রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

দুটি ছবি ও অনেকগুলো প্রশ্ন


রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর প্রধান দুই হত্যাকারী যথাক্রমে ইব্রাহিম (হৃদয়) ও আবু জাফরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ নাজমুল আলম তার ‘ফেইসবুক পেজ’-এ তাদের ছবিসহ এই তথ্যটি দিয়েছেন। তিনি দুদিন অভিযুক্ত হৃদয় ও জাফরের ছবি আপলোড করেন, যা ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে পুলিশের এই ভূমিকাকে আমরা স্বাগত জানাই। পুলিশ যে ইচ্ছে করলেই পারে, এটা তার বড় প্রমাণ। ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাসলিমাকে গত ২০ জুলাই। এর মাত্র তিন দিনের মাথায় অভিযুক্ত হৃদয় ও আবু জাফরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলো ডিবি পুলিশ। হৃদয় ও আবু জাফর এই গণপিটুনির নেতৃত্ব দিয়েছিল। ফেইসবুকে যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, তাতে অস্পষ্ট হলেও দেখা যায় হৃদয়কে। ডিবি পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের ছোট করতে চাই না। তারা সঠিক কাজটিই করেছেন। এভাবে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, এটা কোনো সভ্যসমাজে কল্পনাও করা যায় না। তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করবে। সেটা তারা করেছে। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের ওপর মানুষের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল।

দুই.
সরকার জনস্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। একাধিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে করে সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শৈথিল্য, অদক্ষতা, অনেক মহাপরিকল্পনা শেষঅব্দি সফল হবে না! রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর) একটি মহাপরিকল্পনা যেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। পঞ্চবটির এই এলাকা, যা বালুরমাঠ নামে পরিচিত ছিল, তা ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত ডাকাতদের অভয়ারণ্য। দিয়াবাড়ী-পঞ্চবটি এলাকায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষ হত্যা করে এখানে লাশ ফেলে রাখা হয়েছেÑ এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। শুধু তাই নয়, মিরপুর-বেড়িবাঁধ সড়কে একাধিকবার ডাকাতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সুতরাং এমনই একটি এলাকায় যখন রাজউক বসতি গড়ার উদ্যোগ নেয়, যখন হাজার হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করে, তখন প্রথমেই উচিত ছিল এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজউক তা করেনি। অদক্ষতা, সুশাসনের অভাব এই প্রজেক্টের ভবিষ্যৎকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

রাজউক কর্মকর্তারা এই প্রজেক্ট নিয়ে গর্ব করেন। তারা এই প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে চান। কিন্তু দিন-দুপুরে যখন সেখানে গাড়ি চুরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, রাতের বেলায় যখন কোনো স্ট্রিটলাইট থাকে না এবং পুরো এলাকাটি ডাকাতদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়, তখন কি রাজউক কর্মকর্তারা কোনো প্রশংসা আশা করতে পারেন? তখন কি তারা এই প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন? ৭৯টি হাইরাইজ ভবন উত্তরা রাজউক প্রজেক্টে ‘এ’ ব্লকে তৈরি করা হয়েছে। এরপর ‘বি’ ব্লকে তৈরি করা হবে ৭২টি ভবনে ৬০৪৮টি ফ্ল্যাট। তারপর ‘সি’ ব্লকে ৭২টি ভবনে তৈরি হবে আরও ৬৬০৮টি ফ্ল্যাট। এর অর্থ এই এলাকায় মোট ২২৩টি হাইরাইজ ভবনে মোট ১৮৭৩২টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। এরই মধ্যে শুধু ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে ৬৬৩৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ বসবাস করছে। ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লক এখনো নির্মাণাধীন।

অথচ ওই এলাকায় অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি দোলনচাঁপা ভবনে দিন-দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাসায় ডাকাতি হয়েছে এবং প্রকাশ্য দিবালোকে পার্কিং এলাকায় রাখা তার গাড়ি চুরির চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তুরাগ থানায় একটি মামলাও দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন চোরদের ছবিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশের (তুরাগ থানা) কোনো তৎপরতা নেই। আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি না ডিবি পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করবে এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে যেভাবে তাসলিমা বেগমের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে, একইভাবে ওই গাড়িচোর তথা ডাকাতদের গ্রেপ্তার করবে? এতে অন্তত ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে। সরকারের অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা, তা বাস্তবায়িত হবে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে বসবাসকারীরা এমনটাই প্রত্যাশা করে তুরাগ থানা তথা ডিবি পুলিশের কাছ থেকে।

তিন.
গত ২৩ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ বসে নেই। পুলিশকে দুর্বল ভাববেন না। ফেইসবুকে গুজব সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশে তিনি এ কথা বলেন (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই)। সম্প্রতি পদ্মা সেতু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজবের জেরে গণপিটুনিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেন। প্রায় একই সময় আইজিপিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। রাজধানীর পল্টন ও খামারবাড়িতে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী মন্তব্য করেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। রাষ্ট্রের পুলিশ প্রধান যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না।

ছেলেধরা সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে গুজবটি আরও মারাত্মক। একই সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বোমাসদৃশ বস্তু রেখে যাওয়া হচ্ছে। এসব আলামত ভালো নয়। সরকারকে বিপদে ফেলার এটি যে জঘন্য কাজ, তা একেবারে অস্বীকার যাবে না। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে দিন-দুপুরে ডাকাতির চেষ্টা, গাড়ি চুরির চেষ্টা, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর থেকে আস্থা হারানোÑ সবই একই পরিকল্পনার অংশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা তাই বড় ও ব্যাপক। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ তাসলিমার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে যারা গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের ছবি আছে এবং তাদের যদি গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, তাহলে ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে। না হলে ওই এলাকায় মানুষ আর বসবাস করতে আসবে না।

যেহেতু উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে রাজউক নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেÑ প্রয়োজন অনতিবিলম্বে এই এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া, পুরো এলাকাটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা, প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া, তুরাগ থানার কর্মকা- বাড়ানো। উত্তরা প্রজেক্টের দোলনচাঁপা ভবনের গাড়ি চুরির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছবি, তাদের ফোন নম্বর ও এনআইডি তুরাগ পুলিশকে দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা নেই কেন? এটা কি পুলিশের শুধু শৈথিল্য, নাকি অন্য কিছু? নাকি পুলিশ আদৌ উৎসাহিত হচ্ছে না? গাড়ি চুরির ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার ভবিষ্যৎই-বা কী? এর জবাব আমাদের জানা নেই। তবে আস্থাটা রাখতে চাই। পুলিশের অনেক দক্ষ অফিসার আছেন। আমার অনেক ছাত্র ও শুভাকাক্সক্ষী পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা। আমি তাদের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। এদের নিয়ে আমি গর্ব করতে চাই। অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের সহযোগিতা আমি পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। এদের অনেকেই আমাকে চেনেন। আমার বই পড়ে বিসিএস পাস করেছেনÑ অনেকে দেখা হলে এ কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন। আমি গর্বিত হই। তাসলিমার হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার হয়েছেÑ আমি স্বস্তি পেয়েছি। এখন দেখতে চাই উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে দোলনচাঁপা ভবনে যারা গাড়ি এবং ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা। যেকোনো অজুহাতে দায়িত্ব এড়ালে পুলিশের ওপর থেকে আস্থাটা চলে যাবে। পুলিশ আমাদের ভরসার স্থল, তুরাগ থানা-পুলিশ নেতৃত্ব যেন এমনটা মনে করে।
লেখক
তারেক শামসুর রেহমান | ২৮ জুলাই, ২০১৯

অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

রাজউক উত্তরা প্রকল্প কতটুকু নিরাপদ?


