তিস্তা
লংমার্চ শেষ হয়েছে ২৩ এপ্রিল। ৩০ ঘণ্টার এ লংমার্চ ডেকেছিল বিএনপি।
নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই
লংমার্চের প্রাপ্তি কী? সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ লংমার্চকে ‘গাড়ি মার্চ’
হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এতে কোনো বাধা দেয়নি। অতীতে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে
পার্বত্য চট্টগ্রাম লংমার্চ যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন ওই লংমার্চে বাধা
দেয়া হয়েছিল। রাস্তায় এলোপাতাড়ি গাড়ি রেখে লংমার্চকে বাধাগ্রস্ত করা
হয়েছিল। এবার তিস্তার ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটি হয়নি। যদিও একটা অভিযোগ আছে,
তিস্তা লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের রংপুরে রাতে থাকার জন্য হোটেলে বাধা
সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এটি কখনও বড় হয়ে দেখা দেয়নি। মির্জা ফখরুল
তিস্তা হেলিপ্যাড পয়েন্টে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতাও করেছেন। তবে পার্থক্যটি
হল- এই লংমার্চে বেগম জিয়া ছিলেন অনুপস্থিত। এমনকি ১৯ দলের সিনিয়র নেতাদের
কাউকে দেখা যায়নি। তারপরও এ লংমার্চের গুরুত্ব একেবারে কম নয়। যখন তিস্তা
ব্যারাজ এলাকায় পানির পরিমাণ মাত্র ৫০০ কিউসেকে নেমে এসেছিল, তখনই বিএনপি এ
লংমার্চের আয়োজন করে।
বিএনপির এ লংমার্চ সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি ছিল না। এ মার্চের উদ্দেশ্য ছিল জনসম্পৃক্ত একটি বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ভারতের কাছে আমাদের ন্যায্য হিস্যার দাবি জানানো। এটা একটা ভালো দিক। এ লংমার্চ অতীতে, ১৯৭৬ সালের মে মাসে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ফারাক্কা লংমার্চের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বয়োবৃদ্ধ এ নেতা মৃত্যুর কিছুদিন আগে লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়ে রাজশাহীর কানসাটে গিয়েছিলেন। সেদিন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে সেদিনের ফারাক্কা লংমার্চের সঙ্গে আজকের তিস্তা লংমার্চের পার্থক্য রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার পরোক্ষভাবে ওই ফারাক্কা লংমার্চকে সমর্থন করেছিল। আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা তিস্তা লংমার্চের বিরোধিতা না করলেও তিস্তার পানি কমে যাওয়ার প্রশ্নে প্রচণ্ড নীরব।
তিস্তার লংমার্চকে কেন্দ্র করে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক. লংমার্চের শুরুর দিন হঠাৎ করেই তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ তিন হাজার কিউসেকের উপরে চলে আসে (যেখানে এর আগের দু’সপ্তাহে পাওয়া গিয়েছিল গড়ে ৫০০ কিউসেক)। লংমার্চের পর এ প্রবাহ কমে এসে দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০ কিউসেকে। এর অর্থ কী? উজানে বৃষ্টির কোনো খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব লংমার্চকারীদের খুশি করতেই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত? দুই. পানির প্রবাহ যখন বাড়ল, তখন সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি বলল, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে গেছে। যদিও আমরা কেউ জানলাম না সরকার কোথায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে! ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনেও (২০১৪) মনমোহন সিং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ভারতের নয়া সরকারই এ সিদ্ধান্তটি নেবে। তাহলে আমাদের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী এ ‘কূটনৈতিক তৎপরতার’ তথ্য কোথায় পেলেন? আর এখন যে পানির প্রবাহ আবার কমে গেল, এর ব্যাখ্যা তিনি কী দেবেন?
