রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

রোহিঙ্গা প্রশ্নে সক্রিয় কূটনীতিতে যেতে হবে


মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর একটি প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে- রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? দেশে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন নিয়ে যখন বড় ধরনের হতাশার জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই এলো এ প্রতিবেদনের খবরটি। এতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লায়িংসহ পাঁচজন জেনারেলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের পর (যাকে জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তারা ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ বলে চিহ্নিত করেছেন) গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
উল্লেখ করার মতো ঘটনা রয়েছে দুটি। এক. বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গত বছর নভেম্বরে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যাতে মিয়ানমার তার নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত নিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। দুই. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই প্রথমবারের মতো বিধ্বস্ত ও ধ্বংস্তূপে পরিণত হওয়া রাখাইনে হেলিকপ্টারযোগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী নিজ চোখে রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি দেখেছেন। তিনি ঢাকায় ফিরে এসে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন আশাবাদী হয়েছেন মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নেবে, এর এক সপ্তাহের মাথায় সিঙ্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে আসল মনোভাবটি প্রকাশ করে ফেলেছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তিনি রোহিঙ্গা পুনর্বাসন না হওয়ার জন্য বাংলাদেশেকে দায়ী করেছেন!
আমরা বারবার বলে আসছি, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের কূটনীতি অনেক দুর্বল। গত এক বছরে যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝাতে চেয়েছি, আমরা যেভাবে কূটনীতি পরিচালনা করছি, তাতে করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে।
আমি একাধিকবার বিভিন্ন টকশোতে বলেছি, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের ‘অবস্থানের’ কারণে মিয়ানমার আমাদের দুর্বল মনে করছে। আমি দীর্ঘ এক বছর বলতে চেয়েছি, রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে এবং এ গণহত্যার জন্য দেশটির শীর্ষ জেনারেলরা দায়ী। অলিখিত সরকারপ্রধান হিসেবে অং সান সু চিও এর দায় এড়াতে পারেন না। এদের সবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া উচিত। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন এক বছর পর সে কথাই বলল।
আমি বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হককে ধন্যবাদ জানাই সত্য কথা বলার জন্য। গত ২৭ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পরোক্ষভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনাই করেছেন। তিনি বলেছেন, উচ্চপর্যায়ে একাধিক বৈঠক করে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি চুক্তি করা হয়েছিল। অথচ এখনও কাউকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের লোকেরা এ ব্যাপারে আদৌ কোনো কাজ করছেন না বা করতে পেরেছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ‘অ্যাগ্রেসিভ’ ভূমিকা নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি (সমকাল, ২৮ আগস্ট)। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হয়।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান একটি ‘অ্যাগ্রেসিভ’ ভূমিকা নেয়ার কথা বলেছেন বটে; কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেননি এ ভূমিকা কী হওয়া উচিত। এটা সত্য, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ একটি ‘সফট অ্যাপ্রোচ’ নিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ কোনো শক্ত অবস্থানে যায়নি। যেখানে সারা বিশ্ব রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এ থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় ‘সুবিধা’ নিতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ তা পারেনি।
সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের পর এটা আরও স্পষ্ট হল যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারকে একরকম ‘সমীহ’ করেই চলছে! মিয়ানমারের দাবির কাছে বাংলাদেশ একরকম নতজানু হয়েছে! সংবাদপত্রে এমন একটি সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।
সেদিন এক টকশোতে (সময় টিভি) এক আলোচকও (যিনি সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বললেন, ১৯৭৮ সালের চুক্তিতেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিক’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল! তার যুক্তি, সেদিন যদি বাংলাদেশ এটা স্বীকার করে নেয়, তাহলে আজ স্বীকার করতে দোষ কোথায়? নিশ্চয়ই কোনো দোষ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭৮ সালে একটি চুক্তি হয়েছিল বটে; কিন্তু তখন কী লেখা হয়েছিল ওই চুক্তিনামায়? ‘বাস্তুচ্যুত নাগরিক’, না মিয়ানমারের নাগরিক?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪ সালে একটি ‘গোপন’ দলিল প্রকাশ করে (রোহিঙ্গা নাগরিকদের ১৯৭৮ সালের প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত), যেখানে মিয়ানমার সরকার উল্লেখ করেছিল, রোহিঙ্গারা আইনসিদ্ধভাবেই মিয়ানমারে থাকছেন। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। ফোর্বস (Forbes) ম্যাগাজিনে Anders Corr-এর লেখা 'Secret 1978 Document Indicates Burma Recognized Rohingya Legal Residence' শীর্ষক প্রবন্ধেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন সাবেক কূটনীতিক। পররাষ্ট্র সচিবও দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আছেন। তারা ভালো করে জানেন ১৯৭৮ সালের চুক্তিতেই মিয়ানমার (১৯৮৯ সাল থেকে বার্মার পরিবর্তে মিয়ানমার নামের ব্যবহার শুরু হয়) রোহিঙ্গাদের বৈধতা মেনে নিয়েছিল। ২৫ আগস্টের (২০১৭) পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিলে একাধিকবার দুই দেশের মাঝে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। একটি চুক্তিও হয়েছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ মিয়ানমার সফরে বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওই দাবিকে স্বীকৃতি দিল! কিন্তু তাতে করে কি মিয়ানমার এতটুকু নমনীয় হয়েছে? কিংবা মিয়ানমার কি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছে? মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের আর গ্রহণ করবে না, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের এক সপ্তাহের মাথায় সিঙ্গাপুরে অং সান সু চি সেটা জানিয়ে দিতে ভুল করেননি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী পদক্ষেপ নেব আগামীতে। বাংলাদেশ ‘প্রিভেনটিভ ডিপ্লোম্যাসি’ বা নিবারক কূটনীতিতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ সংঘর্ষ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ। তবে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ যে নানাবিধ সংকটের সম্মুখীন, তার সমাধানে বাংলাদেশকে ‘অ্যাক্টিভ ডিপ্লোম্যাসি’তে যেতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এখন একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে গণহত্যার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিয়ে যেতে। ইতিমধ্যেই আদালতের একজন কৌঁসুলি একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি কীভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) আইনের মাধ্যমে করা সম্ভব, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এ চুক্তিতে (রোম স্ট্যাটিউট) স্বাক্ষর করেনি, যার মাধ্যমে আইসিসির জন্ম।
বাংলাদেশসহ ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এতে স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমার এর আওতাভুক্ত নয়, কেননা দেশটি রোম স্ট্যাটিউটে স্বাক্ষর করেনি। সেক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অত সহজ হবে না। তবে মিয়ানমারকে ‘চাপে’ রাখার একটি কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে, যে ‘চাপে’ রাখার কথা জাতিসংঘের মহাসচিব বলে গিয়েছিলেন তার ঢাকা সফরের সময়।
প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে (২০১৮) নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাউকে কাউকে সম্ভাব্য একটি নিষেধাজ্ঞা (মিয়ানমারের বিরুদ্ধে) চেয়ে কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপনের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে শুনেছি। বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। কংগ্রেসে ‘বাংলাদেশ ককাস’ সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে। এজন্য ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
ইন্টারন্যাশনাল ইমপার্শিয়াল অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট মেকানিজম বা আইআইআইএমের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ আইআইআইএম সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর আওতায় যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের ভবিষ্যৎ বিচারের জন্য তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কর
মূলত ২০১১ সালের পর থেকে সিরিয়ায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব অপরাধকে বিবেচনায় নিয়েই আইআইআইএম গঠন করা হয়েছিল। যদিও এটি কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংগঠনটির চেয়ারপারসন হচ্ছেন ফ্রান্সের একজন সাবেক বিচারপতি মিস মার্চি উল। ইরাকে ইসলামিক স্টেট ও আল কায়দা যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, সে ব্যাপারে তিনি অনুসন্ধান এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে আইএস ও আল কায়দার নেতাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়।
যেহেতু জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল রাখাইনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মতামত দিয়েছে, সেহেতু রোহিঙ্গা প্রশ্নে আইআইআইএমকে এখন সক্রিয় করা যায়। জাতিসংঘের সদর দফতরে আইআইআইএমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে।
আরও একটি কথা। জাতিসংঘের ওই রিপোর্ট সামনে রেখে বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়ায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। ইতিমধ্যে, গত ২৮ আগস্ট, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিতর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথা বললেও নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
বিতর্কে আবারও চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বলেছেন, এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ দুই দেশের সমস্যা, দ্বিপাক্ষিকভাবেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত চীনা বক্তব্য সমর্থন করেন। সত্য হল, এটি এখন আর দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়- এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যখন একটি দেশের সাড়ে সাত লাখ নাগরিক (মোট প্রায় ১২ লাখ) নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং অন্য দেশে আশ্রয় নেয়, তখন তা আর দ্বিপাক্ষিক সমস্যা থাকে না।
বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কসোভো, রুয়ান্ডাতে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা-ও কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় আটকে থাকেনি। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই- আমরা চীন ও রাশিয়াকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, এটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়। নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু মনে করে রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে।
আমরা এ তিনটি দেশকে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা পারিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল এসব দেশ সফর করা। তিনি তা-ও করেননি। এখন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশনের রিপোর্ট আমাদের পক্ষে। গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের দাবি বাংলাদেশেরও করা উচিত। মনে রাখতে হবে, এ বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের বাংলাদেশে অবস্থান আমাদের নানা সংকটের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কেই এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
Daily Jugantor
01.09.2018

