রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস কীভাবে স্মরণ করবে এরশাদকে





পরিণত বয়সে মারা গেছেন এইচ এম এরশাদ। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। বর্তমানে সংবাদে বিরোধীদলীয় নেতা। একটি দলের চেয়ারম্যান, তার নামে দলটি চলে। একাধিকবার তার দলে বিভক্তি এসেছিল। অনেকেই আলাদাভাবে জাতীয় পার্টি নামে সংগঠিত হয়েছেন। কিন্তু মূলধারা জাতীয় পার্টি তার নেতৃত্বেই থেকে গেছে। স্বৈরশাসক হিসেবে অভিহিত করা হয় তাকে। আবার বাস্তবতা হচ্ছে, বারবার তিনি সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। রংপুরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘ছাওয়াল’, অর্থাৎ ‘আমাদের সন্তান’। তিনি রংপুরের সন্তানই ছিলেন বটে! রংপুরের মানুষ তাকে বারবার সংসদে পাঠিয়েছে। তিনি ছিলেন কবি। কবিতা লিখতেন। কবিতার বইও প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তার সেসব কবিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তিনি প্রেমিক ছিলেন। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছিলেন, তার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য ছিল ৪০ বছরের ওপর। প্রেমিক হিসেবে তার সার্থকতা সেখানেই সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার পর, এই স্ত্রীর নামে চুরির মামলা করার পরও বিদিশা তাকে কখনো ভোলেননি। বরং ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, যখন এরশাদ মৃত্যুর সঙ্গে সিএমএইচে লড়ছিলেন।
তার মৃত্যুর পর তিনি সম্মান পেয়েছেন। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনা কবরস্থানে তার দাফন হয়েছে। একজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনী তাকে এই সম্মান দিয়েছে। এতে অন্তত ‘কবর’ নিয়ে যে ‘রাজনীতি’, সেই রাজনীতির আর সুযোগ থাকল না। কিন্তু ইতিহাস তাকে কীভাবে স্মরণ করবে? একজন স্বৈরশাসক? একজন গণতন্ত্রকামী? একজন আপসকামী নেতা, যিনি ‘নিজের স্বার্থে’র জন্য বারবার আত্মসমর্পণ করেছেন? বাংলাদেশের দীর্ঘ ৪৮ বছরের রাজনীতিতে দুজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা রাজনীতিতে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ। দুজনই রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতাকে নিয়মতান্ত্রিক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, ক্ষমতা দখল করার আগেই এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় প্রবন্ধ লিখে প্রশাসনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের দাবি করেছিলেন। তার ১২ দফা দাবি ওই সময় যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তখন অবশ্য জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় নেই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হয়েছিলেন। বয়োবৃদ্ধ বিচারপতি সাত্তার ছিলেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে। এক দুর্বল প্রেসিডেন্টকে চাপে রাখতে তিনি সেনাবাহিনীর অংশীদারত্ব দাবি করেছিলেন। আর এ দাবির পরপরই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তিনি ক্ষমতা দখল করেন।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি আহসানউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের (১৯৯০, ৬ ডিসেম্বর) আগ পর্যন্ত তিনি কখনোই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারেননি। তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। দল করেছেন। দু-দুবার (১৯৮৬, ১৯৮৮) সংসদ নির্বাচন দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠিত হলেও, সেই সংসদ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (বিএনপি অংশ নেয়নি) অংশ নিলেও, সেই সংসদও পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারেনি শুধু বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন আ স ম আবদুর রবকে সামনে রেখে তাকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে (১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে) সংসদীয় রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে। কিন্তু সেখানেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। জনগণ জাতীয় পার্টিকে অন্যতম শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে নেয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি, সেটা প্রমাণিত হয়েছিল।
এরশাদের ব্যর্থতা ছিল ওই সময় এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে তা থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়া। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আগে তিনি যদি এটা করতে পারতেন, সম্ভবত আজকের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অনেক পর তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সখ্য’ গড়ে তুলেছিলেন বটে, কিন্তু নিজ দল ও নিজের ব্যক্তিগত ইমেজ তিনি বাড়াতে পারেননি। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল জাতীয় পার্টির। কিন্তু দেখা গেল ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত যে সময়সীমা, তাতে জাতীয় পার্টি ‘প্রধান বিরোধী দল’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কিংবা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পেয়েও বিএনপি এখনো ‘প্রধান বিরোধী দল’ই! রাজপথে বিএনপি না