আমরা লক্ষ্য করছি, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা দরকষাকষিতে শক্তভাবে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারি না। সাম্প্রতিককালে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিমাত্রায় ভারতকেন্দ্রিক। ভারত আমাদের কোনো কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়, সে রকম কোনো কাজ আমরা করতে চাই না। এটা যে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং দেখা গেছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা কোনো ‘শক্ত’ অবস্থানে যেতে পারিনি। ভারত আমাদের ভূমি ব্যবহার করছে তথাকথিত ‘কানেকটিভিটির’ নামে। কিন্তু কোনো ‘ফি’ প্রদান করছে না। উপরন্তু নেপাল কিংবা ভুটানও এ সুবিধা পাচ্ছে না। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে (অরুনাচল থেকে বিহার) বিদ্যুৎ দেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত আদৌ কোনো শুল্ক বা ফি দেবে কি-না, এটা স্পষ্ট নয়। তিস্তার ক্ষেত্রেও তাই সরকার খুব প্রতিবাদী নয়। খুব কঠোর অবস্থানেও যায়নি সরকার। শুধু সরকারের কথা কেন বলি? এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিও তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে কোনো জোরালো অবস্থানে যায়নি। অথচ জাতীয় পার্টির একটা বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে উত্তরবঙ্গে। এরশাদ নিজে রংপুরের বাসিন্দা। সরকারের অংশীদার জাসদ কিংবা ওয়ার্কার্র্স পার্টিরও কোনো ভূমিকা নেই। তবে বাসদ ও সিপিবি আলাদাভাবে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে লংমার্চ করেছে।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। যেখানে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়ার কথা, সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। রোদে ওই শস্যও পুড়ে গেছে। পানির অভাবে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদনের ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে তেমনি বাড়ছে মরুকরণ প্রবণতা। উত্তরবঙ্গের মানুষ জানে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। ১৯৭২ সালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। মাঝখানে ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে ও ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। এ নদীর পানি বণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার ‘একগুঁয়েমি’র জন্য পানি বণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া বা না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার ‘নেতৃত্ব’ প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সংকটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি এতে করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকা বা না থাকাটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী পর্যন্ত এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কারণ সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ ‘যুক্তি ও ন্যায়ে’র ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে, যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকল।
তিস্তা লংমার্চ করে বিএনপি একটি জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় জনসভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন সম্ভব নয়।’ তারা এও জানিয়েছেন, ‘পানি ছাড়া ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়’ (যুগান্তর, ২৪ এপ্রিল)। স্পষ্টতই এটা ভারতীয় নেতাদের জন্য একটি মেসেজ। তবে ভয়টা হচ্ছে নয়াদিল্লিতে সরকার গঠনে মমতা যদি একটি ফ্যাক্টর হয়ে যান, তাহলে তিস্তা চুক্তি ঝুলে যাবে। মমতা এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে তা সেচ কাজে ব্যবহার করবেন। পানি সেখানকার রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। এখন দায়িত্বটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্র সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে। কারণ সিকিমও উজানে পানি প্রত্যাহার করে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এলাকায় ভারত ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ জায়গায় বাঁধ দিয়েছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমছে। এখন বাংলাদেশ যদি শুধু ভারতের দিকে তাকিয়ে থেকে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তির প্রত্যাশা করে, তাতে সময় ক্ষেপণ হবে মাত্র। ভারতকে চুক্তিতে বাধ্য করতে হলে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টির আন্তর্জাতিকরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার এখন এ কাজটি করবে কিনা, এটাই হচ্ছে আসল কথা। Daily JUGANTOR ২৯ এপ্রিল, ২০১৪
বিএনপির এ লংমার্চ সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি ছিল না। এ মার্চের উদ্দেশ্য ছিল জনসম্পৃক্ত একটি বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ভারতের কাছে আমাদের ন্যায্য হিস্যার দাবি জানানো। এটা একটা ভালো দিক। এ লংমার্চ অতীতে, ১৯৭৬ সালের মে মাসে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ফারাক্কা লংমার্চের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বয়োবৃদ্ধ এ নেতা মৃত্যুর কিছুদিন আগে লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়ে রাজশাহীর কানসাটে গিয়েছিলেন। সেদিন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে সেদিনের ফারাক্কা লংমার্চের সঙ্গে আজকের তিস্তা লংমার্চের পার্থক্য রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার পরোক্ষভাবে ওই ফারাক্কা লংমার্চকে সমর্থন করেছিল। আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা তিস্তা লংমার্চের বিরোধিতা না করলেও তিস্তার পানি কমে যাওয়ার প্রশ্নে প্রচণ্ড নীরব।
তিস্তার লংমার্চকে কেন্দ্র করে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক. লংমার্চের শুরুর দিন হঠাৎ করেই তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ তিন হাজার কিউসেকের উপরে চলে আসে (যেখানে এর আগের দু’সপ্তাহে পাওয়া গিয়েছিল গড়ে ৫০০ কিউসেক)। লংমার্চের পর এ প্রবাহ কমে এসে দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০ কিউসেকে। এর অর্থ কী? উজানে বৃষ্টির কোনো খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব লংমার্চকারীদের খুশি করতেই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত? দুই. পানির প্রবাহ যখন বাড়ল, তখন সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি বলল, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে গেছে। যদিও আমরা কেউ জানলাম না সরকার কোথায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে! ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনেও (২০১৪) মনমোহন সিং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ভারতের নয়া সরকারই এ সিদ্ধান্তটি নেবে। তাহলে আমাদের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী এ ‘কূটনৈতিক তৎপরতার’ তথ্য কোথায় পেলেন? আর এখন যে পানির প্রবাহ আবার কমে গেল, এর ব্যাখ্যা তিনি কী দেবেন?