ইমরান খান পাকিস্তানকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন




গত ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এক সময়ের ক্রিকেটার ইমরান খান। গত প্রায় দুই সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তিনি পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? মন্ত্রীদের ১৪ ঘণ্টা কাজ করা ও বিদেশে কম যাওয়া ও চিকিৎসা না করা, বাসভবনকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা ও নিজে সামরিক সচিবের ৩ কক্ষের বাসায় থাকা, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত দুটি বুলেটপ্রুপ গাড়ি রেখে বাকি গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া, নিজে বেতন না নেওয়া, বিস্কুট ছাড়া কেবিনেট মিটিং করা ইত্যাদি সিদ্ধান্ত জনপ্রিয় হবে সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই কৃচ্ছ্রসাধন পাকিস্তানের অর্থনীতিকে সঠিক পথে আসতে আদৌ সাহায্য করবে কী? পাকিস্তানের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। এখন তিনি যে কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা জনপ্রিয় হবে। এটা সত্য, অতীতে সরকারগুলো এ দিকে দৃষ্টি দেয়নি। একটি পরিসংখ্যান আমরা পেয়েছি সংবাদপত্র থেকে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের শপথ অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছিল ৯২ লাখ রুপি, ২০০৮ সালে জারদারির অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছিল ৭৬ লাখ রুপি। আর ইমরান খানের শপথ অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার রুপি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য কর্মচারী ছিল ৫২৪ জন। তিনি এর মধ্যে রেখেছেন মাত্র ২১ জনকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য ছিল ৮০টি গাড়ি। এর মধ্যে ৩৬টি বুলেটপ্রুফ গাড়ির মধ্যে তিনি রেখেছেন মাত্র দুটি। বাকিগুলো নিলামে তোলা হবে।
এর মধ্যে ইমরান খানের আন্তরিকতা যতটুকু থাকুক না কেন তার রাজনীতি এখন আবর্তিত হচ্ছে কতগুলো বিষয়কে সামনে রেখে। যেমন বলা যেতে পারে, ভারতের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গী এখন কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার যে আস্থাহীনতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা কী তিনি ফিরিয়ে এনে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন? কিংবা আর্থিক সংকট মোকাবিলায় চীনের প্রতি তার নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে কিনা? বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের আগ্রহ থাকবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক আদৌ উন্নত হয় কিনা, তা দেখা।
ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম এজেন্ডা ভারত সম্পর্ক নিয়ে এখন নানা কথা হচ্ছে। ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদি যখন শপথ নেন, তখন ওই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তখন ধারণা করা হয়েছিল এর মধ্য দিয়ে পাক-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলবে! কিন্তু দেখা গেল উরির ঘটনা (২০১৬) দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটায়। ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু এবং কাশ্মীরের উরিতে অবস্থিত ভারতীয় সেনা ছাউনিতে পাকিস্তান সমর্থিত জয়েসই মোহাম্মদ নামক একটি গোষ্ঠী হামলা চালায়। তাতে চারজন আক্রমণকারীসহ ১৯ ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। ভারত এ ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। সেই থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে অবস্থান করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া ইমরান খান আদৌ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না? যদিও নয়া পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরাইশি বলেছেন, তিনি কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে যেতে চান। এসব মূলত কথার কথা, কূটনৈতিক ভাষা। ভারতে কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি সরকার ক্ষমতায়। ২০১৯ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচন। সেখানে বড় ধরনের পাকিস্তান বিরোধিতা রয়েছে। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে বরফ গলবে, এটা মনে হয় না। আরও একটা কথা। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ভারত ‘নাক’ গলাচ্ছেÑ এটা পাকিস্তানের অভিযোগ। বেলুচিস্তানে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, তার পেছনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে পাকিস্তান মনে করে। নির্বাচনের আগে ও পরে সেখানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- হয়েছে। এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে উদ্বিগ্ন এখন চীনও। কেননা চীনের ওবিওআর মহাপরিচালনার আওতায় উইগর থেকে গাওদার পর্যন্ত যে মহাসড়ক, যেখানে চীনা ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা কাজ করছেন, তাদের টার্গেট করে ওই সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- পরিচালিত হয়েছিল। চীন এখন সরাসরি বেলুচ লিবারেশন আর্মির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলছে, যারা ওই সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- চালিয়েছিল। পাকিস্তানের জন্য আরেকটি চিন্তার কারণ ভারত আফগানিস্তানে শাহতুত বাঁধ নির্মাণ করছে (আনন্দবাজার, ১৫ আগস্ট ২০১৫)। হিন্দুকুশ পবর্তের সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়ে একটি নদী, যার নাম কাবুল নদী আফগানিস্তানের জালালাবাদ হয়ে পাকিস্তানের সাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে প্রবেশ করেছে। শাহতুত বাঁধ নিয়ে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের যখন আলোচনা চলছিল, তখন পাকিস্তান সরকার আপত্তি জানিয়েছিল। পাকিস্তানের যুক্তি কাবুল নদীতে বাঁধ দেওয়া হলে তাদের দেশে পানির প্রবাহ কমে যাবে। পাকিস্তান আফগানিস্তানকে ‘চাপ’ দিচ্ছে দু-দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে একটি স্থায়ী চুক্তি করতে। কিন্তু আফগানিস্তানের সম্মতি তাতে পাওয়া যায়নি। আফগানিস্তানের বক্তব্য কাবুল নদীর অববাহিকায় ভবিষ্যতে জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পে বড় ধরনের সমস্যা হবে। কাবুলের বক্তব্য এই প্রকল্পটি রূপায়িত হলে কাবুলের ২০ লাখ মানুষের পানি সমস্যা মিটবে। পাশাপাশি চাহার আশিয়াব ও খাইরাবাদ এলাকার প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের ১৯৬০ সালে সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানেও এখন নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমাদের আগ্রহ বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে।
ইমরান খান একজন সাবেক ক্রিকেটার। এমনও শোনা যায় ১৯৭১ সালের মার্চে যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হয়, ওই মার্চে ইমরান খান ঢাকায় খেলতে এসেছিলেন। পরে গণহত্যা শুরু হলে তিনি করাচি চলে যান। এরপর দীর্ঘ সময় একজন পাকিস্তানি হিসেবে ওই গণহত্যার জন্য তিনি নিজে ক্ষমা চেয়েছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ রোধ করে তাকে মাফ করে দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া যায় (The Express Tribune, November 24th, 2015)। পাকিস্তান সংসদে এই ঘটনার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যেখানে পিটিআইর সদস্যরা (যারা এখন সরকার গঠন করেছে) উত্থাপিত (পিপিপি কর্তৃক) ওই প্রস্তাব সর্থন করেছিল। তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলেও পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ এই ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মবার্ষিকীতে ইসলামাবাদে জিওটিভির প্রধান নির্বাহী হামিদ মীরের নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হয়েছিল। তারা একটি ব্যানার বহন করছিল। ব্যানারে লেখা ছিল Dear Bangladeshi sorry for ‘71 genocide, from Pakistan media and Lawyers। পাকিস্তানে হামিদ মীরের বাবা ওয়ারিস মীর একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ছিলেন। তিনি এই গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছিলেন ওই সময়। কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও নিন্দা জানিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। ওই সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণপত্র দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় বাংলাদেশ হিনা রব্বানীর কাছে দুটি দাবি উত্থাপন করেÑ ১. ১৯৭১ সালে যেসব পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার করা, ২. পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া। সংগত কারণেই তাই প্রশ্নটি উঠেছে যে, ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন যে সরকার, সেই সরকার তাদের সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য আদৌ ক্ষমা চাইবে কিনা? এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য সেনাবাহিনী যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সেনাবাহিনীকে যারা চালিয়েছে। স্পষ্টতই তিনি ওই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি ও তার দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। এখন তার জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমা চাইবার। কিন্তু যে সেনাবাহিনী তাকে ‘পরিকল্পিতভাবে’ ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন, এটা মনে হয় না।
কতগুলো বিষয়কে সামনে রেখে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক আটকে আছে। এগুলো হচ্ছে : ১. পাকিস্তানের কাছে পাওনা টাকা আদায়, ২. বাংলাদেশে বসবাস করা পাকিস্তানি নাগরিকদের (বিহারি) পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানো, ৩. সন্ত্রাসী কর্মকা-ে মদদ দেওয়া, ৪. সার্ককে শক্তিশালী করা। ২০১৬ সালে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদে। কিন্তু উরির সন্ত্রাসবাদী ঘটনার (২০১৬) সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত, এই অভিযোগে ভারত সার্ক সম্মেলন বয়কট করলে, সার্কের প্রায় প্রতিটি দেশ ওই সম্মেলন বয়কট করেছিল। এরপর আর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ক সম্মেলনে যোগ না দিলেও (২০১৬), ১৯৯৭ সালে তিনি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া পাকিস্তান সফর করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর ফিরতি সফরে ১৯৯২ সালেও পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বেগম জিয়া। বলা ভালো, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) পাকিস্তানে গিয়েছিলেন (লাহোর) ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। গত ৪৪ বছরের যে ইতিহাস, তাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত উষ্ণ ছিল না। বেশ কিছু সমস্যা আছে, যা গত ৪৪ বছরেও সমাধান হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্লানিং কমিশন ২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের যুক্ত পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে এই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪৪ বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তান বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরানো টাইপের বোয়িং বিমান দিয়েছিল, যা যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় ছিল নগণ্য। ১৯৮০ সালে এ ব্যাপারে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হলেও, কমিটি সম্পদ ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বাংলাদেশে আটকেপড়া নাগরিকদের (বিহারি) নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তারও কোনো সমাধান হয়নি। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা, সেই সমস্যার সমাধানে ইমরান খানের সরকার কী উদ্যোগ নেয়, সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।
ইমরান খান দায়িত্ব নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।  কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে কিছু মেসেজ দিতে চান। কিন্তু পাহাড়সম সমস্যা নিয়ে তিনি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তার জন্য আগামী দিনগুলো খুব সুখের হবে বলে মনে হয় না।
Daily Alokito Bangladesh
26.08.2018

রোহিঙ্গা সমস্যা কি স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে?