সাম্প্রতিক সময়ে একটি বড় ধরনের অভিযোগ উঠেছে রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের ব্যাপারে। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই রাজউকের কর্মকর্তারা এখানে বরাদ্দৃকত অ্যালোটিদের নিজ নিজ ফ্ল্যাটে উঠতে বাধ্য করছেন।
রাতের বেলা এ এলাকা একটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়। ভেতরের রাস্তায় কোনো স্ট্রিটলাইট নেই। ছিনতাইকারী আর চোর-ডাকাতরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়। কোনো নিরাপত্তাকর্মীর ব্যবস্থাও করেনি রাজউক।
একটি পুলিশ ফাঁড়ির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এখানে যারা থাকেন, তারা প্রচণ্ড একটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকেন। প্রকাশ্য দিবালোকে ফ্ল্যাটে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। গাড়ি ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়েছে। আমি নিজে এর ভুক্তভোগী।
অথচ রাজউক এক্ষেত্রে নির্বিকার। ফ্ল্যাটে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এ অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেকেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে অন্যত্র ক্রয় করার কথা ভাবছেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন অনেকে। আমি নিজেও এমনটি ভাবছি।
৯০৩০ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার টাকার প্রকল্প এটি। উত্তরা ১৮নং সেক্টর হিসেবে এটি পরিচিত হলেও এলাকাটি আশুলিয়ার কাছাকাছি বালুরমাঠ (পঞ্চবটি নামেও পরিচিত) নামক স্থানে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটি গড়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, এটি প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প।
এখানে মোট ৭৯টি ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক এলাকা নিয়ে। ভবনগুলোতে ইতিমধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়ে গেছে এবং গত নভেম্বর থেকে মানুষ এখানে বসবাস করতে শুরু করেছে। গত এক বছরে গুটিকয়েক পরিবার বসবাস শুরু করা ছাড়া শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি ফ্ল্যাট খালি পড়ে রয়েছে।
ফ্ল্যাট মালিকরা উঠছেন না। এর মূল কারণ নিরাপত্তাহীনতা ও যোগাযোগের অভাব। আমি অনেককে চিনি, যারা এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিন্তু থাকছেন অন্যত্র। তাদের সবার অভিযোগ- কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করেই দ্রুত ফ্ল্যাট মালিকদেরকে নিজ নিজ ফ্ল্যাটে উঠতে বাধ্য করেছে রাজউক!
অনেকেই অভিযোগ করেছেন, দুষ্কৃতকারীরা যদি কাউকে এখানে ‘খুন’ করে ফেলে রেখে যায়, তা দেখারও কেউ নেই! আরও একটা অভিযোগ- জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে পারে এই অঞ্চলটি।
পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটগুলো জঙ্গিরা ভাড়া নিতে পারে। এখানে বসে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে পারে তারা, যা দেখার কেউ নেই। সিসি ক্যামেরা লাগানোর কথা বলা হলেও আজ অব্দি কোনো ভবনে, এমনকি পুরো কম্পাউন্ডের কোথাও কোনো সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। ফলে এলাকায় বড় ধরনের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
২.
নিরাপত্তাহীনতা কোন্ পর্যায়ে তার তিনটি দৃষ্টান্ত দেই। এক. রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে বসবাসরত একজন কর্মজীবী নারী পঞ্চবটি বাসস্ট্যান্ডে নেমে হেঁটে তার ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলেন। তখন সন্ধ্যা। মাঝপথে তিনি আক্রান্ত হন। তার সবকিছু ছিনতাই হয়ে যায়।
দুই. দিনদুপুরে ‘দোলনচাঁপা’ ভবনে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা মালিকের অবর্তমানে তার ফ্ল্যাটের লক/ সিকিউরিটি লক কেটে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে যায়। এবং পরে ওই ডকুমেন্ট (গাড়ির কাগজপত্র, ব্লু বুক, চাবি, ফিটনেসের কাগজ ইত্যাদি) দেখিয়ে গাড়ি চুরির চেষ্টা করে।
তিন. ‘সুরমা’ ভবনে রাতের বেলা বিদেশ প্রত্যাগত ফ্ল্যাট মালিকের আত্মীয় এসেছে এই খবর পেয়ে ডাকাতরা ওই ভবনে চড়াও হয়। একাধিকবার কলিংবেল বাজিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। এমনকি ফ্ল্যাট মালিক ফ্ল্যাটে থাকা সত্ত্বেও ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রুম খোলার চেষ্টা করে।
ওই এলাকায় নিরাপত্তাহীনতা কোন্ পর্যায়ে নেমেছে, এ তিনটি ঘটনা এর বড় প্রমাণ। প্রতিটি ঘটনা রাজউক ও পুলিশকে জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় তুরাগ থানায় মামলা হয়েছে। তুরাগ থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে গাড়ি চোরের ছবি, তার ফোন নম্বর, এমনকি এনআইডি নম্বর পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই! অগ্রগতি খুব একটা নেই।
রাজউক চাচ্ছে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে লোকজন আরও উঠুক। কিন্তু দিনের বেলা সংঘবদ্ধ ডাকাত দল যদি ডাকাতি করতে আসে, যদি প্রকাশ্য দিবালোকে গাড়ি চুরির চেষ্টা চালায়, তাহলে ওই এলাকায় কি মানুষ বসবাস করতে আসবে? যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন, তারা এখন ফ্ল্যাট বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবেন।
এই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বটি কার? তুরাগ থানা কি তার দায়দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে? মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেবেন? ডিএমপি কিংবা উত্তরা ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বও রয়েছে। এ দায়িত্ব পুলিশ কর্মকর্তারা উপেক্ষা করতে পারেন না।
৩.
সরকার জনস্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। একাধিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এজন্য সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শৈথিল্যে, অদক্ষতায় অনেক মহাপরিকল্পনা শেষ অব্দি সফল হবে না।
রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (উত্তরা ১৮নং সেক্টর) এমন একটি মহাপরিকল্পনা, যা এখন শুধু বিতর্কেরই জন্ম দিচ্ছে। রাজউক তার দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেনি। পঞ্চবটির এই এলাকা, যা বালুরমাঠ নামে পরিচিত, তা ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত ডাকাতদের অভয়ারণ্য।
দিয়াবাড়ী-পঞ্চবটি এলাকায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষ হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে- এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। শুধু তাই নয়, মিরপুর-বেড়িবাঁধ সড়কে একাধিকবার ডাকাতি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
সুতরাং এমন একটি এলাকায় যখন রাজউক বসতি গড়ার উদ্যোগ নেয়, যখন হাজার হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করে, তখন প্রথমেই উচিত ছিল এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজউক তা করেনি। অদক্ষতা, সুশাসনের অভাব এই প্রজেক্টের ভবিষ্যৎকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজউক কর্মকর্তারা এই প্রজেক্ট নিয়ে গর্ব করেন। তারা এ প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে চান। কিন্তু দিনদুপুরে যখন গাড়ি চুরির চেষ্টা চালানো হয়, রাতের বেলায় যখন কোনো স্ট্রিটলাইট থাকে না এবং পুরো এলাকাটি ডাকাতদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়, তখন কি রাজউক কর্মকর্তারা কোনো প্রশংসা আশা করতে পারেন? এখন কি তারা এই প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন?
৭৯টি হাইরাইজ ভবন উত্তরা রাজউক প্রজেক্টের ‘এ’ ব্লকে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর ‘বি’ ব্লকে নির্মাণ করা হবে ৭২টি ভবনে ৬ হাজার ৪৮টি ফ্ল্যাট। তারপর ‘সি’ ব্লকে ৭২টি ভবনে নির্মাণ করা হবে আরও ৬ হাজার ৬০৮টি ফ্ল্যাট। এর অর্থ, এ এলাকায় মোট ২২৩টি হাইরাইজ ভবনে মোট ১৮ হাজার ৭৩২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে।
ইতিমধ্যে শুধু ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ বসবাস করছে। ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লক এখনও নির্মাণাধীন। এক্ষেত্রে শুধু পরিকল্পনা নিয়ে ভবন নির্মাণ করলেই চলবে না, এ এলাকার নিরাপত্তার ব্যাপারটিও রাজউককে নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এ প্রজেক্টে মানুষ বসবাস করবে না। সরকারি অর্থের অপচয় হবে মাত্র!
৪.
যেহেতু উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে রাজউক নিুলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে : ১. অনতিবিলম্বে এ এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া; ২. পুরো এলাকাটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা; ৩. প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া; ৪. তুরাগ থানার কর্মকাণ্ড বাড়ানো।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেনুর হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হৃদয়কে পুলিশ অতি দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু উত্তরা প্রজেক্টের ‘দোলনচাঁপা’ ভবনের গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছবি, তাদের ফোন নম্বর ও এনআইডি নম্বর তুরাগ পুলিশকে দেয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা নেই কেন? এটা কি পুলিশের শৈথিল্য, নাকি অন্য কিছু? নাকি পুলিশ আদৌ এ ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছে না? গাড়ি চুরির ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার ভবিষ্যৎই বা কী?
প্রধানমন্ত্রীর অনেক ‘স্বপ্নের’ একটি হচ্ছে এই রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট। ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে। জমি নেই। তাই হাইরাইজ ভবন নির্মাণ। সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভালো ও প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দক্ষ জনশক্তি দরকার, তা রাজউকের নেই। তাদের মাঝে এক ধরনের শৈথিল্য ও দায়সারা ভাব লক্ষ করা যায়।
তাদের মাঝে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। এই অনীহা, শৈথিল্য, অদক্ষতা এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ৯০৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের যদি সফল বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এটা সরকারের জন্য একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেবে, যা আমরা কেউই চাই না।



