রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নাইন-ইলেভেনের আঠারো বছর পর

 
টুইন টাওয়ার হামলা
টুইন টাওয়ার হামলা। ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রে ‘নাইন-ইলেভেনের’ (২০০১) বিয়োগান্তক ঘটনার ১৮ বছর পার হয়েছে গত বুধবার। ওই ঘটনা পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ প্রথমবারের মতো জেনেছিল একটি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী- আল কায়দা ও তার নেতা ওসামা বিন লাদেনের নাম।
নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় ধ্বংস হয়েছিল নিউইয়র্কে অবস্থিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দুটি ভবন, যা ‘টুইন টাওয়ার’ নামে পরিচিত ছিল। সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছিল ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ১৯ জন জড়িত ছিল, যাদের প্রায় সবাই ছিল সৌদি, ইয়েমেনি ও মিসরের নাগরিক। মোট চারটি বিমান তারা হাইজ্যাক করেছিল, এর মধ্যে দুটি (আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট নং এএ১১ ও ইউনাইটেড এয়ার ফ্লাইট নং ১৭৫) নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয়েছিল।
এছাড়া একটি বিমান পেনসিলভেনিয়া স্টেট ও অপরটি ভার্জিনিয়া স্টেটে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বলা হয়, হোয়াইট হাউসে একটি বিমান বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। কিন্তু তা পেনসিলভেনিয়ায় ভেঙে পড়ে। টুইন টাওয়ারের ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৯৯৬ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে ২ হাজার ৭৫৩ জনের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু করা হয়েছিল। বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। টুইন টাওয়ার হামলায় ৪০ জন বাংলাদেশিও মারা গেছেন। এ হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রশ্নের জবাব আজও পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এসব প্রশ্ন ঘুরেফিরে বারবার আলোচিত হচ্ছে, যার জবাব আদৌ কোনোদিন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ষড়যন্ত্রকারীরা ৫ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এ অর্থ কারা সরবরাহ করেছিল? শুধু ওসামা বিন লাদেন একাই কি এ অর্থ দিয়েছিলেন? নাকি পর্দার অন্তরালে কোনো পক্ষ ওসামা বিন লাদেনকে ব্যবহার করেছিল? আক্রমণকারীরা (১৯ জন) সবাই ছিল মুসলমান। যে প্রশ্নগুলো অনেকে করার চেষ্টা করেন (Elias Davidsson-এর প্রবন্ধ ‘There is no evidence that Muslims committed the crime of 9/11', opednews.com, 10 January, 2008) তা হল, শুধু মুসলমানরাই কি টুইন টাওয়ার হামলা ও ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত ছিল? আসলেই কি আল কায়দা এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই হামলা চালিয়েছিল?
ওই ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পরিশোধ করেছিল ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের দাবিনামা। শুধু বিধ্বস্ত ভবন পরিষ্কার করতে ব্যয় হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। এসব পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হল এ কারণে যে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। যারাই এ কাজটি করে থাকুক না কেন, এর পেছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র। তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা আজও পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি অনেকের কাছেই।
যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন তারা বলার চেষ্টা করেন, টুইন টাওয়ারে হামলায় এতজন মানুষ মারা গেল, একজন ইহুদিও মারা গেল না কেন? এটা কি কাকতালীয়, না এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? নিউইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকার একদম শেষ প্রান্তে টুইন টাওয়ারটি অবস্থিত ছিল। সাবওয়ের এটাই ছিল সর্বশেষ স্টেশন। ওই এলাকা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় ও টুইন টাওয়ারে ছিল। এ এলাকায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অবস্থিত। আর সবাই এটা জানেন, ইহুদিরা এ এলাকার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তা সত্ত্বেও একজন ইহুদিও মারা যাবে না, এটা অনেকেই মানতে চান না।
ওই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে। সেই যুদ্ধ আজও চলছে। তৎকালীন আফগান তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছেন- এ অভিযোগ তুলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দেশটি দখল করে নেয়। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকে মারণাস্ত্র রয়েছে- এ অভিযোগ তুলে ইরাকও দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এর পরের ঘটনা লিবিয়া ও সিরিয়া। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ থেমে থাকেনি। এবং আল কায়দার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে জন্ম হয় (সিরিয়া ও ইরাক) ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) নামে ভয়ংকর এক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর। অব্যাহত মার্কিন ও রুশ বিমান হামলায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা সিরিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে বটে; কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকায়। মালি, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়ায় নতুন নতুন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা আল কায়দা কিংবা ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