৮ আগস্ট বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরের পর একটি প্রশ্ন নতুন করে আলোচনায় এসেছে, তা হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যাটি কি স্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে? কেননা ওই সফরের পর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে করে এ ধরনের একটি আশঙ্কারই জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই সফরে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। উপরন্তু একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা আমাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এমন একটি খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্রে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দটি বাদ দিতে সম্মত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির অফিসে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেয়াও তিন্ত সূর্যির মধ্যকার বৈঠকে এ সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় বলে রেডিও সাউথ এশিয়ার খবরে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আইডিতে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দের পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ শব্দটি বসাতে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মিয়ানমারের নাগরিক নয়’ শব্দটি ব্যবহার না করায় আমরা কি পরোক্ষভাবে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য সমর্থন করলাম না? মিয়ানমার তো প্রথম থেকেই বলে আসছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন! তাহলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরে আমাদের অর্জন কতটুকু? অর্জনের মাঝে শুধু এতটুকু আমরা দেখি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে হেলিকপ্টারযোগে রাখাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এতেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুশি। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, ‘অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ সফরটি বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। কারণ আগের সফরে মিয়ানমার সরকার সবকিছু কেমন যেন লুকাতে চাইত; কিন্তু এবার সড়কপথে ও হেলিকপ্টারযোগে তারা সবকিছু দেখাতে কার্পণ্য করেনি’ (মানবজমিন, ১৫ আগস্ট)। তিনি রাখাইন অঞ্চলের আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর দেখেছেন; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে এ সফর কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তা আমি বুঝতে অক্ষম। উপরন্তু অং সান সু চি সর্বশেষ যে মন্তব্যটি করেছেন, তা আমাদের আশাবাদী করে না। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরে একটি সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার জন্য বাংলাদেশ দায়ী! সু চি বলেছেন, মিয়ানমার শরণার্থীদের নিতে প্রস্তুত। তাদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গাও ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের পাঠানোর দায়িত্ব বাংলাদেশের। আমরা শুধু সীমান্তে তাদের স্বাগত জানাব। কত দ্রুত এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। বিবিসি এ খবর দিয়েছে (যুগান্তর, ২১ আগস্ট)। এর অর্থ পরিষ্কার, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পরপরই সু চি এ মন্তব্যটি করলেন। এটা যে কত বড় মিথ্যাচার, তা বিশ্ব জানে। বাংলাদেশ বারবার মিয়ানমারের নাগরিকদের ফেরত নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি নমনীয় অবস্থান নিলেও মিয়ানমারের মন গলাতে পারেনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ খুব শক্ত অবস্থানে গিয়েছে, এটা আমার মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পরবর্তী কার্যক্রম বলে দেয় বাংলাদেশ একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার কোনো কৌশল অবলম্বন করেনি। জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান একটি ঘৃণ্য অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইতিমধ্যে বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কঙ্গো, লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডাতে যারা জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত ছিলেন সেসব সেনা কর্মকর্তার বিচার হয়েছে। রায়ও দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ এদের বিচারের দাবি করতে পারত। তাহলে অন্তত মিয়ানমার সরকার একটা ‘চাপ’-এর মুখে থাকত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি ‘সফট ডিপ্লোমেসি’র আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও বাংলাদেশ কাছের প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ‘সাহায্য’ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করার ব্যাপারে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেষ অব্দি চীন স্বউদ্যোগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সেই প্রস্তাব অনুসরণ করেই মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু এ আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেবে না। হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাখাইনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা। এটি তারা খুব সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় ‘দুই পক্ষ মত দিয়েছে, প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু হওয়া উচিত। প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক।’ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে এ তথ্যটি আমরা জানতে পেরেছি (কালের কণ্ঠ, ১১ আগস্ট)। পাঠক লক্ষ করুন, মিয়ানমারের বক্তব্যে বলা হয়েছে প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক। প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গারা কি স্বেচ্ছায় যাবেন? তাদের কি নিরাপত্তা সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে? রোহিঙ্গারা যেখানে তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না, সেখানে তারা ফিরে যাবেন না। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে রাজি হয়েছেন, রোহিঙ্গাদের আইডিতে ‘মিয়ানমারের নাগরিকের’ পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ লিখতে হবে। রোহিঙ্গারা কি এটা লিখতে রাজি হবে? আমাদের ‘ডিপ্লোমেসি’ খুব শক্ত নয়। আমরা মিয়ানমারের সব কথাতেই রাজি হয়েছি। কিন্তু এতে করে সমস্যার সমাধান হবে না। নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে বিলম্ব করছে। আমরা চাই মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিক। এটা যত দ্রুত করা সম্ভব, তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল।
কিন্তু আমি মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডে আস্থা রাখতে পারছি না। এটা তাদের স্ট্র্যাটেজি, সময়ক্ষেপণ করা। তাই তারা করছে। সু চি নিজেই এর জন্য বাংলাদেশকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। বাংলাদেশ নাকি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করছে না! এটা এক ধরনের পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই না। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জাতিসংঘের মহাসচিব, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের নেতারা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ নিয়েও যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, তারা তার প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ভূমিকাকে সারা বিশ্ব প্রশংসা করেছে। সাময়িকভাবে বাংলাদেশ এত বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ স্পষ্ট করেছে মিয়ানমারের নাগরিকদের গ্রহণ করার দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। কিন্তু সু চি কী করে বলেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হচ্ছে না? বাংলাদেশের উচিত সু চির এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া। বাংলাদেশ ‘নিবারক কূটনীতি’ প্রয়োগ করেই মিয়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে চায়। সর্বশেষ ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিক’ হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকার করে নেয়ার পেছনেও এ স্ট্র্যাটেজি কাজ করে থাকতে পারে। মিয়ানমার আমাদের এ স্ট্র্যাটেজিকে আমাদের কোনো দুর্বলতা ভাবছে কিনা, সেটাই একটা প্রশ্ন এখন।
মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে বলে মনে হয় না। যে কারণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থাকলেও সুচির মতো নেত্রী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে খুশি করার জন্য অবাস্তব ও মিথ্যাচার করে চলেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে পথ একটাই, আর তা হচ্ছে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানো, যা কিনা জাতিসংঘের মহাসচিব তার বাংলাদেশ সফরের সময় বলে গেছেন। একইসঙ্গে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি তোলা। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একজন কৌশলী একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলাদা আলাদাভাবে চিঠিও দিয়েছেন। বাংলাদেশ ওই চিঠির জবাবও দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার জানিয়ে দিয়েছে তারা এ চিঠির জবাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। এ থেকেই বোঝা যায়, মিয়ানমার সরকার আদৌ আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। আমাদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে কয়েকজন শীর্ষ জেনারেলকে চিহ্নিত করেছে, যারা রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। ওইসব জেনারেলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এসব জেনারেলকে এখন আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত সহকারী মন্ত্রী সয়মান হেনশ ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক ধরনের বিকল্প নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। যখন যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র সেই পদক্ষেপ নেবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর শেষ করে তিনি ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করার প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কয়েকজন কংগ্রেসম্যান এখন কাজ করছেন। এটা একটা ভালো দিক। এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগ মিয়ানমারকে ‘চাপ’-এ রাখবে। বিল উত্থাপনের বিষয়টি মার্কিন আইনপ্রণেতাদের জন্য অত সহজ নয়। কিছু কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হয়তো এটা চাইবে না। কেননা মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ রয়েছে। তারা মিয়ানমারে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছেন। মিয়ানমারে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তা এ ঘটনায় ব্যাহত হতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুব ধীরগতিতেই এগোচ্ছে।
জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থের কারণে এগোচ্ছে অত্যন্ত শ্লথগতিতে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন কসোভোতে গণহত্যা বন্ধে ন্যাটো বাহিনী ১৯৯৯ সালের জুন মাসে সার্ব বাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছিল। সার্ব বাহিনী (সার্বিয়া) যখন সব ধরনের আলাপ-আলোচনা উপেক্ষা করে মুসলমান গণহত্যা অব্যাহত রেখেছিল, তখন এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো বাহিনীকে হামলার নির্দেশ দিয়েছিল। ন্যাটোর বিমান হামলার পরই ওই গণহত্যা বন্ধ হয়েছিল। এখন অবশ্য রাখাইনে সেই পরিস্থিতি নেই। পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার পর তারা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এখন মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে। কিন্তু সিঙ্গাপুরে দেয়া সু চির বক্তব্য ভিন্ন বার্তা দেয় আমাদের। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য নাকি জায়গাও ঠিক করা হয়েছে। তিনি অবশ্য রোহিঙ্গা শব্দটি বলেননি, বলেছেন রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিক। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা কেন? রোহিঙ্গারা ফিরে যাবেন তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে। কফি আনান কমিশনের রিপোর্টে সে কথাটাই বলা হয়েছে। সু চি নিজে এ কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু শক্ত কোনো ‘জনমত’ গড়ে তুলতে পারেনি। তাই একটা আশঙ্কার জন্ম হয়েছে, মিয়ানমার সময়ক্ষেপণ করার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা একটা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে বলেই আমাদের ধারণা। নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Daily Jugantor
25.08.2018

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলই


২৩ নভেম্বর (২০১৭) বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং ১৯ ডিসেম্বর দেশ দুটি একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করার ৮ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফিরে যায়নি। ফলে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা কি আদৌ তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবেন? এরই মধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প দেখে গেছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরাও মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল সফর করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু ফলাফল কী? মিয়ানমারের নেতাদের মানসিকতায় তো আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। ‘সময়ক্ষেপণ’ করার যে স্ট্র্যাটেজি তারা গ্রহণ করেছেন, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ থাকা সত্ত্বেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ৮ আগস্ট মিয়ানমার সফরে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী। সঙ্গে নিয়ে যান জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের ১৪ সদস্যকে। ১০ আগস্ট তাদের রাখাইন অঞ্চল হেলিকপ্টারযোগে ঘুরে দেখানো হয়। ১২ আগস্ট তারা জানান, ‘অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে এ সফরটি বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। কারণ আগের সফরে মিয়ানমার সরকার সবকিছু কেমন যেন লুকাতে চাইত; কিন্তু এবার সড়কপথে ও হেলিকপ্টারযোগে তারা সবকিছু দেখাতে কার্পণ্য করেনি।’ (মানবজমিন, ১৫ আগস্ট)। কিন্তু যা আমাকে একটু দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্রে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দটি বাদ দিতে ঢাকার সম্মতি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের সময় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র অফিসে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেয়াও তিন্ত সুযির মধ্যকার বৈঠকে এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় বলে রেডিও সাউথ এশিয়ার খবরে বলা হয়েছে। (শীর্ষ নিউজ, ১৪ আগস্ট)। রোহিঙ্গাদের আইডিতে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ শব্দের পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ শব্দটি বসাতে বাংলাদেশ রাজি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতকিছু করেও কি মিয়ানমার রাজি হবে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে? উপরন্তু ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ নয় শব্দটি ব্যবহার না করায় আমরা কি পরোক্ষভাবে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যই সমর্থন করলাম না? মিয়ানমার তো প্রথম থেকেই বলে আসছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন! অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মিয়ানমার এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেনি। এ নিয়ে দুই দেশের মাঝে একাধিক বৈঠক হলেও তা কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিছু রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিয়ে গেছে; কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা নিবন্ধিত নয়, তারা বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে গিয়েছিল। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দিয়ে নিঃসন্দেহে মানবতার পরিচয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের এই ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা জরুরি ছিল। বাংলাদেশ সেটা করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারে! সুতরাং মিয়ানমার সরকারের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে, এটা আমরা বলতে পারি না। তাদের কোনো কার্যকলাপে তা প্রমাণিত হয় না। সেজন্য একটা আশঙ্কা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে যে, মিয়ানমার তথাকথিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কালক্ষেপণ করছে। এই কালক্ষেপণের স্ট্র্যাটেজি তাদের অনেক পুরানো। এবারও এমনটি হতে যাচ্ছে। ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন অবধি শুরু হয়নি। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর ১২ মাস পার হয়েছে। এই ১২ মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তুরস্কের ফার্স্টলেডি, পোপ ফ্যান্সিস, মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দলসহ একাধিক ব্রিটিশ মন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরে যাবেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চাপে শেষ অব্দি গেল এপ্রিলে একজন মিয়ানমারের মন্ত্রীও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। আর এরই মাঝে ঘুরে গেছেন তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা ঢাকায় এসে রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইআরসি’র প্রেসিডেন্ট যখন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরার কোনো পরিবেশ নেই, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, মিয়ানমারের আসল উদ্দেশ্যটা কী। তারা কালক্ষেপণ করছে এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বিভ্রান্ত করছে। এখন জাতিসংঘের মহাসচিব বলছেন, ‘চাপ’ প্রয়োগের কথা। কিন্তু এই ‘চাপ’ প্রয়োগ কীভাবে হবে? নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না। কেননা চীন ও রাশিয়ার সমর্থন তাতে পাওয়া যাবে না। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যাবে না। বাস্তবতা এটাই। কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কনসার্নকে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে শরণার্থী সংক্রান্ত একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, যা ‘বালি প্রসেস’ নামে পরিচিত। ৪৮ দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে এ ‘বালি প্রসেস’ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আরও সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের আহ্বানে কি আদৌ কোনো কাজ হবে? মিয়ানমার সরকার এ ধরনের আহ্বানকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয় না। মিয়ানমার যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগকে কোনো গুরুত্বই দেয় না, তার একটি বড় প্রমাণ গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের যে উদ্যোগ জনৈক কৌঁসুলি নিয়েছিলেন, মিয়ানমার তা খারিজ করে দিয়েছে। আইসিসির কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি মিয়ানমার ও একই সঙ্গে বাংলাদেশের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। আইসিসি ২৭ জুলাই মিয়ানমারকে জবাব দেওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ তার জবাব দিলেও মিয়ানমার আইসিসিকে জানিয়ে দিয়েছিল, তারা জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। এ থেকেই বোঝা যায়, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে কোনো গুরুত্বই দেয় না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ খুব শক্ত অবস্থানে গিয়েছেÑ এটা আমার মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পরবর্তী কার্যক্রম বলে দেয়, বাংলাদেশ একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল! কিন্তু মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার কোনো কৌশল অবলম্বন করেনি। জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান একটি ঘৃণিত অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এরই মধ্যে বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কঙ্গো, লাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডাতে যারা জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত ছিলেন, সেসব সেনা কর্মকর্তার বিচার হয়েছে। রায়ও দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ এদের বিচারের দাবি করতে পারত। তাহলে অন্তত মিয়ানমার সরকার একটা ‘চাপ’ এর মুখে থাকত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি ‘সফট ডিপ্লোম্যাসি’র আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্টে (২০১৭) রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ‘সাহায্য’ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করার ব্যাপারে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেষ অবধি চীন নিজ উদ্যোগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সেই প্রস্তাব অনুসরণ করেই মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু এ আলোচনা আদৌ কোনো ফল দেবে না। হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাখাইনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা। এটি তারা খুব সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগস্টের (২০১৮) মিয়ানমার সফরের সময় ‘দুই পক্ষ মত দিয়েছে, প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু হওয়া উচিত। প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক।’ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে এ তথ্যটি আমরা জানতে পেরেছি। (কালের কণ্ঠ, ১১ আগস্ট)। পাঠক লক্ষ করুন, ‘মিয়ানমারের বক্তব্যে বলা হয়েছে, প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক।’ প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গারা কি স্বেচ্ছায় যাবেন? তাদের কি নিরাপত্তা সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে? রোহিঙ্গারা যেখানে তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না, সেখানে তারা ফিরে যাবেন না। উপরন্তু তাদের নিরাপত্তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে রাজি হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের আইডিতে মিয়ানমারের নাগরিকের পরিবর্তে ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ লিখতে হবে। রোহিঙ্গারা কি এটা লিখতে রাজি হবে? আমাদের ‘ডিপ্লোম্যাসি’ খুব শক্ত নয়। আমরা মিয়ানমারের সব কথাতেই রাজি হয়েছি। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হবে না। নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে বিলম্ব করবে। আমরা চাই, মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নিক। এটা যত দ্রুত করা সম্ভব, তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল।
Daily Alokito Bangladesh
19.08.2018