২৭ জুলাই ২০১৯

তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

রিফাত হত্যাকাণ্ড ও গণমাধ্যম


শেষ পর্যন্ত জানা গেল বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জড়িত। মিন্নি নিজে তা স্বীকার করেছেন, এ বক্তব্য বরগুনার পুলিশ সুপারের। এসপি জানিয়েছেন, একাধিক আসামি আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মিডিয়া আমাদের এভাবেই সংবাদটি পরিষ্কার করেছে। মিন্নি তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কতটুকু জড়িত ছিলেন কিংবা আদৌ জড়িত ছিলেন কি না, এর বিচার একদিন হবে। নিশ্চয়ই আমরা তখন জানতে পারব মিন্নি ওই হত্যাকাণ্ডে কতটুকু জড়িত ছিলেন; কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে বারবার তাড়িত করে তা হচ্ছে, কেন স্থানীয় আইনি সহায়তা পেলেন না মিন্নি? একজন নাগরিক যদি দোষী হন, তাহলেও এটা তাঁর সাংবিধানিক অধিকার তিনি একজন আইনজীবীর সহায়তা পাবেন। কেন স্থানীয় আইনি সহযোগিতা তিনি পেলেন না? এখানে কী স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কোনো ‘হুমকি-ধমকি’ আছে?
পেশাগত কারণেই তো আইনজীবীরা এ ধরনের একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে ‘ভিকটিমের’ পক্ষে থাকবেন। প্রথম দিকে তাঁরা থাকলেন না কেন? এমনকি কোর্টও তো একজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারতেন? এ ক্ষেত্রেও তো তেমন কিছু হয়নি। নারীদের অধিকার নিয়ে যাঁরা ঢাকায় সোচ্চার, যাঁরা সভা-সমিতি করে নারীদের অধিকারের কথা বলেন, তাঁরাও তো একজন নারীর পাশে দাঁড়াতে পারতেন? হতে পারে সেই নারী হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত! কিন্তু একজন অসহায় নারী, যিনি স্বামী হারিয়েছেন মাত্র কয়েক দিন আগে, যিনি একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, হঠাৎ করে তিনি ‘খুনের আসামি’ হয়ে গেলেন! একজন স্থানীয় আইনজীবীকেও পেলেন না তাঁর পাশে, নারীবাদীদের কি তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো উচিত ছিল না? এ ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিল স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি কত বিভক্ত ও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল, সেখানে কারা ০০৭ বন্ড বাহিনী তৈরি করেছিল? কেন করেছিল? মাদক কারবারের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? আঙুল নির্দেশ করা আছে একজন ‘বিশেষ ব্যক্তি’ ও তাঁর সন্তানের দিকে। কথাটার সত্যটা কতটুকু? রিফাত হত্যাকাণ্ডে এই ০০৭ বন্ড বাহিনীর মূল মদদদাতাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হলো কেন, আমরা চাই সত্যটা বেরিয়ে আসুক। যদি মিন্নি সত্যি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁর শাস্তি হোক। কিন্তু এই মামলার ক্ষেত্রে মিন্নির পক্ষে প্রথম দিকে কোনো আইনজীবী না থাকা ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান সমাজে এ ধরনের খারাপ সংবাদের সংখ্যাই যেন বেশি। প্রতিদিনই এ ধরনের হাজারটা মন্দ সংবাদ আমাদের শুনতে হয়। জানতে হয়।
আর ভালো খবরগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায় মন্দ খবরের কারণে। সমাজে মন্দ খবরের সংখ্যাই যেন বেশি। অতি সাম্প্রতিককালে মন্দ খবরগুলোই যেন বেশি করে চোখে পড়ে। কিছুদিন আগে রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের ‘বালিশ’ কাহিনি সারা দেশে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেখানে রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ২১টি বহুতলবিশিষ্ট ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ভবন তৈরি ও মালামাল সরবরাহের দুর্নীতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিল একটি সংবাদপত্র। তাতে দেখা যায়, একটি বালিশ ক্রয় করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা দিয়ে, আর তা ভবনে তুলতে খরচ হয়েছে ৭৬০ টাকা। একটি বিদ্যুতের স্টোভ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে সাত হাজার ৭৪৭ টাকা। এবং যাঁরা এটা তুলেছেন তাঁদের উত্তোলন খরচ দেখানো হয়েছে স্টোভপ্রতি ছয় হাজার ৬৫০ টাকা (ঢাকা ট্রিবিউন, ৪ জুলাই)। শেষ অবধি এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছেন। তাতে হাইকোর্ট নির্মাণাধীন ওই ভবনের আসবাবপত্র বিশ্বস্ততার সঙ্গে (গুড ফেইথ) কেনা ও উত্তোলনের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছেন (মানবজমিন, ৩ জুলাই)। আমরা জানি না শেষ অবধি দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে কি না? তবে সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সম্পর্কে মন্তব্য করেন, তখন দোষীদের বিচার হবে, এটা আশা করতেই পারি। কিন্তু এ ধরনের ‘বালিশ কাহিনি’ তো শত শত—এর কয়টিই বা সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়, কয়টির ক্ষেত্রেই বা হাইকোর্ট রুল ইস্যু করেন?
হাইকোর্টের এই রুল ইস্যুর কাহিনি যখন সংবাদপত্রে ঘোষিত হয়, তখন প্রকাশিত হয়েছে আরো কয়েকটি সংবাদ—বিটিসিএলের আধুনিকায়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ৮০০ কোটি টাকা, যেখানে একটি সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে এক লাখ টাকা করে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৮০ লাখ টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে সাত কোটিতে, আর ভবন তৈরির আগেই যন্ত্রপাতি কিনতে প্রতিনিধিদল গিয়েছিলেন জার্মানিতে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আছে আরেকটি সংবাদ—৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণে সুদ দিতে হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে চুক্তি হয়েছে ১৮ লাখ টাকার, অগ্রিম দিতে হয়েছে ১০ লাখ। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে, এক বছরে বেড়েছে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ‘বালিশ’ কাহিনির মতো আরো একটি সংবাদ—সাত লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে একটি রেইনট্রিগাছ! এটা পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পায়রা সেতুর (লেবুখালী) নদীর তীর রক্ষা প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে এ টাকা! আর সিলেট রেলওয়ে দুর্ঘটনার পর জানা গেল ‘বাঁশ কাহিনি’—রেলওয়ে স্লিপার যাতে খুলে না যায়, সে জন্য বাঁশ দিয়ে পেরেক মেরে আটকানো হয়েছে। সংবাদপত্রে রয়েছে সেই কাহিনি—হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ৮০টি নাটের জায়গায় রয়েছে ৩৫টি, তা-ও পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া এবং নষ্ট (সিলেট টাইমস)। আগের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আমাদের জানিয়েছিলেন, রেললাইন স্লিপারে বাঁশ ব্যবহার সম্পূর্ণ যৌক্তিক। আর এবার মৌলভীবাজারে আন্ত নগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ দুর্ঘটনার পর বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানালেন, ‘মানুষ হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে ওঠে, তাই এই দুর্ঘটনা’। মন্দ সংবাদ তো আরো আছে—২০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.২ লাখ কোটি টাকা। দুধে ডিটারজেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, ফরমালিন, মসলায় টেক্সটাইল রং, তেল মানহীন। পাম অয়েলের সঙ্গে ফেভিকল গাম মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি গাওয়া ঘি’। কী অদ্ভুত দেশে আমরা বসবাস করি। ন্যূনতম বেঁচে থাকার নিরাপত্তাটুকুও যেন আমাদের আর নেই! সুশাসনের অভাব যেন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রিফাতকে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এই ঘটনায় হাইকোর্টের বিচারপতিরা মর্মাহত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এটা জনগণেরও ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মানুষ তো এমন ছিল না’। আদালতের আরো একটি মন্তব্য ছিল এ রকম—‘নয়ন বন্ড এক দিনে তৈরি হয়নি, তাকে কেউ না কেউ লালন করেছে’। মিথ্যা বলেননি হাইকোর্টের বিচারপতিরা। একজন সন্ত্রাসী যদি প্রশ্রয় না পায়, তাহলে সে প্রকাশ্যে এভাবে মানুষ খুন করতে পারে না। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাই পরোক্ষভাবে বলে গেলেন মাননীয় বিচারপতিরা। সমাজ কিভাবে বদলে যাচ্ছে এটা তার বড় প্রমাণ। একজন ডিআইজি মিজান ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন, কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন। আর ওসি মোয়াজ্জেমের কাহিনি তো সবার জানা। মন্দ সংবাদগুলো সব ভালো সংবাদগুলোকে চেপে রাখে। ভালো সংবাদগুলো আর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় না। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একটি মন্দ সংবাদ আরেকটি মন্দ সংবাদের জন্ম দেয়। একটি মন্দ সংবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের যখন বিচার হয় না, তখন মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ে। এ ধরনের হতাশা একটি দেশের জন্য কখনোই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনতে পারে না।
নয়ন বন্ড, ০০৭ বন্ড, মিন্নিরা তো আমাদের সমাজেরই প্রতিনিধি। বরগুনার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। আমরা চাই, সত্যটা বেরিয়ে আসুক। সরকারি দলের নেতাদেরও কেউ কেউ বলেছেন, ‘বন্ডরা এক দিনে তৈরি হয়নি!’ কথাটার মধ্যে মিথ্যা কিছু নেই। কিন্তু কেন ০০৭ বন্ড নামে একটি সংগঠন তৈরি হবে—এটা জানাও জরুরি। এটাও তো এক দিনে তৈরি হয়নি। কারো না কারো আশ্রয়ে, লালন-পালনে ০০৭ বন্ডের জন্ম। এরা কারা? সরকার কি এটা তলিয়ে দেখবে? এ ধরনের সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে না। বরগুনার একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশকে আমরা বিচার করতে চাই না। কিন্তু একটা ‘০০৭ বন্ড কাহিনি’ যেন আরেকটি বন্ড কাহিনির জন্ম না দেয়। একজন ব্যক্তির হাতে যদি ২৫ বছর দলের নেতৃত্ব থাকে, তাকে কেন্দ্র করে একটা সুবিধাবাদী নেতৃত্ব তৈরি হবেই। বরগুনার ক্ষেত্রেও তেমনি হয়েছে। এই সুবিধাবাদী শ্রেণিই তাদের স্বার্থে ‘বন্ড বাহিনী’ তৈরি করে।
মিন্নি কাহিনি এই মুহূর্তে আলোচিত। তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটা অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। আশার কথা, ঢাকা থেকে একদল আইনজীবী যাবেন মিন্নির পক্ষে লড়তে। তাঁরা সেই কথা জানিয়েছেন। কিন্তু বরগুনা আইনজীবী সমিতির সদস্য যদি তাঁরা না হয়ে থাকেন, তাঁরা আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারবেন কি? এটা একটা প্রশ্ন। মিন্নির মতো হয়তো এ ধরনের সংবাদ সব সময় সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। কিন্তু এর বাইরেও প্রতিদিনই যেসব অনিয়মের সংবাদ সংবাদপত্রে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাপা হয়, তা আমাদের আশাবাদী করে না। আমাদের হতাশায় ফেলে দেয়। ৪৮ বছরের বাংলাদেশের যে জীবন, এই জীবনে আমরা আশাবাদী হতে চাই। মিন্নি কাহিনি যেন আমাদের সেই আশাবাদের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।
নিউ ইয়র্ক, যুুক্তরাষ্ট্র
 kalerkantho
২৪ জুলাই, ২০১৯ 

