রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস, হানটিংটনের তত্ত্ব ও প্রসঙ্গ কথা

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রয়াত অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হানটিংটনের তত্ত্বের (সভ্যতার সংকট) কি আদৌ কোনো মিল আছে? ১৯৯৩ সালে অক্সফোর্ডের সাবেক এই অধ্যাপক একটি প্রবন্ধ লিখে (The clash of civilization : The next Pattern of conflict, Forign Affairs, Summer, vol. 72, I 1993, Page.-22-28) ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। হানটিংটন পরে এটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেন। হানটিংটনের তত্ত্বের মূল কথা ছিল সভ্যতার দ্বন্দ্ব, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থা বিকশিত হবে। তিনি আটটি সভ্যতার কথা বলেছিলেন, যার মধ্যের দুটি নয়া বিশ্বব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেবে। তিনি যেসব সভ্যতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা সভ্যতা (খ্রিষ্টীয় সভ্যতা), কনফুসিয়াস, জাপানিজ, ইসলাম, হিন্দু, স্লাভিক-অর্থোডক্স, লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান সভ্যতা। হানটিংটন মনে করতেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে সিভিল জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে ওপরে উল্লিখিত আটটি সভ্যতার ছত্রছায়ায় একত্র করবে। তবে তিনি অর্থনৈতিক শক্তি জোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তার মতে, অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ করবে, যদি সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় বন্ধনটা অটুট থাকে। হানটিংটন আরও লেখেন,‘Nation states will remain the most powerful actors in world affairs, but the principle conflicts of global politics will occur between nations and groups of different civilizations’.হানটিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা বললেও চূড়ান্ত বিচারে দুটি সভ্যতা তথা ধর্মের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন (খ্রিষ্টীয় সভ্যতা বনাম ইসলাম), যা একুশ শতকে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

হানটিংটন তার তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন আজ থেকে ২৬ বছর আগে। ওই সময় তার তত্ত্ব ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অনেকেই তার তত্ত্বের সমালোচনা করেছিলেন তখন। একাধিক প্রবন্ধ ও গল্পও রচিত হয়েছিল তার তত্ত্বের বিপরীতে। হানটিংটন আজ বেঁচে থাকলে খ্রিষ্টধর্মকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস কিংবা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকে তিনি কীভাবে বিশ্নেষণ করতেন, আমি জানি না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, তার তত্ত্ব উপস্থাপনের পরপরই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ৯/১১-এর মতো ঘটনা (নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা, ২০০১)। আর ৯/১১-এর মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা। কার্যত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' আজ ১৭ বছর পরও চলছে। এরই মাঝে যোগ হয়েছে ট্রাম্পের উত্থান ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও ইসলাম-বিদ্বেষের ধুয়া তুলে ট্রাম্প ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। হানটিংটনের ধারণার (খ্রিষ্টীয় মতবাদ বনাম ইসলাম) সঙ্গে ট্রাম্পের চিন্তাধারার রয়েছে অদ্ভুত মিল। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ব কিংবা ইসলামবিদ্বেষ যে কত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তার সর্বশেষ প্রমাণ আমরা পেলাম জনৈক উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ ব্রেনটন টারেন্ট কর্তৃক ৫০ জন মুসলমানকে মসজিদে ঢুকে হত্যা করায়। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'- এ টার্গেট করা হয়েছে মুসলিম বিশ্বকে তথা ইসলাম ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়কে। কিন্তু উগ্র শ্বেতাঙ্গ ডানপন্থিদের উত্থান ও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে কম।  esri terrorist attacks Ges Peace Tech Lab শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত (২০১৯) আমাদের ৫৪০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর দিয়েছে, যার অনেকটির সঙ্গেই জড়িত রয়েছে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা। তবে এটাও সত্য, তথাকথিত ইসলামের নামে ইসলামিক স্টেট কিংবা নাইজেরিয়ায় বোকো হারামের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম হয়েছে, যারা ইসলামের নামে এখনও মানুষ হত্যা করে চলেছে। মেয়েদের যৌনদাসী বানানোর কাহিনী সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। এদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের আদৌ কোনো মিল নেই।

হানটিংটন তার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য কিংবা শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসকে কতটুকু উসকে দিয়েছেন, এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা বিশ্বকে শুধু অস্থিতিশীল করেনি বরং বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই পরিস্থিতি থেকে বিশ্ব আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাকর্ম এখানে উল্লেখ করতে পারি। এই প্রতিষ্ঠানটি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করে। তাদের প্রতিবেদনের কয়েকটি দিক- ১. 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর ফলে এখন পর্যন্ত চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন (যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি); ২. যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৯৫০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন; ৩. ২১ মিলিয়ন মানুষ (ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া) যুদ্ধের কারণে দেশান্তর হয়েছেন; ৪. যুক্তরাষ্ট্র ৭৬টি দেশে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে; ৫. ইরাক, আফগানিস্তান আর সিরিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আগামী ৪০ বছরে এই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী মানুষকে এই অর্থ বহন করতে হচ্ছে; ৬. যুদ্ধের খরচ মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। সাধারণ মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না; ৭. ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়া অথবা লিবিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। চিন্তা করা যায়- যুক্তিহীন এই যুদ্ধের পেছনে খরচ হয়ে গেছে ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন (১০০০ বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন) ডলার। এই বিপুল অর্থ দিয়ে কত চাকরির ব্যবস্থা করা যেত? স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেত সবার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে (পাঠক David Vine-Gi MÖš’ Base Nation : How U.S. Military Base abroad Harm America and the World পড়ে দেখতে পারেন)।

মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' আর ট্রাম্পের 'শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য' ধারণা একই সূত্রে গাঁথা; যার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় হানটিংটনের 'সভ্যতার সংকট' ধারণায়।

খ্রিষ্টীয় মতবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, ইসলাম ধর্মকে 'সন্ত্রাসী ধর্ম' (?) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে। এসব শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মসজিদে হামলা চালিয়ে সাধারণ মুসল্লিদের হত্যা করেছে। একাধিক সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্মও হয়েছে; যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন টারেন্ট 'ব্ল্যাক সান' বা 'কালো সূর্য' নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ওরা নব্য নাৎসি। এই নব্য নাৎসিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হচ্ছে। এরা নাৎসি মতবাদকে গ্রহণ করেছে, নাৎসি মতবাদকে আদর্শ হিসেবে মানছে। এমনকি তাদের সিম্বলও গ্রহণ করছে। এই নাৎসিবাদী সংগঠনগুলো এখন সভ্যতার প্রতি একধরনের হুমকি। ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া কমব্যাট-১৮ (Combat-18) নামে একটি সংগঠনের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া উগ্র কট্টরপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী এই সংগঠনটির শাখা এখন ইউরোপের ১৮টি দেশে সংগঠিত হয়েছে। এদের মূল আদর্শ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ববাদ, ইসলামবিরোধী ও শক্তিশালী একক নেতৃত্ব। এদের রাজনীতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অভিবাসী প্রসঙ্গটি। ২০১৫-১৬ সালে ইউরোপে ব্যাপক সংখ্যক সিরীয় অভিবাসী আসায় পুরো ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল প্রায় ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে জার্মানিতে আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বে প্রশংসিত হলেও তিনি বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান এই অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে ইউরোপে আগমনকে কেন্দ্র করে কট্টরপন্থি ডানপন্থি দলগুলো সেখানে শক্তিশালী হয়। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালিতে তারা এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে জার্মানিতে উগ্র নব্য নাৎসি সংগঠন 'অলটারনেটিভ ফর জার্মানি' পার্টি তৃতীয় স্থান অধিকার করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এটা ছিল একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। একসময় একেবারেই অপরিচিত এই দলটি এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। তারা যদি পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতার স্বাদ পায়, তাহলে ইউরোপে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। শুধু জার্মানির কথা কেন বলি- ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান, ইতালিতে নর্দান লীগের ক্ষমতার অংশীদার, হাঙ্গেরিতে 'জাম্বিক' কিংবা নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট ((Nordic Registance Movement) পুরো নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক) যেভাবে নব্য নাৎসি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড বিস্তার লাভ করছে, তা যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষের জন্য চিন্তার কারণ। এরা ইউরোপে 'হেইট ক্রাইম'-এর জন্ম দিয়েছে এবং লোন উল্কম্ফ' (Lone Wolf) বা একক সন্ত্রাসী হামলার জন্ম দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। উগ্র এই সংগঠনগুলো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।


ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ড আমাদের দেখিয়ে দিল শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদ কীভাবে সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে এরা বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্থিতিশীল বিশ্বের জন্য এ ধরনের ঘটনা কোনো ভালো খবর নয়
Daily Samakal
27.03.2019

শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস ও বিশ্ব পরিস্থিতি

In New Zealand terrorist act এর ছবির ফলাফলনিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ডে বিশ্বনেতাদের শোক ও নিন্দা প্রকাশ পেলেও ঘটনাটি বেশ কিছু বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে, যা আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতিকে কিছুটা হলেও ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে। এটা একটা নতুন মাত্রা, যা নতুন করে গড়ে ওঠা স্নায়ুযুদ্ধতেও প্রভাব ফেলবে। এটা বর্ণবাদী আচরণের নতুন এক রূপ। বিশ্বব্যাপী নতুন করে এক ধরনের বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন মুল্লুক থেকে আটলান্টিকের ওপারে ইউরোপের দেশগুলোতেও বর্ণবাদী আচরণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। জন্ম হচ্ছে উগ্র দক্ষিণপন্থী সংগঠনের, যারা এক ধরনের ঘৃণার রাজনীতির জন্ম দিয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।
ক্রাইস্টচার্চে ব্রেন্টন টারান্ট যে ৪৯ জন নিরীহ মুসলমান নাগরিককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করল, তাকে নিছক একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড ভাবলে আমরা ভুল করব। এটা বিশ্বব্যাপী ‘হেইট ক্যাম্পেইন’ বা ‘ঘৃণা প্রচারণার’ অংশবিশেষ। এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের ঘৃণা করা এবং ধর্মীয় বিভক্তি সৃষ্টি করে ‘সুবিধা’ আদায় করে নেওয়া। ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ডকে আমরা এখন কিভাবে মূল্যায়ন করব? প্রথমত, নিঃসন্দেহে এর একটি ধর্মীয় দিক আছে। হত্যাকারী ব্রেন্টন টারান্ট একজন উগ্র দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী মানুষ। তিনি প্রচণ্ডভাবে মুসলমানবিদ্বেষী। তিনি চান বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। ট্রাম্প তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস—এ কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। এর আগে পৃথিবীর যেসব জায়গায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে, তিনি সেসব ঘটনা থেকে উৎসাহিত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, তিনি একাই ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছেন। কিন্তু ‘পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করা, বাস্তবায়ন করা—এর সঙ্গে আরো লোকজন জড়িত রয়েছে এবং এটা একটা সুদূর পরিকল্পনার অংশ। তৃতীয়ত, হত্যাকারী ব্রেন্টন টারান্ট লাইভ সম্প্রচার করে দীর্ঘ ১৭ মিনিট ধরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করলেন, আগ্নেয়াস্ত্র বদল করে হত্যাকাণ্ড চালানোর বিষয়টি কারো নজরে পড়ল না কেন? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী তিনি টুইটারে তাঁর তথাকথিত ইশতেহারটি প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের কার্যালয়ে তার একটি কপিও তিনি পাঠিয়েছিলেন। সংবাদপত্র আমাদের সে খবরই দিয়েছে। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সতর্ক হলো না কেন? এটা কি প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতা? গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা, নাকি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে? চতুর্থত, নিউজিল্যান্ডকে বরাবরই একটি ‘শান্তির দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর (যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা, ২০০১) বিশ্বের অনেক দেশেই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেও নিউজিল্যান্ড ছিল ব্যতিক্রম। কিন্তু এই ‘শান্তির দেশ’টিও এখন অশান্ত হয়ে উঠল। এই ‘হেইট ক্রাইম’ এখন শ্বেতাঙ্গশাসিত দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পঞ্চমত, ব্রেন্টন টারান্ট তাঁর তথাকথিত ইশতেহারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন ব্যবসায়ী ও উগ্র মানসিকতাসম্পন্ন লোক ট্রাম্প নির্বাচনের আগে (২০১৬) এক ধরনের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ আর ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে সাধারণ আমেরিকানদের মন জয় করতে পেরেছিলেন। মার্কিন সমাজ মূলত অভিবাসীদের নিয়েই গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থনীতিতে বিশ্বের এক নম্বরে পরিণত হয়েছে, এর পেছনে রয়েছে অভিবাসীদের বড় অবদান। এটা ঠিক, এই অভিবাসীদের (ট্রাম্প নিজেও অভিবাসী পরিবারের সন্তান। তাঁর স্ত্রীও অভিবাসী) একটা বড় অংশ শ্বেতাঙ্গ; কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ, চৈনিক কিংবা এশিয়ান অভিবাসীদের অবদানকে ছোট করে দেখা যাবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি তাঁর ‘হেইট ক্যাম্পেইন’ অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর এক নম্বর টার্গেট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিবাসী, বিশেষ করে মুসলমান অভিবাসীদের বের করে দেওয়া এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের এই ‘স্ট্র্যাটেজি’ ব্রেন্টন টারান্টের মতো হত্যাকারীদের অনুপ্রেরণা জুুগিয়ে থাকবে। ষষ্ঠত, হত্যাকারী ব্রেন্টন ‘ব্লাক সান’ (কালো সূর্য) নামে একটি নব্য নাজি সংগঠনের সদস্য। এই নব্য নাজিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হচ্ছে! এরা নাজি মতাদর্শকে গ্রহণ করছে, নাজিবাদকে আদর্শ হিসেবে মানছে। এমনকি তাদের সিম্বলও গ্রহণ করছে। এই নাজিবাদী সংগঠনগুলো এখন সভ্যতার প্রতি এক ধরনের হুমকি। ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া কমব্যাট ১৮ (combat 18) নামে একটি সংগঠনের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া উগ্র কট্টরপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী এই সংগঠনের শাখা এখন ইউরোপের ১৮টি দেশে সংগঠিত হয়েছে। এদের মূল আদর্শ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ কর্তৃত্ববাদ, ইসলামবিরোধী ও শক্তিশালী একক নেতৃত্ব। এদের রাজনীতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অভিবাসী প্রসঙ্গটি। ২০১৫-১৬ সালে ইউরোপে ব্যাপকভাবে সিরীয় অভিবাসী আসায় পুরো ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে বদলে দেয়। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল প্রায় ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে জার্মানিতে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হলেও, তিনি বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমান এই অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে ইউরোপে আগমনকে কেন্দ্র করে কট্টরপন্থী ডানপন্থী দলগুলো সেখানে শক্তিশালী হয়। শুধু তা-ই নয়, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালিতে তারা এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে জার্মানিতে উগ্র নব্য নাজি সংগঠন অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি পার্টি তৃতীয় স্থান পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এটা ছিল একটা অকল্পনীয় ব্যাপার। একসময় একেবারেই অপরিচিত এই দল এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। তারা যদি পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতার স্বাদ পায়, তাহলে ইউরোপে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। শুধু জার্মানির কথা কেন বলি? ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান, ইতালিতে নর্দান লীগের ক্ষমতার অংশীদার, হাঙ্গেরিতে ‘জব্বিক’ কিংবা ‘নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ পুরো নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে (সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক) যেভাবে নব্য নাজি সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড বিস্তার লাভ করছে, তা যেকোনো শুভবুদ্ধির মানুষের জন্য চিন্তার কারণ। এরা ইউরোপে ‘হেইট ক্রাইম’-এর জন্ম দিয়েছে এবং ‘লোন উলফ’ (Lone wolf) বা একক সন্ত্রাসী হামলার জন্ম দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। উগ্র এই সংগঠনগুলো ইউরোপের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। মুসলমান অভিবাসীদের কারণেই ব্রেক্সিটের জন্ম। আগামী দিনে এসব নব্য নাজিবাদী সংগঠনের জন্য ইউরোপ এক বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে এবং পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বসনিয়া-হারজেগোভিনার পরিস্থিতি মানুষ আজও স্মরণ করে। তখন উগ্র সার্বীয় জাতীয়তাবাদ বসনিয়া-হারজেগোভিনা থেকে মুসলমানদের উত্খাত করেছিল। হাজার হাজার মুসলমান নারী-পুুরুষ ও শিশুকে উগ্র সার্বরা (ধর্মীয়ভাবে অর্থডক্স খ্রিস্টান) হত্যা করেছিল। ১৯৯৫ সালের ১২ জুলাইয়ের স্রেব্রেনিচার (Srebrenica) গণহত্যার খবর নিশ্চয়ই আমরা স্মরণ করতে পারি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সার্ব যুদ্ধবাজ কমান্ডার রাটকো ম্লাদিকের (Ratko Mladic) বিচার হয়েছিল। আজ ব্রেন্টন টারান্টের অপরাধ স্রেব্রেনিচার গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে ৯/১১-এর ঘটনা একটি বড় ধরনের ঘটনা। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মুসলমানবিদ্বেষী যে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ জেনেছে আল-কায়েদা নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে ‘ঘটনা’ ঘটেছিল, তার রেশ এখনো ফুরিয়ে যায়নি। একের পর এক ‘ঘটনা’ ঘটে চলেছে। আফগানিস্তান দখল, ইরাক-লিবিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন, আইএসের উত্থান—এসবই মূলত একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে নেতৃত্বশূন্য করা, সারা বিশ্বে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়া, ইসলামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা—দীর্ঘ ১৭ বছর আগে যে ‘স্ট্র্যাটেজি’ রচিত হয়েছিল, তা আজও রয়ে গেছে। সন্ত্রাসী ব্রেন্টন টারান্ট কর্তৃক ৪৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা এরই সর্বশেষ উদাহরণ। এর মধ্য দিয়ে এই স্ট্র্যাটেজির (অ্যান্টি ইসলাম) যে এখানেই শেষ, তা বলা যাবে না। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে পারে আগামী দিনে। এটা ঠিক, বিশ্বনেতারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন বটে। কিন্তু এই ‘হেইট ক্রাইম’ বন্ধে কোনো বড় ধরনের উদ্যোগ বিশ্বসম্প্রদায় নিতে পারেনি। এমনকি ইসলামিক ঐক্য সংস্থার মতো সংগঠনও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। ইসলামকে যে পশ্চিমা বিশ্ব ‘সন্ত্রাসী ধর্ম’ (?) হিসেবে চিত্রিত করছে, সে ব্যাপারেও ওআইসি উদাসীন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান ‘অ্যান্টি ইসলামিক’ সেন্টিমেন্টকে আরো উসকে দিয়েছে। তাই কোনো কোনো গণমাধ্যম মন্তব্য করেছে এভাবে, ‘New Zealand : Is Trumpism now replacing ISIL as a major cause of Stochastic terrorism? জুয়ান কোলের (Juan Cole) এই নিবন্ধ ছাপা হয়েছে Informed comment-এ গত ১৫ মার্চ। অর্থাৎ জুয়ান কোল বলতে চেয়েছেন, আইএসআইএল বা ইসলামিক স্টেট যে অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত, ট্রাম্পবাদ কি তার স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে? অর্থাৎ ট্রাম্পের মতবাদ যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ‘হেইট ক্রাইম’-এর জন্ম দিয়েছে, এটাই হচ্ছে কোলের মূল্যায়ন। বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রাম্প যদি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ সম্পর্কে তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে আসতেন, বিশ্বে এই ‘হেইট ক্রাইম’ অনেক কমে আসত।
ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা আমাদের জন্য একটি ‘ওয়েক আপ কল’। অর্থাৎ ‘জেগে ওঠার সময়’। বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব আসরে হয়তো আমরা ‘বড়’ ভূমিকা পালন করতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশ জাতিসংঘে সোচ্চার হতে পারে। ওআইসিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মুসলমান। অতীতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান আমাদের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে কিছুটা হলেও ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশ যেকোনো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার—এ কথাই আজ বিশ্বকে বলতে হবে
Daily Kalerkontho
18.03.2019