ইমরান খানের শাসনামলে কেমন হবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক


গতকাল ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ইমরান খান। সংগত কারণেই একটি প্রশ্ন এখন উঠবে, তাঁর শাসনামলে কেমন হবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক? সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রধান ইস্যু বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, আর তা হচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল সে ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের ক্ষমা চাওয়া। বাংলাদেশ সরকার তথা সুধীসমাজের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলেও পাকিস্তান এ কাজ করেনি। এখন ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি কি বাংলাদেশের জনগণ তথা সরকারের কাছে ক্ষমা চাইবেন? অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী কি চাইবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাক! নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্ন এখন আলোচিত হবে।
ইমরান খান একজন সাবেক ক্রিকেটার। এমনও শোনা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হয়, ওই মার্চে ইমরান খান ঢাকায় খেলতে এসেছিলেন। পরে গণহত্যা শুরু হলে তিনি করাচি চলে যান। এরপর দীর্ঘ সময় একজন পাকিস্তানি হিসেবে ওই গণহত্যার জন্য তিনি নিজে ক্ষমা চেয়েছেন—এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ রোধ করে তাঁকে মাফ করে দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়  (The Express Tribune, November 24th, 2015)। পাকিস্তান সংসদে এ ঘটনার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যেখানে পিটিআইয়ের সদস্যরা (যাঁরা এখন সরকার গঠন করেছেন) উত্থাপিত (পিপিপি কর্তৃক) ওই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের রাজনীতিকরা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলেও পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ এই ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে ছিল। ২০০৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মবার্ষিকীতে ইসলামাবাদে জিওটিভির প্রধান নির্বাহী হামিদ মিরের নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হয়েছিল। তারা একটি ব্যানার বহন করছিল। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘Dear Bangladeshi’s sorry for 71th genocide from Pakistan media and Lawyers’. পাকিস্তানে হামিদ মিরের বাবা ওয়ারিস মির একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ছিলেন। তিনি এ গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছিলেন ওই সময়। কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও নিন্দা জানিয়েছিলেন। ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। ওই সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণপত্র দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় বাংলাদেশ হিনা রব্বানির কাছে দুটি দাবি উত্থাপন করে। ১. ১৯৭১ সালে যেসব পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার করা; ২. পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া। সংগত কারণেই তাই প্রশ্নটি উঠেছে যে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন যে সরকার, সেই সরকার তাদের সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য আদৌ ক্ষমা চাইবে কি না? এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য সেনাবাহিনী যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী সেনাবাহিনীকে যারা চালিয়েছে। স্পষ্টতই তিনি ওই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার পরও তিনি ও তাঁর দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। এখন তাঁর জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমা চাওয়ার। কিন্তু যে সেনাবাহিনী তাঁকে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন, এটা মনে হয় না।
কতগুলো বিষয় সামনে রেখে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক আটকে আছে। এগুলো হচ্ছে—১. পাকিস্তানের কাছে পাওনা টাকা আদায়; ২. বাংলাদেশে বসবাস করা পাকিস্তানি নাগরিকদের (বিহারি) পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানো; ৩. সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ না দেওয়া; ৪. সার্ককে শক্তিশালী করা। ২০১৬ সালে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদে। কিন্তু উরির সন্ত্রাসবাদী ঘটনার (২০১৬) সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত—এই অভিযোগে ভারত সার্ক সম্মেলন বয়কট করলে সার্কের প্রায় প্রতিটি দেশ ওই সম্মেলন বয়কট করেছিল। এরপর আর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ক সম্মেলনে যোগ না দিলেও (২০১৬) ১৯৯৭ সালে তিনি ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তান সফর করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর ফিরতি সফরে ১৯৯২ সালেও পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বেগম জিয়া। বলা ভালো, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) পাকিস্তানে গিয়েছিলেন (লাহোর) ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। গত ৪৪ বছরের যে ইতিহাস তাতে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এত উষ্ণ ছিল না। বেশ কিছু সমস্যা আছে, যা গত ৪৪ বছরেও সমাধান হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্ল্যানিং কমিশন দুই হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের যুক্ত পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে এই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪৪ বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তান বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরনো টাইপের বোয়িং বিমান দিয়েছিল, যা যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় ছিল নগণ্য। ১৯৮০ সালে এ ব্যাপারে একটি আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হলেও কমিটি সম্পদ ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় পাকিস্তান নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একটি কাউন্সিল গঠন করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বেনজির ভুট্টোর উপদেষ্টাদের বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ওই অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। একটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারের স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পাওনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংস্থাকে পরিশোধ করেছে।
বাংলাদেশে আটকে পড়া ওই সময়কার আড়াই লাখ পাকিস্তানি নাগরিকের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জটিলতা আজও দূর হয়নি। ওই সব পাকিস্তানির সংখ্যা আজ বেড়ে ২০ লাখ বা তার বেশি এখন। ওই সব নাগরিকের প্রায় সবাই পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়। একসময় সৌদি আরবভিত্তিক ইসলামিক সাহায্য সংস্থা রাবিতা আল ইসলাম আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারেও অগ্রগতি হয়েছে কম। ১৯৯২ সালের জুন মাসে প্রত্যাবাসনের কিছু কাজ শুরু হয়েছিল এবং কিছু নাগরিক পাকিস্তানে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু তা থেমে গেছে। এসব নাগরিক পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রয়াত বেনজির ভুট্টো তাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং পাকিস্তান তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিল। পারভেজ মোশাররফ কিংবা পরবর্তী সময়ে নওয়াজ শরিফের শাসনামলে এ পাকিস্তানি নাগরিকদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ পাকিস্তানি নাগরিকরা, যারা ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের করাচিতে চলে গিয়েছিল (যারা মুহাজির হিসেবে সেখানে পরিচিত) তারা খোদ পাকিস্তানের জন্য একটি সমস্যা তৈরি করছে। মুহাজিরদের পক্ষ থেকে করাচি ও হায়দরাবাদ শহরকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবিও উঠেছে! করাচি মূলত এদের নিয়ন্ত্রণে। এরা মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করে। এমকিউএম এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ নির্বাচন বর্জন করেছে; অন্য ভাগ ইমরান খানের সরকারে যোগ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে যারা আছে, পাকিস্তান তাদের ফেরত নেবে—এটা আমার মনে হয় না। তবে বাংলাদেশকে তাদের দাবি অব্যাহত রাখতে হবে।
এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে পাকিস্তান কোনো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে সাহায্য ও সমর্থন করছে। লস্কর-ই-তৈয়বা ও এর নেতা হাফিজ সাইদ জাতিসংঘ কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত ও নিষিদ্ধ। কিন্তু হাফিজ সাইদ ও তাঁর দলকে এবার পাকিস্তানের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল; যদিও তারা ভালো করেনি এবং একটি আসনেও বিজয়ী হয়নি। কিন্তু হাফিজ সাইদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি নয়া সরকারের জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। পাকিস্তান যত দিন পর্যন্ত না নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবে তত দিন পর্যন্ত সার্কভুক্ত দেশগুলোর আস্থা পাকিস্তান নিশ্চিত করতে পারবে না। ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, তিনি তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন। তাঁর শাসনামলে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা শক্তিশালী হবে। এতে  দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ হচ্ছে পাকিস্তানের অষ্টম বাজার। বাংলাদেশ পাকিস্তানে রপ্তানি করে কম, আমদানি করে বেশি। ২০০৯-১০ সালে রপ্তানি-আমদানির রেশিও ছিল ১ঃ৪, অর্থাৎ চার গুণ বেশি পণ্য আমরা আমদানি করতাম (৭৭.৬৭ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি, ৩২৩.৭ মিলিয়ন ডলার আমদানি)। ২০১৫-১৬ সালে এই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ গুণে, অর্থাৎ ওই সময় রপ্তানি করা হয় ৪৭.০৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ আমদানি করা হয় ৫০৭.৪৬৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এক ‘নতুন পাকিস্তানের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইমরান খান। একজন ক্রিকেটার হিসেবে তিনি বাংলাদেশে জনপ্রিয়। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সেই ‘জনপ্রিয়তা’ ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক্ষমা চান, তাতে সম্পর্ক উন্নতি হতে পারে। সেনাবাহিনীর ‘চাপ’ উপেক্ষা করে তিনি এ কাজ করবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Daily Kalerkontho
19.08.2018

ইমরান খানের ‘দ্বিতীয় ইনিংস’