থাকলেও, সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপিই প্রধান বিরোধী দল। অথচ সংসদে বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল ‘বিরোধী দল’ হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার। সেটা জাতীয় পার্টি পারেনি। এখানেই বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির পার্থক্য। সত্যিকার অর্থেই জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে পারেনি প্রধানত একটি কারণেÑ আর তা হচ্ছে দলের মাঝে সুবিধাবাদিতা। এই সুবিধাবাদিতার কারণেই দেখা যায় জাতীয় পার্টি সরকারে থেকেও আবার বিরোধী দলে (২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর)। রাজনীতি এখানে সঠিক ছিল না। স্বচ্ছ ছিল না। দলের সুবিধাবাদী নেতাদের কারণে জাতীয় পার্টি ‘সঠিক রাজনীতি’টা গ্রহণ করতে পারেনি। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ১১তম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত যে সময়সীমা, দীর্ঘ ২৮ বছর, এই সময়সীমায় জাতীয় পার্টি সত্যিকার অর্থেই প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত; কিন্তু পারেনি। এর পেছনে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সুবিধাবাদিতা যেমনি দায়ী, তেমনি দায়ী এরশাদের নেতৃত্বও। তিনি সঠিক রাজনীতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’র ছায়া তার রাজনীতিকে অনুসরণ করত সব সময়। সম্ভবত এতে তিনি ভীতু ছিলেন! রাজনীতিতে এটাই ছিল তার সীমাবদ্ধতা।
সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন এরশাদ। ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়ে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান। সেই অর্থে প্রায় ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবন তার। এই রাজনৈতিক জীবনে তিনি জেল খেটেছেন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বারবার সংসদে এসেছেন। একাধিকবার জেলে থেকেও পাঁচ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যত ‘অভিযোগ’ই থাকুক না কেন, তার কারণেই জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটা বলতেই হবে, তার অবর্তমানে দলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি দলের ‘ঐক্য’কে ধরে রাখতে পারবেন। দল মূলত অলিখিতভাবে দুভাগে ভাগ হয়ে আছেÑ একভাগ জি এম কাদেরের পেছনে, অপর ভাগ রওশন এরশাদের পেছনে। বাস্তবতা হচ্ছে, দুজনের কারোরই সেই ‘ক্যারিশমা’ নেই। জাতীয় পার্টি আবারও ভেঙে যেতে পারেÑ সে আশঙ্কাও আছে। রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে টিকে থাকতে হলে এখন ব্যক্তি নয়, বরং একটি নতুন রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
পরিণত বয়সে এরশাদ মারা গেলেন। ইতিহাস তাকে চূড়ান্ত বিচারে কীভাবে চিহ্নিত করবে, আমি তা জানি না। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার এটাইÑ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, এটা তার দুঃখ যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।
যেসব ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তাদেরই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেকেই অন্তর্দ্বন্দ্ব জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় সেনা নেতৃত্বের মাঝে অসন্তোষ, অবিশ^াস আর ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিয়েছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসাররা। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন এরশাদ। তিনি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি অবলম্বন করে সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। তার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি অনেকগুলো ভালো কাজ করেছিলেন। মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করা, উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা, শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা, সড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন ইত্যাদি অনেক ভালো ভালো কাজের জন্য তার নাম বারবার উচ্চারিত হবে।
কিন্তু স্বৈরাচারের তকমা, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক, নারীপ্রীতির অপবাদ তিনি দূর করতে পারেননি। পারিবারিক জীবনও তার সুখের ছিল না। ৬৩ বছরের সাংসারিক জীবনে রওশন এরশাদের সঙ্গে তার বৈবাহিক বিচ্ছেদ ঘটেনি সত্য; কিন্তু দীর্ঘ ২০-২৫ বছর তারা আলাদা আলাদা থাকতেন, যা মুসলমান অধ্যুষিত সমাজে কখনোই ভালো চোখে দেখা হয়নি। এইচ এম এরশাদের সম্ভাবনা ছিল একজন ‘জামাল আবদুল নাসের’ (মিসর) কিংবা জুয়ান ডমিনগো পেরন (আর্জেন্টিনা) হওয়ার, যারা কি না সেনাবাহিনী থেকে এসেও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। মানুষ তাদের আজও স্মরণ করে। এইচ এম এরশাদ সে রকম কিছু হতে পারেননি। একজন দুর্বলচিত্তের মানুষ, একজন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত এরশাদ ইতিহাসে তার নাম রেখে যাবেন এভাবেই যে, তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ১৫ জুলাই, ২০১৯
পরিণত বয়সে এরশাদ মারা গেলেন। ইতিহাস তাকে চূড়ান্ত বিচারে কীভাবে চিহ্নিত করবে, আমি তা জানি না। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও যুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার এটাইÑ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও পরে সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, এটা তার দুঃখ যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।

দেশ রূপান্তর 
১৬ জুলাই, ২০১৯
লেখক
তারেক শামসুর রেহমান |  
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

0 comments:

Post a Comment