একজন সুলতান মনসুর ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন গত ৭ মার্চ। তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে যোগ দেন গণফোরামে। অতঃপর গণফোরামের পক্ষ হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। কিন্তু গণফোরাম তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জটিলতা তৈরি হয়। এখন সুলতান মনসুর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সংসদে যোগ দিলেন। সংসদে তার যোগদানের সিদ্ধান্ত এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দেওয়ায় তার সংসদ সদস্য পদ আদৌ বহাল থাকবে কি-না? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই সিদ্ধান্ত দলীয় অপর সদস্য মোকাব্বির খানও অনুসরণ করবেন কি-না? তৃতীয় প্রশ্ন, সুলতান মনসুরের সংসদে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে যাবে কি-না? এই তিনটি প্রশ্নকে ঘিরেই এখন রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে।

নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য দলীয় কার্যক্রম দ্বারা নিয়ত্রিত। অর্থাৎ তিনি যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত মানতে তিনি বাধ্য। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ১. কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে ...।' এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরের একটি দল আছে (গণফোরাম) এবং তিনি ওই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তিনি গণফোরাম থেকে পদত্যাগ করেননি এবং সংসদে এখন পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেননি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত তিনি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বরখেলাপ করেননি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে কোথাও লেখা নেই 'দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে' সংসদে যোগদানের কথাটি। তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন, এটা সত্য (সংসদে যোগ না দেওয়ার প্রশ্নে)। কিন্তু তিনি দল থেকে পদত্যাগও করেননি। এমনকি সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ভোটও দেননি। তিনি বিরোধী দলের আসনে বসেছেন এবং আমার ধারণা, গণফোরাম বা ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে সরকারের সমালোচনাও করবেন। এটা এখন আইনগত একটা ব্যাখ্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল যে, তিনি ৭০ অনুচ্ছেদের কতটুকু বরখেলাপ করেছেন!

তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ডাকসুর ভিপি ছিলেন। এর আগেও সাংসদ ছিলেন। বিষয়টি যে তিনি জানেন না, তা নয়। তিনি জানেন, বোঝেন। আমার ধারণা, তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করেই সংসদে যোগ দিয়েছেন। এমনও হতে পারে, আগামীতে তিনি আলাদাভাবে গণফোরামকে সংগঠিত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে গণফোরামের একটি অংশের প্রতিনিধি হয়ে তিনি তার সংসদ সদস্য পদ বহাল রাখবেন। তবে বিষয়টি যে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেল, তা স্পষ্ট। গণফোরাম তথা ঐক্যফ্রন্ট বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছে। কমিশন এখন একটি সিদ্ধান্ত নেবে। এই সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে। চাই কি, বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়াতে পারে। সুতরাং সুলতান মনসুরের বিষয়টি যে কালকেই সমাধান হয়ে যাবে, তেমন নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটাও সত্য, যে সিদ্ধান্তই আসুক না কেন, ওই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি 'আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না'। ৭০ অনুচ্ছেদে এ কথাটাও লেখা আছে।

সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন, কি পারবেন না- এই বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিই তুলেছেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। এখন দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ 'কেনাবেচার' হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা 'বিক্রি' হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন- ৭০ অনুচ্ছেদে 'দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে' কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্ণ করবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে- রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও তা ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন।

সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তিনি কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী ৫ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষ দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষ দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিস্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয়, আমি অবাক হবো না। সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু নৈতিকভাবে তিনি 'পরাজিত' হয়েছেন। আওয়ামী লীগের 'রাজনৈতিক শত্রু' বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।

সুলতান মনসুরের সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনায় আরও একটা প্রশ্ন সামনে এলো। আর তা হচ্ছে, গণফোরাম থেকে নির্বাচিত অপর সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানও কি সুলতান মনসুরকে অনুসরণ করবেন? সংবিধানের ৬৭(১) অনুযায়ী তিনি সময় পাবেন ৯০ দিন। সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে এই ৯০ দিন শুরু হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে মোকাব্বির খান শপথ না নিলে তিনি তার সংসদ সদস্যপদ হারাবেন। একই কথা প্রযোজ্য বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জন সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রেও। তাদের সবার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হলে নিয়ম অনুযায়ী সেখানে উপনির্বাচন হবে। ঐক্যফ্রন্ট বিগত নির্বাচনে অনিয়মের দাবি তুললেও বড় কোনো আন্দোলনের ডাক দেয়নি কিংবা বড় কোনো জনমতও গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। দশম জাতীয় সংসদের মতো একাদশ জাতীয় সংসদও তার টার্ম শেষ করবে। এ ক্ষেত্রে আগামী ৫ বছর বিএনপি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না, সেটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। দলের নেত্রী এখন জেলে। তাকে আইনগতভাবে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারেনি বিএনপি। শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনেকের নামেই একাধিক মামলা। মামলা থেকে মুক্ত হননি বিএনপির নেতৃবৃন্দ। দল গোছানোর কাজটাও অসম্পূর্ণ। ফলে এক অনিশ্চয়তা নিয়ে বিএনপি হাঁটছে। কর্মীরা রয়েছেন বড় ধরনের বিভ্রান্তিতে। দলের কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা আসছে না। এখন বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে যোগ না দিলেও সংসদ টিকে থাকবে, যেমনটি টিকে ছিল দশম জাতীয় সংসদ। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই এলো সুলতান মনসুরের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তটি। এতে করে সংসদ কতটুকু কার্যকর হবে, সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কতটুকু স্বীকৃত হবে- তা এক প্রশ্ন বটে। সংসদে একটি বিরোধী দল আছে। তাদের ব্যাপারে মানুষের এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সরকারি ছত্রছায়ায় জাতীয় পার্টির রাজনীতি দলটিকে সত্যিকার অর্থে একটি বিরোধী দলে পরিণত করতে পারেনি। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একজন সুলতান মনসুর বিরোধী দলের আসনে বসলেও একটি 'বিতর্কের' মধ্য দিয়েই তিনি সংসদে যোগ দিলেন। তিনি চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে মনে হয় না।
Daily Samakal
16.03.2019

নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর আমরা কতটুকু আস্থা রাখতে পারছি



৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১০ মার্চ ৭৮ উপজেলার ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মনসুর দলীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা সংসদে যাবে না। এখন সুলতান মনসুর গেলেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ছে। অথচ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য নির্বাচন হলো একটি অন্যতম ধাপ। কিন্তু সেই নির্বাচন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষের আগ্রহ যদি না থাকে, তাহলে তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না।
১০ মার্চ ৭৮ উপজেলায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। কেমন হলো এ উপজেলা নির্বাচন? সংবাদপত্রের ভাষ্য থেকেই বোঝা যায়, এ নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের পর এ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়নি। সংবাদপত্রের ভাষায়Ñ ‘পর্যাপ্ত আয়োজন, ছিল না তেমন ভোটার’ (প্রথম আলো)। জাতীয় সংসদের মতো উপজেলা নির্বাচনও ছিল সরকারি দলের জয়জয়কার। ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ৪১টিতে, বিদ্রোহীরা ১৯টিতে, বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা তিনটিতে বিজয়ী হয়েছেন (যুগান্তর)। কিন্তু এ নির্বাচন কি সুষ্ঠু হয়েছে? সংবাদপত্রের ভাষা অবশ্য সে কথা বলে না! কোথাও কোথাও অতিরিক্ত ভোটও পড়েছে (শাহজাদপুর)। রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে (সিরাজগঞ্জ)। প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে গ্রেপ্তার করে জেল দেওয়া হয়েছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে (কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ)। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার খবরও আছে। এর অর্থ এ নির্বাচনটিও ভালো হয়নি। নির্বাচনের অপর নাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একজন অপরজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, শঙ্কামুক্তভাবে নির্বাচন হবে; কিন্তু তা হয়নি। এই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। সরকারি দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেশি থাকলেও নির্বাচনে রাতের বেলা সিল মারা, ব্যালট ছিনতাই, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো আশার কথা বলে না। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার নেই, কোথাও ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ঘুমিয়ে নিচ্ছেন, কোথাওবা ভোটকেন্দ্রের বাইরে রোদ পোহাচ্ছেনÑ এসবই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, সব কেন্দ্রে হয়তো এমনটি ঘটেনি। কিন্তু ‘উৎসাহ-উদ্দীপনার’ মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়, উপজেলা নির্বাচনে তেমনটি ছিল নাÑ এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। মানুষ ভোটের ওপর থেকে কি আস্থা হারিয়ে ফেলছে? এসব প্রশ্ন এখন উচ্চারিত হচ্ছে।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচন মানেই একটা জমজমাট আসর। প্রচুর লোকজন ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থাকে। ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় উভয় পক্ষ থেকে। কিন্তু এবার তেমনটি ছিল না। বিএনপির ‘তেমন অংশগ্রহণ’ না থাকায় নির্বাচনটি জমে ওঠেনি। বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনটি ভালো হয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে এর একটা প্রভাব যে উপজেলায় থাকবেÑ এটা সবাই অনুমান করেছিলেন। বাস্তব ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ভোট হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। আবার এরই মাঝে যখন ‘রাতের বেলায় সিল মারার ঘটনা’ ঘটে কিংবা ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়, এ ঘটনাকে আমরা যতই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলি না কেন, বাস্তব ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনি সংস্কৃতির জন্য এটা খারাপ খবর। নির্বাচনি রাজনীতির জন্য আরেকটি খারাপ খবর হচ্ছে সুলতান মনসুরের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জোগদান। সুলতান মনসুর গণফোরামের সদস্য ও ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু গণফোরাম সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সংসদে যাবে না। কিন্তু সুলতান মনসুর গেলেন। এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার এ সিদ্ধান্ত আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। যদিও ৭০ অনুচ্ছেদ অতীতেও কার্যকর হতে দেখা যায়নি। তবে সুলতান মনসুরের সংসদে জোগদান বিতর্ক বাড়িয়েছে মাত্র।
সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিতে পারবেন কী পারবেন না, এ বিতর্কের আরও একটি দিক আছে। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এলাকার জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এখন কি তিনি তার এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নটিই তুলেছেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। এখন দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই প্রতিনিধিত্বে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদের এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এ অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ ‘কেনা-বেচার’ হাটে পরিণত হবে! টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা ‘বিক্রি’ হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা সংসদ সদস্যদের ‘ক্রয়’ করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদে ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দেবে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এ ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছেÑ রাজনীতির সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এ আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুর সংসদে যোগ দিলেন।
সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তিনি কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী ৫ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তার সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি, সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয় আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেনÑ এটা সত্য। কিন্তু নৈতিকভাবে তিনি ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা হবে দুঃখজনক ঘটনা। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষ যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবারও দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনটি দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু এ নির্বাচনটিও যে ‘ভালো’ হয়েছে, তা বলা যাবে না। এখন আমাদের রাজনীতিবিদদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কীভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনবেন। আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে এবং তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবে। এর যদি ব্যত্যয় ঘটে, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Alokito Bangladesh
13.03.2019