পাকিস্তানের ১৯তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আজ ১৮ আগস্ট শপথ নেবেন সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে (১৯৪৭-১৯৫১) সর্বশেষ শহীদ খাকান আব্বাসী (২০১৭-২০১৮) পর্যন্ত ১৮ জন প্রধানমন্ত্রী দেশটি শাসন করেছেন। এই কাতারে এখন যোগ হল ইমরান খানের নাম। তার পুরো নাম ইমরান আহমাদ খান নিয়াজী। কিন্তু নিয়াজী পদবি তিনি কখনোই ব্যবহার করেননি।
পাখতুন (পাঠান) পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কখনোই পাকিস্তানের পাখতুন এলাকায় (পাখতুনখোয়া প্রদেশ) বসবাস করেননি। লাহোরে জন্ম নেয়া এই ক্রিকেটার ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বেই পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বিশ্বকাপ জয়লাভ করে। আর এখন তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন ‘ইনিংসের’ সূচনা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তার ‘দ্বিতীয় ইনিংস’ নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কেমন হবে পাকিস্তান?
পাকিস্তানের রাজনীতি বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করেছে ভূস্বামী তথা জমিদাররা। পরে আশির দশকে বড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সিন্ধুর জমিদার আর পাঞ্জাবের ধনী ব্যবসায়ীদের হাতেই ছিল রাজনীতির চাবিকাঠি। পাকিস্তানি রাজনীতিতে এই পাঞ্জাবি প্রভাব সেখানে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
পাঞ্জাবের রাজনীতিকরাই যে শুধু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তা নয়, এমনকি সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণ করত পাঞ্জাবি জেনারেলরা। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া পাঞ্জাবের জাট পরিবারের সন্তান হলেও তার জন্ম করাচিতে। একজন পাঞ্জাবি জেনারেলকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নিলেও ওই সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বেই তিনি ক্ষমতা হারিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থে তিনি আঘাত করেছিলেন, যা ছিল তার ক্ষমতা হারানোর অন্যতম কারণ। সেদিন পাঞ্জাবি জেনারেল বাজওয়া পাঞ্জাবি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পক্ষে দাঁড়াননি। পাঞ্জাবি প্রভাবাধীন রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর বাইরে ইমরান খান কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? ইমরান খান একজন পাঠান, কিন্তু তিনি কি পাঞ্জাবি স্বার্থ উপেক্ষা করতে পারবেন? এটা সত্য যে, পাঞ্জাবি এলিটদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
অনেক পর্যবেক্ষকই বলার চেষ্টা করছেন যে, দুই পরিবারের (ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ) বাইরে সেনাবাহিনী চেয়েছে এমন একজন ব্যক্তিকে যার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আছে। ইমরান খান এ কারণেই ছিলেন তাদের পছন্দের তালিকায়। পর্দার অন্তরালে থেকেই তাকে সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল।
প্লেবয় ইমেজের মানুষ ইমরান খান নিজেকে বদলে ফেলেছিলেন। ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এ সবই তিনি করেছিলেন ‘বিশেষ গোষ্ঠীর’ স্বার্থে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই- পাকিস্তানি সমাজের উপযোগী করে নিজেকে তৈরি করা। ধর্ম যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর, এটা ইমরান খান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই একপর্যায়ে তিনি ধর্মীয় নেতা তথা পীরদের শরণাপন্ন হন।
এ কথা পাকিস্তানে বহুল প্রচলিত যে, এই ধর্মীয় গুরুরাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিল নারী পীর বুশরা মানিকাকে বিয়ে করার। পাঁচ সন্তানের জননী বুশরা মানিকা ছিলেন তার ধর্মীয় উপদেষ্টা। এমন কথাও শোনা যায়, বুশরা নাকি ইমরান খানকে বলেছিলেন, তিনি যদি তাকে বিয়ে করেন তাহলে তিনি অর্থাৎ ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলা মুশকিল।
তবে চলতি বছরই তার দলের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছিল, ইমরান বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেছেন। বুশরার বোরকা পরা ছবি (সম্ভবত পারিবারিক বিয়ে), যেখানে ইমরানও আছেন, এমন একটি ছবি ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়। কোনো কোনো সংবাদে আমি এমনটাও দেখেছি যে, ইমরানকে বিয়ে করার জন্য বুশরা মানিকা তার স্বামীকে তালাক পর্যন্ত দিয়েছিলেন!
ইমরান খানের জীবন কখনোই ধর্মসম্মত ছিল না। ১৯৯৫ সালে তিনি একজন ইহুদি ব্যবসায়ীর কন্যা জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেছিলেন। তখন ইমরানের বয়স ৪৩, আর জেমিমার মাত্র ২১। এ বিয়ে টেকেনি।
২০০৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি বিয়ে করেন ব্রিটিশ পাকিস্তানি সাংবাদিক রেহাম খানকে। এ বিয়েও টেনেকি। রেহাম সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি ইমরান খানের নানা অপকর্ম, বিশেষ করে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার একাধিক সন্তান রয়েছে বলেও জানান রেহাম। এরপর ইমরান যখন বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেন, তখন নানা কথাবার্তা আকাশে-বাতাসে ভাসতে থাকে।
ইমরান খানের যে ব্যক্তি ইমেজ, তার সঙ্গে বুশরা মানিকার ব্যক্তি ইমেজ মেলে না। বুশরা একজন পীর, তার অসংখ্য মুরিদ আছে। সেই পীর ইমরানের স্ত্রী এটা কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু তার দল পিটিআই যখন এই বিয়ের কথা স্বীকার করে (ডন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮), তখন এ নিয়ে আর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই ‘ধর্মীয় জীবন’ কি তাকে ক্ষমতায় থাকার আদৌ কোনো নিশ্চয়তা দেয়? ‘ডিপ স্টেট’ (সেনাবাহিনী, আমলা ও বিচার বিভাগ) তাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু কতদিনের জন্য?
অতীতে দেখা গেছে, বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ তিন তিনবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও ‘ডিপ স্টেটের’ ষড়যন্ত্রের কারণে তারা বারবার ক্ষমতা হারিয়েছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ‘ডিপ স্টেটের’ নিজেদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা বাহ্যত আজও বজায় রয়েছে। তবে স্ট্র্যাটেজিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে।
বলা হয়, ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানে একটি সীমিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল। ১৯৮৮ সালেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ‘ডিপ স্টেট’ কখনোই সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। ফলে ১৯৯০ সালে বেনজির ভুট্টো অপসারিত হয়েছিলেন। ‘ডিপ স্টেটের’ প্রতিনিধি প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান শুধু বেনজির ভুট্টোকেই অপসারণ করেননি, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সরকারকেও বরখাস্ত করেছিলেন (১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল) ২৯ মাসের মধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য পাকিস্তানের রাজননৈতিক সংস্কৃতির!
১৯৯৩ সালের ৬ অক্টোবর বেনজির ভুট্টো বিজয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করছিলেন বটে; কিন্তু ওই ‘ডিপ স্টেটই’ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে। মজার ব্যাপার হল, যে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তিনি অপসারিত হয়েছিলেন, সেই ফারুক লেঘারি বেনজির ভুট্টো কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন। পিপিপির টিকিটে তিনি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। এখানে ‘ডিপ স্টেটের’ স্বার্থটাই ছিল বড়।
এরপর নওয়াজ শরিফ যখন আবার ক্ষমতাসীন হন (দ্বিতীয়বার ১৯৯৭), সেবারও ‘ডিপ স্টেট’ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে (১৯৯৯)। তবে পার্থক্য হল, সেনাবাহিনী জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে এবার সরাসরি ক্ষমতা দখল করে। তিনি দল গঠন করেন (মুসলিম লীগ-কয়েদে আজম)। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য দু’জন প্রধানমন্ত্রী (জাফরুল্লাহ খান জামালী ও চৌধুরী সুজাত হোসেন) দায়িত্ব পালন করলেও শওকত আজিজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার টার্ম পূরণ করেন (২০০৭)। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি, যিনি তার টার্ম পূরণ করতে পেরেছিলেন। কারণ তার পেছনে সেনাবাহিনী তথা ‘ডিপ স্টেটের’ সমর্থন ছিল।
নওয়াজ শরিফের মতো বেনজির ভুট্টোও ‘ডিপ স্টেটের’ সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনিও কখনও তার টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে তিনি কথিত তালেবানদের আত্মঘাতী হামলায় মারা যান। এই মৃত্যুরহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে তার মৃত্যু তার দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। কিন্তু নির্বাচিত দু’জন প্রধানমন্ত্রীই (ইউসুফ রাজা জিলানী ও রাজা পারভেজ আশরাফ) ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ‘ডিপ স্টেটের’ আস্থা তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
আদালত অবমাননার অভিযোগে দু’জনই অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে আদালত কর্তৃক নওয়াজ শরিফ আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন।
ধারণা করা হয়, ‘ডিপ স্টেট’ এবার নতুন স্ট্রাটেজি নিয়েছে। তারা এবার তাদের নিজেদের দল ও প্রার্থীকে বিজয়ী করে নিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী তথা ‘ডিপ স্টেটের’ প্রার্থীই হচ্ছেন ইমরান খান। বিরোধী পক্ষ এবং সেই সঙ্গে দৈনিক সংবাদপত্র ডেইলি নিউজের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে (নির্বাচনী আইন ৪৫ অনুযায়ী পোলিং অফিসারের স্বাক্ষর ছিল না শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে)।
ইমরান খান এখন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এটাই বাস্তবতা। ‘ডিপ স্টেট’ তাকে কতদিন ক্ষমতায় রাখবে? কেমন হবে তার ‘নয়া পাকিস্তান’? তিনি চলতি (২০১৮) জানুয়ারিতে বলেছিলেন, নারীবাদ একটি পশ্চিমা ধ্যানধারণা।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারীবাদে মায়ের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়। তার এই অতি রক্ষণশীল মনোভাব পাকিস্তানে তাকে বিতর্কিত করতে পারে। উপরন্তু পাকিস্তানের ধর্ম অবমাননাবিষয়ক আইনের তিনি সমর্থক। পিটিআই এ আইন সমর্থন করে।
তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী এ কথা বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে না।’ তার এই বক্তব্য আহমদিয়া সম্প্রদায়কে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে এখন।
অভিযোগ আছে, তার সঙ্গে আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানদের সখ্য রয়েছে, যে কারণে কোনো কোনো মহল থেকে তাকে ‘তালেবান খান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পাকিস্তানে তালেবানদের কার্যালয় খোলারও দাবি জানিয়েছিলেন। তালেবানরা যখন নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফ জাইয়ের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তখন তিনি এর নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন। কাজেই তার এই তালেবান সংশ্লিষ্টতা তাকে বহির্বিশ্বে আরও বিতর্কিত করবে এখন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন ড্রোন হামলার তিনি বরাবর বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি গুলি করে ড্রোন নামানোর কথাও একবার বলেছিলেন। তার এ ধরনের বক্তব্যের কারণে ২০১২ সালে একবার কানাডা থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় ইমরান খানকে বিমান থেকে নামিয়ে আটক করা হয়েছিল এবং ড্রোন হামলার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ফলে তার শাসনামলে এক ধরনের ‘অস্বস্তিতে’ থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এটা ঠিক, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু অন্য দল থেকে যারা তার দলে যোগ দিয়েছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এক ধরনের অবিশ্বাসের মুখে থাকবে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি অনেক আসনেই বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে নানা ত্র“টির কথা বলেছে বিরোধী দল। কিন্তু তা খুব একটা ধোপে টেকেনি।
তবে একটা আশার কথা হল, আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকবে। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি, আর মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল (মোট আসন ১১৯) জোট গঠনে রাজি হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ এখন সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করবেন। ইমরান খানকে এখন এই বিরোধীদলীয় জোটকে আস্থায় নিতে হবে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই
Daily Jugantor
18.08.2018