আমরা লক্ষ্য করছি, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা দরকষাকষিতে শক্তভাবে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারি না। সাম্প্রতিককালে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিমাত্রায় ভারতকেন্দ্রিক। ভারত আমাদের কোনো কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়, সে রকম কোনো কাজ আমরা করতে চাই না। এটা যে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং দেখা গেছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা কোনো ‘শক্ত’ অবস্থানে যেতে পারিনি। ভারত আমাদের ভূমি ব্যবহার করছে তথাকথিত ‘কানেকটিভিটির’ নামে। কিন্তু কোনো ‘ফি’ প্রদান করছে না। উপরন্তু নেপাল কিংবা ভুটানও এ সুবিধা পাচ্ছে না। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে (অরুনাচল থেকে বিহার) বিদ্যুৎ দেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত আদৌ কোনো শুল্ক বা ফি দেবে কি-না, এটা স্পষ্ট নয়। তিস্তার ক্ষেত্রেও তাই সরকার খুব প্রতিবাদী নয়। খুব কঠোর অবস্থানেও যায়নি সরকার। শুধু সরকারের কথা কেন বলি? এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিও তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে কোনো জোরালো অবস্থানে যায়নি। অথচ জাতীয় পার্টির একটা বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে উত্তরবঙ্গে। এরশাদ নিজে রংপুরের বাসিন্দা। সরকারের অংশীদার জাসদ কিংবা ওয়ার্কার্র্স পার্টিরও কোনো ভূমিকা নেই। তবে বাসদ ও সিপিবি আলাদাভাবে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে লংমার্চ করেছে।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। যেখানে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়ার কথা, সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। রোদে ওই শস্যও পুড়ে গেছে। পানির অভাবে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদনের ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে তেমনি বাড়ছে মরুকরণ প্রবণতা। উত্তরবঙ্গের মানুষ জানে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। ১৯৭২ সালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। মাঝখানে ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে ও ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। এ নদীর পানি বণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার ‘একগুঁয়েমি’র জন্য পানি বণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া বা না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার ‘নেতৃত্ব’ প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সংকটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি এতে করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকা বা না থাকাটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী পর্যন্ত এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কারণ সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ ‘যুক্তি ও ন্যায়ে’র ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে, যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকল।
তিস্তা লংমার্চ করে বিএনপি একটি জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় জনসভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন সম্ভব নয়।’ তারা এও জানিয়েছেন, ‘পানি ছাড়া ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়’ (যুগান্তর, ২৪ এপ্রিল)। স্পষ্টতই এটা ভারতীয় নেতাদের জন্য একটি মেসেজ। তবে ভয়টা হচ্ছে নয়াদিল্লিতে সরকার গঠনে মমতা যদি একটি ফ্যাক্টর হয়ে যান, তাহলে তিস্তা চুক্তি ঝুলে যাবে। মমতা এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে তা সেচ কাজে ব্যবহার করবেন। পানি সেখানকার রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। এখন দায়িত্বটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্র সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে। কারণ সিকিমও উজানে পানি প্রত্যাহার করে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এলাকায় ভারত ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ জায়গায় বাঁধ দিয়েছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমছে। এখন বাংলাদেশ যদি শুধু ভারতের দিকে তাকিয়ে থেকে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তির প্রত্যাশা করে, তাতে সময় ক্ষেপণ হবে মাত্র। ভারতকে চুক্তিতে বাধ্য করতে হলে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টির আন্তর্জাতিকরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার এখন এ কাজটি করবে কিনা, এটাই হচ্ছে আসল কথা। Daily JUGANTOR ২৯ এপ্রিল, ২০১৪