রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা ও সার্কের ভবিষ্যৎ

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর প্রতিটি হামলার পেছনে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা সার্কের বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবিশ্বাসের কারণে সার্ক একরকম
মুখ থুবড়ে পড়েছে
সম্প্রতি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার পর ভারত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। বালাকোট পাকিস্তানের প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত। পাকিস্তানের ভেতরে ভারতীয় বিমান হামলার ঘটনা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অতীতে আর কখনও ঘটেনি। ১৯৯৯ সালে কারগিল সংঘর্ষের আগে ভারত ও পাকিস্তান তিন-তিনবার সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল (১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭১)। এখন বালাকোটে বিমান হামলার পর নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বালাকোটে বিমান হামলার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি ভারতীয় সামরিক ছাউনির ওপর মর্টার হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান দুটি ভারতীয় বিমান ভূপাতি করেছে বলেও দাবি করেছে এবং বিধ্বস্ত বিমানের দুজন পাইলটকে তারা গ্রেপ্তার করেছে বলেও দাবি করেছে। ওই ঘটনা এ অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। ভারতে আগামী এপ্রিল-মে মাসে লোকসভার নির্বাচন। লোকসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারত আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। তবে ভারতে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো যুদ্ধের ডাক দিয়েছে। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৪ ভারতীয় সেনাসদস্য মারা গেছেন। সুতরাং বিষয়টি ভারতে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর প্রতিটি হামলার পেছনে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা সার্কের বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবিশ্বাসের কারণে সার্ক একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। অভিযোগ আছে, ভারত এখন সার্কের বদলে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা বিবিআইএন ও বিমসটেককে গুরুত্ব দিচ্ছে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে না পারলেও ভারতে বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলতি বছর সার্ক সম্মেলন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। এখন দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা সার্ক সম্মেলনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। বলা ভালো, বাংলাদেশের উদ্যোগে সার্ক গঠিত হয়েছিল। গেল বছরের ডিসেম্বরে সার্ক ৩৩ বছর পার করেছে। ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা সংস্থা সার্কের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে এরই মাঝে। ৯ ডিসেম্বর (২০১৮) ইসলামাবাদে সার্কের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংগঠনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক থেকে ভারত বেরিয়ে যাওয়ায় আগামীতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা যাবে কি না, তাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সম্মেলনে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একজন মন্ত্রী উপস্থিত থাকায় ওই সম্মেলনে উপস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শুভম সিংহ অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান। ভারত কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। ফলে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের (যা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ) ‘একজন মন্ত্রী’ উপস্থিত থাকায় ভারত ওই সম্মেলন বয়কট করে। এর আগে ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে একটি সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলায় (২০১৬) পাকিস্তানি জঙ্গিরা জড়িত রয়েছেÑ এ অভিযোগ তুলে ভারত ইসলামাবাদ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিল। শুধু ভারত কেন, ভুটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানও সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিল। ফলে আর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ৯ ডিসেম্বর (১০১৮) সার্কের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংগঠনের শীর্ষ সম্মেলন যখন ভারত বয়কট করল, তখন আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ওপর তা এক ‘কালো ছায়া’ রেখে গেল।
উরির সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। গেল বছর (২০১৮) জাতিসংঘে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পাকিস্তান বিতর্কিত হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির ছবি দিয়ে ডাকটটিকিট প্রকাশ করলে তা দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটায়। ২০১৬ সালে ভারতীয় সেনা অভিযানে বুরহান নিহত হয়েছিলেন। ইমরান খান পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এমনকি ইমরান খান কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব করলে, ভারত তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। পাকিস্তান সার্কের আয়োজক। পাকিস্তানকেই সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের আয়োজনে কোনো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারত যোগ দেবে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো মহল থেকে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানের পরিবর্তে অন্য কোনো সার্কভুক্ত দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও পাকিস্তানের সম্মতি এতে পাওয়া যায়নি। ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একটি জিনিস লক্ষ করা যায়, আর তা হচ্ছে সার্কের ব্যাপারে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত এখন সম্পর্কে গুরুত্ব না দিয়ে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো), ভুটান ও নেপালকে নিয়ে বিবিআইএন নামে একটি উপআঞ্চলিক সংস্থা গঠন করা হয়। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের সাত বোন রাজ্যগুলোর উন্নয়ন। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা গুরুত্ব পেয়েছে কম। ওই উপআঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রেন যোগাযোগেরও উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এ সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এরই মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর যাতে ভারত ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে যে শুল্ক দেওয়ার কথা, তাতে রয়েছে ভারতের আপত্তি। ভারত তা দিচ্ছে না। ফলে একটা প্রশ্ন থাকবেইÑ এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বার্থ কী? এখানে ভারতের স্বার্থ বেশি। ভারত চায় না এ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি কর্তৃত্ব করুক। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের ভুবনেশ্বরে ইন্ডিয়ান ওসেন রিম বা আইওআরের একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি তখন সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছেন। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে, এ অঞ্চলের ‘দেখভাল’-এর দায়িত্ব ভারতের। ভারত চায় না অন্যকোনো দেশ এ অঞ্চলের ব্যাপারে কোনো ‘উৎসাহ’ দেখাক। স্পষ্টই ইঙ্গিতটি ছিল চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। ভারত তাই ‘বিবিআইএন’ উপআঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, একই সঙ্গে বিমসটেক বা ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’কে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ভারত এখন সার্কের বিকল্প হিসেবে বিমসটেককে প্রমোট করছে। ফলে সার্ক ধীরে ধীরে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, ৩৩ বছরে সার্কের উন্নয়ন যতটুকু হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। সার্ক আশিয়ান মডেলে গড়ে উঠতে পারেনি। এর জন্য অবিশ্য ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব প্রধানত দায়ী। পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের সমর্থন ও সহযোগিতা করছে, এমন অভিযোগ ভারতসহ আরও কয়েকটি সার্কভুক্ত দেশের। ফলে সার্কের বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সার্ক এখন একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হবে মাত্র। সার্ক নিয়ে এ যখন অনিশ্চয়তা, ঠিক তখনই ঘটল পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা ও বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা।
একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে হয়তো দেশ দুটি যাবে না। কিন্তু একটি বড় ধরনের অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান যেমন জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা বন্ধ করছে না, ঠিক তেমনি বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে ভারতের ইন্ধন রয়েছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ। ষাট বছরের ওপরে হলো দেশ দুটি স্বাধীন হয়েছে। অনেক সম্ভাবনা ছিল দেশ দুটির। কিন্তু অবিশ্বাস আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেশ দুটির উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। ভারতের দারিদ্র্য অনেক বড় সমস্যা। সামরিক খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যবহৃত হওয়ায় এ দরিদ্রতা দূর করা যায়নি। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এখন বাজেটে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাই দুই দেশের রাজনীতিবিদরা শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা গড়ে তুলবেনÑ এই প্রত্যাশা দক্ষিণ এশিয়ার সব মানুষের।
Daily Alokito Bangladesh
05.03.2019

0 comments:

Post a Comment