তারেক শামসুর রেহমান

লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com




সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপ্রধান : এরশাদ অধ্যায়




গত শতাব্দীর সত্তর দশকে একাডেমিক সার্কেলে সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাঠ্যসূচিতে অন্যতম বিষয় ছিল সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক। অর্থাৎ প্রশাসনে, রাষ্ট্রকাঠামোয় সেনাবাহিনীর ভ‚মিকা। বিষয়টি একাডেমিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। আমরা যারা আশির দশকে ইউরোপে পড়তে গিয়েছিলাম, আমাদের কোর্স ওয়ার্কেরও অন্তর্ভুক্ত ছিল এই বিষয়টি। এমনকি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিলেবাসেও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেনাবাহিনী কেন ক্ষমতা দখল করে, তারা কোন মডেল অনুসরণ করে এ নিয়ে বিদেশে শত শত গবেষণা হয়েছে। পিএইচডি থিসিস হয়েছে। বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার নিজেরও এ সংক্রান্ত একটি বই রয়েছে, যা এই মুহূর্তে হয়তো আর বাজারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওই সময় একটা কথা চালু ছিল, কেউ যদি একবার ল্যাতিন আমেরিকার কোনো একটি দেশের সেনাবাহিনী প্রধান হতে পারেন, তাহলে তার জন্য প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দরজা সব সময় খোলা থাকে। প্রেসিডেন্ট হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ কারণেই সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কটি অন্যতম একাডেমিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কও অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু, সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান, সিপাহি বিদ্রোহ, রানী মৌমাছি, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানÑ ১৫ বছরের এই যে সময়সীমা, ওই সময় সিভিল মিলিটারি সম্পর্ক একটি মাত্রা পেয়েছিল। ওই সময়সীমায় সেনা শাসকরা দল করেছেন। যা ছিল অনেকটা তত্ত¡ মাফিক, নিজেরা উর্দি ছেড়ে রাজনীতিবিদ হয়েছেন। কেউ সফল হয়েছেন। কেউ সফল হতে পারেননি। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ ওই সময়সীমায় ক্ষমতায় ছিলেন। এ ক্ষেত্রে এদের সঙ্গে পার্থক্য ছিল এক জায়গায়Ñ জিয়া পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন। আর এরশাদ গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছিলেন। কিন্তু মিল আছে এক জায়গাতে দুজনই দল গঠন করেছেন। যে দল দুটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও অন্যতম একটি ‘শক্তি’। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পরও তার দল বিএনপি অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের। বলা যেতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প হচ্ছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করেই বিএনপির রাজনীতি বিকশিত হয়েছে এবং দলটি এখনও টিকে আছে। অন্যদিকে এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি তার অস্তিত্ব নিয়ে কত দিন টিকে থাকবে, এটা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে উন্নয়নশীল বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ায় এবং সমর্থন না পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র তা ‘প্রমোট’ও করে। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না উন্নয়নশীল বিশ্বে সামরিক বাহিনী এখনও একটি শক্তি এবং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা প্রভাব বিস্তার করে আসছে। কোথাও কোথাও তারা একটি করপোরেট শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মিসর এর বড় উদাহরণ।
তত্ত¡গতভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনানায়করা যা করেন, তা হচ্ছে তারা একটি দল গঠন করে ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। এখানে রানী মৌমাছি তত্ত¡ কাজ করে। অর্থাৎ একটি রানী মৌমাছিকে ঘিরে যেমনি একটি মৌচাক তৈরি হয়। ঠিক তেমনি একজন সেনানায়ককে ঘিরে তৈরি হয় একটি রাজনৈতিক বলয়। সেই রাজনৈতিক বলয় সেনানায়ককে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করে। মিসরে এমনটি হয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও আমরা তেমনটি দেখি। অনেক ক্ষেত্রেই আগের সেনানায়ক যে দল গঠন করেন, পরের সেনানায়ক আর সেই দলে আশ্রয় নেন না। বরং নতুন একটি দল গঠন করেন। মিসরে জামাল আবদেল নাসের (১৯৫৪-৭০) যে দল গঠন করে ক্ষমতা পরিচালনা করেছিলেন, আনোয়ার সাদাত (১৯৭০-৮১), কিংবা হোসনি মোবারক (১৯৮১-২০১১) সেই দলে যোগ দেননি। তারা নতুন দল গঠন করেছিলেন। পাকিস্তানে জেনারেল জিয়া কিংবা জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আলাদা আলাদা দল গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আদর্শ এক হলেও (বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিরাষ্ট্রীয়করণ ইত্যাদি প্রশ্নে), জিয়া ও এরশাদের দল ছিল আলাদা আলাদা। কখনই দল দুটি একত্রিত হওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এখানে রাজনীতির চেয়ে বেশি প্রশ্ন ছিল নেতৃত্বের।
সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন এরশাদ। জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়ে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান। সেই অর্থে প্রায় ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবন ছিল তার। এই রাজনৈতিক জীবনে তিনি জেল খেটেছেন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বারবার সংসদে এসেছেন। একাধিকবার, জেলে থেকেও পাঁচ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, তার কারণেই জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটা বলতেই হবে, তার অবর্তমানে দলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। যিনি দলের ‘ঐক্য’ ধরে রাখতে পারবেন। দল মূলত অলিখিতভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছেÑ এক ভাগ জিএম কাদেরের পেছনে, অপর ভাগ রওশন এরশাদের পেছনে। বাস্তবতা হচ্ছে এদের দুজনের কারও সেই ‘ক্যারিসমা’ নেই। জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙে যেতে পারেÑ সে সম্ভাবনাও আছে। রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে টিকে 
থাকতে হলে জাতীয় পার্টিকে এখন ব্যক্তি নয় বরং একটি নতুন রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
পরিণত বয়সে এরশাদ মারা গেলেন। ইতিহাস তাকে চ‚ড়ান্ত বিচারে কীভাবে চিহ্নিত করবে, আমি তা জানি না। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার কোনো অবদান ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও যুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার এটাইÑ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও পরবর্তীতে সেনাপ্রধান (১৯৭৮) হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, এটা তার দুঃখ যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। যেসব ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তাদেরই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেকেই তখন অন্তর্দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় সেনা নেতৃত্বের অসন্তোষ, অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিয়েছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসাররা। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন এরশাদ। যিনি ‘ডিভাইড ত্রæড রুল’ পলিসি অবলম্বন করে সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। তার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে তিনি অনেকগুলো ভালো কাজ করেছিলেন। মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করা, উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা, শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা, সড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি অনেক ভালো ভালো কাজের জন্য তার নাম বারবার উচ্চারিত হবে। কিন্তু স্বৈরাচারের তকমা, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক, নারী প্রীতির অপবাদ তিনি দূর করতে পারেননি। পারিবারিক জীবনও তার সুখের ছিল না। ৬৩ বছরের সাংসারিক জীবনে রওশন এরশাদের সঙ্গে তার বৈবাহিক বিচ্ছেদ ঘটেনি সত্য, কিন্তু দীর্ঘ ২০-২৫ বছর তারা আলাদা 
থাকতেন, যা মুসলমান অধ্যুষিত সমাজে কখনই ভালো চোখে দেখা হয়নি।
সিভিল মিলিটারি সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় পৃথিবীর যেসব দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং যেখানে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে, কোনো জায়গাতেই সেনানায়করা তেমন জনপ্রিয়তা পাননি। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। ব্যতিক্রম আছে। জামাল আবদেল নাসের (১৯৫৪) ক্ষমতা গ্রহণ করে ‘প্যান অ্যারাবিয়ান’ রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, যা তাকে আরব বিশে^র অন্যতম জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করে। তাকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে অনেক আরব নেতাই জনপ্রিয় হয়েছেন। জায়ারের মুবুতোর কথাও বলতে পারি (১৯৬৫-৯৭), যিনি সেনাবাহিনীর অফিসার হয়ে দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ও পরে দেশটিকে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিণত করেছিলেন। আর্জেন্টিনার পেরনের কথা অনেকের মনে থাকার কথা (১৯৪৬-৫৫, ১৯৭৩-৭৪)। তুমুল জনপ্রিয়তার অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। তার নিজের নামে দল গঠন করে (পেরনিস্ট পার্টি) তিনি ক্ষমতায় থেকেছেন। শুধু তাই নয় তার স্ত্রী ইসাবেলা পেরনও শুধু স্বামীর নামে সে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন। হুগো শ্যাভেজ (১৯৯২-২০১৩) ভেনিজুয়েলায়, সুহার্তো (১৯৬৭-৯৮) ইন্দোনেশিয়ায়, দ্য গল (১৯৫৯-৬৯) ফ্রান্সে এক ধরনের পপুলিজমের জন্ম দিয়েছিলেন। সুহার্তো ও নে উইন (১৯৫৮-৮১, মিয়ানমার) সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন তাদের সঙ্গে। ইন্দোনেশিয়ার ‘গোলকার’ সিসটেমের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সরাসরি পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করত, যে পদ্ধতি এখনও মিয়ানমার অনুসরণ করছে। উর্দি পরেই সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা সেখানে ক্ষমতার অংশীদার। এখন ভাইস প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা। তুরস্কে কামাল পাশার (১৯২৩-৩৮) কথাও বলতে পারি, যিনি অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করে তুরস্ককে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ও শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছিলেন। সুতরাং সেনা অফিসার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া কেউ কেউ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন বটে। জেনারেল এরশাদের অনেক কর্মকাÐ বিতর্কিত। তবে তার নামেই দল (জাতীয় পার্টি) পরিচালিত হয়েছে। তিনিই ছিলেন মুখ্যব্যক্তি। এখানে রাজনীতি ছিল কম। এরশাদকে কেন্দ্র করেই জাতীয় পার্টির রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হয়েছে। এখন জাতীয় পার্টি তার অস্তিত্ব নিয়ে কতদিন টিকে থাকতে পারবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।