ইমরান খান কি তার টার্ম পূরণ করতে পারবেন


সবকিছু ঠিক থাকলে ১৮ আগস্ট ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। ২৬ জুলাই সে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই ইনসাফ পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও সরকার গঠনের জন্য ১৩৭টি আসন পায়নি দলটি। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো সরকার গঠনের জন্য নির্ধারিত ১৩৭টি আসনও পায়নি। ফলে ইমরান খানকে ছোট ছোট আঞ্চলিক দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইমরান খানের নেতৃত্বে যে কোয়ালিশন সরকার হতে যাচ্ছে, তাতে যোগ দেবে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম, ৬ আসন), মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম, ৪ আসন), বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (৩ আসন), গ্র্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (২ আসন), জামহুরি ওয়াতান পার্টি (১ আসন) ও নিরপেক্ষ (১৩ আসন)। আওয়ামী মুসলিম লীগ (১ আসন) ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টিও (১ আসন) কোয়ালিশনে যোগ দিতে পারে। আর তেহরিক-ই ইনসাফ পেয়েছে ১১৬ আসন। মোটামুটিভাবে ইমরান খানের সরকার গঠনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও তিনি একটি দুর্বল সরকারের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। ফলে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, ইমরান খান শেষ পর্যন্ত ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন কি না? অতীতে প্রধানমন্ত্রীরা বারবার উৎখাত হয়েছেন, কখনওবা সরাসরি সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়েছে। বেনজির ভুট্টো, কিংবা নওয়াজ শরিফ বারবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিন-তিনবার জনগণ তাদের ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের উৎখাত করা হয়েছিল। এমনকি সেনা শাসকরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো জনপ্রিয় নেতাকে ফাঁসিতে পর্যন্ত ঝুলিয়েছিল। সেই স্ট্র্যাটেজিতে এবার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এবার সরাসরি ক্ষমতা দখল নয়, বরং এমন একটি দল ও তার নেতাকে তারা সামনে নিয়ে এসেছে, যারা বাহ্যত ‘সিভিলিয়ান’, কিন্তু কার্যত সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, বেসামরিক পোশাকে যারা সেনাবাহিনীর হয়েই কাজ করবেন। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সংসদই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের হয়ে সেখানে আইন প্রণয়ন করেন এবং তা প্রয়োগ করেন। এবারে পার্লামেন্ট বা সংসদ এবং একটি কেবিনেট গঠিত হতে যাচ্ছে; কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তরের হাতে থাকবে মূল ক্ষমতা, যাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়িত হবে সংসদে গৃহীত আইনের মধ্য দিয়ে। এটা উর্দিতন্ত্রের নতুন রূপ। সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ নয়, বরং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাদের দলকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করা। সরাসরি নয়, বরং পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনীই এখন দেশকে পরিচালনা করবে! ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই ইনসাফ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। সেনাবাহিনী তাকে ব্যবহার করেছিল অনেক আগে থেকেই। তার একটি ব্যক্তিগত ইমেজ ছিল। ক্রিকেটে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেওয়া, বিশ্ব ক্রিকেটে পাকিস্তানকে বিজয়ী করা, মায়ের নামে ক্যান্সার হাসপাতাল করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, হঠাৎ করে পশ্চিমা লেবাস ছেড়ে ইসলামপন্থি হয়ে যাওয়া, পিরতন্ত্রের ভক্ত ও একজন পিরানিকে (ধর্মগুরু) বিয়ে করাÑ সবই ছিল পরিকল্পিত। ইমরান খান সেই ছকে পা দিয়েছিলেন। আর এখন ‘বিজয়ী’ হলেন! এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন চলতি সপ্তাহেই।
পাকিস্তানের যে রাজনীতির ধারা, তাতে পর্দার অন্তরালে থেকেই সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ বাহ্যত ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত এদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। প্রথমে বিচার বিভাগ তাকে চলতি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং পরে ন্যাশনাল অ্যাকাউটিবিলিটি ব্যুরোর মামলায় তিনি দ-প্রাপ্ত হন। নওয়াজ শরিফ শেষের দিকে তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মেয়ে মরিয়মকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন, অনেকটা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক মেয়ে বেনজিরকে যেভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘তৈরি’ করেছিলেন, নওয়াজ শরিফও মরিয়মকে সেভাবেই তৈরি করেছিলেন। মরিয়মেরও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবার তিনি তা আর পারলেন না। মুসলিম লীগ এবার তার আসনে নওয়াজের নাতি ও মরিয়মের জ্যেষ্ঠ সন্তানকে মনোনয়ন দিয়েছিল।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচার বিভাগের ‘সখ্য’ নতুন কিছু নয়। নওয়াজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বও অনেক পুরানো। তিন-তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি টার্ম পূরণ করতে পারেননি। এবারও পারলেন না। তবে এবারের প্রেক্ষাপটটা ছিল কিছুটা ভিন্নতর। নওয়াজের সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান ও পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের দ্বন্দ্ব ছিল কাশ্মীর নিয়ে। ১৯৯০ ও ১৯৯৭Ñ দু-দুবারই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের অন্যতম ‘রাজনৈতিক শক্তি’ সেনাবাহিনীর কাছে তিনি কখনওই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পেছনে ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১৩ সালের ১১ মের নির্বাচনে মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু এবারও পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তবে সেনাবাহিনী এবার ব্যবহার করে বিচার বিভাগকে। সেনাবাহিনী তাকে সরাসরি ক্ষমতাচ্যুত করেনি কিংবা কোনো প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে তিনি ক্ষমতা হারাননি। পর্দার অন্তরালে থেকে এ অসাংবিধানিক শক্তিই মূলত ‘ডিপ স্টেট’ নামে পরিচিত। ‘ডিপ স্টেট’ বলতে বোঝায়, ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের কিছু ব্যক্তি সরকারি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রচলিত যে রীতিনীতি তার বাইরে গিয়ে সরকারি নীতিতে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেন। ‘ডিপ স্টেট’ কোনো একক ব্যক্তি নয়, বরং প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র, যারা নীতি প্রণয়নে ও গ্রহণে প্রভাব খাটায় (২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট শিবিরের বাইরে প্রভাবশালী একটি চক্র সক্রিয় ছিল)। পাকিস্তানে, বিশেষ করে আফগান সংকটের পর থেকেই সেনা আমলা, গোয়েন্দা আমলারা রাজনীতিতে বেশিমাত্রায় প্রভাব খাটাচ্ছেন। আর এদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন বিচার বিভাগের কিছু বিচারপতি। এদের কারণেই শেষ পর্যন্ত নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব তিনি কখনও দিতে পারেননি। পানামা কেলেঙ্কারিতে তিনি নিজে ও তার সন্তানরা অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে এবার একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়Ñ আর তা হচ্ছে বিকল্প শক্তি হিসেবে ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই ইনসাফকে (পিটিআই) সামনে নিয়ে আসা। সেনাবাহিনী যে ইমরান খানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছে, এটা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পাঠক স্মরণ করতে চেষ্টা করুন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ইমরান খানের আবির্ভাব ঘটেছে। একজন সাবেক ক্রিকেটার, যিনি নিজে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং যৌন কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে তাকে তৎপর দেখা যায়। এমনকি ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই পিটিআই ও তাহিরুল কাদরির নেতৃত্বে ইসলামাবাদ ঘেরাও করে সরকার পতনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইমরান খান। সেদিন তিনি অবশ্য সফল হননি। কিন্তু সেনাবাহিনী তখন থেকেই ইমরান খানকে ব্যবহার করে নওয়াজ শরিফের সরকারকে ‘চাপে’ রেখেছিল।
শপথ নেওয়ার বাকি আছে মাত্র পাঁচ দিন। কিন্তু পাকিস্তান থেকে যেসব খবরাখবর আসছে, খুব আশার কথা বলে না। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এক ধরনের ‘চাপের’ মুখে আছেন ইমরান খান। তার জয়লাভ করা দুই আসনের ভোটের ফল ঘোষণা স্থগিত করা হয়েছে। তবে ঘোষিত তিনটির একটি আসনের সদস্য হিসেবে তিনি শপথ নিতে পারবেন। তবে নির্বাচন কমিশনের শর্ত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ নিষ্পত্তির ওপর তার শপথ নির্ভর করবে। প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারা, প্রচারাভিযানে অসংগত ভাষা ব্যবহার করা ইত্যাদি নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তিনি হয়তো নির্বাচন কমিশনের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পাবেন। কেননা ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীই চাচ্ছে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হন।
তবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলেও বেশকিছু বিতর্ক তার পিছু ছাড়ছে না। প্রথমত, তিনি জানুয়ারিতে বলেছিলেন, নারীবাদ একটি পশ্চিমা ধ্যানধারণা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারীবাদে মায়ের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়। ফলে তার এ অতি রক্ষণশীল মনোভাব পাকিস্তানে তাকে বিতর্কিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের ধর্ম অবমাননাবিষয়ক আইনের তিনি সমর্থক। পিটিআই এই আইন সমর্থন করে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী এ কথা বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে না। তার এ বক্তব্য আহমদিয়া সম্প্রদায়কে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দেবে এখন। তৃতীয়ত, তার সঙ্গে আফগান তালেবানদের সখ্য রয়েছে, যে কারণে কোনো কোনো মহল থেকে তাকে ‘তালেবান খান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পাকিস্তানে তালেবানদের কার্যালয় খোলারও দাবি জানিয়েছিলেন। তালেবানরা যখন নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফ জাইয়ের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তখন তিনি এর নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে তার এ তালেবানসংশ্লিষ্টতা তাকে বহির্বিশ্বে আরও বিতর্কিত করবে। চতুর্থত, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন ড্রোন হামলা তিনি বরাবর বিরোধিতা করে আসছেন। তিনি গুলি করে ড্রোন নামানোর কথাও একবার বলেছিলেন। তার এ ধরনের বক্তব্যের কারণে ২০১২ সালে একবার কানাডা থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় ইমরান খানকে বিমান থেকে নামিয়ে আটক করা হয়েছিল এবং ড্রোন হামলার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ফলে তার শাসনামল নিয়ে এক ধরনের অশান্তিতে থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পঞ্চমত, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু অন্য দল থেকে যারা তার দলে যোগ দিয়েছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এক ধরনের অবিশ্বাসের মুখে থাকবে। তারপরও বাস্তবা হচ্ছে, তিনি অনেক আসনেই বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে নানা ত্রুটির কথা বলেছে বিরোধী দল। কিন্তু তা খুব একটা ধোপে টেকেনি। তবে একটা আশার কথা, আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকবে। নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ, পিপলস লীগ আর মুত্তাহিদা মজলিস-ই আমল (মোট আসন ১১৯) জোট গঠনে রাজি হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ এখন সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করবেন। ইমরান খানকে এখন এ বিরোধীদলীয় জোটকে আস্থায় নিতে হবে। সুতরাং সংসদ চালানো, আইন প্রণয়ন করার কাজটি তার জন্য সহজ হবে না। এর ওপরে রয়েছে অর্থনীতি। চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে আইএমএফ থেকে প্রাপ্ত ঋণ আটকে যেতে পারে। সব মিলিয়ে ইমরান খানের আগামী দিনগুলো যে ‘সুখের’ হবে, তা মনে হয় না।
Daily Alokito Bangladesh
13.08.2018

সড়কে আদৌ শৃঙ্খলা ফিরবে কি?

