মাত্র ১৬ বছর বয়স তাঁর। গ্রেটা থানবার্গ। ডেনমার্কের নাগরিক। গ্রেটা থানবার্গ এই মুহূর্তে একটি আলোচিত নাম। মাত্র ১৬ বছর বয়সী এই কিশোরী নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ‘ক্লাইমেট প্রটেস্ট’ মার্চ আয়োজন করে তিনি বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্বের সারিতে উঠে এসেছেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে দেখেছি শত শত মানুষের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মিছিল করতে। তাঁর আহ্বানে ১৮৫টি দেশের স্কুলছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এর কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এই জ্বালানি ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদ। মনে আছে, নিশ্চয়ই এই কিশোরী আগস্টে নিউ ইয়র্কের পরিবেশ সম্মেলনে যোগ দিতে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ১৫ দিনের এই সমুদ্রযাত্রাকে বলা হয়েছিল ‘Carbon Neutral Transatlantic Crossing’। একটি ছোট্ট ইয়টে করে তাঁর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াই আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে তিনি নিউ ইয়র্কে এসেছেন। এরপর এখান থেকে তিনি যাবেন চিলির সান্টিয়াগোতে, যোগ দেবেন COP25 সম্মেলনে।
বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের কারণে উষ্ণতা বাড়ছে, যা কিনা এরই মধ্যে বিপত্সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
Greta Maliza11 ইয়টে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেছেন সোলার পাওয়ার। তাঁর ইয়টে কোনো টয়লেট, কিচেন ও শাওয়ার ছিল না। সোলার পাওয়ার ব্যবহার করেছেন শুধু কমিউনিকেশনের জন্য। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার—বিশ্বের উষ্ণতা কমিয়ে আনা ও জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস) কমিয়ে আনার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা। গ্রেটা থানবার্গ (Greta Thunberg) যখন নিউ ইয়র্ক ক্লাইমেট শীর্ষ সম্মেলনে বলেন, ‘ You have stolen my dreams, and my childhood with your empty words’, তখন বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। একজন কিশোরী, যে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে এই আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন, যখন সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে বলেন, We will be watching you. This is all wrong. I should not be up here. I should be back in School, on the other side of the Ocean’, তখন হলভর্তি মানুষ তাঁকে করতালি দিয়ে তাঁর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। অশ্রুভেজা কণ্ঠে তাঁর দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায় যখন তিনি বলে ওঠেন, ‘How dare you.’ গ্রেটা বলতে ভোলেননি অর্থ এবং শুধু অর্থের কারণেই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
গ্রেটা থানবার্গ মিথ্যা বলননি। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, বিপণনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ-সম্পদ। সুতরাং তেল ও গ্যাস উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কম্পানিগুলো কোনো অবস্থায়ই চাইবে না তাদের উৎপাদনপ্রক্রিয়া বন্ধ হোক। তারা বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ করে। এই লবিস্টরা ওই সব কম্পানির পক্ষে কাজ করেন। সিরিয়াস পাঠকরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন, ‘‘Seven Sisters’-এর কথা। কারা এই সাত বোন? এই সাত বোন হচ্ছে সাতটি কম্পানি, যারা বিশ্বজুড়ে তেল উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এই সাতটি কম্পানি হচ্ছে— BP, Gulf Oil, Dutch Shell, Chevron, Exxon Mobil, Standard Oil, Texaco। এগুলো সবই বেসরকারি তেল কম্পানি। এসব কম্পানি বিশ্ব তেল রিজার্ভের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তেলের বড় রিজার্ভ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশ্ব রিজার্ভের ৪৯ শতাংশ। এরপর রয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ২০ শতাংশ। উত্তর আমেরিকায় আছে ১৩ শতাংশ, আফ্রিকায় ৮ শতাংশ, ইউরো-এশিয়া জোনে ৭ শতাংশ। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে যেখানে তেল রিজার্ভ রয়েছে, সেখানেই তৎপর হয়েছে এই সেভেন সিস্টার্স। তারা পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ককে তাদের ‘পে-রোলে’ ফেলে দয়। কোনো সরকারপ্রধান (যেমন—ইরানের মোসাদ্দেক) যদি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাঁদের সরিয়ে দিতেও তারা দ্বিধা বোধ করে না। মার্কিন প্রশাসনে, কংগ্রেসে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। বলা হয়, তাদের প্রভাবের কারণেই ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের উষ্ণতা রোধে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কপ-২১ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। কপ-২১-এ (প্যারিস) বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে বলে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ (১৭৪ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) রাজি হয়েছিল। বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলেই বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস পাবে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ দায়ী নয়। কিন্তু এসব দেশই বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