সময়ের আলো
রোববার, ২১ জুলাই

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র  


তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক






একটি গবেষণা ও আমলাতন্ত্রের চোখ রাঙানি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের একটি গবেষণা নিয়ে যে ‘বিতর্কের’ সৃষ্টি হয়েছিল, তার রেশ এখনও আছে। সর্বশেষ ঘটনায় আমরা দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি একটি অনলাইন পোর্টালকে জানিয়েছেন, ‘তার পক্ষে (অধ্যাপক ফারুক) সমগ্র জাতি থাকবে। আর তিনি তো ঢাবির অধ্যাপক হিসেবেই গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।’ বলা ভালো, গত ২৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ এবং বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের এক যৌথ গবেষণায় দেশের পাঁচটি কোম্পানির উৎপাদিত পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান পান গবেষকরা। কোম্পানিগুলো হচ্ছে প্রাণ, মিল্ক ভিটা, ইগলু, আড়ং ও ফার্ম ফ্রেশ। এর পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে বড় প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একটি অনুষ্ঠানে ওই গবেষক অর্থাৎ অধ্যাপক ফারুকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দেন। নিজে একজন গবেষক না হয়েও এবং জীবনে কোনোদিন কোনো গবেষণাকর্মে সম্পৃক্ত না থেকেও জানান, গবেষণা প্রতিবেদনে কোনো ‘প্রোটোকল’ মানা হয়নি। একটি টিভি চ্যানেলেও তিনি তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী দু’জন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারেননি। মূলত অধ্যাপক ফারুকের গবেষণা নিয়ে যতটুকু না ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি হয়েছে ওই আমলার বক্তব্যে।একজন আমলা কি একটি গবেষণা নিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন? তিনি ‘আইনি পদক্ষেপের’ কথা বলে কি অধ্যাপক ফারুকের মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ করলেন না? অধ্যাপক ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য। আমি খুশি হতাম যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাকে ওই আমলার উদ্দেশে একটি উকিল নোটিশ পাঠানোর নির্দেশ দিতেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। আমি জানি না অধ্যাপক ফারুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নীল দল’ না ‘সাদা দল’ করতেন। যদি তিনি নীল দলের শীর্ষ নেতা হয়ে থাকতেন, তাহলে কি উপাচার্য এত দেরিতে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারতেন? আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের নেতারা, যারা টিভিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন’ নিয়ে কথা বলেন, তাদের একজনও কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। পরিস্থিতি আজ কোথায়- ভাবতেও আমার অবাক লাগে। ছাত্রতুল্য একজন আমলা, তিনি কিনা অধ্যাপক ফারুকের মতো একজন সিনিয়র শিক্ষককে অনেকটা ‘গ্রেফতারের’(?) ভয় দেখান! আইনি নোটিশ মানেই তো হুমকি! তিনি যে ধরনের কথা বলেছেন, এতে কি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আছে? মন্ত্রীও কি আমলার এ বক্তব্য ধারণ করেন? মন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মন্ত্রী বাহাদুর কি বোঝেন এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা দূরত্ব তৈরি হল! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন- তাহলেই বুঝতে পারবেন। এই আমলা এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে কার স্বার্থ রক্ষা করলেন?
প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যাপক ফারুকের নেতৃত্বে একটি টিম গবেষণা করেছে। এ গবেষণায় তারা পেয়েছেন উল্লিখিত পাঁচটি কোম্পানির দুধে অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরও বেশকিছু উপাদান, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করেও তারা একই উপাদান পেয়েছেন। ওই আমলার ‘সমস্যা’টা এখানেই- অধ্যাপক ফারুক আগে কেন মন্ত্রণালয়কে গবেষণার ফলাফল জানালেন না? কেন এটা ‘পিয়ার রিভিউ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশ না করে সংবাদ সম্মেলন করলেন? ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। এ ভদ্রলোক আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কি না সন্দেহ! অনেক সচিবকেই চিনি, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথাকথিত মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। আমি বেশ ক’বছর পিএসসিতে ভাইভা বোর্ডে ছিলাম। তখন আমি অনেক বিএ পাস পরীক্ষার্থী পেয়েছি, যাদের কেউ কেউ চূড়ান্ত বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে সচিব পর্যন্ত হয়েছেন! অধ্যাপক ফারুক তো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুদান নিয়ে ওই গবেষণাটি করেননি যে, তাকে তার গবেষণাটি মন্ত্রণালয়েই জমা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি গবেষণার ফলাফলটি কোনো গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করতে চান বা গবেষণাকর্ম জমা দেন, শুধু তখনই ‘পিয়ার রিভিউ’র প্রশ্নটি আসবে, এর আগে নয়। এমনও তো হতে পারে তিনি আগামীতে এটা কোনো জার্নালে প্রকাশ করবেন, কিংবা আদৌ করবেন না। গবেষণার ‘মেথোডলজি’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা কি ওই আমলার সাজে? তিনি ‘মেথোডলজি’ কী তা বোঝেন? সব ‘মেথোডলজি’ এক হয় না। সমাজবিজ্ঞানের ‘মেথোডলজি’র সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো শাখার ‘মেথোডলজি’কে মেলানো যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অধ্যাপক ফারুক গবেষণা সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপন করলেন? এটা তিনি করেছেন জনস্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে। বলা ভালো, এ গবেষণার জন্য তিনি আরেকটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পেয়েছেন। বিভাগের সভাপতি এটা অনুমোদনও করেছেন। তাহলে? তিনি গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল কেন জাতিকে জানাবেন না? এর সঙ্গে তো জনস্বার্থ জড়িত। তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন।
আমি নিজে গবেষণা করি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার গবেষণাধর্মী বই আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির ওপর আমার একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ও নীতি পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং কিছু সুপারিশমালাও দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত আমলার ‘হুমকি’টা যদি আমি বিবেচনায় নিই, তাহলে কি আমি আমার পাণ্ডুলিপি আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাব? তারা ‘অনুমোদন’ দেবেন, তারপর আমি তা প্রকাশ করব? এটা একটা ভুল ধারণা। কোনো গবেষকই এমনটা করেন না। তাই অধ্যাপক ফারুক যেটা করেছেন, সেটা যৌক্তিক। তিনি দায়বদ্ধতা থেকে এটা করেছেন। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি চাকরি করেন না আমলাদের মতো। তারা রাষ্ট্র থেকে বেতন-ভাতা পান বটে, কিন্তু তাদের ‘সরকারি চাকুরে’ হিসেবে গণ্য করা অন্যায়। ওই আমলা একজন সিনিয়র অধ্যাপককে ‘হুমকি’ দিয়ে শুধু বড় অন্যায়ই করেননি, বরং পুরো আমলাতন্ত্র সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছেন। আমি মনে করি, একজন অধ্যাপক ফারুককে ‘হুমকি’ দেয়া মানে পুরো শিক্ষক সমাজকে হুমকি দেয়া। আমি হুমকি দেয়া ওই আমলার ‘বিচার’ দাবি করছি। আমি মনে করি, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যে মানহানির মামলা করার প্রস্তাব দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অধ্যাপক ফারুক এটা বিবেচনায় নিতে পারেন।
এখন মূল প্রশ্নে আসি। দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষায়ও দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। ওই পাঁচটি দুধ কোম্পানি ও মন্ত্রণালয় এটা মানতে নারাজ। তারা আপত্তি জানিয়েছে। হাইকোর্ট এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন- চারটি গবেষণাগার থেকে দুধ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানেও কথা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে ‘দুধ পরীক্ষা’ হবে, তার মাঝে সরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে। তারা কি সরকারের ‘অবস্থানের’ বাইরে যেতে পারবে? যদি ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া যায়, তখন কী হবে? এতে করে কি পুরো ‘সত্যটা’ পাওয়া যাবে? এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে এবং বিদেশ থেকে ‘দুধের নমুনা’ পরীক্ষা করিয়ে আনা যেতে পারে। একই সঙ্গে সমস্যার মূলে যেতে হবে। গরুকে যে গো-খাদ্য সরবরাহ করা হয় অথবা খাওয়ানো হয়, তাতে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। ফলে গো-মাংসে ও দুধে অ্যান্টিবায়োটিক থাকবেই। গো-খাদ্য উৎপাদনে কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে কিংবা আদৌ যাবে কি না, সে ব্যাপারে নীতিমালা থাকা দরকার। একই সঙ্গে নিয়মিত গো-খাদ্য পরীক্ষা করাও জরুরি। এখানে আমাদের শিথিলতা রয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এখানে নেই বললেই চলে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং গো-খাদ্য উৎপাদন, পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ- এসব যদি মনিটর করত, তাহলে ভালো করত। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন- আর তা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, যাদের মাঝে নারীরাও রয়েছেন, তারা গো-দুগ্ধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। গ্রামগঞ্জে খামার গড়ে উঠছে। এ ধরনের সংবাদে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাদের অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গো-খামার করেছেন। দুধ বিক্রি যদি কমে যায়, তাহলে কোম্পানিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারিদের কাছ থেকে আর দুধ ক্রয় করবে না। আসলে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য ছোট ছোট খামারিরা যতটুকু না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী কোম্পানিগুলো। সুতরাং খুদে খামারিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকে সরকারের লক্ষ রাখা উচিত।
সমস্যার মূলে যেতে হবে। একটি গবেষণাকে ‘মিথ্যা’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে কিংবা গবেষককে ‘হুমকি’ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচিত বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়ে কী করে এ সমস্যার সমাধান বের করা যায়, তার পথ খোঁজা। মন্ত্রণালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতামত গ্রহণ করতে পারে। এমনকি অধ্যাপক ফারুকের মতামতও নেয়া যেতে পারে। একজন আমলা গবেষকদের হুমকি দেবেন, লাল চোখ দেখাবেন, শুভবুদ্ধির কোনো মানুষ এটা মেনে নেবে না। এটা আমলাতন্ত্রের ‘অতি ক্ষমতায়নের’ একটি ফল! আমলারা নিজেদের অতি ক্ষমতাবান মনে করেন! শিক্ষকতুল্য একজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে ‘হুমকি’ দিয়ে শুধু একজন অধ্যাপক ফারুককেই অসম্মানিত করা হয়নি, বরং সমগ্র শিক্ষক সমাজকেই অসম্মানিত করা হয়েছে।