গেল সপ্তাহে কিশোরদের আন্দোলন বোধকরি বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে গেছে। কিন্তু এ আন্দোলন নিয়ে পরবর্তীকালে যা ঘটেছে, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। দুই শিক্ষার্থী মিম ও রাজিবের ‘হত্যাকাণ্ডের’ প্রতিক্রিয়ায় দেশে যা ঘটেছে, তা ছিল অভূতপূর্ব। স্কুল ও কলেজের ছেলেমেয়েরা কোনো ধরনের নেতৃত্ব ছাড়াই রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা প্রতিবাদী হয়েছিল।
সড়ক ব্যবস্থাপনা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, যা তাদের করার কথা নয়। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, যদি ‘ইচ্ছা’ ও ‘আগ্রহ’ থাকে তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে এক লাইনে গাড়ি চালাতে হয়, সড়কে শৃঙ্খলা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। ওরা রোদে পুড়ল, বৃষ্টিতে ভিজল। কিন্তু তারপর আমরা যা দেখলাম, তা আমাদের শুধু হতাশার মাঝেই ফেলে দেয়নি, বরং সমাজ কোন পথে যাচ্ছে, তার একটি ‘কালো অধ্যায়’ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।
গুজব ছড়ানো হল। আওয়ামী লীগ প্রধানের কার্যালয় আক্রান্ত হল। পুলিশের পাশাপাশি হেলমেটধারীরা আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করল। তাদের রক্তাক্ত করল। আমরা দেখলাম ছোট ছোট বাচ্চাদের রক্তাক্ত ছবি, কারও মাথা ফেটে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। কারও চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কিশোরদের ‘সড়ক নিরাপত্তার’ আন্দোলন চলে গেল অন্য খাতে! সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলেন।
বিদেশি এজেন্সিতে কর্মরত একজন ফটোসাংবাদিককে পেটানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদী হল। তথ্যমন্ত্রী চিঠি লিখলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এরই মাঝে খুব দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন পাস হল, যা এখন সংসদে যাবে এবং সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
কিশোরদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিএনপির একজন শীর্ষ নেতার অডিও রেকর্ড ফাঁস হল। যেখানে তিনি বিএনপির কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য। তার নামে মামলা হয়েছে, যদিও এখন অব্দি তিনি গ্রেফতার হননি। মামলা হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নামেও, যদিও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন এতে তিনি বিচলিত নন, কারণ তার নামে আরও ৮৪টি মামলা আছে! এক অভিনেত্রী গ্রেফতার হয়েছেন গুজব ছড়ানোর অভিযোগে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন আলোকচিত্রী গ্রেফতার হয়েছেন ‘বিদেশি মিডিয়ায় ভুল তথ্য দেয়ার’ জন্য!
সব মিলিয়ে কিশোরদের এ আন্দোলন প্রশংসিত এবং সব শ্রেণীর মানুষের সমর্থন পেলেও তা রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। প্রশ্ন এক. কিশোরদের এই আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে গেল? প্রশ্ন দুই. প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি ‘তৃতীয় পক্ষ’ ঢুকে গিয়েছিল ওই আন্দোলনে। এরা কারা? প্রশ্ন তিন. পুলিশের পাশে থেকে ‘হেলমেটধারীরা’ আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হল।
তাদের পেটাল। রক্তাক্ত করল। পুলিশ তাদের ধরল না কেন? প্রশ্ন চার. যারা গুজব ছড়াল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? প্রশ্ন পাঁচ. মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে যারা আক্রমণ চালিয়েছিল, তারা কারা? প্রশ্ন ছয়. সড়ক পরিবহন আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? প্রশ্ন সাত. কিশোরদের এই আন্দোলন কি জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে?
কিশোরদের আন্দোলন যে যৌক্তিক ছিল, তা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেছেন। অনেক মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনে যখন ‘অন্য শক্তি’ জড়িয়ে যায়, তখন তা লক্ষ্যচ্যুত হয়। শেষদিকে এসে এ আন্দোলনে জড়িয়ে যায় কোটা আন্দোলনকারীরা। জড়িয়ে যায় বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে আন্দোলনটি ‘কক্ষচ্যুত’ হয়ে পড়ে।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানা গুজব ছড়ানো হয়েছে। একজন অভিনেত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি যেভাবে আবেগতাড়িত হয়ে ফেসবুক লাইভে এসেছিলেন, তা তার উচিত হয়নি। তার উচিত ছিল গুজব যাচাই-বাছাই করা। নিশ্চয়ই আমরা এ থেকে শিখব। আমাদের কারও এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেছে। তাদের আন্দোলন ‘ব্যর্থ’ হয়েছে এটা বলা যাবে না।
ওরা সমাজের ‘ক্ষতচিহ্ন’গুলো চিহ্নিত করেছে। আমাদের সবার উচিত হবে এই ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা। কিন্তু তা কি আমরা পারব, কিংবা তা কি আমরা করব? ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই গত ৭ আগস্ট আমি দেখলাম ঢাকার সেই চিরচেনা চিত্র- সড়কে গাড়ি কম, কিন্তু কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে গাড়িগুলো চলছে, সেগুলোর ‘ফিটনেস’ আছে কিনা সন্দেহ! রংচটা, ভাঙা, ব্যাকলাইট না থাকা, সড়কে টেম্পো চালকদের দৌরাত্ম্য (এদের আদৌ কি লাইসেন্স আছে? ফিটনেস আছে?)- এ সবই ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।
শুনতে খারাপ শোনায়, বর্তমান ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এই সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ‘অর্থ’ একটি ফ্যাক্টর। এই অর্থের বিষয়টি যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি, তাহলে এই সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি হবে না। ডিএমপি কমিশনার ‘সচিব’ হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ধন্যবাদ তাকে। কিন্তু নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি কী ভূমিকা রেখেছেন? মিরপুর এক নম্বর সড়কের (বাঙলা কলেজের আশপাশ এলাকা) একটা অংশ ‘দখল’ হয়ে গেছে। সেখানে এখন বাজার বসে।
ফুটপাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে এখন মুদি দোকান। তাহলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? মিরপুরের দৃষ্টান্ত দিলাম এ কারণে যে এই ‘দৃশ্য’ প্রায় সব বড় সড়কেই দেখা যায়। ডিএমপি কমিশনার সম্মানিত হবেন এবং সবার প্রশংসা পাবেন, যদি তিনি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, যদি সড়ক থেকে বাজার উঠিয়ে দেন, যদি ফুটপাত দখলমুক্ত করেন। বাচ্চারা যে আন্দোলন করল, ডিএমপির কমিশনার তার প্রশংসা করেছেন। তাকে এ জন্য সাধুবাদ জানাই।
শুধু অনুরোধ থাকবে, বাচ্চাদের এই আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানিয়ে সড়ক দখলমুক্ত করুন- মানুষ আপনাকে স্মরণে রাখবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সড়ক দখলে প্রভাবশালীরা জড়িত। তাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মডেল অনুসরণ করতে পারি আমরা। প্রয়োজনে সড়ক ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। সরকারের নীতিনির্ধাকরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। সড়কে সেনাবাহিনী থাকলে ক্ষতি কী?
প্রস্তাবিত সড়ক আইন আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ‘গরু-ছাগল চিহ্নিত করতে পারা’ চালকদের অষ্টম শ্রেণী পাস ও সহকারীর পঞ্চম শ্রেণী পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সমস্যা হবে অনেক : ১. ভুয়া অষ্টম শ্রেণীর সার্টিফিকেটে সয়লাব হয়ে যাবে দেশ। নীলক্ষেতের বাকুশা মার্কেট এখন পরিণত হবে ‘সার্টিফিকেট উৎপাদন’ কেন্দ্রে!
এটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করব কীভাবে? এখানে একটা ‘ক্লজ’ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে এবং ভুল তথ্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২. সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই সহকারীরাই পরে বাসচালক হয়। তাহলে? ওই পঞ্চম শ্রেণী ‘পাস’ নিয়েই তো সে বাসচালক হচ্ছে! এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রতিটি চালককে প্রশিক্ষণ নিতে হব। এর ব্যবস্থা করবেন মালিকরা।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে হবে প্রতিটি উপজেলায়। প্রতিটি উপজেলায় যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। এ জন্য মালিক ও চালকের শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঢাকার বিআরটিএ নিয়ে অভিযোগ স্বয়ং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর। এলাকা ভিত্তিতে ঢাকায় বিআরটিএ’র আরও ন্যূনতম ১০টি শাখা গঠন করা প্রয়োজন। এটা যুগের চাহিদা। বিআরটিএ অফিসে গাড়ির ফিটনেস কার্যক্রম মেশিনের পরিবর্তে ব্যক্তিনির্ভর। যেখানে ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকে, সেখানে দুর্নীতি হবেই। সুতরাং মেশিন দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে এর শাস্তির বিধান। বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে এ সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের ৩০২, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। কোনো দুর্ঘটনায় ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে কিনা, তা কে নির্ধারণ করবে?
কোন প্রক্রিয়ায় তা নির্ধারিত হবে? একজন পুলিশ পরিদর্শক যখন এর ‘তদন্ত’ করবেন, তার ওপর কি আস্থা রাখা যাবে? তাই দুর্ঘটনায় হত্যাকাণ্ডে আদৌ কোনো চালককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া যাবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর (আগে ছিল ৩ বছর) করা হয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। চালকের লাইসেন্স বাতিলের কথাও বলা হয়নি।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিম ও রাজিবের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এই অর্থ নিহতদের পরিবারের সাহায্যে আসবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যা উচিত ছিল তা হচ্ছে, এ টাকা মালিকদের দিতে বাধ্য করা। চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, চালকদের নিয়োগপত্র দেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। কিন্তু আমরা কি পারব এগুলো নিশ্চিত করতে? রুটে গাড়িপ্রতি মালিকরা অর্থ নির্ধারণ করে দেন। এটা বন্ধ না হলে প্রতিযোগিতা থাকবেই।
একটি শক্তিশালী চক্র এই পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার অসহায়। যারা মালিক, তারাই যেন আবার শ্রমিক। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলে তারা। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এর সঙ্গে জড়িত। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে (যা আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল) তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। হয়তো আগামী দিনে প্রমাণিত হবে ওই মন্ত্রী সরকারের জন্য আশীর্বাদ নয়, ‘বোঝা’। মানুষ এটা বোঝে যে, একসঙ্গে মালিক ও শ্রমিক নেতা হওয়া যায় না।
শিশু-কিশোররা সমাজকে একটা বড় ‘ধাক্কা’ দিয়ে স্কুল-কলেজে ফিরে গেছে। কিন্তু এর রেশ তো থাকবেই। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শেষদিকে ‘ছিনতাই’ হয়ে গিয়েছে। এটাও একটা শিক্ষা। আন্দোলন ‘রক্তাক্ত’ হয়েছে- সুস্থ আন্দোলনের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ‘হত্যাকাণ্ডের’ পরও সমাজ জেগেছিল। মানুষ প্রতিবাদী হয়েছিল। তারপর? এই সমাজ কি ওই বাসচালককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পেরেছিল?
না, পারেনি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ঘাতক চালক হয়তো এখনও গাড়ি চালাচ্ছে। একটা মৃত্যু ঘটে, সাময়িকভাবে আমরা জেগে উঠি, তারপর ভুলে যাই। মিম ও রাজিবের ‘হত্যাকাণ্ডে’ ছোট ছোট বাচ্চারা জেগে উঠেছিল, সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পর এর মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের ‘নিয়ন্ত্রণ’ থেকে যদি সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের ‘মুক্ত’ করা না যায়, তাহলে এ ধরনের মৃত্যু আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করতে থাকব। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পুনশ্চ : সম্ভবত কিছু কিশোর ‘অভিযুক্ত’ হয়ে জেলে আছে। অনুরোধ থাকবে তাদের দ্রুত জেল থেকে মুক্তি দেয়ার
Daily Jugantor
12.08.2018

আসামের নাগরিকত্ব তালিকা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক


ভারতের আসামে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনসের (এনআরসি) খসড়া তালিকা নিয়ে খোদ ভারতেই এখন বড় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ আসামের নাগরিক। এই তালিকা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তাতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। প্রকাশিত খসড়া তালিকায় দেখা যায়, অনেক বৈধ নাগরিক পর্যন্ত তাতে বাদ পড়েছে। এ রকম একটি তালিকা যে করা হবে এবং ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের (?) যে আসাম থেকে বের করে দেওয়া হবে, এ ধরনের আশঙ্কার কথা দীর্ঘদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। যাদের বের করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তারা মূলত মুসলমান। এবং আসামের বিজেপি তথা আসাম সরকারের ভাষায় তারা অবৈধ বাংলাদেশি! এরই মধ্যে বিষয়টি একটি বড় রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি তাদের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় দেবেন!
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এনআরসির বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। ২০১৯ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি সরকার এটিকে ইস্যু করতে চায়। ভুলে গেলে চলবে না, আসামসহ ভারতের ‘সাত বোন’ রাজ্যগুলোর প্রায় সব কটিতেই বিজেপি ও বিজেপির মিত্ররা ক্ষমতায়। অতি সম্প্রতি সেখানে যে বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, তার মধ্য দিয়ে বিজেপি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার অবস্থান অনেক শক্তিশালী করেছে। আসামে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার রয়েছে।
আসামের নাগরিকত্ব তালিকা নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে সেখানে বাঙালি মুসলমানরা যে এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলছেন, এখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, তার পরও কথা থেকে যায়। আগামী লোকসভা এবং পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন সামনে রেখে বিজেপি এই ইস্যু তুলে রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করে নিতে চায়। এতে  বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সময় পার করছে। তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ইস্যুতে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এবং তাতে লাভবান হবে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত কী বলেছিলেন। এর পরপরই এনআরসির খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন কিছুদিন আগে। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, দেশটির (অর্থাৎ ভারতের) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। একজন সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন এমন এক সময়ে যখন আসামে এক ধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছিল। এই বাঙালিরা মূলত মুসলমান। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়! বিজেপি মনে করে, ওই সব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে গেছে এবং সেখানে বসবাস করছে, যার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এর আগে বিজেপি সরকার পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ উত্খাতের পরিকল্পনা করেছিল। এটা সম্ভব হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে। ভারতীয় গণমাধ্যম বিপিন রাওয়াতের ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেছে। দ্য হিন্দু, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকায় বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছিল। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্য ছিল ‘রাজনৈতিক’। চলতি ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যাবেন। নিজের ‘রাজনৈতিক পথ’ পরিষ্কার করতেই তিনি ওই মন্তব্য করেছেন। বিপিন রাওয়াতের উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, এটি সত্য, দুই বছর আগেই আসাম সরকার নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অতি সম্প্রতি। আসাম সরকার তখন এক কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের নাগরিকদের শনাক্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। এতে  কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমান সেখান থেকে বিতাড়িত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের যদি বাংলাদেশ গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের বন্দিশালায় রাখা হবে বলে একটি পরিকল্পনাও তারা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের বন্দিশালা নির্মিত হয়েছে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল বিপিন রাওয়াত যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন তখন এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্পর্ক একটি উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে মোদির জমানায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে উভয় সরকার। এখন তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়নপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা কিনা নয়া বিশ্বব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন; কিন্তু এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন (BBIN) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগাতে সম্মত হয়েছেন। এই বিবিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা বাস সার্ভিস। যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনও এরই মধ্যে চালু হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে এই চারটি দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় ভুটান এতে রাজি হয়েছিল। তবে ভুটানের সংসদ আপত্তি তুলেছিল। সংসদে তা অনুমোদিত হয়নি।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম (BCIM) হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তাঁর চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটিকে একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তী সময়ে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোট কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এই চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামী দিনে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব-অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই জোট। বলা বাহুল্য, এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্য পদ পাওয়া সহজ হয়। এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগ নিতে পারি।
কিন্তু ‘বাংলাদেশি খেদাও’ অভিযান যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তা দুই দেশের জন্যই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। যে ৪০ লাখ বাঙালির কথা বলা হচ্ছে, তারা বংশপরম্পরায় সেখানে বসবাস করছে। তাদের প্রায় সবার ভোটার আইডি কার্ড আছে। তারা ভোট দেয়। রেশন কার্ডও আছে। তাদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা অযৌক্তিক। নিশ্চয়ই আমরা আশা করব, সেখানে শুভ বুদ্ধির মানুষ আছেন; যাঁরা এর প্রতিবাদ করবেন। ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে আমরা শিখতে চাই। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন যে সংস্কৃতি, তা আমাদের কিছু শেখাতে পারবে না। এতে দুই দেশের মধ্যে অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে, আর তাতে লাভবান হবে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো।
Daily Kalerkontho
09.08.2018