শিল্পোন্নত ১০টি দেশ বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ৬৭.৬ শতাংশ নিজেরা নিঃসরণ করে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন। দুঃখজনক হচ্ছে, কপ-২১-এ যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সারা বিশ্ব যেখানে এটা স্বীকার করে নিয়েছে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি দায়ী, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত সত্যকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে সাগর-মহাসাগরের জলরাশি।
World Meteorological Organization (সিড়)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে—কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতীতের চেয়ে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়সীমায় ২০ শতাংশ হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে যেখানে সাগরের জলসীমার উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩.২ মিলিমিটার, সেখানে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়সীমায় বেড়েছে পাঁচ মিলিমিটারের ওপর (এবিসি নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর)। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বারবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো আতঙ্কের মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে বড় রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তা পালন করছে না।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই যে বিশ্বের উষ্ণতা রোধে জাতিসংঘ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সুতরাং ভয়টা এখানেই। কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, তা কতটুকু আবেদন রাখতে পারবে? চলতি সংখ্যা ইকোনমিস্টের কাভার স্টোরি
‘The Climate Issue’ (২১ সেপ্টেম্বর)। এই প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কিভাবে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাময়িকীটি একটি তথ্য দিয়েছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। ব্যক্তি পর্যায়ে এর পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৩ গিগাটন, মধ্যপ্রাচ্যে ২.৭ গিগাটন, ইউরোপে ৪.৯ গিগাটন, চীনে ৯.৮ গিগাটন, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৫.১ গিগাটন, ভারতে ২.৫ গিগাটন ইত্যাদি (বিশ্বে গড় ৪.৬ গিগাটন, ২০১৭ সালের হিসাব)। বিকল্প জ্বালানির অভাব এবং না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। ‘নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা উপলব্ধি করেন। তাই তিনি যখন কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, তাঁর বিবেচনায় এটা ছিল। তবে এটা ঠিক, বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন, গবেষণা ইত্যাদির দিকে তিনি নজর দিতে পারতেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলো উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে ক্ষতি হবে, তা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সোলার বা বায়ু শক্তির প্রসার ঘটিয়ে তারা শক্তি বা জ্বালানির চাহিদা পূরণ করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশসহ সাগরপারের দেশগুলো? অনেক দেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে।
প্যারিস কপ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে উন্নত দেশগুলো পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়নশীল, বিশেষ করে সাগরপারের দেশগুলোকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি গত চার বছরেও। বলা ভালো, উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্ব জিডিপির ৭৫ শতাংশ আর তারা কার্বন নিঃসরণ করে ৬৭.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ এসব উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে (২০০৯) এসব উদ্বাস্তু মানুষকে Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এ দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশ জাতিসংঘে এ দাবি আবারও উত্থাপন করবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার দাবি জানাবে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টিও।
কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ খুব সাহস করেই কথা বলেছেন। তিনি তাঁর কৈশোর হারানোর কথা বলেছেন। তিনি স্কুলে যেতে চান, সে কথাও বলেছেন। এটা ঠিক, জাতিসংঘ একটা প্যানেল তৈরি করেছিল Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)| তাদের একাধিক প্রতিবেদনে আছে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও এর ভয়াবহতার কথা। কিন্তু জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারছে না জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। তারা সোলারসহ বিকল্প অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগটা অনেক কম। এককভাবে ডেনমার্ক কিংবা গ্রেটা থানবার্গ বিশ্বের উষ্ণতা কমাতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর সাহসী উচ্চারণ ‘How dare you’ নিশ্চয়ই অনেক তরুণকে উৎসাহ জোগাবে। একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। এই সচেতনতাই হাজারো গ্রেটা থানবার্গ তৈরি করবে এবং ধরিত্রীকে বাঁচাবে।
Daily Kalerkontho
29.09.2019