যুগান্তর 
 ২০ জুলাই ২০১৯
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটা ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। অর্থাৎ কোনো একটি দেশের প্রতি ‘অতিরিক্ত ঝুঁকে’ না যাওয়া। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আর নিকট প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে চীন। উন্নয়নের স্বার্থে দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক দরকার। কোনো দেশের সঙ্গেই ‘কৌশলগত’ কোনো সম্পর্কে না জড়িয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি চীন ঘুরে এসেছেন। আগামী অক্টোবরে তিনি ভারত সফরে যাচ্ছেন। উন্নয়নের স্বার্থে চীনের সহযোগিতা যেমনি আমাদের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি দেশের প্রতি যদি আমরা বেশি ‘ঝুঁকে’ পড়ি, তা হলে তাতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। আর সেজন্যই চীন সফরের পরপর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটাই সঠিক পররাষ্ট্রনীতি।
চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। শুধু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিল, এটা মনে করলে আমরা ভুল করব। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত চীনা এডমিরাল ঝেং হি ভারত মহাসাগরে সাতবার তার বাণিজ্যতরী নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন মিং সাম্রাজ্যের তৎকালীন সম্রাট ইয়ংলির প্রতিনিধি। ওই সময় তিনি তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওতেও এসেছিলেন। এভাবেই চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। চীন এখন এডমিরাল ঝেং হির সফরকে গুরুত্ব দেয়। তাকে শ্রেষ্ঠ কূটনীতিক হিসেবে চীন স্বীকার করে। তারও আগে আমাদের বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া (তৎকালীন পালা সাম্রাজ্য) অতীশ দীপংকর শ্রীমান বৌদ্ধধর্মচর্চা ও প্রচারের জন্য সুদূর তিব্বতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার দেহভস্ম চীন থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। ফলে সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। এডমিরাল ঝেং হি প্রায় ছয়শ বছর আগে যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করেছিলেন, আজ তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশ বিদেশ থেকে যা আমদানি করে তার মধ্যে শতকরা ৩৪ ভাগ আসে চীন থেকে (১৫.১ বিলিয়ন ডলার) আর ১৬ ভাগ আসে ভারত থেকে (৭.০৫ বিলিয়ন ডলার)। তবে রপ্তানির তালিকায় চীনের অবস্থান অনেক পেছনে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ৩৯.২ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করেছিল, যার মধ্যে শীর্ষে ছিল জার্মানি (৬.১১ মিলিয়ন)। এর পর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্থান (৫.৮১ মিলিয়ন)। প্রধানমন্ত্রীর চলতি চীন সফরে (জুলাই ২০১৯) ৯টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য চীন ২ হাজার ৫শ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করবে। অন্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা স্মারক, ইয়ালু ঝাংঝে ও ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্যবিনিময়সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি ইত্যাদি। শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং আলোচনায় বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরকে শক্তিশালী করতে এই রুটের মধ্যকার অবকাঠামো খাত উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয় (সিজিটিএন ৫ জুলাই)। বলা ভালো, চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’র (ওবিওআর) যে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, তাতে যে মোট ৬টি অর্থনৈতিক করিডর রয়েছে, বিসিআইএম করিডর তার একটি। বাংলাদেশ-চীন (ইউনান প্রদেশ)-ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য) ও মিয়ানমারকে নিয়ে প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক করিডরটি গড়ে উঠছে। ফলে সড়কপথে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে। ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে। অদূর ভবিষ্যতে এ পথে রেললাইনও চালু হবে। তবে বিসিআইএম নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভারত শেষ পর্যন্ত এই করিডরের ব্যাপারে তার সম্মতি জানালেও ভারত ওবিওআরে যোগ দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। ওবিআরের পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারের সন্নিকটে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা আর স্বাক্ষরিত হয়নি ভারতের আপত্তির কারণে। ফলে শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিসিআইএমের অবকাঠামো খাত নির্মাণের আহ্বান জানালেও ভারতের ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। ভারত না চাইলে বিসিআইএম করিডরের ধারণা শুধু ধারণা পর্যায়েই থেকে যাবে।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের শর্ত কী, সুদের হার কী, আমরা তা জানি না। সাম্প্রতিককালে ‘চীনা ঋণ’ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো এক ধরনের ‘চীনা ঋণ ফাঁদ’-এ পড়েছে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে (শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া)। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদও বটে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি’ (একটি অনলাইনে, ২৮ জুন)। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে চীনা ঋণ পাচ্ছে (৩১ বিলিয়ন ডলার), তা পাকিস্তানের সিপিইসির (ঈচঊঈ) পর (৬০ বিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ জুলাই)। তাই চীনা ঋণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। তবে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চীনের প্রতি তিনি ঋণচুক্তির শর্তাবলি সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন। চীন এই আহ্বানে কতটুকু ছাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য আমরা তেমন কিছু জানি না। উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এজন্য আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। ফলে চীনের ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য সহজ। কিন্তু আমরা যেন শ্রীলংকার হামবনাতোতা সমুদ্রবন্দরের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে না যাই। মালয়েশিয়ার কথাও যেন আমাদের মনে থাকে। তবে চীনা ঋণ আমাদের প্রয়োজন আছে। চীন অবকাঠামো খাতে ঋণ দিয়ে থাকে। ওই ঋণ আমাদের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয় ঋণও গ্রহণ করছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ২০১৫ সালের ২৭ মে। এর পর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারতের ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের মতো ভারতের জন্যও বিশেষ ইপিজেড তৈরি করা হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সেখানে বিনিয়োগ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদেও তা স্বীকার করেছেন। ৪০ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘তাদের ইচ্ছায়’ ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী ভারতে প্রবেশ করে নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করত। এখন তার অবসান হয়েছে। আমরা ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও বিদ্যুৎ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যে এখন ভারতের পণ্য যাচ্ছে। তবে দুদেশের মধ্যে সমস্যা যে নেই, তা নয়। যেমন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে। টিপাইমুখ বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়েও কথা আছে। বাংলাদেশ ভারতে তার বাণিজ্য রপ্তানি বাড়াতে পারছে না শুধু ট্যারিফ আর প্যারা ট্যারিফের কারণে। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। গঙ্গা পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। তখন জনসংখ্যা ও পানির চাহিদা বাড়বে ৩ গুণ। তাই পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করা জরুরি। ভারতে পানি সংকট রয়েছে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয় তা হলে বাংলাদেশে পানি সংকট দেখা দেবে।
দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে কীভাবে পানি সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলে ‘রিজার্ভিয়ার’ নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা ও শুষ্ক মৌসুমে তা ছেড়ে দেওয়াÑ এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় আমরা নতুন একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা শুনেছিলাম (বিপিআইএন)। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও পানি সমস্যার সমাধানে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ভুটান ও নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানি সংরক্ষণের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে এই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা বাংলাদেশ যদি নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায়, তা হলে তা ভারতীয় সীমানার ওপর দিয়ে আমদানি করতে হবে। ভারতের সম্মত্তি না পেলে, তা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাই চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন-ভারত সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করার প্রশ্নে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করি। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আক্রান্ত হতে পারে। তাই খুব কৌশলে এই দেশ দুটির সঙ্গে আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি তাই একটি ভালো ‘অ্যাপ্রোচ’। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, বরং বন্ধুত্ব’ করে এবং আমাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে্

আমাদের সময়
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯

তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

ইতিহাস কীভাবে স্মরণ করবে এরশাদকে





পরিণত বয়সে মারা গেছেন এইচ এম এরশাদ। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। বর্তমানে সংবাদে বিরোধীদলীয় নেতা। একটি দলের চেয়ারম্যান, তার নামে দলটি চলে। একাধিকবার তার দলে বিভক্তি এসেছিল। অনেকেই আলাদাভাবে জাতীয় পার্টি নামে সংগঠিত হয়েছেন। কিন্তু মূলধারা জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বেই থেকে গেছে। স্বৈরশাসক হিসেবে অভিহিত করা হয় তাকে। আবার বাস্তবতা হচ্ছে, বারবার তিনি সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। রংপুরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘ছাওয়াল’, অর্থাৎ ‘আমাদের সন্তান’। তিনি রংপুরের সন্তানই ছিলেন বটে! রংপুরের মানুষ তাকে বারবার সংসদে পাঠিয়েছে। তিনি ছিলেন কবি। কবিতা লিখতেন। কবিতার বইও প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তার সেসব কবিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তিনি প্রেমিক ছিলেন। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছিলেন, তার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য ছিল ৪০ বছরের ওপর। প্রেমিক হিসেবে তার সার্থকতা সেখানেই সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার পর, এই স্ত্রীর নামে চুরির মামলা করার পরও বিদিশা তাকে কখনো ভোলেননি। বরং ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, যখন এরশাদ মৃত্যুর সঙ্গে সিএমএইচে লড়ছিলেন।
তার মৃত্যুর পর তিনি সম্মান পেয়েছেন। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনা কবরস্থানে তার দাফন হয়েছে। একজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনী তাকে এই সম্মান দিয়েছে। এতে অন্তত ‘কবর’ নিয়ে যে ‘রাজনীতি’, সেই রাজনীতির আর সুযোগ থাকল না। কিন্তু ইতিহাস তাকে কীভাবে স্মরণ করবে? একজন স্বৈরশাসক? একজন গণতন্ত্রকামী? একজন আপসকামী নেতা, যিনি ‘নিজের স্বার্থে’র জন্য বারবার আত্মসমর্পণ করেছেন? বাংলাদেশের দীর্ঘ ৪৮ বছরের রাজনীতিতে দুজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা রাজনীতিতে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ। দুজনই রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতাকে নিয়মতান্ত্রিক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, ক্ষমতা দখল করার আগেই এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় প্রবন্ধ লিখে প্রশাসনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের দাবি করেছিলেন। তার ১২ দফা দাবি ওই সময় যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তখন অবশ্য জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় নেই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হয়েছিলেন। বয়োবৃদ্ধ বিচারপতি সাত্তার ছিলেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে। এক দুর্বল প্রেসিডেন্টকে চাপে রাখতে তিনি সেনাবাহিনীর অংশীদারত্ব দাবি করেছিলেন। আর এ দাবির পরপরই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তিনি ক্ষমতা দখল করেন।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি আহসানউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের (১৯৯০, ৬ ডিসেম্বর) আগ পর্যন্ত তিনি কখনোই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারেননি। তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। দল করেছেন। দু-দুবার (১৯৮৬, ১৯৮৮) সংসদ নির্বাচন দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠিত হলেও, সেই সংসদ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (বিএনপি অংশ নেয়নি) অংশ নিলেও, সেই সংসদও পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারেনি শুধু বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন আ স ম আবদুর রবকে সামনে রেখে তাকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে (১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে) সংসদীয় রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে। কিন্তু সেখানেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। জনগণ জাতীয় পার্টিকে অন্যতম শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে নেয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি, সেটা প্রমাণিত হয়েছিল।
এরশাদের ব্যর্থতা ছিল ওই সময় এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে তা থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়া। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আগে তিনি যদি এটা করতে পারতেন, সম্ভবত আজকের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অনেক পর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সখ্য’ গড়ে তুলেছিলেন বটে, কিন্তু নিজ দল ও নিজের ব্যক্তিগত ইমেজ তিনি বাড়াতে পারেননি। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল জাতীয় পার্টির। কিন্তু দেখা গেল ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত যে সময়সীমা, তাতে জাতীয় পার্টি ‘প্রধান বিরোধী দল’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কিংবা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পেয়েও বিএনপি এখনো ‘প্রধান বিরোধী দল’ই! রাজপথে বিএনপি না
থাকলেও, সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপিই প্রধান বিরোধী দল। অথচ সংসদে বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল ‘বিরোধী দল’ হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার। সেটা জাতীয় পার্টি পারেনি। এখানেই বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির পার্থক্য। সত্যিকার অর্থেই জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে পারেনি প্রধানত একটি কারণেÑ আর তা হচ্ছে দলের মাঝে সুবিধাবাদিতা। এই সুবিধাবাদিতার কারণেই দেখা যায় জাতীয় পার্টি সরকারে থেকেও আবার বিরোধী দলে (২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর)। রাজনীতি এখানে সঠিক ছিল না। স্বচ্ছ ছিল না। দলের সুবিধাবাদী নেতাদের কারণে জাতীয় পার্টি ‘সঠিক রাজনীতি’টা গ্রহণ করতে পারেনি। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ১১তম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত যে সময়সীমা, দীর্ঘ ২৮ বছর, এই সময়সীমায় জাতীয় পার্টি সত্যিকার অর্থেই প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত; কিন্তু পারেনি। এর পেছনে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সুবিধাবাদিতা যেমনি দায়ী, তেমনি দায়ী এরশাদের নেতৃত্বও। তিনি সঠিক রাজনীতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’র ছায়া তার রাজনীতিকে অনুসরণ করত সব সময়। সম্ভবত এতে তিনি ভীতু ছিলেন! রাজনীতিতে এটাই ছিল তার সীমাবদ্ধতা।
সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন এরশাদ। ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়ে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান। সেই অর্থে প্রায় ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবন তার। এই রাজনৈতিক জীবনে তিনি জেল খেটেছেন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বারবার সংসদে এসেছেন। একাধিকবার জেলে থেকেও পাঁচ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যত ‘অভিযোগ’ই থাকুক না কেন, তার কারণেই জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটা বলতেই হবে, তার অবর্তমানে দলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি দলের ‘ঐক্য’কে ধরে রাখতে পারবেন। দল মূলত অলিখিতভাবে দুভাগে ভাগ হয়ে আছেÑ একভাগ জি এম কাদেরের পেছনে, অপর ভাগ রওশন এরশাদের পেছনে। বাস্তবতা হচ্ছে, দুজনের কারোরই সেই ‘ক্যারিশমা’ নেই। জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙে যেতে পারেÑ সে আশঙ্কাও আছে। রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে টিকে থাকতে হলে এখন ব্যক্তি নয়, বরং একটি নতুন রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
পরিণত বয়সে এরশাদ মারা গেলেন। ইতিহাস তাকে চূড়ান্ত বিচারে কীভাবে চিহ্নিত করবে, আমি তা জানি না। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার এটাইÑ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, এটা তার দুঃখ যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।
যেসব ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তাদেরই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেকেই অন্তর্দ্বন্দ্ব জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় সেনা নেতৃত্বের মাঝে অসন্তোষ, অবিশ^াস আর ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিয়েছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসাররা। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন এরশাদ। তিনি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি অবলম্বন করে সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। তার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি অনেকগুলো ভালো কাজ করেছিলেন। মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করা, উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা, শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা, সড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি অনেক ভালো ভালো কাজের জন্য তার নাম বারবার উচ্চারিত হবে।
কিন্তু স্বৈরাচারের তকমা, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক, নারীপ্রীতির অপবাদ তিনি দূর করতে পারেননি। পারিবারিক জীবনও তার সুখের ছিল না। ৬৩ বছরের সাংসারিক জীবনে রওশন এরশাদের সঙ্গে তার বৈবাহিক বিচ্ছেদ ঘটেনি সত্য; কিন্তু দীর্ঘ ২০-২৫ বছর তারা আলাদা আলাদা থাকতেন, যা মুসলমান অধ্যুষিত সমাজে কখনোই ভালো চোখে দেখা হয়নি। এইচ এম এরশাদের সম্ভাবনা ছিল একজন ‘জামাল আবদুল নাসের’ (মিসর) কিংবা জুয়ান ডমিনগো পেরন (আর্জেন্টিনা) হওয়ার, যারা কি না সেনাবাহিনী থেকে এসেও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। মানুষ তাদের আজও স্মরণ করে। এইচ এম এরশাদ সে রকম কিছু হতে পারেননি। একজন দুর্বলচিত্তের মানুষ, একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত এরশাদ ইতিহাসে তার নাম রেখে যাবেন এভাবেই যে, তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ১৫ জুলাই, ২০১৯
পরিণত বয়সে এরশাদ মারা গেলেন। ইতিহাস তাকে চূড়ান্ত বিচারে কীভাবে চিহ্নিত করবে, আমি তা জানি না। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার এটাইÑ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, এটা তার দুঃখ যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।

