব দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটি জোট গঠন করতে পারে! এবং সত্যিই যদি এমন একটি জোট গঠিত হয়, তাহলে তা বিজেপি জোটের উদ্দেশে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।
গেল মাসে যেসব উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় চারটি লোকসভার উপনির্বাচনে শুধু মহারাষ্ট্রে বিজেপি তার আসনটি ধরে রাখতে পেরেছে। বাকি তিনটির মধ্যে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছে আরএলডি, মহারাষ্ট্রের অপর একটি বিজেপি আসন পেয়েছে এনসিপি, আর নাগাল্যান্ডে আঞ্চলিক দল এনডিপিপি তাদের নিজের আসন ধরে রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি মাত্র একটি আসনে বিজয়ী হয়েছে। উত্তর প্রদেশে এসপি, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস, বিহারে আরজেডি, কেরালায় সিপিএম, ঝাড়খণ্ডের ২টি আসনে জেএমএম, মেঘালয়ে কংগ্রেস, পশ্চিবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও কর্নাটকে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজয়ী হওয়ার পর গত মে পর্যন্ত (২০১৮) ২৭টি লোকসভার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে ২৭১ আসনের বাইরে (২০১৪ সালের রেজাল্ট) একটি আসনও বাড়াতে পারেনি বিজেপি। এতেই বোঝা যায় ২০১৪ সালে যে ‘মোদি ম্যাজিক’ সারা ভারতে কাজ করেছিল, তা এখন আর কাজ করছে না। ২০১৭ সালে উপনির্বাচন হয়েছিল চারটি আসনে। সেখানে পাঞ্জাবে বিজেপির আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৬ সালের পাঁচটি উপনির্বাচনে দলীয় আসনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১৫ সালে মধ্যপ্রদেশের একটি আসন ছিল বিজেপির, তা এখন কংগ্রেসের দখলে। আর ২০১৪ সালের উপনির্বাচনে দলীয় আসনের কোনো পরিবর্তন হয়নি (The Wire, 01 June 2018).
এটা সত্য, ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ প্রভাব ভারতের সর্বত্র রয়ে গেছে। একসময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলোতে বিজেপির কোনো অবস্থান ছিল না। এখন সেখানে প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই বিজেপি তথা বিজেপি সমর্থকরা সরকার গঠন করেছে। ভারতে ২৯টি রাজ্য ও ৭টি ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’। ১৬টি রাজ্যে বিজেপি এখন ক্ষমতায়। এ রাজ্যগুলো হচ্ছে অরুনাচল, আসাম, ছত্তিশগড়, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মনিপুর, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরখণ্ড। তৃণমূল কংগ্রেস আছে পশ্চিমবঙ্গে, তেলেংগানা রাষ্ট্র সমিতি আছে তেলেংগানায়, এআইএডিএমকে আছে তামিলনাড়ুতে, পাঞ্জাবে আছে কংগ্রেস, পণ্ডিচেরিতে কংগ্রেস, উড়িষ্যায় বিজু জনতা দল, নাগাল্যান্ডে এনডিপি, মিজোয়ামে কংগ্রেস, মেঘালয়ে এনপিপি, কেরালায় সিপিআই (এম), কর্নাটকে জনতা দল (এস), দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, বিহারে জনতা দল (ইউনাইটেড), অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগুদেশাম পার্টি। সুতরাং বোঝাই যায় আঞ্চলিক পর্যায়ে বিজেপির অবস্থান ভালো। কংগ্রেস আর আগের অবস্থানে নেই। আঞ্চলিক দলগুলো স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও যথেষ্ট শক্তিশালী। সুতরাং বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে কংগ্রেসের এসব আঞ্চলিক দলের সঙ্গে ‘ঐক্য’ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এখন কংগ্রেস ‘কর্নাটক মডেল’ নিয়ে এগিয়ে যাবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করা অত সহজ হবে না।
