রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আসামের মুসলমানরা এখন কোথায় যাবে


আসামের বাঙালি মুসলমানরা এখন কোথায় যাবে? এই প্রশ্নটি উঠেছে এ কারণে যে, আসামে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লাখ নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে এনআরসির আওতায়। বলা হচ্ছে, এরা ভারতীয় নাগরিক নন! ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনসের (এনআরসি) আওতায় এই জরিপ করছে আসামের বিজেপি সরকার। আসামের ৩ কোটি ২১ লাখ বাসিন্দা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করে এনআরসিতে নাম নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলেন। খসড়া এনআরসিতে ২ কোটি ৮৯ লাখ বাসিন্দাকে প্রকৃত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাদ পড়েছেন প্রায় ৪০ লাখ। এই ৪০ লাখের অধিকাংশই মুসলমান। এদের বাংলাদেশি(?) হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অবাক করার বিষয়, ভারতীয় নাগরিক নন, এমন তালিকায় ভারতের সাবেক ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ফকরুদ্দীন আলী আহমেদের পরিবারের নামও নেই। আসামের অনেক প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মী, যারা ভারতের রাজনীতি তথা অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছেন, তাদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এর পেছনে যে সুস্পষ্ট একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রয়েছে, তা স্পষ্ট। কেননা বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিং হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানদের থাকতে দেব না।’ তিনি এ কথা জানাতেও ভোলেননি যে, বাংলাদেশের হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের (আসামে বসবাসরত) তারা শরণার্থী হিসেবে মনে করেন। তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে; কিন্তু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হবে না। রাহুল সিংয়ের এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক উসকানির শামিল। বাংলাদেশ থেকে এরা গেছেন, এই তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? বাংলায় এরা কথা বলেন বটে; কিন্তু তাই বলে এরা বাংলাদেশি নন। বছরের পর বছর ধরে এরা আসামে বসবাস করে আসছেন। আসলে আসামের বিজিপি সরকার মুসলমানদের বহিষ্কার করে এটাকে একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চায়। ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনেও জিততে চায় বিজেপি। তাই একটি ‘ইস্যু’ দরকার, তাই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে ‘অবৈধ বাংলাদেশি ইস্যুটি’! এটি একটি সদূর পরিকল্পনার অংশ। বিজেপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। যদিও পশ্চিম বাংলার তৃণমূল কংগ্রেসসহ অনেক দল এর বিরোধিতা করছে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভারতের সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত কী বলেছিলেন। এর পরপরই এনআরসির খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন কিছুদিন আগে। নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, দেশটির (অর্থাৎ ভারতের) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকানো হচ্ছে! এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। চীনের মদদে একটি ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারতের ওই এলাকাকে ‘অস্থির’ করে তুলতেই এ কাজ করা হচ্ছে। একজন সেনাপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি এই মন্তব্যটি করেছিলেন এমন একসময়, যখন আসামে এক ধরনের ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়েছিল। এই বাঙালিরা মূলত মুসলমান। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়! বিজেপি মনে করে ওইসব বাঙালি বাংলাদেশ থেকে গেছেন এবং সেখানে বসবাস করছেন, যার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এর আগে বিজেপি সরকার পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাঙালিদের’ উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। এটা সম্ভব হয়নি মমতা ব্যানার্জির কারণে। বিপিন রাওয়াতের এই বক্তব্য ভারতীয় গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে। দি হিন্দু, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া, কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো পত্রিকায় বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছিল। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বিপিন রাওয়াতের ওই মন্তব্যটি ছিল রাজনৈতিক। ডিসেম্বরে তিনি অবসরে যাবেন। নিজের ‘রাজনৈতিক পথ’ পরিষ্কার করতেই তিনি ওই মন্তব্যটি করেছেন। বিপিন রাওয়াতের উদ্দেশ যাই থাকুক না কেন, এটা সত্য, গত দুই বছর আগেই আসামে সরকার নাগরিকত্ব শনাক্তকরণের একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অতি সম্প্রতি। আসাম সরকার তখন ১ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের নাগরিকদের শনাক্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। এতে কয়েক লাখ বাঙালি মুসলমান সেখান থেকে বিতাড়িত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের যদি বাংলাদেশ গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের বন্দিশালায় রাখা হবে বলে একটি পরিকল্পনাও তারা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের বন্দিশালা নির্মিত হয়েছে বলেও গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জেনারেল বিপিন রাওয়াত যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবেই। সাম্প্রতিক সময়ে এ সম্পর্ক একটি উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির জমানায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএন) ব্যাপারে দুই দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মূল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের সাতবোন রাজ্যেগুলোর উন্নয়ন। এই সাতবোন রাজ্যগুলোর মধ্যে আসামও রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো সড়কপথে সংযুক্ত হয়েছে। এখন যদি তথাকথিত ‘বাংলাদেশি খেদাও’ অভিযান শুরু হয়, তাহলে তো বিবিআইএনের উদ্যোগ ভেস্তে যাবে!