প্রসঙ্গত বোকো হারাম (নাইজেরিয়া) ও আল শাবাবের (সোমালিয়া) নাম উল্লেখ করা যায়। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ায় ‘যুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছেন ১১ মিলিয়ন মানুষ। এর মাঝে ইরাকে ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৫০ লাখ, এমনকি সিরিয়াতেও মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ লাখ। প্রায় ১০ লাখ সিরীয় নাগরিক যুদ্ধের কারণে দেশান্তরিত হয়েছেন এবং তারা এখন জার্মানিতে বসবাস করছেন। যুদ্ধ এ দেশগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। একটি নতুন প্রজন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ যুদ্ধের শেষ কোথায়? খুব শিগগিরই এ যুদ্ধ শেষ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগান তালেবানদের সঙ্গে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, তখন গত ১১ সেপ্টেম্বর কাবুলে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে তালেবানরা। যদিও শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আফগান শান্তি আলোচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে চায়।
দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সেখানে যুদ্ধ চলছে। একসময় ন্যাটোর সেনাবাহিনী সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সেনা সেখানে এখনও আছে। কিন্তু আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল চলে গেছে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। একটা অংশ আবার নিয়ন্ত্রণ করে সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাত হওয়া ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। ইরাকে এই সেপ্টেম্বরে আশুরা মিছিলে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ৩১ জনকে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩১ আগস্ট সিরিয়ার ইদলিবে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার- গেল ১৮ বছরেও ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শেষ হয়নি। ফলে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ আদৌ শেষ হবে না!
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আজ বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। একসময় ইউরোপ ছিল স্থিতিশীল একটি এলাকা। কিন্তু সন্ত্রাসীরা আজ প্যারিস, ব্রাসেলস ও লন্ডনের মতো শহরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষদের হত্যা করছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বলতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদেরই বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে।
ইউরোপের অনেক দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিছু তরুণ জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল ‘যুদ্ধ’ করতে। এদের কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারলেও এরাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফিরে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আবার এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, ২০১৭ সালে আইএস জঙ্গিরা সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাত হলেও তারা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে একটা আশঙ্কা থেকেই গেছে যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ হবে না। তাহলে এর পরিণতি কী?
স্পষ্টতই আফগানিস্তানে তালেবানরা অনেক শক্তিশালী। আফগান সরকারের অস্তিত্ব শুধু কাবুলেই সীমাবদ্ধ। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সব সেনাসদস্যকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে কাবুলে আশরাফ গনি সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সেক্ষেত্রে তালেবানরা কি আবার ক্ষমতা দখল করবে? একসময় (১৯৯৪-২০০১) তো তারা ক্ষমতায় ছিল। তত্ত্বগতভাবে তালেবানরা যদি আবার কাবুলে ক্ষমতা দখল করে, তাহলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আফগানিস্তান কি আবারও প্রত্যক্ষ করবে সেই মধ্যযুগীয় শাসন? এ এলাকার শান্তি তথা স্থিতিশীলতার জন্য তা কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
আর ইরাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। সিরিয়ার ঘটনাবলিও তেমনই। আসাদ সরকার সেখানে ক্ষমতায় আছে বটে; কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। আর লিবিয়া কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার নেই।
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ গত ১৮ বছরের এই হল ইতিহাস। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে না, যতদিন পর্যন্ত না তাদের অস্ত্র ও অর্থের উৎস বন্ধ করা যায়। এটা তো স্পষ্ট এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে কোন্ কোন্ সূত্র থেকে সন্ত্রাসীরা অর্থ ও অস্ত্র পায়। এসব বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে সন্ত্রাসীদের মূলধারায় নিয়ে আসাও জরুরি। ইতিহাস শিক্ষা দেয়- নাইন-ইলেভেনের ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘৃণার রাজনীতির জন্ম হয়েছিল বিশ্বব্যাপী। সেই ‘ঘৃণার রাজনীতি’ ১৮ বছর পার হওয়ার পর আজও অব্যাহত রয়েছে।
Daily Jugantor
14.09.2019

0 comments:

Post a Comment