ডাকসু কতটুকু কার্যকর হবে

দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত সোমবার যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তা কিছু প্রশ্ন রেখে গেলেও, যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই ডাকসু কতটুকু কার্যকর হবে? ডাকসুর ভিপি পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নুরুর বিজয় ও ছাত্রলীগ কর্তৃক এই ফলাফল না মানা ও নুরুকে বহিষ্কারের দাবি করা ডাকসুর ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডকে এখনই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যদিও ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদসহ ২৫টি পদের একটি বাদে বাকি সব পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৮টি হলের ১২টিতেই ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ছয়টি হলে ভিপি হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় আর অনলাইন সংবাদপত্রগুলোতে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের শুধু হতাশার মধ্যেই ফেলে দেয়নি, বরং নির্বাচনব্যবস্থার ওপরও রেখে গেছে একটি ‘কালো দাগ’। নির্বাচনব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা বোধ হয় আর থাকল না।



Image result for DUCSU incident Dhaka University

ডাকসু নির্বাচনটি ভালো হবে—এ রকম একটা প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু অভিযোগ উঠল ভোট কারচুপির। কুয়েত মৈত্রী হলে পাওয়া গেল সিল মারা বিপুল ব্যালট। এই অভিযোগে হলের প্রভোস্টকে বহিষ্কার করা হলো। নিয়োগ দেওয়া হলো নতুন একজন প্রভোস্টকে। রোকেয়া হলে ব্যালট বাক্স নিয়ে লুকোচুরির খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো, ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকল কিছুক্ষণ। ছাত্রলীগ বাদে যারা ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে—স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট, ছাত্রদল, কিংবা ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, সবাই ডাকসু নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের ডাক দিয়েছে। সোমবার সারা দিন বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আর ছাত্র ধর্মঘটের ডাকও এসেছে বিক্ষোভকারী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। মিডিয়ায় উপ-উপাচার্যের বক্তব্য এসেছে এ রকম—‘আমরা এ দায় এড়াতে পারি না।’ আর চিফ রিটার্নিং অফিসারের বিব্রত হওয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। যদিও কোনো অভিযোগই স্বীকার করলেন না ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। জানালেন, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আচরণে তিনি বিস্মিত। ছাত্ররা গণতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে, তাতেই তিনি খুশি। আর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ছাত্রলীগবিরোধী নীতি নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।’ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী গোলাম রব্বানী বলেছেন, কুয়েত মৈত্রী হলে উদ্ধার হওয়া ব্যালট ভুয়া। রব্বানীর বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা আমরা তা জানি না। এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি নিশ্চয়ই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবে। তবে গণমাধ্যমের কর্মীরা জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ব্যালটগুলো (কুয়েত মৈত্রী হল থেকে) আসল এবং সেখানে চিফ রিটার্নিং অফিসারের স্বাক্ষর ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচনেও আমরা দোষারোপের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করলাম। কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালট ভর্তি বাক্স পাওয়া গেছে। রোকেয়া হলে তিনটি ব্যালট বাক্স দেখানোর কথা ছিল, তা দেখানো হয়নি। এ সবই বাস্তবতা। এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। উদ্ধার হওয়া ব্যালটের কারণেই প্রভোস্ট অপসারিত হলেন! আমি মনে করি শুধু তাঁকে অপসারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁকে আরো কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেননি।
আমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছিল পুরো জাতিকে দেখানো যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করবে ভোট সংস্কৃতিতে জালিয়াতির সুযোগ এখানে অন্তত নেই। কিন্তু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কলঙ্কিত হলো। এটা সত্য শুধু কুয়েত মৈত্রী হল কিংবা রোকেয়া হলকে কেন্দ্র করে অভিযোগগুলোই বেশি। কিন্তু অন্য হলগুলোর ক্ষেত্রে অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম। তার পরও এটা হওয়া উচিত ছিল না। ছাত্রলীগ নেতাদের উচিত ছিল বিরোধী প্রার্থীদের দোষী না করে প্রতিটি অভিযোগের তদন্ত দাবি করা। নির্বাচন হলেই ভোট কারচুপি হবে, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অভিযুক্ত করবে—রাজনীতির এই যে সনাতন চিত্র, এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। যাঁরাই অতি উৎসাহী হয়ে এই কাজগুলো করেছেন তাঁরা পরোক্ষভাবে সরকারেরও ক্ষতি করলেন। উপ-উপাচার্য স্বীকার করেছেন তাঁরা এই দায়ভার এড়াতে পারেন না। উপ-উপাচার্য সামাদ সাহেব কবি মানুষ। কিন্তু তাঁর স্বীকারোক্তিতে পরিবেশ কি বদলানো যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে! ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা যেত, তাতে তো ক্ষতির কিছু ছিল না। যুক্তি হিসেবে ধরে নিই যদি বিরোধী ছাত্রসংগঠন ডাকসু নির্বাচনে সব আসনে বিজয়ীও হতো (?), গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা হতো আমাদের জন্য বড় পাওয়া। অতি উৎসাহীরা সরকারকেও যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিতে পারে, ডাকসু নির্বাচন এর বড় প্রমাণ।
ডাকসু নির্বাচনের কিছু প্লাস পয়েন্ট, কিছু মাইনাস পয়েন্ট রয়েছে। নির্বাচনে কোনো সহিংসতা হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল, শঙ্কা ছিল সহিংসতা হতে পারে। ভালো খবর, তেমন কিছুই হয়নি। ভালো হোক, মন্দ হোক ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছে। সরকারি ছাত্রসংগঠনের প্রভাব বেশি থাকায় তারা নির্বাচনে ভালো করেছে—এটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হলগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বিজয়ী হয়েছেন—এই বিষয়টিকেও হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একসময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রনেতা পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ যাঁরা ডাকসুতে বিজয়ী হলেন, প্রত্যাশা থাকল তাঁরাই জাতীয় রাজনীতিতে আসবেন এবং রাজনীতির গুণগত মানে পরিবর্তন আনবেন। নির্বাচিত ভিপির কাছ থেকেও প্রত্যাশা বাড়ল অনেক। কিন্তু মাইনাস পয়েন্ট অনেক। এক. যে শঙ্কা ও আশঙ্কা নির্বাচনের আগে সংবাদপত্রগুলো করেছিল (কালের কণ্ঠ : শঙ্কা থেকে উত্তেজনা), তা অনেকটাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। দুই. কুয়েত মৈত্রী হল ও রোকেয়া হলে ভোটের অনিয়ম বন্ধে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতা পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যে অভিযোগটি উঠেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনকে বিজয়ী করার জন্যই এই নির্বাচনের আয়োজন করেছে’—এই অভিযোগটি এখন আরো শক্তিশালী হবে। তিন. এই নির্বাচন ডাকসুর মর্যাদাকে আরো ক্ষুণ্ন করল। চার. সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠন এখন প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন আয়োজন করতে চাইবে। ডাকসুতে ও হলগুলোতে তাদের বিজয় সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতাদের আরো উৎসাহ জোগাবে দ্রুত বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচন আয়োজন করতে। তবে ডাকসুর অভিজ্ঞতার কারণে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হবে না। পাঁচ. ডাকসু নির্বাচনে বিএনপিপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের ভরাডুবি চোখে লাগার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব ছিল। ছাত্রদল সমর্থকরা ছিল নিষ্ক্রিয়। তারা কোনো দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়ে হলের ‘সিট’ হারানোর ঝুঁকিতে ছিল। ছাত্রদলের অবর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনো কোনো হলে ভিপি পদে পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাই তাঁদের বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে। তাঁরাই এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অন্যতম শক্তিরূপে আবির্ভূত হবেন।
ডাকসু নির্বাচনে কিছু অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজে ‘বিব্রত’ হয়েছেন মন্তব্য করে দায় এড়াতে চাইছেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মন্তব্য করেছে—‘এভাবে ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি’। সরকারি দলের কাছ থেকে আসবে উল্টো বক্তব্য। তবে একটা জিনিস আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে, এত কিছুর পরও কোটা আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নুরু ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছাত্রলীগের প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান অনেক। তাঁর বিজয়ে অনেক ইতিবাচক দিকও আছে। শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে পরিত্যাগ করেছে। ছাত্রনেতারা শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবেন—সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। নুরুল হক কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় একাধিকবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। এমনকি ডাকসু নির্বাচনের সময়ও তিনি রোকেয়া হলে ছাত্রলীগের নারী কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একপর্যায়ে তাঁরা ভোট বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে রোকেয়া হলের প্রভোস্টকে লাঞ্ছনা করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের কর্মীরা ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নুরুর বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করায় একটা আশঙ্কার জন্ম হয়েছে যে নির্বাচিত ভিপি নুরুল হককে আদৌ কাজ করতে দেওয়া হবে না। এটা হওয়া উচিত নয়। তাঁকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। ছাত্রলীগের নেতাদের উচিত বিষয়টি ভাবা, কেন তাঁরা ভিপি পদে হারলেন। এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির তুলনা করাও ঠিক হবে না। তবে জাতীয় নেতারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যত কম মন্তব্য করবেন, ততই মঙ্গল। উভয় পক্ষেরই জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া ভালো। ছাত্রলীগ যদি ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার অব্যাহত রাখে, তাহলে ডাকসু নির্বাচন অর্থহীন হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা যাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে, তাঁদের সবার সম্মান জানানো উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নিশ্চয়ই ডাকসু নির্বাচন থেকে কিছু শিখেছে। দীর্ঘদিন পর তারা এই নির্বাচনের আয়োজন করল। তারা নিশ্চয়ই তাদের এই অভিজ্ঞতাকে আগামী দিনে কাজে লাগাবে। দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচন হয়েছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করে যাবেন—এই প্রত্যাশা সবার।
Daily Kalerkontho
13.03.2019

পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা ও সার্কের ভবিষ্যৎ

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর প্রতিটি হামলার পেছনে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা সার্কের বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবিশ্বাসের কারণে সার্ক একরকম
মুখ থুবড়ে পড়েছে
সম্প্রতি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার পর ভারত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। বালাকোট পাকিস্তানের প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত। পাকিস্তানের ভেতরে ভারতীয় বিমান হামলার ঘটনা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অতীতে আর কখনও ঘটেনি। ১৯৯৯ সালে কারগিল সংঘর্ষের আগে ভারত ও পাকিস্তান তিন-তিনবার সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল (১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭১)। এখন বালাকোটে বিমান হামলার পর নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বালাকোটে বিমান হামলার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি ভারতীয় সামরিক ছাউনির ওপর মর্টার হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান দুটি ভারতীয় বিমান ভূপাতি করেছে বলেও দাবি করেছে এবং বিধ্বস্ত বিমানের দুজন পাইলটকে তারা গ্রেপ্তার করেছে বলেও দাবি করেছে। ওই ঘটনা এ অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। ভারতে আগামী এপ্রিল-মে মাসে লোকসভার নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারত আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। তবে ভারতে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো যুদ্ধের ডাক দিয়েছে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৪ ভারতীয় সেনাসদস্য মারা গেছেন। সুতরাং বিষয়টি ভারতে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর প্রতিটি হামলার পেছনে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা সার্কের বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবিশ্বাসের কারণে সার্ক একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। অভিযোগ আছে, ভারত এখন সার্কের বদলে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বিবিআইএন ও বিমসটেককে গুরুত্ব দিচ্ছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে না পারলেও ভারতে বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছর সার্ক সম্মেলন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। এখন দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা সার্ক সম্মেলনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। বলা ভালো, বাংলাদেশের উদ্যোগে সার্ক গঠিত হয়েছিল। গেল বছরের ডিসেম্বরে সার্ক ৩৩ বছর পার করেছে। ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা সার্কের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে এরই মাঝে। ৯ ডিসেম্বর (২০১৮) ইসলামাবাদে সার্কের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংগঠনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক থেকে ভারত বেরিয়ে যাওয়ায় আগামীতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা যাবে কি না, তাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সম্মেলনে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একজন মন্ত্রী উপস্থিত থাকায় ওই সম্মেলনে উপস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শুভম সিংহ অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান। ভারত কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। ফলে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের (যা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ) ‘একজন মন্ত্রী’ উপস্থিত থাকায় ভারত ওই সম্মেলন বয়কট করে। এর আগে ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে একটি সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলায় (২০১৬) পাকিস্তানি জঙ্গিরা জড়িত রয়েছেÑ এ অভিযোগ তুলে ভারত ইসলামাবাদ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিল। শুধু ভারত কেন, ভুটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানও সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিল। ফলে আর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ৯ ডিসেম্বর (১০১৮) সার্কের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংগঠনের শীর্ষ সম্মেলন যখন ভারত বয়কট করল, তখন আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ওপর তা এক ‘কালো ছায়া’ রেখে গেল।
উরির সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। গেল বছর (২০১৮) জাতিসংঘে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পাকিস্তান বিতর্কিত হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির ছবি দিয়ে ডাকটটিকিট প্রকাশ করলে তা দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটায়। ২০১৬ সালে ভারতীয় সেনা অভিযানে বুরহান নিহত হয়েছিলেন। ইমরান খান পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমনকি ইমরান খান কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব করলে, ভারত তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। পাকিস্তান সার্কের আয়োজক। পাকিস্তানকেই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের আয়োজনে কোনো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারত যোগ দেবে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো মহল থেকে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানের পরিবর্তে অন্য কোনো সার্কভুক্ত দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও পাকিস্তানের সম্মতি এতে পাওয়া যায়নি। ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একটি জিনিস লক্ষ করা যায়, আর তা হচ্ছে সার্কের ব্যাপারে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত এখন সম্পর্কে গুরুত্ব না দিয়ে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো), ভুটান ও নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন নামে একটি উপআঞ্চলিক সংস্থা গঠন করা হয়। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলোর উন্নয়ন। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্ব পেয়েছে কম। ওই উপআঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রেন যোগাযোগেরও উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এ সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এরই মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর যাতে ভারত ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে যে শুল্ক দেওয়ার কথা, তাতে রয়েছে ভারতের আপত্তি। ভারত তা দিচ্ছে না। ফলে একটা প্রশ্ন থাকবেইÑ এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বার্থ কী? এখানে ভারতের স্বার্থ বেশি। ভারত চায় না এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি কর্তৃত্ব করুক। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের ভুবনেশ্বরে ইন্ডিয়ান ওসেন রিম বা আইওআরের একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি তখন সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছেন। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে, এ অঞ্চলের ‘দেখভাল’-এর দায়িত্ব ভারতের। ভারত চায় না অন্যকোনো দেশ এ অঞ্চলের ব্যাপারে কোনো ‘উৎসাহ’ দেখাক। স্পষ্টই ইঙ্গিতটি ছিল চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। ভারত তাই ‘বিবিআইএন’ উপআঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, একই সঙ্গে বিমসটেক বা ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’কে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ভারত এখন সার্কের বিকল্প হিসেবে বিমসটেককে প্রমোট করছে। ফলে সার্ক ধীরে ধীরে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, ৩৩ বছরে সার্কের উন্নয়ন যতটুকু হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। সার্ক আশিয়ান মডেলে গড়ে উঠতে পারেনি। এর জন্য অবিশ্য ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব প্রধানত দায়ী। পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের সমর্থন ও সহযোগিতা করছে, এমন অভিযোগ ভারতসহ আরও কয়েকটি সার্কভুক্ত দেশের। ফলে সার্কের বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সার্ক এখন একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হবে মাত্র। সার্ক নিয়ে এ যখন অনিশ্চয়তা, ঠিক তখনই ঘটল পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা ও বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা।
একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে হয়তো দেশ দুটি যাবে না। কিন্তু একটি বড় ধরনের অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান যেমন জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা বন্ধ করছে না, ঠিক তেমনি বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে ভারতের ইন্ধন রয়েছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ। ষাট বছরের ওপরে হলো দেশ দুটি স্বাধীন হয়েছে। অনেক সম্ভাবনা ছিল দেশ দুটির। কিন্তু অবিশ্বাস আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেশ দুটির উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। ভারতের দারিদ্র্য অনেক বড় সমস্যা। সামরিক খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবহৃত হওয়ায় এ দরিদ্রতা দূর করা যায়নি। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এখন বাজেটে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাই দুই দেশের রাজনীতিবিদরা শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা গড়ে তুলবেনÑ এই প্রত্যাশা দক্ষিণ এশিয়ার সব মানুষের।
Daily Alokito Bangladesh
05.03.2019

পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা

Image result for Indo Pak recent conflictপাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোটের কাছে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান হামলার পর যে প্রশ্নটি এখন বহুল আলোচিত, তা হচ্ছে চতুর্থবারের মতো পাকিস্তান ও ভারত কি আবারও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে? গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর ৪৪ সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এই আত্মঘাতী বোমা হামলার দায়ভার স্বীকার করেছিল পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ। আর এর প্রতিশোধ হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের ২৩ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। যদিও ভারত দাবি করেছে, তারা ৩০০ জঙ্গিকে হত্যা করেছে। কিন্তু পাকিস্তান বলেছে, ওই বিমান হামলায় মাত্র একজন আহত হয়েছে। এই বিমান হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। এরই মধ্যে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় সেনাছাউনিতে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নিউজ এইটিনের খবর অনুযায়ী ‘কৃষ্ণা’, নওশেবা, বালাকোট ও মেন্দার সেক্টরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
এখানে বলা ভালো, সীমান্তে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বরাবর ভারত-পাকিস্তান অস্ত্রবিরতি সমঝোতা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভারতের অভিযোগ, এরপর অন্তত তিন হাজারবার পাকিস্তান অস্ত্রবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। অতীতে প্রতিবেশী এই দেশ দুটির সীমান্তে মাঝেমধ্যে গুলিবিনিময় হলেও, এই প্রথমবারের মতো ভারত বিমান হামলা চালিয়েছে। তবে এটা এখন অবধি নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ঘটনার পরপরই জাব্বা টপ পাহাড়ের আশপাশের এলাকা নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে ফেলেছে এবং কাউকেই সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ওই ঘটনায় কত মানুষ মারা গেছে তা-ও স্পষ্ট নয়। পাকিস্তান কিভাবে এই বালাকোট হামলার প্রত্যুত্তর দেবে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরাইশি বলেছেন, এই ‘হামলার’ সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে গড়াবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। অতীতে তিন-তিনবার এই দেশ দুটি পরস্পর যুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান তৃতীয়বারের মতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও ১৯৯৯ সালে কারগিলে দেশ দুটি সীমিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, যাকে ঠিক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বলা যাবে না।
মূলত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে কাশ্মীর নিয়ে বড় ধরনের সংকটের জন্ম হয়। ভারত বিভক্তির সময় (১৯৪৭) তৎকালীন কাশ্মীরের শাসক রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি একটি চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে অভিযোগ আছে, যে শর্তে রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, ভারত সেই শর্ত থেকে পরে সরে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরের কিছু স্বাধীনতাকামী পাকিস্তানের সমর্থন নিয়ে কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে নিজেদের ভারত থেকে আলাদা করে। এই অংশটি আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত এবং পাকিস্তানের একটি প্রদেশ এখন। তবে কাশ্মীরের আরেকটি অংশ আছে—সিয়াচেন গ্লেসিয়ার ও আকসাই চীন, যা চীন নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করছে। পাকিস্তান এই অঞ্চলে তাদের অংশ চীনকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ভারত এখনো এ অঞ্চলটি তাদের নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। সিয়াচেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধের খবরও আমরা জানি। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তানবিরোধী জনমত না থাকলেও ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে প্রচণ্ড ভারতবিরোধিতা রয়েছে। এই ভারতবিরোধিতাকে কেন্দ্র করে সেখানে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা এই অঞ্চলটিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। পাকিস্তান এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই কাশ্মীর বারবার উত্তেজনার জন্ম দিচ্ছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা একাধিকবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ৬০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ২০০৩ সালে দেশ দুটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করলে দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাকিস্তান ওই সময় কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থসহায়তা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ২০১৪ সালে ভারতে মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। নওয়াজ শরিফ নিজে দিল্লি গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এর আগে বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি লাহোরে বাসে করে গিয়ে ‘বাস কূটনীতি’ শুরু করেছিলেন। তবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায় জঙ্গিদের আত্মঘাতী তৎপরতার কারণে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা যে এই প্রথম, তা নয়। বরং এর আগেও একাধিকবার পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গিরা ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। পাঠক, নিশ্চয়ই উরি-পাঠানকোটের ঘটনা মনে করতে পারেন। উরি-পাঠানকোটের জঙ্গি হামলার জের ধরেই পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা হলো।
২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উরি সামরিক ছাউনিতে জইশ-ই-মোহাম্মদের জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছিল। ওই আত্মঘাতী হামলায় ২৩ জন ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছিল। আত্মঘাতী হামলায় চার জঙ্গিও মারা গিয়েছিল। ওই হামলার পর ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, ওই হামলার ১০ দিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী জঙ্গিদের ঘাঁটিতে (আজাদ কাশ্মীর) ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়। অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা আজাদ কাশ্মীরে প্রবেশ করে জঙ্গিঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে অনেক জঙ্গিকে হত্যা করে। ওই হামলায় আরেকটি জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাও তাদের দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছিল। ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার খবরও অনেকে স্মরণ করতে পারেন। ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল ওই হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করলেও ধারণা করা হয়, ওই জঙ্গিগোষ্ঠীটি জইশ-ই-মোহাম্মদেরই একটি উপদল।
ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গিরা যে কত তৎপর, তার প্রমাণ ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টে জঙ্গি হামলা। লস্কর-ই-তৈয়বা এই জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল। জইশ-ই-মোহাম্মদও এই হামলায় অংশ নেয়। ওই হামলায় ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছিল, যার মধ্যে ছয়জন ছিল পুলিশ সদস্য। ওই সময় পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছিল। জঙ্গিরা একে-৪৭ রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তারা যে কত শক্তিশালী ও সংগঠিত, তার প্রমাণ ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলসহ একাধিক স্থানে একসঙ্গে জঙ্গি হামলা। জঙ্গিরা প্রায় তিন দিন তাজ হোটেলের গেস্টদের জিম্মি করে রেখেছিল। প্রায় ১০টি স্থানে একই সময় পরিচালিত হামলায় ১৬৬ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিল। হামলায় অংশ নেওয়া আজমল খাসাবের ছবি ওই সময় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। পরে বিচারে খাসাবের ফাঁসি হয়েছিল।
সুতরাং বোঝাই যায়, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলাই একমাত্র জঙ্গি হামলা নয়। জঙ্গিরা মূলত জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এরা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাকিস্তানের বিভিন্ন সূত্র থেকে এরা অস্ত্র ও অর্থ পেয়ে থাকে। এদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—সন্ত্রাসী তৎপরতার মধ্য দিয়ে ভারতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। সুতরাং আজ ভারতীয় বিমানবাহিনী যখন বালাকোটে জঙ্গিঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়, আমি তাতে অবাক হইনি। বরং এটাই যুক্তিযুক্ত। ভারতে জঙ্গি হামলা বন্ধ হওয়া উচিত। এসব জঙ্গি হামলার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় উগ্রবাদীরা এখন দাবি জানাচ্ছে পাকিস্তান আক্রমণের। এখন যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় (?), তাহলে তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দুটি বড় দেশের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ এ অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এমনিতেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। পাকিস্তানের আরেকটি যুদ্ধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এই যুদ্ধ পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। একটি ‘যুদ্ধ’ হয়তো নরেন্দ্র মোদির অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। এপ্রিল-মে মাসে সেখানে লোকসভার নির্বাচন। এখন ‘যুদ্ধ’ হলে তা মোদির অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। ভারতে দারিদ্র্য আছে। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হবে।
কাশ্মীর উভয় দেশের জন্যই একটি রাজনৈতিক ইস্যু। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ইস্যুকে ব্যবহার করে আসছেন। ইমরান খানও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। সেনাবাহিনীর জন্য এটা একটা বড় ইস্যু। কাশ্মীর ইস্যু ব্যবহার করেই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শক্তির ওপর বারবার ‘চাপ’ প্রয়োগ করে আসছে। সুতরাং এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে উত্তেজনা হ্রাস করা, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করা এবং জঙ্গিদের যেকোনো সমর্থন প্রদান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া। কাশ্মীরে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখাটা জরুরি। এমনকি কাশ্মীরের জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপ করা যায় কি না, তা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা বিবেচনায় নিতে পারেন। প্রয়োজনে কাশ্মীরি নেতাদের ভারত ব্যবহার করতে পারেন। একটি স্থিতিশীল কাশ্মীর দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
Daily Kalerkontho
05.03.2019