দেশ রূপান্তর 
১৬ জুলাই, ২০১৯
লেখক
তারেক শামসুর রেহমান |  
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ ও ভারতে পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি

ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই পদত্যাগ কি ভারতের পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? কিংবা কংগ্রেস কি আবারও নেহরু-গান্ধী পরিবারের দিকে তাকাবে? সীমিত সময়ের জন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আবার কি গান্ধী পরিবারই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেবে? এ বিষয়গুলো এখন ভারতে বহুল আলোচিত। এখনো এ বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছে। গত ৩ জুলাই রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলের পরাজয়ের সব দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে তিনি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়ে দেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এই পদত্যাগ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি নিজের পারিবারিক আসনেও (আমেথি, উত্তর প্রদেশ) হেরে গিয়েছিলেন। যে আদর্শ ও নীতি নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে গিয়েছিল, ভারতীয় ভোটাররা তা গ্রহণ করে নেয়নি। এ ক্ষেত্রে তিনি সভাপতি হিসেবে থেকে যেতে পারতেন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এমনটাই হয়। দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব ধরে রাখেন। এমনকি নির্বাচনে পরাজয়ের পর কিংবা আদালত কর্তৃক নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরও (পাকিস্তান) নেতৃত্ব থেকে যায় পরিবারের হাতেই। রাহুল গান্ধী এমনটি পারতেন। যে কংগ্রেসের নেতৃত্ব বারবার নেহরু-গান্ধী পরিবার থেকে এসেছে, সেই পরিবারের সর্বশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সভাপতি পদে থেকে যেতে পারতেন; কিন্তু তিনি থাকলেন না। নয়া নেতৃত্ব, নয়া নীতি ও নয়া রাজনীতির জন্য তিনি সভাপতির চেয়ার ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কি কোনো উদাহরণ?
স্পষ্ট করেই বলতে পারি, এই পদত্যাগ কোনো উদাহরণ তৈরি করবে না ভারতীয় রাজনীতির জন্য। ২৯টি রাজ্য ও সাতটি ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ নিয়ে ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠেছে। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে কেরালা পর্যন্ত সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ কিছু পরিবার কোনো কোনো রাজ্যে এত বেশি শক্তিশালী যে কোথাও কোথাও একটি পরিবার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের মতো দলও ওই পারিবারিক রাজনীতির কাছে দাঁড়াতে পারছে না। দাদা একসময় রাজনীতি করেছেন। দাদার পর বাবা, তারপর তাঁর নাতিরা এখন স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সনাতন ভারতীয় রাজনীতির চিত্র এখন পাল্টে গেছে। একটি একক দলের পক্ষে এখন আর সরকার গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরকার গঠনে প্রয়োজন হয় আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থনের। ভারত এখন কোয়ালিশনের রাজনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। সে জন্যই দেখা যায়, ভারতে জন্ম হয়েছে ইউপিএ ও এনডিএ জোটের। বলাই বাহল্য, দুটি বড় দল কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুটি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বারবার নেহরু পরিবার তথা পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, নেহরুর প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি বল্লভ ভাই প্যাটেলকে সামনে এনেছেন। তাঁর একটি বিশাল স্ট্যাচু তিনি তৈরি করেছেন গুজরাট রাজ্যের নর্মদা জেলার কাভাদিয়া এলাকায়। ১৮২ মিটার দীর্ঘ এই স্ট্যাচু (স্ট্যাটিউ অব ইউনিটি) তৈরি করতে খরচ হয়েছে দুই হাজার ৯৮৯ কোটি রুপি, যা ৪২০ মিলিয়ন ডলার সমতুল্য। বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মোদি ভারতকে পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের করে নিয়ে আসতে চান; কিন্তু তা সম্ভব হবে না। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। কর্ণাটকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে দেব গৌড়া পরিবার। দেব গৌড়া সীমিত সময়ের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (জনতা দল, ১৯৯৬-৯৭)। এখন তাঁর ছেলে এইচ ডি কুমারাস্বামী কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী। নাতি প্রাজোয়াল রেভান্মা ও নিখিল কুমারাস্বামী (আরেক নাতি) কর্ণাটকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। দেব গৌড়ার দল জনতা দল (সেক্যুলার) কর্ণাটকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। উত্তর প্রদেশে রয়েছে মুলায়াম সিং যাদব পরিবার। সমাজবাদী দল নিয়ে তাদের অবস্থান সেখানে শক্তিশালী। ছেলে অখিলেশ যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। ঝাড়খণ্ডে রয়েছেন শিবু সরেনের পরিবার ও তাঁর দল জেএসএম বা ঝাড়খণ্ডমুক্তি মোর্চা। মেয়ে অবুলি সরেন এখন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছেন বাবার স্থান নিতে। তামিলনাড়ুতে রয়েছে করুণানিধির পরিবার। মেয়ে কানিমাঝি এখন দল ডিএমকের মূল ব্যক্তি। মহারাষ্ট্রে সারদ পাওয়ারের রয়েছে নিজ দল এনসিপি। মেয়ে সুপ্রিয়া সুলে এখন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। বিহারে রাম বিলাস পাসওয়ান ও লালুপ্রসাদের খবর সবাই জানে। পাসওয়ান পরিবার—দুই ছেলে চিরাগ পাসওয়ান ও রামচন্দ্র পাসওয়ান এবং ভাই পশুপতি কুমার পরাশ এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাঁর দল হচ্ছে লোক জনশক্তি পার্টি। আর লালুপ্রসাদ যাদব ও তাঁর দল রাষ্ট্রীয় জনতা দল। তাঁর দুই ছেলে তেজ প্রতাপ যাদব ও তেজস্বী যাদব, মেয়ে মিসা ভারতী, হেমা যাদব—সবাই মিলে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বিহারে। সবার স্মরণ থাকার কথা, মূর্খ (যিনি পড়ালেখা জানতেন না) রাবড়ি দেবী (লালুপ্রসাদ যাদবের স্ত্রী) বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। অন্ধ্র প্রদেশের রামা রাওয়ের ছেলে কিশোর চন্দ্র দিত্ত ও মেয়ে শ্রুতি দেবী, পাঞ্জাবে আকালি দলের মূল নেতা শুকবির সিং বাদল ও তাঁর পরিবার পাঞ্জাবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মায়াবতীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। উত্তর প্রদেশের লাখ লাখ দলিতের, অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির মানুষের ‘সেন্টিমেন্ট’কে পুঁজি করে মায়াবতী চার-চারবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। লালুপ্রসাদ ও রাম বিলাস পাসওয়ানও দলিত, অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির। এটাই তাঁদের প্লাস পয়েন্ট।
এই দলিত আর পারিবারিক রাজনীতিই হচ্ছে ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। ক্ষমতায় আসার জন্য প্রয়োজনে তাঁরা দল বদল করেন। কখনো নিজে দল গঠন করে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান। কিন্তু রাহুল গান্ধী ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি উচ্চ বংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি পারিবারিক ধারায় রাজনীতিতে এসেছিলেন। মোতিলাল নেহরু (১৯২৮), জওয়াহেরলাল নেহরু (১৯২৯, ৩০, ১৯৩৬, ১৯৩৭, ১৯৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪), ইন্দিরা গান্ধী (১৯৫৯, ১৯৭৮-৮৩), রাজীব গান্ধী (১৯৮৫-৯১), সোনিয়া গান্ধীর (১৯৯৮-২০১৭) পথ ধরে রাহুল গান্ধীও কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন (২০১৭-১৯)। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেস সর্বশেষ ১৭তম লোকসভায় পায় ৫২ আসন। ফলে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখন কংগ্রেসকে নেহরু পরিবারের বাইরে একজনকে সভাপতি হিসেবে বরণ করে নিতে হবে। ১৩৩ বছরের (জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৮৮৫) যে সংগঠন, সেই সংগঠনটি এর আগে আর এত বড় সংকটের মধ্যে পড়েনি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর নরসিমা রাও কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন। এরপর সীতারাম কেশরিও দায়িত্ব নিয়েছিলেন; কিন্তু কংগ্রেসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেননি। ফলে নেহরু পরিবারের ‘একজন’কেই কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে?
পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় ‘একজন’কে (শচীন পাইলট, অশোক গেহ্লট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়া) কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হলেও তিনি যে সাময়িকভাবে এই দায়িত্ব পালন করবেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। কংগ্রেস মানেই হচ্ছে পরিবারতন্ত্র, নেহরু পরিবারের দিকেই শেষ পর্যন্ত তাকাতে হয় কংগ্রেসকে। সুতরাং কংগ্রেসের নেতৃত্ব যে শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ওপরই বর্তাবে, তা বোধ হয় একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। ৪৭ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কা রাহুল গান্ধীর ছোট বোন ও বর্তমানে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। অন্তর্বর্তীকালের জন্য ‘কেউ একজন’ সভাপতির দায়িত্ব নেবেন। এবং চূড়ান্ত বিচারে আমরা দেখব প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিতে। একটা কথা এখানে বলতেই হয়—পরিবারতন্ত্রই ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভারতের প্রতিটি রাজ্যের রাজনীতিতে এই পরিবারতন্ত্র আছে। বংশপরম্পরায় একটি বা একাধিক পরিবার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। আর স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে প্রায়ই সরকার গঠনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। একসময় পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘প্রতিবাদ’ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন। অথচ তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই এখন পরিবারতন্ত্রের ব্যাপারে বড় অভিযোগ উঠেছে। তিনি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং তাঁকে দল পরিচালনার জন্য তৈরি করছেন—এমন অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সুতরাং ভারত তার পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারবে না। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। ব্রিটেনে সাধারণত নির্বাচনে কোনো দলের পরাজয় ঘটলে, দলের সভাপতি সরে দাঁড়ান। দল তখন নতুন একজন সভাপতি নির্বাচিত করে। আর হেরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে বিজয়ী হলেও তিনি ‘ব্যাকবেঞ্চার’ এমপি হয়ে যান। তবে ব্রিটেনে না হলেও ফ্রান্স, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে এক ধরনের পরিবারতন্ত্র আছে। সব সময় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র যে খারাপ, তা বলা যাবে না। ভারতের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের নতুন সদস্যদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, বিদেশে পড়াশোনা করা অনেকেই আছেন। সুতরাং রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ কংগ্রেসের জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন নয়া রাজনীতি এবং তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো। এই কাজটি কংগ্রেস করতে পারেনি। ‘মোদি ম্যাজিক’-এর বিকল্প হিসেবে কোনো রাজনীতি উপস্থাপন করতে পারেনি কংগ্রেস। তাই পরাজয় ছিল অবধারিত।
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র


