রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

Image result for Rohingya



বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্ট কুতুপালং ক্যাম্পে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে তাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে বলেছে এসব দাবি মানা না হলে কোনো রোহিঙ্গা নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরে যাবে না। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৭ লাখ ৪২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, মিয়ানমারের সময়ক্ষেপণ ও নানা টালবাহানের কারণে এতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। ২২ আগস্ট একটি দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট এই রোহিঙ্গা সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয় ও তারা তাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে। এই পাঁচ দফার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান, নির্যাতনের জন্য ক্ষতিপূরণ, মিয়ানমারে তাদের চলাফেরার অধিকার ও রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার। এর আগে আরও একটি দাবি তারা জানিয়েছিল আর তা হচ্ছে রোহিঙ্গারা কোনো অভ্যর্থনা ক্যাম্পে নয়, বরং তারা নিজেদের পৈতৃক ভিটায় ফিরতে চায়।
সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গাদের এই দাবি ও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফেরত না যাওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, বেশকিছু এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। রোহিঙ্গারা চলে গেলে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান কমে যাবে। তাই তারা রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন, জনসমাবেশ সংঘটিত করা এসবই এনজিওদের উৎসাহে হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন, মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড কারম্যান রাখাইন স্টেটকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি করেছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
জাতিসংঘ সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় (২.৩) উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ^ শান্তিকে বিঘিœত করে। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে কোনো রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব বিঘিœত হয় এমন কোনো কর্মকাÐে অংশ নেবে না। সুতরাং জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকাÐে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনও উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (ঠরৎমরহ খধহফং গধহধমবসবহঃ ধপঃ-ঠঋঠ)। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার প্রয়োজন ও উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকারও তাই করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনা ছাউনি করা হয়েছে।
কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনালের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন শেষে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে। এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে।
২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার) সরবরাহ করেছে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য ইউনান প্রদেশের জ্বালানি সুধা মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে এবং তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ শতাংশ। চীন রাখাইন প্রদেশের শুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে
গঁংব-গধহফধষধু রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে শুধঁশঢ়যুঁ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী গঁংব পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশ নিয়ে যাওয়া। সুতরাং সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগে রয়েছে। সেখানে তাদের জাতীয় ঋণ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক, কিংবা মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায় না। চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে ইঈওগ করিডোর
মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউয়ানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়কপথ রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত তবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে ইঈওগ করিডোরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই একধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়।
এদিকে গত মার্চ মাসেই মিয়ানমার সরকার রাখাইন স্টেটে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৩০টি চুক্তি করেছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (সিনহুয়া নিউজ, ১ মার্চ ২০১৯)। এর অর্থ পরিষ্কার চীন মিয়ানমারের বিরোধী কোনো কর্মকাÐকে সমর্থন করবে না। চীন বারবার বলে আসছে দ্বিপক্ষীয় (মিয়ানমার ও বাংলাদেশ) আলোচনার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজটি সম্পন্ন হোক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন ও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফেরত না যাওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি এখন ঝুলে গেল। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী? ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গেল দু’বছরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ করেছে ৭২ হাজার কোটি টাকা (বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ আগস্ট)। বাংলাদেশ যে আগামীতে আর এই অর্থ বহন করতে পারবে না, এ কথাটাও তিনি জানিয়েছেন। আরও একটা উদ্বেগের খবর আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। আর তা হচ্ছে একাধিক সন্ত্রাসী দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
সন্ত্রাসী আল ইয়াকিন গ্রæপের নামও সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিরা ইতোমধ্যে সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে বাঙালিদের মৃত্যুর খবরও একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এই যে পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। বিশাল একটি বিদেশি গোষ্ঠী অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করবে, এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে ভ‚মিকা পালন করার কথা তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পালন করছে না। সংগত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? মাত্র ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এই সংখ্যা কিছুই না।
কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি মিয়ানমার। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আশ^াস না পেলে রোহিঙ্গারা যে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা ও মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সে সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা, যারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য দায়ী, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
Daily Somoyer Alo
01.09.2019

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আরাম তত্ত্বে’ সমাধান মিলবে কি?


পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা সংকট একটি নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন ধার্য থাকলেও একজন রোহিঙ্গাও ওই দিন মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়ে দিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
আর বেশিদিন রোহিঙ্গারা আরামে থাকতে পারবে না। মানবিক এ সংকট মোকাবেলায় দাতারাও আর অর্থ দিতে চাইবে না। তখনই সমস্যা তৈরি হবে (ডেইলি স্টার, বাংলা অনলাইন সংস্করণ, ২২ আগস্ট)। এদিকে রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্ট কুতুপালং ক্যাম্পে একটি বিশাল শোডাউন করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রতি অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
এ বিশাল সমাবেশে তারা তাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। প্রশ্নটা সেখানেই। যেখানে রোহিঙ্গারা জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের উত্থাপিত পাঁচ দফা মানা না হলে তারা রাখাইনে ফেরত যাবে না, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকারান্তরে জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা আর সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন তাদের উদ্বেগের কথা জানালেন, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘও। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে জাতিসংঘ মনে করে। গত অর্থবছরে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের জন্য একটি অস্থায়ী আবাসন গড়তে নোয়াখালীর ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ব্যারাক ও ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হয়েছে। এখন রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা ভাসানচরেও যাবে না। তাহলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কোন্ দিকে যাচ্ছে? কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্যই বা কী?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আরাম’ তত্ত্ব ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার আর খরচ বহন করতে পারবে না, এবং বিদেশ থেকে সাহায্যও কমে আসবে। তাহলে এর সমাধান হবে কীভাবে? রোহিঙ্গাদের দাবি- তাদের পাঁচ দফা মানলেই তারা ফেরত যাবে। এই পাঁচ দফার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ, মিয়ানমারে তাদের চলাফেরার অধিকার, গণহত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে মিয়ানমারে যারা জড়িত তাদের বিচার ও তাদের নিজ পৈতৃক বাসভূমে থাকার অধিকার। বাংলাদেশ মনে করে এ দাবিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা মিয়ানমারের নিজস্ব বিষয়। মিয়ানমারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
কিন্তু সমাধানটা হবে কীভাবে? ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা কুতুপালং ক্যাম্পে যে শো-ডাউন করল, তা সংগঠিত করেছে কারা? পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওই সমাবেশের ব্যাপারে তারা অবগত ছিলেন না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি আবেদনপত্র ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায় সমাবেশের অনুমতিপত্র তারা গ্রহণ করেছিল। অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইএনজিওরা রোহিঙ্গাদের স্থায়ী হতে স্বপ্ন দেখাচ্ছে (উখিয়া নিউজ, ২৬ আগস্ট)।
বিবিসি বাংলা আমাদের জানাচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রাতের আঁধারে নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো (২৭ আগস্ট)। এখানে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। একটি বড় ধরনের উদ্বেগের খবর আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। আর তা হচ্ছে, একাধিক সন্ত্রাসী দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসী আল ইয়াকিন গ্রুপের নামও সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিরা ইতিমধ্যে সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে বাঙালিদের মৃত্যুর খবরও একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এই যে পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। বিশাল একটি বিদেশি জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা তারা করছে না। তাই সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এ সংখ্যা কিছুই নয়। কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি মিয়ানমার।
এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আশ্বাস না পেলে রোহিঙ্গারা যে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের, যারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য দায়ী, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা ছাড়াও কোনো গত্যন্তর নেই। কিন্তু সে ব্যাপারেও তেমন অগ্রগতি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানকার ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিষিদ্ধ করেছে।
কিন্তু মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, মিয়ানমার কিছু রোহিঙ্গাকে নিতে চায়; কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে চাইছে। উপরন্তু রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাদের নিয়ে রাখা হবে নির্ধারিত ক্যাম্পে। ক্যাম্পেই কাটাতে হবে তাদের বাকি জীবন। এ ধরনের বেশকিছু ক্যাম্প চীন ও ভারতের অর্থায়নে তৈরি হয়েছে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি ব্যাপক মাত্রায় বিশ্বে প্রচার পেলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি। এর বড় প্রমাণ- দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন আগামী ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- মিয়ানমারে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ বাড়ানো। গত মাসেই দক্ষিণ কোরিয়া সেখানে ৩ দশমিক ৯৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে (The Irrawaddy, ২৬ আগস্ট)। চীনের কথাও উল্লেখ করা যায়। চীন অনেকটা দু’মুখো নীতি গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীন দ্বিপাক্ষিক আলোচনার (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) ওপর গুরুত্ব দিলেও মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চেন হাই গত ২২ আগস্ট সেনাপ্রধান মিন আউয়ং হ্লাইয়ংয়ের সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন (The Irrawaddy, ২২ আগস্ট)। চীন রাখাইন স্টেটের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে। এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই।
অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে।
২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাবাহুল্য, ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর শতকরা ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনিজ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন রাখাইন প্রদেশের kyaukpyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একইসঙ্গে Muse-Mandalay রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে kyaukpyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী Muse পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এ পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।
সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীন সফরে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অবস্থানকেও সমর্থন করেছেন। এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক, কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হোক, এটা চীন চায় না।
তাহলে সমাধানটা কোন্ পথে? মিয়ানমার টালবাহানা করছে, এটা স্পষ্ট। মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ জনকে নিতে চেয়েছিল মিয়ানমার! তাও সম্ভব হল না। একটি আন্তর্জাতিক চক্র চাচ্ছে রোহিঙ্গারা বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলেই থেকে যাক! এটা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি।
আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের এ নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা সঠিকভাবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করতে পারিনি। সংকট শুরু হওয়ার দু’বছর পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ‘আরাম তত্ত্বের’ কথা বলছেন, তাতে করে কি এ সমস্যার সমাধান হবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হল না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় ফাঁদে পড়েছি।
‘জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না’- এই যুক্তি তুলে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গাদের এখানে রেখে দিতে চায়। দেশবিরোধী এসব এনজিও ও আইএনজিওর ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের কর্মকাণ্ড সীমিত করতে হবে। সাহায্যের নামে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ‘আরাম তত্ত্ব’ কোনো ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা নয়। কূটনৈতিকভাবে আমাদের কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। না হলে আমাদের জন্য আগামীতে খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে।

Daily Jugantor
31.08.2019

ভারতীয় গণতন্ত্র কতটা ঝুঁকির মুখে

Image result for Communalism in India


কাশ্মীর সংকটকে কেন্দ্র করে ভারতীয় গণতন্ত্র কতটা ঝুঁকির মুখে পড়েছে এটা নিয়ে খোদ ভারত ও বাইরে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর যে ‘বিশেষ মর্যাদা’ পেত, তা সংসদে বাতিল হওয়ায় এই বিতর্ক এখন আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে ৯টি রাজ্যেও এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সংবিধান অনুযায়ী ওইসব রাজ্যও এক ধরনের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। ১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধান জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল, যে মর্যাদা বলে ওই রাজ্যটি তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষা করতে পারত (তাদের আলাদা পতাকাও ছিল)। এটা এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন। পরে ১৯৫৪ সালে সংবিধানে ৩৫-ক ধারাটি সংযোজিত হয়। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি তাদের আলাদা মর্যাদা আরও সংরক্ষিত করতে পারত দ্বৈত নাগরিকত্ব, স্থানীয় নাগরিকত্ব, স্থানীয় জমিতে ও চাকরিতে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ইত্যাদি)। এখন ওই অধিকার বাতিল হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে সেখানে সাত লাখ ভারতীয় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সিএনএনএ কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার খবর সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভ দমনে ভারতীয় বাহিনী যে ভয়ংকর ও সহিংস ভূমিকা নিয়েছে, কিংবা সংবাদপত্র প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা তখন জাজিরা সম্প্রচার করেছে। স্কুল-কলেজ খুললেও, তাতে উপস্থিতি কম। ফোন, ইন্টারনেট পুরোপুরি চালু হয়নি। মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবর প্রচার করেছে বিবিসি।

জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে এই যে সংবাদ, তা ভারতীয় গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ৭২ বছরের যে ভারত, সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন, অসাম্প্রদায়িক নীতি, বহু মত, ধর্ম ও পথের সহাবস্থান বিশে^ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেই ভারত এখন এক ভিন্ন ‘চিত্র’ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৪ সালে এবং ২০১৯ সালে জনগণের ভোটে মোদি সরকার নির্বাচিত হয়েছে। তিনি ও তার সরকার যেসব কাজ করছেন, তার প্রতিটির পেছনে জনগণের সমর্থন আছে বলে তিনি দাবি করছেন। কিন্তু তার এসব কর্মকা-ে গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট, তা কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটি এখন ভারতের সর্বত্র মূল আলোচনার বিষয়। কাশ্মীর প্রশ্নে মোদি সরকারের এই নীতি যে বিশে^ ভারতের ভাবমূর্তি কতটা নষ্ট করেছে, কিংবা ভারতীয় গণতন্ত্রকে কতটা ধ্বংস করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্ব তথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক কাশ্মীরে গণহত্যা। তিনি এও বলেছেন, ভারতীয় হিসেবে তিনি এখন আর গর্ববোধ করেন না। বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, কাশ্মীরে দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করছে মোদি সরকার। তিনি ভারতীয় গণতন্ত্রের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ও গবেষক রামচন্দ্র গুহ ওয়াশিংটন পোস্টে (১৪ আগস্ট) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন) ‘India was a miracle Democracy; But it is time to downgrade its credential "। তার বক্তব্য পরিষ্কার ভারত রাষ্ট্রটি অনেকগুলো জাতি ও উপজাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। সেখানে উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। আচার-আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তার মতে, ভারত হচ্ছে  A Nation of many Nations । গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও প্র্যাকটিস ভারতকে এক কাঠামোয় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন সেই গণতন্ত্রকে আর প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বলা যাবে না। মিথ্যা বলেননি রামচন্দ্র গুহ।

বিশাল এক দেশ ভারত। ধর্মীয়ভাবে অনেক ধর্মের অনুসারীদের বাস ওই ভারতে। জনসংখ্যার ৭৯ দশমিক ৮০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এরপরই মুসলমানদের স্থান, জনসংখ্যার হার ১৪ দশমিক ২৩ ভাগ। খ্রিস্ট ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৩০ ও ১ দশমিক ৭২ ভাগ। ২০ কোটির ওপর মুসলমানদের এই সংখ্যা যেকোনো মুসলমান প্রধান দেশের চেয়ে বেশি। বর্ণ, ধর্ম ও জাতিভিত্তিকভাবে বিভক্ত ভারতকে এক কাঠামোয় রাখতে ভারতীয় সংবিধানপ্রণেতারা একদিকে যেমনি দলিত শ্রেণির (নিম্ন শ্রেণির, অশিক্ষিত মানুষ)Ñ সংবিধানে এক ধরনের রক্ষাকবচ রেখেছেন, অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ রাজ্যের জন্য (যেমন : উত্তর পূর্বাঞ্চল, কিংবা কাশ্মীর, অন্ধ্রপ্রদেশ) বিশেষ মর্যাদা তখন সীমিত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। উদ্দশ্য ছিল স্পষ্ট একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোয় কিছু রাজ্যকে কিছু সুবিধা দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আওতায় ভারতীয় ঐক্যকে টিকিয়ে রাখা। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৭২ বছর এই ঐক্য টিকে থাকলেও, এখন ওই ঐক্য ফাটল দেখা দিয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ, কিংবা হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এখন ভারতীয় ঐক্যের জন্য রীতিমতো হুমকি। উত্তর পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলে আসছিল, তা একটা পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে এলেও, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ায় নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যে নতুন করে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এই অসন্তোষ অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং একই সঙ্গে ৩৫-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ‘আলাদা মর্যাদা’ পেত। এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ (স্থানীয়দের চাকরি-শিক্ষা থেকে সুবিধা, স্থায়ী নাগরিকদের মর্যাদা ইত্যাদি) শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল, তেমনটি নয়, অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্য এখনো সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ ভোগ করে থাকে। ৩৭১ এ ও ৩৭১ জি ধারা বলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জমির ওপর, বন ও খনিজ সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকৃত। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এই অঞ্চলে সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর হয়। সেখানে দেশীয় আইন, ঐতিহ্য অনুযায়ী অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্পত্তি ও জমির হস্তান্তরও নিজস্ব নিয়মে চলে। সংবিধানের ৩৬৮ ধারার ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর ধারায় ৯টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও অন্ধ্রপ্রদেশ রয়েছে সেই তালিকায়। ৩৭১ বি ধারায় কিংবা ২৪৪ এ ধারায় আসাম বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ৩৭১ ডি ও ই ধারায় অন্ধ্রপ্রদেশে শিক্ষা, চাকরিতে সংরক্ষণসহ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ৩৭১ এইচ ধারা মতে, অরুনাচল রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারেন কেন্দ্র থেকে নিযুক্ত রাজ্যপাল। সুতরাং যেসব অঞ্চল বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে, তাদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে নাগাল্যান্ড, মিজোরামে বিক্ষোভ হয়েছে, স্থানীয় নেতারা কঠোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জম্মু ও কাশ্মীর দ্বিখ-িত হওয়ায় অনেক রাজ্যেই এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি এক বাক্যে এসেছে। দার্জিলিংয়ের পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চ্চার বিমল ওরং আত্মগোপনস্থল থেকে এক বার্তায় দার্জিলিংয়েও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এটা একটা অশনিসংকেত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এ ধরনের দাবি উঠতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কী শুধু ‘মিশন কাশ্মীর’ নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন? বাকি অন্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সংবিধানে যে সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা খর্ব করারও উদ্যোগ নেবেন? কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে জন অসন্তোষ গড়ে উঠছে, তা যদি কেন্দ্র বিবেচনায় নেয়, তাহলে সংবিধানে অন্যান্য ও পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলোর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংবিধানের রক্ষকবচগুলো বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত মুসলমানবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি।