১৬তম লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। ওই নির্বাচনে ৫৪৫ আসনবিশিষ্ট লোকসভার আসন সংখ্যা এরকম : বিজেপি ২৭১ আসন, কংগ্রেস ৪৮, এ আইএডিএমকে ৩৭, তৃণমূল কংগ্রেস ৩৪, বিজু জনতা দল ২০, শিবসেনা ১৮, তেলেগুদেশাম ১৬, তেলেংগানা রাষ্ট্রীয় সমিতি ১১, সিপিআই(এম) ৯, ওয়াইএসআর কংগ্রেস ৯, সমাজবাদী দল ৭, লোক জনশক্তি দল ৬, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ৬, আম আমদি ৪, আকালি দল ৪, ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ৩, নির্দলীয় ৩, রাষ্ট্রীয় জনতা দল ৩, লোক সমতা পার্টি ৩, আপনা দল ২, ন্যাশনাল লোক দল ২, মুসলিম লীগ ২, জনতা দল (ইউনাইটেড) ২, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ২, মসজিলস-ই-মুসলেমিন ১, এনআর কংগ্রেস ১, সিপিআই ১, ন্যাশনাল কনফারেন্স ১, কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ১, জনতা দল (এস) ১, কেরালা কংগ্রেস ১, এনপিপি ১, পিএমকে ১, আরএসপি ১, এসডিএফ ১, এসডব্লিউপি ১, লোকতান্ত্রিক দল ১। লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বে রয়েছে ন্যাশনাল ডোমেক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছে ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ)। একসময় এনডিএ জোটে ২৭ দল ছিল, আর ইউপিএ জোটে ছিল ১১ দল। অনেকেই জোট বদল করেছে। যেমন তৃণমূল কংগ্রেস ও এআইএডিএমকে, যারা এনডিএ জোটে ছিল। এখন এরা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সুতরাং এটা বলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয় ২০১৯ সালে কোন দলের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তৃতীয় কোনো জোটও গড়ে ওঠেনি।
বলতে দ্বিধা নেই, নরেন্দ্র মোদির একটা ব্যক্তি ইমেজ আছে। জনপ্রিয়তাও কম নয়। তার ব্যক্তি ইমেজ ২০১৯ সালের নির্বাচনে কাজে দেবে। বিজেপিকে হারানো সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অনেক কিছুই নির্ভর করবে তিনি কী স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন তার ওপর। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি জরিপ চালিয়েছে। গত ২৩ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত প্রভাবশালী মিডিয়া গোষ্ঠী টাইমস গ্রুপের নয়টি গণমাধ্যমে একযোগে অনলাইন জরিপ চালানো হয়। নয় ভাষায় চালনো এ জরিপে অংশ নেয় ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৬ জন। জরিপে মোদির কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন রাখা হয়। তাতে ৪৭ দশমিক ৪৭ ভাগ মানুষ বলেছেন, তার কর্মকাণ্ড খুবই ভালো। ২০ দশমিক ৫৫ ভাগ বলেছেন, খারাপ। ৭৩.৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে অনেক। বামপন্থী একটি পত্রিকায় দাবি করা হয়েছে, সাধারণ মানুষের করের টাকায় ৪ বছরে মোদি সরকারের বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ হয়েছে ৪৩৪৩.২৬ কোটি রুপি। এই বিপুল অর্থে ১০ লাখ শিশুর ৩ বছরের খাদ্যের জোগান হতো (Left Front Daily)। গত মাসে মোদি সরকার তার ৪ বছরের মেয়াদ শেষ করেছে। বাকি আছে এক বছর। বলা হচ্ছে, এই ৪ বছরে সরকার বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলোকে ২.৭২ লাখ কোটি রুপি ঋণ দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য, কৃষকদের জন্য কোনো ভালো কর্মসূচি নিতে পারেনি। পেট্রলের দাম কমানো হয়নি (Truth of India)| বড় নোট বাতিল করা হয় এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে (ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে), যা মোদি সরকার কমাতে পারেনি। উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি মুসলমানদের মধ্যে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, যা সরকার কমাতে পারেনি। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা বারবার ঘটেছে। সরকার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ।