kalerkantho

১৪ জুলাই, ২০১৯

লেখক : 

তারেক শামসুর রেহমান

অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com


প্রধানমন্ত্রীর সফর : রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ ও চীনা ঋণ বৃত্তান্ত




প্রধানমন্ত্রী তার চীন সফর শেষ করে সোমবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই সফরে তিনি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন। চীনের লিওয়ানিং প্রদেশের দালিয়ান শহরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনি তার চীন সফর শুরু করেন। ৬ জুলাই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
এ সফরে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে দেশটির সরকারকে সম্মত করাতে চীন চেষ্টা করবে।
প্রয়োজনে চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবারও মিয়ানমার পাঠাবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করবেন তা হচ্ছে, এই ‘চীনা আশ্বাস’ কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে? চীনের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি।
প্রত্যাশা করেছিলাম চীন একটি শক্ত অবস্থানে যাবে। কিন্তু ‘আশ্বাস’ আর ‘দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যা সমাধানের’ কথা বলার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন তার অবস্থান খুব একটা পরিবর্তন করেছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ আগেই স্পষ্ট করেছিল, চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আলোচনা হবে, ওই আলোচনায় রোহিঙ্গা সমস্যা স্থান পাবে। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার চীন।
বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের বাংলাদেশে উপস্থিতি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক আসরে এ কথাটাই বলে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এটা এখন উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে কারণে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘চাপ’ও বাড়ছে। চীন এটা জানে ও বোঝেও।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীন বরাবরই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে চীন মিয়ানমারের পাশেই ছিল এবং মিয়ানমারের বক্তব্য সমর্থন করে আসছিল।
সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ২৫ জুন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন।
ওই সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তার দেশ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে হবে এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারকে বোঝানোর জন্য তিনি চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন (সাউথ এশিয়া মনিটর, ২৬ জুন ২০১৯)।
এটাই বাংলাদেশের অবস্থান- রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমার ফেরত যেতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে চীন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।
অতি সম্প্রতি তালেবান প্রশ্নে চীনের একটি ভূমিকা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সংলাপ’ যখন কোনো সমাধান বয়ে আনছিল না, ঠিক তখন চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চীনের এ ভূমিকা নতুন।
অতীতে চীন কখনও অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেনি; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনের এ অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। চীন এখন বিশ্বশক্তি। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ চীন। আর এ কারণেই ‘বিশ্বশক্তি’ হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চীন এখন বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি ভূমিকা রাখতে চায়।
এ কারণেই চীন আফগানিস্তানের ‘তালেবান’ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে। চীন এখন আফগান শান্তি চুক্তিতে গ্যারান্টার হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। ২৬ জুন আফগান সরকারের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়। জুন মাসে চীনের বিশেষ দূত দেং শি জুন কাবুল সফর করেছিলেন এবং সেখানে তিনি দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
চীন ইতিমধ্যে কাতারে নিযুক্ত তালেবানদের রাষ্ট্রদূত আবদুল গনি বারাদারকে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে (ডন, জুন ২০)। চীনের এই ‘তৎপরতা’ প্রমাণ করে চীন আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যা সমাধানে একটি ‘ভূমিকা’ রাখতে চায়। চীন আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যকার আলোচনাকেও সমর্থন করছে।
আফগান সমস্যার সমাধানে চীনের এ ভূমিকা চীনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। চীন একটি গ্যারান্টার তথা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখন চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নেও একই ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের যেমন সীমান্ত রয়েছে, ঠিক তেমনি আফগানিস্তানের সঙ্গেও চীনের সীমান্ত রয়েছে। এই দুটো দেশেই চীনের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।
চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর (ওবিওআর) বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে, তাতে মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তান ওবিওআরে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। চীন আফগানিস্তানকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু চীন এখন তাতে পরিবর্তন আনছে।
চীন এখন পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি আফগানিস্তানকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা ছিল, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু দেখা গেল, চীন দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে চীন তার জাতীয় স্বার্থটাকেই বড় করে দেখল। বিশ্বশক্তি তথা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তার যে ভূমিকা পালন করার কথা, তার সেই ভূমিকাকে চীন এখন অনেকটাই এড়িয়ে গেল। চীন আগামীতে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে পাঠাবে হয়তো; কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তা হচ্ছে, চীনা ঋণের সুদের হার কী হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার দাবি করেছিলেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। এ সংক্রান্ত কোনো খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি।
বলা ভালো, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ৯টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জন্য চীন ২ হাজার ৫০০ টন চাল সরবরাহ করবে। অন্য চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা স্মারক, ইয়ালুঝাংবু ও ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্য বিনিময়সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা, ডিপিডিসির আওতাধাীন এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি ইত্যাদি।
শেখ হাসিনা ও লি কেকিয়াংয়ের আলোচনায় বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরকে শক্তিশালী করতে ওই রুটের মধ্যকার অবকাঠামো খাত উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয় (সিজিটিএন, ৫ জুলাই)। বলা ভালো, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) কর্মসূচিতে যে মোট ছয়টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, বিসিআইএম তার একটি।
বাংলাদেশ-চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য) ও মিয়ানমারকে নিয়ে প্রস্তাবিত ওই অর্থনৈতিক করিডোরটি গড়ে উঠছে। এর ফলে সড়কপথে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে।
ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে। অদূর ভবিষ্যতে এ পথে রেললাইনও চালু হবে। তবে বিসিআইএম নিয়ে প্রশ্ন আছে। ভারত শেষ পর্যন্ত এ করিডোরের ব্যাপারে তার সম্মতি জানালেও দেশটি ওবিওআরে যোগ দেয়নি। অথচ বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে।
ওবিওআরের পরিকল্পনার আওতায় কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা থাকলেও তা আর স্বাক্ষরিত হয়নি ভারতের আপত্তির কারণে।
ফলে শেখ হাসিনা-লি কেকিয়াং দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিসিআইএমের অবকাঠামো খাত নির্মাণের আহ্বান জানানো হলেও ভারতের ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। ভারত না চাইলে এ করিডোরের ধারণা শুধু ধারণা পর্যায়েই থেকে যাবে।
চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে ও হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের শর্ত কী, সুদের হার কী, আমরা তা জানি না। সাম্প্রতিককালে ‘চীনা ঋণ’ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো এক ধরনের ‘চীনা ঋণ ফাঁদে’ পড়েছে, এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে (শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া)।
তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদও বটে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হবে।
তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি।’ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যে চীনা ঋণ পাচ্ছে (৩১ বিলিয়ন ডলার), তা পাকিস্তানের সিপিইসির পর (৬০ বিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ জুলাই)। সুতরাং চীনা ঋণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
তবে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, চীনের প্রতি তিনি ঋণচুক্তির শর্তাবলি সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন। চীন এ আহ্বানে কতটুকু ছাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য আমরা তেমন কিছু জানি না। উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এ জন্য আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। এর ফলে চীনের ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য সহজ।
কিন্তু আমরা যেন শ্রীলংকার হামবানটোটা সমুদ্রবন্দরের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে না যাই। মালয়েশিয়ার কথাও যেন আমাদের মনে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে এ কথাটা বলাই যায়, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন নতুন উচ্চতায় উপনীত হল।

যুগান্তর 
১৩ জুলাই ২০১৯
নিউইর্য়ক, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com