রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠকে কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ হবে



আগামী ১২ জুন সিঙ্গাপুরে ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই শীর্ষ বৈঠকটি নিয়ে শুধু পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই নয়, বরং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন এদিকে। এই শীর্ষ বৈঠক কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? উত্তর কোরিয়া কি তার পারমাণবিক অস্ত্র পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলবে? কিংবা কোরিয়ান উপত্যকায় কি শান্তি ফিরে আসবে? এসব প্রশ্ন এখন নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে। তবে এই বৈঠক নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। প্রথমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন দ্বিতীয়বারের মতো পানমুনজমে যান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে দেখা করার জন্য। গত ২৭ এপ্রিল প্রথম তারা মিলিত হয়েছিলেন। যখন সিদ্ধান্ত হয় যে কিম জং উন সত্যি সত্যিই সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই এক মাসের ব্যবধানে কিম জং উন দ্বিতীয়বারের মতো মিলিত হলেন মুন জায়ে ইনের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, এরপর কিম যুক্তরাষ্ট্রে পাঠালেন তার বিশ্বস্ত এক জেনারেল কিম ইয়ং চোলকে আলোচনার জন্য। চোল নিউইয়র্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেইর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করলেন। তারপর গেলেন ওয়াশিংটনে। ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে কিমের একটি চিঠিও দিলেন। ট্রাম্প জানালেন না ওই চিঠির বিষয়বস্তু কী ছিল? শুধু বললেন. ‘ভেরি নাইস’, অর্থাৎ একটি ভালো চিঠি তিনি পেয়েছেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের এ কথাটাও জানিয়েছেন, শুধু একটি বৈঠকের মধ্য দিয়ে কোরিয়া সমস্যার সমাধান হবে না, বরং দীর্ঘ মিটিং হবে এবং এতে সময় লাগবে! উত্তর কোরিয়াকে পরিপূর্ণভাবে ‘পরমাণুবোমামুক্ত করা’র কাজটি খুব সহজ নয়। কতটি পারমাণবিক বোমা উত্তর কোরিয়ার কাছে আছে, তা কেউ জানে না। সবাই জানে ট্রাম্প প্রশাসনের উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব আছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মনে করে, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতিও হুমকিস্বরূপ। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র চাইবে উত্তর কেরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিপূর্ণ ধ্বংস। অনেকের মনে থাকার কথা, উত্তর কোরিয়া গেল বছরের শেষের দিকে একের পর এক আন্তঃমহাসাগরীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। একপর্যায়ে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ামে পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি দিয়েছিল। পেন্টাগনের সিরিয়ার জেনারেলরা নিশ্চয়ই এটা ভুলে যাননি। সুতরাং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যে-কোনো আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের এটাই অগ্রাধিকার যে, উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করবে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া কি তা করবে? বর্তমান বিশ্বে আটটি দেশ রয়েছে, যারা ঘোষিত পারমাণবিক শক্তিধর। এর বাইরে ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ইসরাইল উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক দেশ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেনি। ইতিহাস বলে, ১৯৮০ এবং ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম দেশ, যে দেশটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। আর কোনো দেশ তা করেনি। তাহলে উত্তর কোরিয়া কী করবে? যুক্তরাষ্ট্রের একজন পারমাণবিক গবেষক ও ইতিহাসবিদ, যিনি নিউজার্সির স্ট্রেভেনস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সঙ্গে জড়িত, তিনি বলেছেনÑ উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে এ রকম না-ও ঘটতে পারেÑ যদিও অনেক ক্ষেত্রেই উত্তর কোরিয়া ও তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয় দেশই শক্ত দেশ দ্বারা ঘেরাও ছিল বা রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে মোতায়েন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও এমনটি ছিল। সত্তর ও আশির দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনামলে দেশটি এমন সব দেশ দ্বারা ‘হুমকির’ মুখে ছিল, যারা দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাকামীদের পেছনে ছিল সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়ন। কিউবানদের উপস্থিতি ছিল আফ্রিকায়। ফলে এক পর্যায়ে দক্ষিণ কোরিয়া তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে পারমাণবিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। কিন্তু এ কর্মসূচি যে আদৌ প্রয়োজন ছিল না, এ কথা বর্ণবাদী আমলের প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক পরে স্বীকারও করেছিলেন। ফলে একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করে। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে যেটা বড় সমস্যা, তা হচ্ছে তার নিরাপত্তাহীনতা। উত্তর কোরিয়া মনে করে, তারা এক ধরনের আগ্রাসনের মুখে আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন বিশাল মার্কিন বাহিনী উত্তর কোরিয়ার জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করেছে। এখন দুই কোরিয়ার মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু এতে করে বরফ কি গলবে? একটা আস্থার সম্পর্ক কি সৃষ্টি হবে? উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে একটি পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি; কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। এখনই প্রশ্ন উঠেছেÑ দুই কোরিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘ঐক্য’ কী করে সম্ভব? দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘শত্রু’ হিসেবেই এতদিন গ্রহণ করেছে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী। সেই মানসিকতা পরিত্যাগ করা কি সম্ভব? দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের প্রশ্নে যৌথ শিক্ষা কার্যক্রমইবা কীভাবে পরিচালিত হবে? উত্তর কোরিয়ায় কোনো দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল নেই। সেখানে কি দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল গড়তে দেওয়া হবে? এ ধরনের শত শত প্রশ্ন এখন উঠেছে। তবে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রেখেই দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারে। এক ধরনের কনফেডারেশন! এক কোরিয়ার পতাকাতলে তো খেলোয়াড়রা অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন। তেমনই একধরনের রাজনৈতিক সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে কোরিয়ার একত্রীকরণ সম্ভব। তবে ভয়টা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের উদ্দেশ্য নিয়ে। বিখ্যাত Foreing Policy ম্যাগাজিনে উত্তর কোরীয় নেতার সদুদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মিসাইল জে. গ্রিন তার একটি প্রবন্ধে ((Pyongyang is Playing Washington and Seoul, April 27, 2018) এ ধরনের একটি আশঙ্কাই করছেন। তার মতে, উত্তর কোরিয়ার নেতারা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই উদ্যোগকে (উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়া সংলাপ) কাজে লাগাতে পারে। এটা একটা আশঙ্কা। তবে বলাই বাহুল্য, এই সংলাপ যদি সফল হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারীদের জন্য তা হবে দুঃসংবাদ। ইতোমধ্যে তাদের কোম্পানির শেয়ার মার্কেটে দরপতন হয়েছে। যেমন লকহিড মার্টিনের শেয়ারবাজারের পতন হয়েছে শতকরা ২.৫ ভাগ, যার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯২.১ বিলিয়ন ডলার। নর্থবোরা গ্রুমম্যানের শেয়ারের পতন ঘটেছে ৩.২০ ভাগ, যার বাজারমূল্য ৬২.৫ বিলিয়ন; জেনারেল ডাইনামিকস ৩.৮ ভাগ, যার বাজারমূল্য ৬০.৭ বিলিয়ন; রেথিউন ৩.৬ ভাগ, বাজারমূল্য ৫০.৮ বিলিয়ন ডলার এবং বোয়িং শতকরা ১ ভাগ, বাজারমূল্য ২০০.২ বিলিয়ন ডলার। এটা একটা চিন্তার কারণ। তারা কি এই সফলতা দেখতে চাইবে? এতে করে তো অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমে যেতে পারে। অস্ত্র বিক্রি বন্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি। বিশেষ করে THAAD  বা Terminal Altitude Area Defense  ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা উৎপাদন করে লকহিড মার্টিন। অব্যাহত উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার মুখে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় এই THADD ক্ষেপণাস্ত্র বসায়। একেকটি THADD ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমে ছয়টি করে রকেট থাকে, যা মহাশূন্যে যে-কোনো শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দিতে পারে। একেকটি THADD ক্ষেপণাস্ত্রের দাম এক বিলিয়ন ডলার। এখন যদি কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আর THADD ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন হবে না। এটা কি লকহিড মার্টিন চাইবে? তারা ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রভাব খাটাতে চাইবে। তাই দেখা যায়, দুই কোরিয়ার শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারে ট্রাম্প খুব একটা আশাবাদী হননি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৮ হাজার ৫০০ মার্কিন সেন্য রয়েছে। আর উত্তর কোরিয়ার কাছে রয়েছে ৬০টির মতো পারমাণবিক বোমা। শীর্ষ বৈঠকের পর উত্তর কোরিয়ার কিছু কিছু সিদ্ধান্তে দক্ষিণ কোরিয়া আশাবাদী হয়েছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে, উত্তর কোরিয়ার সব পারমাণবিক স্থাপনা বন্ধ ঘোষণা এবং একই সঙ্গে সব পারমাণবিক বোমার ধ্বংস। উত্তর কোরিয়া তার নিরাপত্তা চাইবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কীভাবে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সংকট রয়েছে। চীন থেকে আমদানীকৃত কয়লা উত্তর কোরিয়ার জ্বালানির অন্যতম উৎস। কিন্তু এখন তাতে ভাটা পড়েছে। জাতিসংঘ নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে চীন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য সংকটও রয়েছে। সমঝোতার একটি ভিত্তি হবে উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ করা। নিঃসন্দেহে ট্রাম্প-কিম আলোচনায় এ প্রশ্ন উঠবে। এটা বলতেই হবে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন অনেক বদলে গেছেন। যিনি ক’মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি কীভাবে হঠাৎ করে বদলে গেলেন? তার ওপর সত্যিই কি আস্থা রাখা যায়? কিমের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন মহল থেকে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা খুব আশার কথা বলে না। অনেকেই তাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বলতে দ্বিধা নেই, এটা হতে যাচ্ছে একটি ‘লোকদেখানো’ শীর্ষ বৈঠক। এ বৈঠকে তেমন কিছুই হবে না! যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের মূল টার্গেট উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরিপূর্ণ ধ্বংস, সেখানে উত্তর কোরিয়া তাতে রাজি হবে, আমার তা মনে হয় না। তবে এটা ঠিক, উত্তর কোরিয়ায় নানা অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। কিম জং উন সিঙ্গাপুরে হোটেল বিল পরিশোধ করতে পারবেন না, এমন একটি সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার পাশে আর চীন নেই। ফলে উত্তর কোরিয়া আর আগের অবস্থানে নেই। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি কিছু ‘ছাড়’ দেয়, তাতে শীর্ষ বৈঠকে একটি সমঝোতা হলেও হতে পারে। 
 ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
Alokito Bangladesh
10.06.2018

0 comments:

Post a Comment