মোদির জনপ্রিয়তা নিয়ে এক বছর আগে পরিচালিত ওই জরিপ সম্পর্কে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। তবে এটা সত্য, গেল বছর কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর রাহুল গান্ধীও কোনো ‘ম্যাজিক’ দেখাতে পারেননি। দায়িত্ব নেয়ার পর অনেক বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু তাতে কংগ্রেস তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কর্নাটকে বেশি আসন পেলেও সরকার গঠন করতে পারেনি। আঞ্চলিক দলগুলো ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ফলে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ দলগুলো একটি বড় ভূমিকা পালন করবে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে মোদি বহির্বিশ্বে তার ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। গত ৪ বছরে তিনি বহুবার বিদেশ সফর করেছেন, অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী এভাবে বিদেশ সফর করেননি। কৈশোরের সাধারণ একজন চা বিক্রেতা নরেন্দ্র মোদি (যা তিনি নিজে স্বীকার করেছেন) ওবামাকে দিল্লিতে সংবর্ধনা দেয়ার সময় ১০ লাখ টাকা দামের স্যুট গায়ে চড়িয়েছিলেন। তার সরকার যখন দিল্লিতে সরকারের ৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান করছিল, তখন মোদি ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর সফরে ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় তার বিখ্যাত ‘মোদি কুর্তার’ পরিবর্তে গায়ে চাপিয়েছিলেন বহু রঙে সজ্জিত ইন্দোনেশিয়ান হাওয়াই শার্ট। এটা নিয়ে জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেনি। মোদি ক্রমেই স্টাইলিশ হয়ে উঠছেন, যা ভারতের সাধারণ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
বিজেপি নেতারা এখন উপনির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত। বিজেপির শীর্ষ নেতা শাহনওয়াজ হুসেনের ভাষায়, ‘গত ৪ বছরে নেতাকর্মীদের একটা অংশের মধ্যে আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে উপনির্বাচনের এ ফলাফল তাই শাপে বর হল।’ মিথ্যা বলেননি শাহনওয়াজ হুসেন। একধরনের আত্মতুষ্টি তো এসে গিয়েছিলই, দুর্নীতিও একটা ফ্যাক্টর। দলীয় সভাপতি অমিত শাহের ছেলের দুর্নীতি এখন মুখে মুখে। এরও কোনো বিচার হয়নি। মোদির একটা বড় ব্যর্থতা তিনি ভারতের বহুত্ববাদী ভাবাদর্শকে সমুন্নত রাখতে পারেননি। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-শিখ- ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানে যে ভারতের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু মুসলমানদেরই নয়, খ্রিস্টানদেরও ‘হুমকির’ মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই দিল্লির আর্চবিশপ অনিল জোসেফ টমাস কুয়োটা যখন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করতে বলেন, তখন আমি অবাক হই না। এমনকি সরকারের পরিবর্তন কামনায় প্রার্থনা ও উপোস করতে অনুরোধ করে তিনি একটি ভক্তিমূলক চিঠি পাঠিয়েছেন তার সহকর্মী পুরহিতদের কাছে। তিনি মনে করেন, ভারত এমন একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের মুখে পড়েছে, যা দেশটির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ (সূত্র : কূলদীপ নায়ারের নিবন্ধ)।
সুতরাং ভারতের আগামী লোকসভা নির্বাচন নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। কর্নাটক নির্বাচনের পর জোট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ভোটের ফলাফল একটা সংকেত। এটা বিজেপির জন্য অশনিসংকতে।’ তার ব্যাখ্যা ‘উত্তর প্রদেশই দেশকে পথ দেখাচ্ছে। মায়াবতী, অখিলেশ, কংগ্রেস এক জোট হয়ে যা করছেন, তাকে আগামী ভোটে ৭০টি আসনের (উত্তর প্রদেশ) ফলাফল উল্টো হয়ে যাবে’ (আনন্দবাজার)। এখন দেখার পালা মমতা ব্যানার্জির এই ভবিষ্যদ্বাণী আদৌ ফলবে কিনা।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
10.06.2018