এরই মধ্যে খোদ ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে ভারতে ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে মমতার এই বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। মমতার অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত নই (তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম)। কিন্তু তিনি জানেন, বিজেপি কী চায়? বিজেপির অনেক দিনের টার্গেট পশ্চিম বাংলা দখল করা। সাতবোন রাজ্যের প্রায় সব ক’টিতে এখন বিজেপি রাজ্য ক্ষমতায়। ভারতের সর্বত্র ‘গেরুয়া ঝান্ডা’ উঠানোর এক মহাপরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির। এখানে বড় অন্তরায় পশ্চিম বাংলার মমতা ব্যানার্জি। বিজেপি পশ্চিম বাংলার রাজ্য ক্ষমতা দখল করতে চায়। এরই মধ্যে তারা পশ্চিম বাংলা থেকেও ‘বাংলাদেশিদের’ (?) বহিষ্কারের দাবি করছে। অথচ মমতা বলছেন, প্রয়োজনে তিনি আসামের ওই ৪০ লাখ ভারতীয় নাগরিককে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় দেবেন। মমতার পেছনে রয়েছে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা। তারা মমতাকে বারবার সমর্থন দিয়ে আসছেন।
এরই মধ্যে এই ইস্যুটি খোদ ভারতে বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে! পশ্চিম বাংলার বিধানসভার কয়েকজন সদস্য আসামে যেতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে একজন রাজ্য সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু তাদের আসামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আসাম সরকার যে কতবেশি সাম্প্রদায়িক, এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। একজন ‘মন্ত্রী’ কয়েকজন বিধানসভার সদস্য, তারাই যদি নিজ দেশের অন্য একটি রাজ্যে ঢুকতে না পারেন, তা তো ভারতের সংহতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা ভারতে বিতর্ক আরও বাড়াবে। মমতা নিজেই বলেছেন, ভারতে ‘সুপার ইমার্জেন্সি’ চলছে। এখন জনপ্রতিনিধিরা ভারতের অন্য অঞ্চলে যেতে পারবেন না, এটা কোনো ভালো সংবাদ নয়। জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিএমও এর সমালোচনা করেছে।
এদিকে জানানো হয়েছে যে, ৭ আগস্টের পর থেকে এনআরসির বিভিন্ন সেবা কেন্দ্র থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে কী কারণে নাম বাদ পড়েছে। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফের সময় দেওয়া হবে নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ফের আবেদন করার। কিন্তু এরপর? যারা চ‚ড়ান্ত তালিকাতেও থাকবেন না। তাদের নেওয়া হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে! ভারতের মতো একটি সভ্য দেশে এভাবে হাজার হাজার মানুষকে কি ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা যায়? এ ঘটনা কি ভারতীয় গণতন্ত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে? এরই মাঝে দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারির দাবি, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ঢুকে বহু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী দিল্লি ও তার লাগোয়া উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে। তাই দিল্লির জন্যও নাগরিক তালিকা তৈরি করা হোক।’ একই দাবি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথেরও।
যদিও আসামের সুপ্রিমকোর্ট এখনই বাদপড়া ৪০ লাখের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই নির্দেশ কতটুকু এবং কীভাবে পালিত হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই গেল। এ বিষয়টি যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি করতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। বিষয়টি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হলেও বাংলাদেশ সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। শুধু ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার এবং স্বরাষ্ট্র ও তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আমরা পেয়েছি। সব বক্তব্যই একই ধাঁচের। তারা বলার চেষ্টা করেছেন যে, ওটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে আমাদের উদ্বিগ্নœ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে না। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি আমাদের জানায়নি বলেও জানান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, যিনি ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা আসামে গেছেন, তারা ১৯৭১ সালের আগেই গেছেন। তাই এটা নিয়ে তাদের উদ্বেগ নেই। তথ্যমন্ত্রীও কলকাতার আনন্দবাজারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একই অভিমত পোষণ করেছেন। মজার কথা হলো, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারও কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিককে ডেকে একই অভিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। কেননা এরই মধ্যে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে আমরা একটা সংকটে আছি। মিয়ানমার তাদের এই নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে বলে চুক্তি করলেও তারা সেই চুক্তি মানছে না। বিশাল এই বিদেশি জনগোষ্ঠী আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। এখন ৪০ লাখ বাংলাদেশির প্রশ্নটি এর সঙ্গে যোগ হলো। সুতরাং উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিষয়টি আমাদের জানায়নিÑ এটা সত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো দেশই এসব বিষয় আগে জানায় না। মিয়ানমার কি আমাদের আগে জানিয়েছিল রোহিঙ্গাদের বিষয়? পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আগেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়া। ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়ে মন্ত্রণালয় এর ব্যাখ্যা চাইতে পারে। এরা সবাই ভারতীয় নাগরিক। ভারতীয় সংবিধানের নাগরিকত্ব সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে (৫ থেকে ১১ ধারা), সেই বিধান অনুযায়ী তারা ভারতীয় নাগরিক। শুধু বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে এই বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের দীর্ঘদিনের বসতি হারাবে, এটা হতে পারে না। আমরা চাই, সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুক।
Daily Alokito bangladesh
05.08.2018

0 comments:

Post a Comment