কোন পথে ব্রেক্সিট

ব্রেক্সিট নিয়ে যেন জটিলতা কাটছেই না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছিল, ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে গত জানুয়ারি মাসে এক ভোটাভুটিতে সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হয়। এখন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে বলছেন, আগামী ১২ মার্চের মধ্যে পার্লামেন্টে আরেকটি ভোটাভুটি হবে। আগামী ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বলা ভালো, ব্রিটেনের গণভোটে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় পড়েছিল। ওই রায়ে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার দশকের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। ওই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের ডেভিড ক্যামেরন। তিনি পদত্যাগ করলে একই দলের তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত দুই বছর ধরে তেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছেন। আইন অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই ১৫ জানুয়ারি তেরেসা মে পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তার খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু তেরেসা মে জানতেন, তিনি এই খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারবেন না। এ জন্য তিনি ভোটাভুটি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তার খসড়া চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট তার জন্য- তার দল এখনও তার ওপর আস্থা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখন ব্রেক্সিটের কী হবে? এখন তেরেসা মে টিকে গেলেও তাকে সব দলের সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করতে হবে অথবা এমনও হতে পারে, কোনো চুক্তি ছাড়াই ২৯ মার্চ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ কার্যকর হবে। তবে এতে করে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না! যদিও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে বাস্তব সমাধান হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়া। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ অনেক ইউরোপীয় দেশ। ইতিমধ্যে অনেক দেশই বলছে, তারা এই চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। জার্মানির মতো দেশ ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তেরেসা মের সঙ্গে যে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কারণ এর আওতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময় দেওয়া হবে। তারপরও কথা থেকে যায়। তখন কী করবেন তেরেসা মে, ব্রিটেনই-বা যাবে কোন পথে?

হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এক. যেহেতু ইইউভুক্ত দেশগুলো আর চাচ্ছে না ব্রেক্সিট নিয়ে পুনরায় ব্রিটেনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা, সেহেতু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই অনেকটা অগোছালোভাবে ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে করে ব্রিটেন বড় ধরনের আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে। অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বে ব্রিটেন। ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কাস্টমস চুক্তি করতে হবে ব্রিটেনকে। আমদানি-রফতানি শুল্ক্কহার নির্ধারণ করতে হবে। ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর মান নতুন করে নির্ধারণ করতে হতে পারে; দুই. ব্রিটেনের যেসব নাগরিক এখন ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন কিংবা ইইউর যেসব নাগরিক ব্রিটেনে কাজ করেন তাদের স্ট্যাটাস কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ইইউর নাগরিকরা ২৭টি দেশের যে কোনো একটি দেশে কোনো ধরনের 'ওয়ার্ক পারমিট' ছাড়াই কাজ করতে পারতেন। ২৯ মার্চের পর নতুন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তিন. ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যের বড় ট্রেডিং পার্টনার হচ্ছে জার্মানি। যুক্তরাজ্য জার্মানি থেকে আমদানি করে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য (এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের চেয়ে বেশি)। হল্যান্ড থেকে আমদানি করে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্স থেকে আমদানি করে প্রায় ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড, স্পেন থেকে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। অথচ রফতানি করে কম। জার্মানিতে রফতানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড। ফ্রান্সে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আমদানি-রফতানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। বলা ভালো, ২০১৭ সালে ব্রিটেন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট রফতানি করে ২৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট রফতানির ৪৪ ভাগ) আর আমদানি করে মোট ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট আমদানির ৫৩ ভাগ)। সুতরাং বোঝাই যায়, কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে; চার. ইতিমধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে যে, নতুন করে ব্রেক্সিট প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা বলে, ২৯ মার্চের আগে নতুন করে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। কেননা, গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন এবং বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে। সুতরাং ২৯ মার্চের আগে এটি আয়োজন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়; পাঁচ. তেরেসা মে পার্লামেন্টে জিতে গেলেও তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। এতে করে তিনি যদি বিজয়ী (?) হনও, তাতে করে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এমনকি নির্বাচনে তার দল অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টি যদি বিজয়ী হয়, তারা ইইউতে পুনঃযোগদানের প্রশ্নে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এতে করে সংকট আরও বাড়বে। বড় জটিলতা তৈরি হবে। সুতরাং তেরেসা মে আগাম নির্বাচনের দিকে যাবেন বলে মনে হয় না; ছয়. ব্রেক্সিট ভোটের পর একটা বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডকে নিয়ে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে এবং এরপর ইইউর সঙ্গে থাকতে আবেদন করতে পারে। ব্রেক্সিট গণভোটের সময় স্কটল্যান্ডে যে ভোট হয়েছিল, তাতে ৬২ ভাগ ভোট পড়েছিল ইইউতে থাকার পক্ষে আর ৩৮ ভাগ ভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা নিকোলা স্টুরজিওন পুনরায় স্কটল্যান্ডে একটি গণভোটের ডাক দিতে পারেন। এখন মিস স্টুরজিওন কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়।

গত ১৫ জানুয়ারি হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। পরিস্কার করে বোঝা যাচ্ছে না পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে। ২৯ মার্চের পর ব্রিটেন যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায়, তাহলে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান তখন আরও শক্তিশালী করবেন। ফ্রান্স, গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র, যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা মেরিন লিপেন ও তার দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে আবারও গণভোটের ডাক দিতে পারে। তার দল ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। জার্মানিতে দক্ষিণপন্থিরা আরও শক্তিশালী হবে। তারা এই প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্টে গেছে (অলটারনেটিভ ফর জার্মানি-এএফডি পার্টি)। এরা জার্মানির ইইউ ত্যাগ করার ডাক দিতে পারে। ইতালিতেও এই কট্টরপন্থিরা (নর্দান লীগ, ফাইভ স্টার মুভমেন্ট) ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শক্তিশালী হয়েছে। নর্দান লীগ ও এর নেতা ম্যাটিও সালভিনি প্রচণ্ডভাবে ইইউবিরোধী। ইইউর অন্যান্য দেশেও এই দক্ষিণপন্থি উত্থান লক্ষ্য করার মতো।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে তেরেসা মে যাচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা কী ফল বয়ে আনবে, এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ২৫ বছর পর সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ল। ইইউ নামে এটি যাত্রা শুরু করলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরও আগে ১৯৫৮ সালে। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন গঠন, ২০০২ সালে একক মুদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় ১৯.২০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (পিপিপি) যে অর্থনীতি, এই অর্থনীতি ইইউকে বিশ্ব আসরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনীতি ক্ষেত্রেও অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলে ইইউর শক্তিকে দুর্বল করবে। আগামী দুই মাস ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। আস্থা ভোটে তেরেসা মে টিকে গেলে কিন্তু এটাই সব কথা নয়। সব মিলিয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে ব্রেক্সিট।
Daily Samakal
03.03.2019