আসামের মুসলমানরা এখন কোথায় যাবে


আসামের বাঙালি মুসলমানরা এখন কোথায় যাবে? এই প্রশ্নটি উঠেছে এ কারণে যে, আসামে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লাখ নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে এনআরসির আওতায়। বলা হচ্ছে, এরা ভারতীয় নাগরিক নন! ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনসের (এনআরসি) আওতায় এই জরিপ করছে আসামের বিজেপি সরকার। আসামের ৩ কোটি ২১ লাখ বাসিন্দা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করে এনআরসিতে নাম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন। খসড়া এনআরসিতে ২ কোটি ৮৯ লাখ বাসিন্দাকে প্রকৃত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাদ পড়েছেন প্রায় ৪০ লাখ। এই ৪০ লাখের অধিকাংশই মুসলমান। এদের বাংলাদেশি(?) হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অবাক করার বিষয়, ভারতীয় নাগরিক নন, এমন তালিকায় ভারতের সাবেক ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ফকরুদ্দীন আলী আহমেদের পরিবারের নামও নেই। আসামের অনেক প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মী, যারা ভারতের রাজনীতি তথা অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছেন, তাদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এর পেছনে যে সুস্পষ্ট একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রয়েছে, তা স্পষ্ট। কেননা বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিং হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানদের থাকতে দেব না।’ তিনি এ কথা জানাতেও ভোলেননি যে, বাংলাদেশের হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের (আসামে বসবাসরত) তারা শরণার্থী হিসেবে মনে করেন। তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে; কিন্তু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হবে না। রাহুল সিংয়ের এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক উসকানির শামিল। বাংলাদেশ থেকে এরা গেছেন, এই তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? বাংলায় এরা কথা বলেন বটে; কিন্তু তাই বলে এরা বাংলাদেশি নন। বছরের পর বছর ধরে এরা আসামে বসবাস করে আসছেন। আসলে আসামের বিজিপি সরকার মুসলমানদের বহিষ্কার করে এটাকে একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চায়। ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনেও জিততে চায় বিজেপি। তাই একটি ‘ইস্যু’ দরকার, তাই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে ‘অবৈধ বাংলাদেশি ইস্যুটি’! এটি একটি সদূর পরিকল্পনার অংশ। বিজেপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। যদিও পশ্চিম বাংলার তৃণমূল কংগ্রেসসহ অনেক দল এর বিরোধিতা করছে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত কী বলেছিলেন। এর পরপরই এনআরসির খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন কিছুদিন আগে। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, দেশটির (অর্থাৎ ভারতের) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে! এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। একজন সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি এই মন্তব্যটি করেছিলেন এমন একসময়, যখন আসামে এক ধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছিল। এই বাঙালিরা মূলত মুসলমান। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়! বিজেপি মনে করে ওইসব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে গেছেন এবং সেখানে বসবাস করছেন, যার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এর আগে বিজেপি সরকার পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। এটা সম্ভব হয়নি মমতা ব্যানার্জির কারণে। বিপিন রাওয়াতের এই বক্তব্য ভারতীয় গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে। দি হিন্দু, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া, কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকায় বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছিল। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যটি ছিল রাজনৈতিক। ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যাবেন। নিজের ‘রাজনৈতিক পথ’ পরিষ্কার করতেই তিনি ওই মন্তব্যটি করেছেন। বিপিন রাওয়াতের উদ্দেশ যাই থাকুক না কেন, এটা সত্য, গত দুই বছর আগেই আসামে সরকার নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অতি সম্প্রতি। আসাম সরকার তখন ১ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের নাগরিকদের শনাক্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। এতে কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমান সেখান থেকে বিতাড়িত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের যদি বাংলাদেশ গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের বন্দিশালায় রাখা হবে বলে একটি পরিকল্পনাও তারা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের বন্দিশালা নির্মিত হয়েছে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল বিপিন রাওয়াত যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ সম্পর্ক একটি উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির জমানায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএন) ব্যাপারে দুই দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের সাতবোন রাজ্যেগুলোর উন্নয়ন। এই সাতবোন রাজ্যগুলোর মধ্যে আসামও রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো সড়কপথে সংযুক্ত হয়েছে। এখন যদি তথাকথিত ‘বাংলাদেশি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়, তাহলে তো বিবিআইএনের উদ্যোগ ভেস্তে যাবে!
এরই মধ্যে খোদ ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে ভারতে ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে মমতার এই বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। মমতার অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত নই (তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম)। কিন্তু তিনি জানেন, বিজেপি কী চায়? বিজেপির অনেক দিনের টার্গেট পশ্চিম বাংলা দখল করা। সাতবোন রাজ্যের প্রায় সব ক’টিতে এখন বিজেপি রাজ্য ক্ষমতায়। ভারতের সর্বত্র ‘গেরুয়া ঝান্ডা’ উঠানোর এক মহাপরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির। এখানে বড় অন্তরায় পশ্চিম বাংলার মমতা ব্যানার্জি। বিজেপি পশ্চিম বাংলার রাজ্য ক্ষমতা দখল করতে চায়। এরই মধ্যে তারা পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাংলাদেশিদের’ (?) বহিষ্কারের দাবি করছে। অথচ মমতা বলছেন, প্রয়োজনে তিনি আসামের ওই ৪০ লাখ ভারতীয় নাগরিককে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় দেবেন। মমতার পেছনে রয়েছে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা। তারা মমতাকে বারবার সমর্থন দিয়ে আসছেন।
এরই মধ্যে এই ইস্যুটি খোদ ভারতে বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে! পশ্চিম বাংলার বিধানসভার কয়েকজন সদস্য আসামে যেতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে একজন রাজ্য সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু তাদের আসামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আসাম সরকার যে কতবেশি সাম্প্রদায়িক, এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। একজন ‘মন্ত্রী’ কয়েকজন বিধানসভার সদস্য, তারাই যদি নিজ দেশের অন্য একটি রাজ্যে ঢুকতে না পারেন, তা তো ভারতের সংহতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা ভারতে বিতর্ক আরও বাড়াবে। মমতা নিজেই বলেছেন, ভারতে ‘সুপার ইমার্জেন্সি’ চলছে। এখন জনপ্রতিনিধিরা ভারতের অন্য অঞ্চলে যেতে পারবেন না, এটা কোনো ভালো সংবাদ নয়। জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিএমও এর সমালোচনা করেছে।
এদিকে জানানো হয়েছে যে, ৭ আগস্টের পর থেকে এনআরসির বিভিন্ন সেবা কেন্দ্র থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে কী কারণে নাম বাদ পড়েছে। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফের সময় দেওয়া হবে নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ফের আবেদন করার। কিন্তু এরপর? যারা চ‚ড়ান্ত তালিকাতেও থাকবেন না। তাদের নেওয়া হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে! ভারতের মতো একটি সভ্য দেশে এভাবে হাজার হাজার মানুষকে কি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা যায়? এ ঘটনা কি ভারতীয় গণতন্ত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে? এরই মাঝে দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারির দাবি, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ঢুকে বহু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী দিল্লি ও তার লাগোয়া উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে। তাই দিল্লির জন্যও নাগরিক তালিকা তৈরি করা হোক।’ একই দাবি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথেরও।
যদিও আসামের সুপ্রিমকোর্ট এখনই বাদপড়া ৪০ লাখের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই নির্দেশ কতটুকু এবং কীভাবে পালিত হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই গেল। এ বিষয়টি যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি করতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। বিষয়টি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হলেও বাংলাদেশ সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। শুধু ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার এবং স্বরাষ্ট্র ও তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা পেয়েছি। সব বক্তব্যই একই ধাঁচের। তারা বলার চেষ্টা করেছেন যে, ওটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে আমাদের উদ্বিগ্নœ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে না। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি আমাদের জানায়নি বলেও জানান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, যিনি ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা আসামে গেছেন, তারা ১৯৭১ সালের আগেই গেছেন। তাই এটা নিয়ে তাদের উদ্বেগ নেই। তথ্যমন্ত্রীও কলকাতার আনন্দবাজারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একই অভিমত পোষণ করেছেন। মজার কথা হলো, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিককে ডেকে একই অভিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। কেননা এরই মধ্যে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে আমরা একটা সংকটে আছি। মিয়ানমার তাদের এই নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে বলে চুক্তি করলেও তারা সেই চুক্তি মানছে না। বিশাল এই বিদেশি জনগোষ্ঠী আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। এখন ৪০ লাখ বাংলাদেশির প্রশ্নটি এর সঙ্গে যোগ হলো। সুতরাং উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিষয়টি আমাদের জানায়নিÑ এটা সত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো দেশই এসব বিষয় আগে জানায় না। মিয়ানমার কি আমাদের আগে জানিয়েছিল রোহিঙ্গাদের বিষয়? পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আগেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়া। ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়ে মন্ত্রণালয় এর ব্যাখ্যা চাইতে পারে। এরা সবাই ভারতীয় নাগরিক। ভারতীয় সংবিধানের নাগরিকত্ব সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে (৫ থেকে ১১ ধারা), সেই বিধান অনুযায়ী তারা ভারতীয় নাগরিক। শুধু বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে এই বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের দীর্ঘদিনের বসতি হারাবে, এটা হতে পারে না। আমরা চাই, সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুক।
Daily Alokito bangladesh
05.08.2018