ভারতের সংবিধানপ্রণেতারা এ ধরনের রক্ষাকবচ দিয়েই ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোকে ‘এক’ রাখতে চেয়েছেন। দীর্ঘদিন কোনো সরকারই এই রক্ষাকবচের ওপর হাত দেয়নি। কেননা, তারা জানতেন সংবিধান লিপিবদ্ধ এসব রক্ষাকবচে যদি ‘হাত’ দেওয়া হয়, তাহলে ভারতের সংহতি বিনষ্ট হবে। ভারত ভেঙে যেতে পারে! বিদেশি সরকারের কাশ্মীর প্রশ্নে নেওয়া সিদ্ধান্ত এখন একদিকে সংবিধানকে যেমনি আঘাত করেছে, তেমনি ভারতের সংহতি ও ঐক্যকেও আঘাত করেছে। একই সঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক সংহতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনিতেই ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ভারতের গণতন্ত্র হচ্ছে ‘ Election only Democracy ’। অর্থাৎ শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিকই হচ্ছে এই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট অনেক ক্ষেত্রেই এখানে অনুপস্থিত। পারিবারিক শাসন তখন পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি (স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে কিছু পরিবার), দলিতদের ব্যবহার করে স্থানীয় তথা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা (মায়াবতী), (লালু প্রসাদ), ক্রিমিনালদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব (শতকরা ৪৩ ভাগ সংসদ সদস্যের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে, দি হিন্দু, ২৬ ২০১৯) ভারতীয় গণতন্ত্রকে সনাতন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে পৃথক করেছে। মোদি জামানায় এখন একটি নতুন মাত্রা বেড়েছেÑ তা হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি অব্যাহত রাখা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন সাম্প্রদায়িক নীতি প্রোমোট করা হচ্ছে, যা সনাতন গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নামে এক ধরনের ‘করপোরেট সংস্কৃতি’ (ধনী গোষ্ঠীর সুবিধা দেওয়া) সনাতন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকেও এখন চ্যালেঞ্জ করছে।

ফ্রিডম হাউজ বিশ^ব্যাপী গণতান্ত্রিক র‌্যাংকিং নিয়ে কাজ করে। ২০১৯ সালে তাদের যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মোট স্কোর-১০০-এর মধ্যে ভারতের স্কোর-৭৫। রাজনৈতিক অধিকার কিংবা মানবাধিকার-সংক্রান্ত রিপোর্টে ভারতের অবস্থাও আশাপ্রদ নয়। আলাদাভাবে জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থানও দেখানো হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক নয়। তাই মিলি মিত্র যখন ওয়াশিংটন পোস্টে তার ‘This is the Modi government’s darkest Movement’ এ মোদি সরকারের কাশ্মীর প্রশ্নে গৃহীত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, কিংবা বিজেপি নেতারা যখন প্রকাশ্যেই বলেন, ‘India is a Hindu Nation,’, তখন ভারতীয় গণতন্ত্রের কালো দিকটাই প্রকাশ পায়। ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে তখন আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু থাকে না।
Daily Desh Rupantor
24.8.2019

অনিশ্চয়তার আবর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন



advertisement
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা, ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত ও নিরাপত্তা নজরদারির শর্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এই শর্তগুলো পূরণ না করায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই শর্তগুলোর ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা না দেওয়ায় রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারে ফেরত যাননি। এ ব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতার। গত ২৮ জুলাই কক্সবাজারে এসেছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে। তখন অবশ্য তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে! কিন্তু ২২ আগস্ট পর্যন্ত নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা দাদা, মা ও সন্তানÑ এ তিনের অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। একইভাবে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) অনুযায়ী যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেও মিন্ট থোয়ে জানিয়েছিলেন। (সাউথ এশিয়া মনিটর, ২৯ জুলাই)। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের নেতা মহিবুল্লাহ তখন সংবাদকর্মীদের জানিয়েছিলেন, মিয়ানমারের দলটি পুরনো প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দেওয়া হলে একজনও মিয়ানমারে ফিরবেন না। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর নে সান লউইন জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা চান পূর্ণ নাগরিকত্ব, জাতিগত অধিকার ও আন্তর্জাতিক সুরক্ষা। এটা নিশ্চিত না হলে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। তখন অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন মন্তব্য করেছিলেন যে, রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তার মতে, আমাদের লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। তাদের নাগরিকত্বে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যানের একটি বক্তব্য (রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা) বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে হয়েছিল (৮ জুলাই)। চীন সফর শেষ করে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছিলেন, রাখাইনকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান করেছেন, তা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায়। তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা এই অঞ্চলে শান্তিতে বিশ্বাসী। কারও ভূখ- আমাদের লাগবে না। বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপকমিটিতে কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যান একটি প্রস্তাব করেন গত ১৩ জুন। তাতে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন স্টেটের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায় অথবা অপারগ হয়, তা হলে ওই স্টেটের (অর্থাৎ রাখাইন স্টেটের) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত এবং ওই এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে (অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত, যা ওই এলাকার মানুষও চাচ্ছে। বক্তব্যটি ছিল স্পষ্ট। যেহেতু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সুরক্ষা দিতে পারছে না। তাই ওই এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হোক! শারম্যান এভাবেই কথাটা বলতে চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কংগ্রেসম্যান শারম্যানের ওই ‘প্রস্তাব’ শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সেখানে যখন এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার লোকজন আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছে, মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়ার অর্থ এটা নয়, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটা অংশ নিয়ে চলে আসব। এই মানসিকতা আমাদের নেই। এটা আমরা চাই না। প্রত্যেক দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে, এটাই আমি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী সঠিকই মন্তব্য করেছেন। মিয়ানমার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান তাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
উপরন্তু জাতিসংঘের সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে (২.৩) যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ্ব শান্তিকে বিঘিœত করে। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে, কোনো রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিঘিœত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে অংশ নেবে না। তাই জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনো উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (Virgin Lands Management Act_ VFP )। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ‘তার প্রয়োজনে ও উন্নয়নের স্বার্থে’ যে কোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকার তাই করেছেও। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনাছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনারেলের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে। ২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালাািন ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মানে ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন রাখাইন প্রদেশের কুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে Muse- Mandalay   রেলওয়ে লাইনও  তৈরি করছে। এতে করে  Kyaukphyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। তাই সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায় না। চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তা হলে বিসিআইএম করিডর মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউনানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়ক তথা রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত হবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে বিসিআইএম করিডরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই এক ধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়। এদিকে গত মার্চ মাসেও মিয়ানমার সরকার রাখাইন স্টেটে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৩০টি চুক্তি করেছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (সিনহুয়া নিউজ, ১ মার্চ ২০১৯)। এর অর্থ পরিষ্কার, মিয়ানমার মুখে মুখে প্রত্যাবাসনের কথা বললেও কার্যত রোহিঙ্গারা যেখানে থাকতেন, সেই রাখাইন স্টেটে দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সেখানে এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে নিয়ে তারা তাদের নিজ পৈতৃক বাসভবনে আর পুনর্বাসিত করবে না, বরং তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে। তাদের কাটাতে হবে ক্যাম্পজীবন। রোহিঙ্গাদের আপত্তিটা সেখানেই। রোহিঙ্গারা যে ৪টি দাবি উত্থাপন করেছেন, তার একটির ব্যাপারেও মিয়ামনার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো, তার সমাধান কীভাবে হবে তা বলা মুশকিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন অবধি রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব, নিজ বাসভূমে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। স্পষ্টতই রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সংকট, তার কোনো সমাধান হলো না।
Daily Amader Somoy
24.08.2019

