রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর প্রধান দুই হত্যাকারী যথাক্রমে ইব্রাহিম (হৃদয়) ও আবু জাফরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ নাজমুল আলম তার ‘ফেইসবুক পেজ’-এ তাদের ছবিসহ এই তথ্যটি দিয়েছেন। তিনি দুদিন অভিযুক্ত হৃদয় ও জাফরের ছবি আপলোড করেন, যা ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে পুলিশের এই ভূমিকাকে আমরা স্বাগত জানাই। পুলিশ যে ইচ্ছে করলেই পারে, এটা তার বড় প্রমাণ। ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাসলিমাকে গত ২০ জুলাই। এর মাত্র তিন দিনের মাথায় অভিযুক্ত হৃদয় ও আবু জাফরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলো ডিবি পুলিশ। হৃদয় ও আবু জাফর এই গণপিটুনির নেতৃত্ব দিয়েছিল। ফেইসবুকে যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, তাতে অস্পষ্ট হলেও দেখা যায় হৃদয়কে। ডিবি পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের ছোট করতে চাই না। তারা সঠিক কাজটিই করেছেন। এভাবে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, এটা কোনো সভ্যসমাজে কল্পনাও করা যায় না। তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করবে। সেটা তারা করেছে। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের ওপর মানুষের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল।
দুই.
সরকার জনস্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। একাধিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে করে সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শৈথিল্য, অদক্ষতা, অনেক মহাপরিকল্পনা শেষঅব্দি সফল হবে না! রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর) একটি মহাপরিকল্পনা যেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। পঞ্চবটির এই এলাকা, যা বালুরমাঠ নামে পরিচিত ছিল, তা ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্ত ডাকাতদের অভয়ারণ্য। দিয়াবাড়ী-পঞ্চবটি এলাকায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষ হত্যা করে এখানে লাশ ফেলে রাখা হয়েছেÑ এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। শুধু তাই নয়, মিরপুর-বেড়িবাঁধ সড়কে একাধিকবার ডাকাতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সুতরাং এমনই একটি এলাকায় যখন রাজউক বসতি গড়ার উদ্যোগ নেয়, যখন হাজার হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করে, তখন প্রথমেই উচিত ছিল এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজউক তা করেনি। অদক্ষতা, সুশাসনের অভাব এই প্রজেক্টের ভবিষ্যৎকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজউক কর্মকর্তারা এই প্রজেক্ট নিয়ে গর্ব করেন। তারা এই প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে চান। কিন্তু দিন-দুপুরে যখন সেখানে গাড়ি চুরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, রাতের বেলায় যখন কোনো স্ট্রিটলাইট থাকে না এবং পুরো এলাকাটি ডাকাতদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়, তখন কি রাজউক কর্মকর্তারা কোনো প্রশংসা আশা করতে পারেন? তখন কি তারা এই প্রজেক্টকে বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন? ৭৯টি হাইরাইজ ভবন উত্তরা রাজউক প্রজেক্টে ‘এ’ ব্লকে তৈরি করা হয়েছে। এরপর ‘বি’ ব্লকে তৈরি করা হবে ৭২টি ভবনে ৬০৪৮টি ফ্ল্যাট। তারপর ‘সি’ ব্লকে ৭২টি ভবনে তৈরি হবে আরও ৬৬০৮টি ফ্ল্যাট। এর অর্থ এই এলাকায় মোট ২২৩টি হাইরাইজ ভবনে মোট ১৮৭৩২টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। এরই মধ্যে শুধু ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে ৬৬৩৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ বসবাস করছে। ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লক এখনো নির্মাণাধীন।
অথচ ওই এলাকায় অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি দোলনচাঁপা ভবনে দিন-দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাসায় ডাকাতি হয়েছে এবং প্রকাশ্য দিবালোকে পার্কিং এলাকায় রাখা তার গাড়ি চুরির চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তুরাগ থানায় একটি মামলাও দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন চোরদের ছবিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে পুলিশের (তুরাগ থানা) কোনো তৎপরতা নেই। আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি না ডিবি পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করবে এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে যেভাবে তাসলিমা বেগমের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে, একইভাবে ওই গাড়িচোর তথা ডাকাতদের গ্রেপ্তার করবে? এতে অন্তত ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে। সরকারের অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা, তা বাস্তবায়িত হবে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে বসবাসকারীরা এমনটাই প্রত্যাশা করে তুরাগ থানা তথা ডিবি পুলিশের কাছ থেকে।
তিন.
গত ২৩ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ বসে নেই। পুলিশকে দুর্বল ভাববেন না। ফেইসবুকে গুজব সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশে তিনি এ কথা বলেন (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই)। সম্প্রতি পদ্মা সেতু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজবের জেরে গণপিটুনিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেন। প্রায় একই সময় আইজিপিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। রাজধানীর পল্টন ও খামারবাড়িতে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী মন্তব্য করেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। রাষ্ট্রের পুলিশ প্রধান যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করেন, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না।
ছেলেধরা সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে গুজবটি আরও মারাত্মক। একই সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বোমাসদৃশ বস্তু রেখে যাওয়া হচ্ছে। এসব আলামত ভালো নয়। সরকারকে বিপদে ফেলার এটি যে জঘন্য কাজ, তা একেবারে অস্বীকার যাবে না। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে দিন-দুপুরে ডাকাতির চেষ্টা, গাড়ি চুরির চেষ্টা, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর থেকে আস্থা হারানোÑ সবই একই পরিকল্পনার অংশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা তাই বড় ও ব্যাপক। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ তাসলিমার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে যারা গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের ছবি আছে এবং তাদের যদি গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, তাহলে ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে। না হলে ওই এলাকায় মানুষ আর বসবাস করতে আসবে না।
যেহেতু উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে রাজউক নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেÑ প্রয়োজন অনতিবিলম্বে এই এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া, পুরো এলাকাটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা, প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া, তুরাগ থানার কর্মকা- বাড়ানো। উত্তরা প্রজেক্টের দোলনচাঁপা ভবনের গাড়ি চুরির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছবি, তাদের ফোন নম্বর ও এনআইডি তুরাগ পুলিশকে দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা নেই কেন? এটা কি পুলিশের শুধু শৈথিল্য, নাকি অন্য কিছু? নাকি পুলিশ আদৌ উৎসাহিত হচ্ছে না? গাড়ি চুরির ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার ভবিষ্যৎই-বা কী? এর জবাব আমাদের জানা নেই। তবে আস্থাটা রাখতে চাই। পুলিশের অনেক দক্ষ অফিসার আছেন। আমার অনেক ছাত্র ও শুভাকাক্সক্ষী পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা। আমি তাদের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। এদের নিয়ে আমি গর্ব করতে চাই। অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের সহযোগিতা আমি পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। এদের অনেকেই আমাকে চেনেন। আমার বই পড়ে বিসিএস পাস করেছেনÑ অনেকে দেখা হলে এ কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন। আমি গর্বিত হই। তাসলিমার হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার হয়েছেÑ আমি স্বস্তি পেয়েছি। এখন দেখতে চাই উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে দোলনচাঁপা ভবনে যারা গাড়ি এবং ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা। যেকোনো অজুহাতে দায়িত্ব এড়ালে পুলিশের ওপর থেকে আস্থাটা চলে যাবে। পুলিশ আমাদের ভরসার স্থল, তুরাগ থানা-পুলিশ নেতৃত্ব যেন এমনটা মনে করে।
লেখক
তারেক শামসুর রেহমান | ২৮ জুলাই, ২০১৯
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক