রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতিতে আস্থার সংকট


ইতোমধ্যে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের সাথে বিএনপি জাতীয় ঐক্য করেছে। এই ঐক্য অনেকটাই এখন ‘কাগুজে ঐক্য’ হয়ে গেছে। কেননা বরাবরের মতো জাতীয় ঐক্য করেই ড. কামাল হোসেন বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি কবে দেশে ফিরবেন কেউ বলতে পারে না। উপরন্তু বিএনপির সাথে বিকল্প ধারার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর বক্তব্য পরিত্যাগ করেছে বিএনপি। বিএনপি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা জামায়াতকে ছাড়বে না। মাহী বি. চৌধুরী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপির অংশগ্রহণের প্রশ্নে কিছু শর্ত দিয়েছিলেন। তার একটি হচ্ছে বিএনপিকে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। বিএনপি এটি করবে না। ফলে যে প্রত্যাশা নিয়ে ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্য করেছিলেন, তা এখন শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল!
বিএনপি গত ৩০ সেপ্টেম্বরের জনসভায় একটি ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এই ৭ দফার মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে সকল দলের সাথে পরামর্শ করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়। কেননা প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুযোগ নেই। তার এই বক্তব্যকে ধারণ করেও বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধানের ৫৫(১) ধারায় মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। আর ৫৬(২) ধারায় প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংসদ সদস্যের বাইরে থেকে ‘টেকনোক্রেট কোটায়’ মন্ত্রী নিয়োগ করতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর। এক্ষেত্রে সংসদ সদস্য নন এবং বিএনপি সমর্থিত সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটাই হলো আসল। বিএনপি যে ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তাতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। যতদূর মনে আছে প্রধানমন্ত্রী নিজেও একবার ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলেছিলেন। যেখানে এখনো ইভিএম মেশিন শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়, সেক্ষেত্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে অতি উৎসাহী সিইসির ইভিএম মেশিন নিয়ে বক্তব্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। ইতোমধ্যে ইসিতে নতুন করে দ্বন্দ্বের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। একটি বড় অভিযোগ করেছেন চার জন কমিশনার। তাদের অভিযোগ কমিশনারদের না জানিয়ে সিইসি একাই অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। কিছুদিন আগে নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হবে এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়া উচিত হয়নি। একটি বা দুটি সিটে ধানের শীষের প্রতীকী প্রার্থী দিয়ে বিএনপি ইচ্ছে করলে তার নিবন্ধন ধরে রাখতে পারে এটা একটা সাধারণ মানুষও বোঝে। অথচ সিইসি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তার নিজের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করলেন!
নির্বাচনের খুব বেশিদিন বাকি নেই। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবি এখন শুধু দেশের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে না, বাইরে থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। সরকার সংবিধানের কথা বারবার বলছে। অথচ সংবিধানের ভেতরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রধানের আন্তরিকতাই হলো আসল। ২০১৪ এর পরিস্থিতির সাথে ২০১৮ এর পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ অব্দি নির্বাচনি জোটে পরিণত হবে কি না, তা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই নানা প্রশ্ন আছে। তবে সরকারকে ‘খালি মাঠে গোল না দেয়ার’ স্ট্র্যাটেজি বিএনপিকে নিতে হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করে যে সরকার এককভাবে নির্বাচন করতে পারে এবং সংসদে একটি বিরোধী দলও ‘সৃষ্টি’ করা সম্ভব। সুতরাং একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল নিয়েই বিএনপির এগিয়ে যাওয়া উচিত।
মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত বিএনপির নেতৃবৃন্দ। ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের পরও বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপিকে এটা ‘মোকাবিলা’ করেই নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যের ধারা অব্যাহত রেখে নির্বাচনের পথে যেতে হবে । এজন্য জনগণের সামনে একটি বিকল্প পরিকল্পনা উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সেটা এখনো করেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির প্রত্যাশাই-বা কি তাও প্রকাশিত নয়।
বিএনপির উচিত জাতির সামনে একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করা, যা ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ উপস্থাপন করেছে। তার আগে যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, এমনকি বাম জোটের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তাদের প্রস্তাব নিয়ে মত-বিনিময় করা উচিত। তাদের প্রস্তাবে সব দল যে ঐকমত্য পোষণ করবে, তেমনটি না-ও হতে পারে। তবে সবার সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো একটি সমাধান হয়তো পাওয়া যাবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে একটি যৌথ প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান সংশোধন করার কারণে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। বাধ্য করা না গেলে সরকার সংবিধান সংশোধন করবে না। এক্ষেত্রে বিএনপির দাবি সরকার মানবে বলে মনে হয় না।
ইতোমধ্যে সরকার ১৪ দলীয় জোটকে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাম দলীয় জোটের সাথে একধরনের ঐক্য করার কথা ভাবছে সরকার! এক্ষেত্রে যদি ন্যূনতম ঐক্যও হয়, এটাও ড. কামাল হোসেন তথা বিএনপির জন্য আরও একটি ‘মাইনাস পয়েন্ট’। তবে বাম ধারা আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ঐক্যে যাচ্ছে না। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ‘তৃতীয় ধারা’ সূচনা করতে চায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত ৪৭ বছরে ‘তৃতীয় ধারার’ কথা আমরা বারবার শুনেছি। কিন্তু মানুষ এই ধারাকে গ্রহণ করেনি। তবে এটা সত্য, এই তৃতীয় ধারার সাথে অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা রয়েছেন। কিন্তু মানুষ তাদের ‘ভোট’ দেয় না। তথাকথিত ইসলামিক দলগুলোরও যে ‘সমর্থন’ রয়েছে, বাম দলগুলোর তা নেই। কেন নেই? কেন বাম দলগুলো ভালো ভালো এবং ‘সত্য’ কথা বলেও মানুষের কাছে যেতে পারছে না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষের আস্থা ওই ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’-এ। তৃতীয় শক্তি হিসেবে ‘লাঙ্গলকেই’ মানুষ বেছে নিয়েছে শুধু এরশাদের ‘আঞ্চলিকতা প্রীতি’র কারণে।
রাজনীতি নয় বরং আঞ্চলিকতাই জাতীয় পার্টির মূল শক্তি। তবে লাঙ্গল কোনোদিনই ‘নৌকার’ বিকল্প হবে না, কিংবা ‘ধানের শীষ’-এর স্থান দখল করে নিতে পারবে না। বাস্তবতা যেহেতু ভোটের রাজনীতিতে ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষ’ অন্যতম ফ্যাক্টর, সেক্ষেত্রে এই দুটি বড় দলের মাঝে ‘আস্থার সম্পর্ক’ থাকা দরকার। এই আস্থার সম্পর্কই এ দেশের রাজনীতিতে একটি স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারে। এখন এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নির্ভর করে এই দুই দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ওপর। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ খুবই জরুরি।
Daily AmaderSomoy.com
06.10.2018

0 comments:

Post a Comment