কাশ্মীর সংকট ঘিরে অনেক প্রশ্ন

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা (সংবিধানের ৩৭০নং ধারা) বাতিল হওয়ার পর তিন সপ্তাহ পার হতে চলেছে; কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে এক ধরনের ‘গণবিস্ফোরণ’ ঘটেছে! সেখানকার মানুষ এখনও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। খোদ ভারতীয় রাজনীতিকদের মাঝেও এ প্রশ্নে দ্বিমতের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোসহ ৯টি রাজ্য, যেসব রাজ্য সাংবিধানিকভাবে ‘বিশেষ সুবিধা’ পায়, তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্কের। যদিও ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পরিস্থিতি সেখানে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং সেখানে প্রচুর বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে; কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। এরই মাঝে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর (লাদাখ আলাদা হয়েছে) শেষ পর্যন্ত ‘ভারতের আফগানিস্তানে’ পরিণত হতে যাচ্ছে কিনা (সাউথ এশিয়ান মনিটর, ১৯ আগস্ট, ২০১৯)।
জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতির সঙ্গে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির কি আদৌ কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে? একটু পেছনের দিকে তাকাতে হয়। ডিসেম্বর ২৫, ১৯৭৯। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, তৎকালীন আফগান সরকারের আমন্ত্রণেই সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের এ দখলদারিত্ব বজায় ছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তৎকালীন সোভিয়েত নেতা গরবাচেভ আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু আফগান আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যে ‘যুদ্ধ’ সেখানে শুরু হয়েছিল, সেই ‘যুদ্ধ’ আজও চলছে। আফগান আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে সেখানে তৈরি করা হয়েছিল তালেবান বাহিনী। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র উদ্যোগে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোতে তালেবানদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ-অস্ত্র সাহায্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এক গেরিলা বাহিনী। সারা বিশ্ব পরবর্র্তী সময়ে জেনেছিল আফগান তালেবানদের নাম। আফগান তালেবানরা এখন আফগানিস্তানে এক ধরনের আতঙ্কের নাম। ১৯৯৬ সালে তারা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত দখল করেছিল। মোল্লা ওমর ছিলেন তাদের নেতা, যিনি কখনই প্রকাশ্যে আসেননি। ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছে। তথাকথিত ৯/১১-এর পর (২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা, আল-কায়দার উত্থান) তালেবানরা আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছে, এই অজুহাত তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তান দখল করে নেয়। এর পরের কাহিনী সবার জানা। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে (ন্যাটো বাহিনীসহ) সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও কিছু মার্কিন সেনা এখনও সেখানে রয়ে গেছে। আর তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘শান্তি’ আলোচনা চলছে, তাতে তালেবানদের শর্ত একটাই- সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। স্পষ্টতই আফগান রাজনীতিতে তালেবানদের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। এখন এ পরিস্থিতির সঙ্গে কাশ্মীরের পরিস্থিতির কি আদৌ কোনো তুলনা করা যাবে?
পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল। কেন্দ্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন গভর্নর এ অঞ্চলটি শাসন করছেন। এতদিন এ অঞ্চলটি (লাদাখসহ) রাজ্যের মর্যাদা পেয়ে আসছিল। এখন তা আর বহাল নেই। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকবে এবং ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ হলে সেখানে নির্বাচন হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এ অঞ্চলটি শাসন করবেন! এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। এক. কাশ্মীরের প্রভাবশালী দুই পরিবার (আবদুল্লাহ ও মুফতি) ও তাদের নেতৃত্বাধীন দল (ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি) কি আদৌ সেই নির্বাচনে অংশ নেবে? আর যদি অংশ না নেয়, তাহলে কি সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে?
দুই. সেখানে বেশকিছু জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে হিজবুল মুজাহিদিন, ইসলামিক স্টেট জম্মু কাশ্মীর, ইসলামিক স্টেট খোরাসান, জইশ-ই-মোহাম্মদ ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালের ১৩ জুলাই ভারতীয় বাহিনী সেখানে বড় ধরনের ‘অপারেশন’ পরিচালনা করে। এর প্রতিক্রিয়াতেই এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের জন্ম হয়, যারা জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করতে চায়। এসব জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তান থেকে আর্থিক ও অস্ত্র সাহায্য পেয়ে থাকে। ভারতের অভিযোগ, এসব জঙ্গি সংগঠন ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, জঙ্গি সংগঠনগুলো আদৌ নির্বাচন আয়োজন করতে দেবে কিনা? কিংবা নির্বাচনে তারা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেবে কিনা? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়।
