রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে ব্রেক্সিট

ব্রেক্সিট নিয়ে যেন জটিলতা কাটছেই না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছিল, ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে গত জানুয়ারি মাসে এক ভোটাভুটিতে সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হয়। এখন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে বলছেন, আগামী ১২ মার্চের মধ্যে পার্লামেন্টে আরেকটি ভোটাভুটি হবে। আগামী ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বলা ভালো, ব্রিটেনের গণভোটে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় পড়েছিল। ওই রায়ে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার দশকের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। ওই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের ডেভিড ক্যামেরন। তিনি পদত্যাগ করলে একই দলের তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত দুই বছর ধরে তেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছেন। আইন অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই ১৫ জানুয়ারি তেরেসা মে পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তার খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু তেরেসা মে জানতেন, তিনি এই খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারবেন না। এ জন্য তিনি ভোটাভুটি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তার খসড়া চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট তার জন্য- তার দল এখনও তার ওপর আস্থা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখন ব্রেক্সিটের কী হবে? এখন তেরেসা মে টিকে গেলেও তাকে সব দলের সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করতে হবে অথবা এমনও হতে পারে, কোনো চুক্তি ছাড়াই ২৯ মার্চ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ কার্যকর হবে। তবে এতে করে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না! যদিও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে বাস্তব সমাধান হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়া। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ অনেক ইউরোপীয় দেশ। ইতিমধ্যে অনেক দেশই বলছে, তারা এই চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। জার্মানির মতো দেশ ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তেরেসা মের সঙ্গে যে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কারণ এর আওতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময় দেওয়া হবে। তারপরও কথা থেকে যায়। তখন কী করবেন তেরেসা মে, ব্রিটেনই-বা যাবে কোন পথে?

হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে। এক. যেহেতু ইইউভুক্ত দেশগুলো আর চাচ্ছে না ব্রেক্সিট নিয়ে পুনরায় ব্রিটেনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা, সেহেতু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই অনেকটা অগোছালোভাবে ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে করে ব্রিটেন বড় ধরনের আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে। অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বে ব্রিটেন। ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কাস্টমস চুক্তি করতে হবে ব্রিটেনকে। আমদানি-রফতানি শুল্ক্কহার নির্ধারণ করতে হবে। ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর মান নতুন করে নির্ধারণ করতে হতে পারে; দুই. ব্রিটেনের যেসব নাগরিক এখন ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন কিংবা ইইউর যেসব নাগরিক ব্রিটেনে কাজ করেন তাদের স্ট্যাটাস কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ইইউর নাগরিকরা ২৭টি দেশের যে কোনো একটি দেশে কোনো ধরনের 'ওয়ার্ক পারমিট' ছাড়াই কাজ করতে পারতেন। ২৯ মার্চের পর নতুন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তিন. ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যের বড় ট্রেডিং পার্টনার হচ্ছে জার্মানি। যুক্তরাজ্য জার্মানি থেকে আমদানি করে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য (এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের চেয়ে বেশি)। হল্যান্ড থেকে আমদানি করে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্স থেকে আমদানি করে প্রায় ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড, স্পেন থেকে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। অথচ রফতানি করে কম। জার্মানিতে রফতানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড। ফ্রান্সে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আমদানি-রফতানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। বলা ভালো, ২০১৭ সালে ব্রিটেন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট রফতানি করে ২৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট রফতানির ৪৪ ভাগ) আর আমদানি করে মোট ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড (মোট আমদানির ৫৩ ভাগ)। সুতরাং বোঝাই যায়, কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে; চার. ইতিমধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে যে, নতুন করে ব্রেক্সিট প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা বলে, ২৯ মার্চের আগে নতুন করে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। কেননা, গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন এবং বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে। সুতরাং ২৯ মার্চের আগে এটি আয়োজন করা কোনোমতেই সম্ভব নয়; পাঁচ. তেরেসা মে পার্লামেন্টে জিতে গেলেও তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। এতে করে তিনি যদি বিজয়ী (?) হনও, তাতে করে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এমনকি নির্বাচনে তার দল অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টি যদি বিজয়ী হয়, তারা ইইউতে পুনঃযোগদানের প্রশ্নে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এতে করে সংকট আরও বাড়বে। বড় জটিলতা তৈরি হবে। সুতরাং তেরেসা মে আগাম নির্বাচনের দিকে যাবেন বলে মনে হয় না; ছয়. ব্রেক্সিট ভোটের পর একটা বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডকে নিয়ে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে এবং এরপর ইইউর সঙ্গে থাকতে আবেদন করতে পারে। ব্রেক্সিট গণভোটের সময় স্কটল্যান্ডে যে ভোট হয়েছিল, তাতে ৬২ ভাগ ভোট পড়েছিল ইইউতে থাকার পক্ষে আর ৩৮ ভাগ ভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা নিকোলা স্টুরজিওন পুনরায় স্কটল্যান্ডে একটি গণভোটের ডাক দিতে পারেন। এখন মিস স্টুরজিওন কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়।

গত ১৫ জানুয়ারি হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। পরিস্কার করে বোঝা যাচ্ছে না পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে। ২৯ মার্চের পর ব্রিটেন যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায়, তাহলে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান তখন আরও শক্তিশালী করবেন। ফ্রান্স, গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র, যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা মেরিন লিপেন ও তার দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে আবারও গণভোটের ডাক দিতে পারে। তার দল ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। জার্মানিতে দক্ষিণপন্থিরা আরও শক্তিশালী হবে। তারা এই প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্টে গেছে (অলটারনেটিভ ফর জার্মানি-এএফডি পার্টি)। এরা জার্মানির ইইউ ত্যাগ করার ডাক দিতে পারে। ইতালিতেও এই কট্টরপন্থিরা (নর্দান লীগ, ফাইভ স্টার মুভমেন্ট) ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শক্তিশালী হয়েছে। নর্দান লীগ ও এর নেতা ম্যাটিও সালভিনি প্রচণ্ডভাবে ইইউবিরোধী। ইইউর অন্যান্য দেশেও এই দক্ষিণপন্থি উত্থান লক্ষ্য করার মতো।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে তেরেসা মে যাচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা কী ফল বয়ে আনবে, এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ২৫ বছর পর সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ল। ইইউ নামে এটি যাত্রা শুরু করলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরও আগে ১৯৫৮ সালে। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন গঠন, ২০০২ সালে একক মুদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় ১৯.২০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (পিপিপি) যে অর্থনীতি, এই অর্থনীতি ইইউকে বিশ্ব আসরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনীতি ক্ষেত্রেও অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলে ইইউর শক্তিকে দুর্বল করবে। আগামী দুই মাস ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। আস্থা ভোটে তেরেসা মে টিকে গেলে কিন্তু এটাই সব কথা নয়। সব মিলিয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে ব্রেক্সিট।
Daily Samakal
03.03.2019

2 comments:

  1. I do believe that It would be better if Britain ll exit from the EU bcoz if britain go then it split into uk, Scotland n Ireland, on the other hand EU ll be weak that make balance of power in international politics.i also wish that uk should get punished bcoz it had tortured, louted 2/3 part of the world n still now palistine is suffering fr their wrong doing business.

    ReplyDelete
    Replies
    1. It has tortured, louted 2/3 of the world n still now palistine is suffering fr their wrong doing business.

      Delete