রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি



সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ ক’টি দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে অথবা বলা যেতে পারে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখানে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, আর এর আগে নেপাল ও ভুটান সর্বত্রই পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেখানে নয়া সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীন ও ভারতের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। অর্থাৎ কোথাও ‘চীনাবান্ধব’ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, কোথাওবা আবার ‘ভারতবান্ধব’ সরকার দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব পেয়েছে।
সর্বশেষ ‘বড়’ পরিবর্তনটা সাধিত হয়েছে মালদ্বীপে। বলা হয়, হাজারো দ্বীপের দেশ হচ্ছে মালদ্বীপ। সম্প্রতি মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। নির্বাচনে শতকরা ৫৮ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। দেশটিতে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যায়, সেখানে চীন ও ভারতের মধ্যে একধরনের ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের’ প্রতিযোগিতা ছিল। নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে চীনাপন্থি বলে গণ্য করা হতো। অন্যদিকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহকে ভারতপন্থি বলে বিবেচনা করা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই সেখানে সংকট শুরু হয়। মুখোমুখি অবস্থান নেন দেশটির আদালত। ওই সময় দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় নয়জন রাজনৈতিক বন্দিকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বহিষ্কৃত ১২ জন আইন প্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনারও আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এটি হলে দেশটির ৮৫ সদস্যের আইনসভায়ও ওই সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো। কিন্তু আবদুল্লাহ ইয়ামিন এতে রাজি ছিলেন না। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। এ সংকটের সময় চীন ইয়ামিনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় হেলিকপ্টার প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি পর্যন্ত জানিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন অতিমাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। চীনের বিনিয়োগও বাড়ছিল মালদ্বীপে। মালদ্বীপের কাছে চীন পাবে ১৩০ কোটি ডলার।
কোনো কোনো মহল থেকে অভিযোগ করা হয়, মালদ্বীপের চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। একসময় শ্রীলঙ্কাকে নিয়েও ভারতের শঙ্কা ছিল। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এটাকে ভারত দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি একধরনের ‘হুমকি’ হিসেবে। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব বাড়ছে। ভারত চায় না, চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়াক। এখন মালদ্বীপে মোহাম্মদ সলিহর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে ভারত। এটা স্পষ্ট, নয়া প্রেসিডেন্ট চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা কমাবেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করবেন। ভারত-মালদ্বীপ সম্পকর্কে আগের অবস্থায় নিয়ে আসবেন। অনেকটা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার মতো স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সলিহ। শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে চীন এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। ভারতের অবস্থান এখানে শক্তিশালী।
মালদ্বীপের পাশাপাশি ভুটানেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ সেপ্টেম্বর। ভুটানের অবস্থান, এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব ভারত ও চীন উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে ভারতপন্থি দল হিসেবে পরিচিত পিডিপির বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে। ভোটের ফলাফলে দলটি নেমে গেছে তৃতীয় অবস্থানে। এটা ছিল প্রথম রাউন্ডের নির্বাচন। ফাইনাল রাউন্ড অনুষ্ঠিত হবে ১৮ অক্টোবর। ১৫ সেপ্টেম্বরের ফলাফলে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোটে যারা প্রথম ও দ্বিতীয়, সেই দলের দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ২০১৩ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে পিডিপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার তাদের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ডিপিটি। এবারও তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু যারা তৃতীয় হয়েছিল ডিএনটি, তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে। দলটির বয়স মাত্র অল্প কিছুদিনের। মজার ব্যাপার হলো, ডিএনটি দলের যিনি প্রধান, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। ভুটানে ভারতের প্রভাব বেশি। প্রশাসন বেশি মাত্রায় ভারত নির্ভর। ভুটানের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে কারণে চীনের কোনো দূতাবাস খোলার অনুমতি দেয়নি ভুটান সরকার। ভুটানে যেতে হলে ভারতের ওপর দিতে যেতে হয়। ভুটান একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন দিয়ে ঘেরা, এমনকি ভুটানে প্রচুর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও তা যদি বাংলাদেশ ব্যবহার করতে চায়, তাহলে এতে ভারতের সম্মতির প্রয়োজন হবে। মোদির ঢাকা সফরের সময় একট উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএন) কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন ভারতপন্থি দল হিসেবে পরিচিত পিডিপির হেরে যাওয়া ভুটানের রাজনীতিতে তা এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। এখন নয়া সরকার গঠিত হওয়ার পরই বোঝা যাবে, নয়া সরকার ভারত ও চীনের ব্যাপারে কী ভূমিকা নেয়।
নেপালের খবর আমরা সবাই জানি। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকার পর সেখানে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। ২০১৫ সালে সংবিধান প্রণয়ন করার পর সেখানে ১৫ ফেব্রুয়ারি (২০১৮) নির্বাচনের দুই মাস পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন কেপি শর্মা অলি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ২৭৫ আসনের মধ্যে নেপালি কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬৩ আসন। অন্যদিকে বাম জোট পেয়েছিল ১৭৪ আসন। এর মাঝে অলির নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনাইটেড-মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট) আসন ১২১ আর পুষ্প কুমার দাহালের (প্রচ-) নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের আসন ৫৩। এর বাইরে রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টির ১৭, আর সমতাবাদী পার্টির আসন ১৬। অলির বিজয় একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেপালের ক্ষেত্রে। এতদিন ভারতের একটা প্রভাব ছিল নেপালে। অলি সেই ভারতীয় প্রভাব থেকে বের হয়ে এসে চীনের দিকে ঝুঁকছেন। নেপাল চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। নেপাল ও চীন রেলসংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন নয়া প্রধানমন্ত্রী। চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায়ও অংশ নিচ্ছে নেপাল। নেপালের এ ভূমিকা ভারতের পছন্দ নয়। সংগত কারণেই ভারত এতে অসন্তুষ্ট। ফলে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব নেপালের রাজনীতিতেও এখন পড়ল। চলতি বছর বাংলাদেশে নির্বাচন। আর ২০১৯ সালের জুনে ভারতের লোকসভার নির্বাচন। পাঠকমাত্রই জানেন, পাকিস্তানে চলতি বছর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি নয়া সরকার সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ইমরান খান অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন পাকিস্তানে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সেখানে খারাপ। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা পাকিস্তানের আরও বেড়েছে। আর আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালের এপ্রিলে।
সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্ম হয়েছে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গোপসাগরে ভারতের সামরিক তৎপরতা বেড়েছে। ভারত মহাসাগরজুড়ে বেশ কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক যুদ্ধজাহাজ ও ডুবোজাহাজের সংখ্যা এবং সামরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলজুড়ে এখন চলছে একধরনের চাপা উত্তেজনা। গাওদারে ও হামবানতোতায় চীনা ডুবোজাহাজের উপস্থিতি ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ অঞ্চলে ভারত তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। পাকিস্তানে নয়া সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা এরই মধ্যে মিইয়ে গেছে। পাকিস্তানে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আগামীতে যে হবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে সার্ক একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলো এখন সার্কের পরিবর্তে বিমসটেককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সমন্বয়ে যারা বঙ্গোপসাগর অববাহিকায় অবস্থিত, নতুন এক শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্ম হচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে।
এসব নতুন শক্তি নতুন রাজনীতি নিয়ে আসছে। পুরানো ট্র্যাডিশনাল শক্তিগুলোর প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমছে। পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালদ্বীপ, এমনকি ভুটানেও নতুন শক্তির উত্থান ঘটছে। এখন দেখার পালা, এ নতুন শক্তি একুশ শতকে দক্ষিণ এশিয়াকে কোথায় নিয়ে যায়।
Daily Alokito Bangladesh
07.10.2018

0 comments:

Post a Comment