তিন. জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে অনেকটা ফিলিস্তিনিদের ‘পশ্চিমতীরের’ মতো। ইসরাইল ও জর্ডানের মাঝখানে পশ্চিমতীর অবস্থিত। আর পশ্চিমতীর ও গাজা নিয়ে গড়ে উঠেছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। কিন্তু পশ্চিমতীরের মাত্র ১১ শতাংশ এলাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে ৬১ শতাংশ এলাকা। ২৮ শতাংশ এলাকা যৌথ নিয়ন্ত্রণে (ইসরাইল ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ) পরিচালিত হয়। ফলে স্বাধীন যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে উঠছে, তা অনেকটাই ইসরাইলি ‘নিয়ন্ত্রণে’ থেকে যাচ্ছে! জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতিও অনেকটা সেরকম হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ আগামীতে একটি কাশ্মীরি কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে (বিধানসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে); কিন্তু পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের। এ রাজ্যটি আগে যে বিশেষ সুবিধা পেত (দ্বৈত নাগরিকত্ব, দ্বৈত পতাকা, নাগরিকত্ব, চাকরিতে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার), সেই সুযোগ এখন আর নেই। তবে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় ৭ লাখ ভারতীয় সেনা মোতায়েন, তরুণ কাশ্মীরিদের ধরে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতন চালানো পশ্চিমতীরে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে হয়তো আফগান পরিস্থিতির সঙ্গে কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে পুরোপুরিভাবে মেলানো যাবে না; কিন্তু কাশ্মীরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সেখানে উগ্র জঙ্গিবাদী রাজনীতির চেতনাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, যার সঙ্গে আফগান পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে।
চার. আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর হামলা ও দেশটি দখল করে নেয়ায় সেখানে ধর্মভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল। জন্ম হয়েছিল তালেবানের পাশাপাশি হাক্কানি নেটওয়ার্ক, আল কায়দা, ইসলামিক স্টেট কিংবা নর্দান অ্যালায়েন্সের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনের। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- হরকাতুল জিহাদ, লস্কর-ই-তাইয়েবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিন, আল বদর জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট, আইএসআইএল-কেপি ইত্যাদি। কাশ্মীরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জঙ্গিবাদী এ তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। তরুণরা ব্যাপক হারে এখন এ জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের পর। তেমন একটি পরিস্থিতি এখন কাশ্মীরে সৃষ্টি হতে পারে।
পাঁচ. আফগান আগ্রাসনে বিদেশি শক্তি জড়িয়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কাশ্মীর প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও চীনের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে এ অঞ্চলে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (যা গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে) চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরটি পাকিস্তান অধিকৃত ‘আজাদ কাশ্মীরের’ উপর দিয়ে গেছে। এই ‘আজাদ কাশ্মীরের’ মালিকানা ভারত দাবি করছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি আবারও আজাদ কাশ্মীরের দাবি উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চীন। এবং কাশ্মীর সংকটে চীনের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ মুহূর্তে ‘নিরপেক্ষ’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মোদি ও ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। কিন্তু কাশ্মীরে জঙ্গিবাদী তৎপরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘জাতীয় স্বার্থের’ কারণে ভারতের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দুটি- চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমানো এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহার-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারতের একটি বড় ভূমিকা পালন। কাশ্মীর সংকটে ইসরাইলের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবাট ফিস্ক লিখেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা সৃষ্টিতে ইসরাইলের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে (The Independent, 28 February)। এমনকি পুলাওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯), ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যে বিমান হামলা চালিয়েছিল, তার পেছনে ইন্ধন ছিল ইসরাইলের। ইসরাইলি সংবাদপত্র HAARETZ জানাচ্ছে, ইসরাইল এ সময় তাদের বৈমানিকদেরও পাঠিয়েছিল ভারতকে সাহায্য করতে (১৪ মার্চ, ২০১৯)। আর ভারত-ইসরাইল সামরিক সম্পর্কের কথা তো সবাই জানে। কাশ্মীর সংকট ও ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। ফলে একটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অ্যালায়েন্সের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন- ইসলামী জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করা ও চীনের প্রভাব কমানো।
কাজেই কাশ্মীর সংকট ঘিরে অনেক প্রশ্ন আছে ও থাকবে। পাকিস্তান এ সংকটকে পুঁজি করে বহির্বিশ্বে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়। পাকিস্তান পঞ্চমবারের মতো ভারতের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে জড়াবে না, এটা যেমন দিব্যি দিয়ে বলা যায়, ঠিক তেমনি এটাও বলা যায় যে, ‘কাশ্মীর সংকট’কে ‘হজম’ করতে ভারতকে বেশ বেগ পেতে হবে। স্পষ্টতই বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার সাধারণ কাশ্মীরিদের মন জয় করতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির ব্যর্থতা এখানেই।
Daily Jugantor
24.8.2019

অনিশ্চয়তার আবর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন




রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা, ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত ও নিরাপত্তা নজরদারির শর্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এই শর্তগুলো পূরণ না করায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই শর্তগুলোর ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা না দেওয়ায় রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারে ফেরত যাননি। এ ব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতার। গত ২৮ জুলাই কক্সবাজারে এসেছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে। তখন অবশ্য তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে! কিন্তু ২২ আগস্ট পর্যন্ত নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা দাদা, মা ও সন্তানÑ এ তিনের অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। একইভাবে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) অনুযায়ী যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেও মিন্ট থোয়ে জানিয়েছিলেন। (সাউথ এশিয়া মনিটর, ২৯ জুলাই)। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের নেতা মহিবুল্লাহ তখন সংবাদকর্মীদের জানিয়েছিলেন, মিয়ানমারের দলটি পুরনো প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দেওয়া হলে একজনও মিয়ানমারে ফিরবেন না। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর নে সান লউইন জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা চান পূর্ণ নাগরিকত্ব, জাতিগত অধিকার ও আন্তর্জাতিক সুরক্ষা। এটা নিশ্চিত না হলে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। তখন অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন মন্তব্য করেছিলেন যে, রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তার মতে, আমাদের লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। তাদের নাগরিকত্বে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যানের একটি বক্তব্য (রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা) বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে হয়েছিল (৮ জুলাই)। চীন সফর শেষ করে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছিলেন, রাখাইনকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান করেছেন, তা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায়। তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা এই অঞ্চলে শান্তিতে বিশ্বাসী। কারও ভূখ- আমাদের লাগবে না। বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপকমিটিতে কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যান একটি প্রস্তাব করেন গত ১৩ জুন। তাতে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন স্টেটের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায় অথবা অপারগ হয়, তা হলে ওই স্টেটের (অর্থাৎ রাখাইন স্টেটের) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত এবং ওই এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে (অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত, যা ওই এলাকার মানুষও চাচ্ছে। বক্তব্যটি ছিল স্পষ্ট। যেহেতু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সুরক্ষা দিতে পারছে না। তাই ওই এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হোক! শারম্যান এভাবেই কথাটা বলতে চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কংগ্রেসম্যান শারম্যানের ওই ‘প্রস্তাব’ শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সেখানে যখন এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার লোকজন আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছে, মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়ার অর্থ এটা নয়, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটা অংশ নিয়ে চলে আসব। এই মানসিকতা আমাদের নেই। এটা আমরা চাই না। প্রত্যেক দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে, এটাই আমি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী সঠিকই মন্তব্য করেছেন। মিয়ানমার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান তাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
উপরন্তু জাতিসংঘের সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে (২.৩) যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ্ব শান্তিকে বিঘিœত করে। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে, কোনো রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিঘিœত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে অংশ নেবে না। তাই জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনো উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (ঠরৎমরহ ষধহফং গধহধমবসবহঃ ধপঃ-ঠঋঠ)। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ‘তার প্রয়োজনে ও উন্নয়নের স্বার্থে’ যে কোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকার তাই করেছেও। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনাছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনারেলের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে। ২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালাািন ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মানে ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন রাখাইন প্রদেশের কুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে গঁংব-সধহফধষধু রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে কুধঁশঢ়যুঁ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। তাই সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায় না। চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তা হলে বিসিআইএম করিডর মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউনানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়ক তথা রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত হবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে বিসিআইএম করিডরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই এক ধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়। এদিকে গত মার্চ মাসেও মিয়ানমার সরকার রাখাইন স্টেটে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৩০টি চুক্তি করেছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (সিনহুয়া নিউজ, ১ মার্চ ২০১৯)। এর অর্থ পরিষ্কার, মিয়ানমার মুখে মুখে প্রত্যাবাসনের কথা বললেও কার্যত রোহিঙ্গারা যেখানে থাকতেন, সেই রাখাইন স্টেটে দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সেখানে এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে নিয়ে তারা তাদের নিজ পৈতৃক বাসভবনে আর পুনর্বাসিত করবে না, বরং তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে। তাদের কাটাতে হবে ক্যাম্পজীবন। রোহিঙ্গাদের আপত্তিটা সেখানেই। রোহিঙ্গারা যে ৪টি দাবি উত্থাপন করেছেন, তার একটির ব্যাপারেও মিয়ামনার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো, তার সমাধান কীভাবে হবে তা বলা মুশকিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন অবধি রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব, নিজ বাসভূমে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। স্পষ্টতই রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সংকট, তার কোনো সমাধান হলো না।


২৪ আগস্ট ২০১৯ 

য় তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

‘মিশন কাশ্মীর’ ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে



গত ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিল হয়েছে। সেই সঙ্গে বাতিল হয়েছে ৩৫-এ ধারাটিও। ভারতের কোনো কোনো গণমাধ্যম ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘মিশন কাশ্মীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে (ঘবংি ১৮, বাংলা)। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতি নতুন একটি মাত্রা পেল। সংবিধানের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ভারত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় তা এখন ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে? প্রথমত, অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় কাশ্মীর এখন ভারতের মূলধারার সঙ্গে একত্র হলো। অর্থাৎ জন্মু ও কাশ্মীরের যে দ্বৈতসত্তা ছিল (আলাদা পতাকা, স্থায়ী নাগরিকত্বের বিষয়), তা আর থাকল না। একই আইন এখন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও কাজ করবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এক রাজ্য ভেঙে অন্য রাজ্য সৃষ্টি করা, এক অংশ অন্য রাজ্যে সংযুক্ত হওয়া এই প্রথম নয়। এর আগেও হয়েছে। কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১৯৫৩ সালে মাদ্রাজ থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধ্র প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে পণ্ডিচেরি, মাহে, ইয়ানমা, করাইকল ও চান্দেরনগর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলোর পুনর্বিন্যাস হয়। ১৯৬০ সালে বোম্বে ভেঙে গঠন করা হয় মহারাষ্ট্র ও গুজরাট। ১৯৬১ সালে গোয়া, দমন-দিউ, দাদরা-হাভেলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড রাজ্যের স্বীকৃতি পায়। ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আলাদা রাজ্যে পরিণত হয়। এক অংশ হিমাচলে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭২ সালে মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল আসাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০০ সালে উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জন্ম হয়। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্যের জন্ম হয়। ১৯৫১ সাল থেকেই ভারতে এই প্রক্রিয়া চলছে। সুতরাং আজ জম্মু ও কাশ্মীর ভেঙে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (কাশ্মীর ও লাদাখ) গঠন করার সিদ্ধান্ত নতুন নয়। এ ধরনের পুনর্বিন্যাস আগেও হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের অনেক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিধানসভা রয়েছে, কোথাও বা আবার বিধানসভা নেই। যেমন—পাদুচেরি কিংবা দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কিন্তু এখানে বিধানসভা আছে। একজন মুখ্যমন্ত্রী আছেন। আবার চণ্ডীগড়, দমন-দিউ, লক্ষাদ্বীপ, আন্দামান-নিকোবর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলেও এখানে কোনো বিধানসভা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরে বিধানসভা থাকবে। কিন্তু লাদাখে কোনো বিধানসভা থাকবে না। একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর দ্বারা এই অঞ্চল শাসিত হবে। তৃতীয়ত, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ‘আলাদা মর্যাদা’ পেত। এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ (স্থানীয়দের চাকরি-শিক্ষা থেকে সুবিধা, স্থায়ী নাগরিকের মর্যাদা ইত্যাদি) শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল তেমনটি নয়, অন্য বেশ কিছু রাজ্য এখনো সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ ভোগ করে থাকে। ৩৭১-এ ও ৩৭১-জি ধারাবলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জমির ওপর, বন ও খনিজ সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকৃত। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এ অঞ্চলে সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর নয়। সেখানে দেশীয় আইন, ঐতিহ্য অনুযায়ী অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্পত্তি ও জমির হস্তান্তরও নিজস্ব নিয়মে চলে। সংবিধানের ৩৬৮ ধারার ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর ধারায় ৯টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও অন্ধ্র প্রদেশ রয়েছে সেই তালিকায়। ৩৭১-বি ধারায় কিংবা ২৪৪-এ ধারায় আসাম বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ৩৭১-ডি ও ই ধারায় অন্ধ্র প্রদেশে শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণসহ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ৩৭১-এইচ ধারা মতে অরুণাচল রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারেন কেন্দ্র থেকে নিযুক্ত রাজ্যপাল। সুতরাং যেসব অঞ্চল বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেগুলোর মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
এরই মধ্যে নাগাল্যান্ড, মিজোরামে বিক্ষোভ হয়েছে এবং স্থানীয় নেতারা কঠোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, জন্মু ও কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় অনেক রাজ্যেই এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি প্রকাশ্যে এসেছে। দার্জিলিংয়ে পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিমল গুরুং আত্মগোপনস্থল থেকে এক বার্তায় দার্জিলিংয়েও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এটা একটা অশনিসংকেত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এ ধরনের দাবি উঠতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কি শুধু ‘মিশন কাশ্মীর’ নিয়েই ক্ষান্ত থাকবে? নাকি অন্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সংবিধানে যে সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা খর্ব করারও উদ্যোগ নেবে? কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে জনঅসন্তোষ গড়ে উঠছে, তা যদি কেন্দ্র বিচেনায় নেয়, তাহলে সংবিধানে অন্যান্য ও পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলোর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংবিধানের রক্ষাকবচগুলো বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে ওই সিদ্ধান্ত মুসলমানবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, বরং ধর্মীয়ভাবে তারা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী।
চতুর্থত, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ বাতিল করে মোদি সরকার একটি বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এখন জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেবে। অর্থাৎ অন্য অঞ্চলের মানুষ এখন কাশ্মীরে গিয়ে বসবাস করবে, স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সেখানে সংসার পাতবে। এতে স্থানীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হবে, জন্ম হবে এক সংকর জাতির। মুসলমানদের একক কর্তৃত্ব ও ধর্মীয় প্রভাব এতে নষ্ট হবে। এ জন্যই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি সতর্ক করেছিলেন যে এই আইনের (৩৭০ ধারা) বিলোপ কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। পঞ্চমত, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হবে। লাদাখ এলাকাটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কৌশলগতভাবে এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। চীন মনে করে, ভারত এই আইন একতরফাভাবে সংশোধন করায় আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা চীনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কড়া মন্তব্য করেছে পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ভারতের বেআইনি সিদ্ধান্তে আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারতে ফের পুলওয়ামা হবে।’ অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার লেথপোরাতে পাকিস্তান সমর্থিত জইশ-ই-মোহাম্মদ জঙ্গিগোষ্ঠীর জনৈক সদস্যের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের রিজার্ভ ফোর্সের ৪০ সদস্য মারা গিয়েছিলেন। ইমরান খান এদিকেই দৃষ্টি দিলেন। ব্যাপক আত্মঘাতী ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে বলে তাঁর আশঙ্কা। আর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কাশ্মীরের জনগণের ‘স্বাধীনতা’ আন্দোলনের শুধু সমর্থনই না, যা যা করার দরকার, তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করবে। এটাও এক ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য ও পরোক্ষাভাবে জঙ্গিবাদকে সেখানে উৎসাহ জুগিয়ে থাকবে।
সরকারিভাবে পাকিস্তান ভারত কর্তৃক ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। ষষ্ঠত, ৩৭০ নম্বর ধারাটি বাতিল করায় আবদুল্লাহ পরিবার (ফারুক আবদুল্লাহ, ওমর আবদুল্লাহসহ) ও মুফতি পরিবারের (মুফতি মোহাম্মদ সাঈদ, মেহবুবা সাঈদ) কর্তৃত্ব তখন কমবে। এরা শুধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে। কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনীতিতে এই দুই-পরিবার সক্রিয় থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে এদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। সপ্তম, কাশ্মীরি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে গত তিন দশকে ৯৫ হাজার ২৩৮ জন কাশ্মীরিকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এই পরিসংখ্যান ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি থেকে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনেও ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনের আর অত্যাচারের খবর রয়েছে। বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। ভারত বড় শক্তি। অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারত এরই মধ্যে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায়। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত-পরবর্তী সেখানকার পরিস্থিতি ভারতের বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দেবে।
সুতরাং ‘মিশন কাশ্মীর’ বিজেপি সরকারের জন্য ‘কাল’ হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কাশ্মীরে অবিলম্বে বিধানসভার নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর স্ট্র্যাটেজিতে আছে আবদুল্লাহ ও মুফতি পরিবারের বাইরে তৃতীয় একটি শক্তিকে সেখানে ক্ষমতায় আনা। এতে তিনি কতটুকু সফল হবেন বলা মুশকিল। সেখানে বিজেপি আছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিজেপি মেহবুবা মুফতির (পিডিপি) অ্যালায়েন্স পার্টনার ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ওই অ্যালায়েন্স আর কাজ করবে না। মোদি-অমিত শাহ জুটি ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দিতে চাচ্ছেন। ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো এত দিন একটি ‘মডেল’ ছিল। এখন ভারতীয়করণের’ নামে সংখ্যালঘু তথা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ মোদি সরকারের ভূমিকাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল।
 kalerkantho
২০ আগস্ট, ২০১৯
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র

তারেক শামসুর রেহমান

লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com