রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বেইজিংয়ের ভূমিকা

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চীন মিয়ানমার সরকারকে সম্মত করতে চেষ্টা করবে। এ রকম একটি আশ্বাস চীন বাংলাশেকে দিয়েছে। গত ৪ জুলাই বেইজিংয়ে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই আশ্বাস দেওয়া হয়। সংবাদ সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়, ওই বৈঠকে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং দীর্ঘস্থায়ী এই সমস্যা দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। তিনি বলেন, চীন এই সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে। তিনি দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ এটা স্পষ্ট করেছে যে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে। সেইসঙ্গে তাদের জমি-সম্পত্তির ওপর অবশ্যই তাদের অধিকার থাকতে হবে। 

প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের এই আশ্বাস রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে কি-না? কিংবা আমরা কি চীনের এই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বসে থাকব? যদিও চীনের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবারও মিয়ানমারে পাঠাবে। এ ধরনের 'আশ্বাস' কিংবা চীনা মন্ত্রীর পুনরায় মিয়ানমার সফর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে জট খুলবে বলে মনে হয় না! মিয়ানমার অত্যন্ত কৌশলে সময়ক্ষেপণ করছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে আশ্বাসও দিচ্ছে! মিয়ানমারের মন্ত্রী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোও ঘুরে গেছেন। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। চীনও মিয়ানমারকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সংকটের গভীরতা বেড়েছে বৈ কমেনি। চীনের বড় স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। ফলে চীন যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য করাতে পারবে- এটা আমার মনে হয় না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে চীন মিয়ানমারের পাশেই ছিল এবং মিয়ানমারের বক্তব্য সমর্থন করে আসছিল। তবে সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২৫ জুন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুয়ো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তার দেশ গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী চীনা রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে হবে এবং ওই বিষয়ে মিয়ানমারকে বোঝানোর জন্য তিনি চীনের প্রতি আহ্বান জানান (সাউথ এশিয়া মনিটর ২৬ জুন, ২০১৯)।
বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে চীন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। অতি সম্প্রতি তালেবান প্রশ্নে চীনের একটি ভূমিকা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'সংলাপ' যখন কোনো সমাধান বয়ে আনছিল না, ঠিক তখন চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চীনের এই ভূমিকা নতুন। অতীতে চীন কখনও অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনের এই অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। চীন এখন বিশ্বশক্তি। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ চীন। আর এ কারণেই 'বিশ্বশক্তি' হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চীন এখন বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি ভূমিকা রাখতে চায়। চীন আফগানিস্তানের 'তালেবান' সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে। চীন এখন আফগান শান্তিচুক্তিতে গ্যারান্টার হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। গত ২৬ জুন আফগান সরকারের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়। চীনের বিশেষ দূত দেং শিজুন কাবুল সফর করেছিলেন ও সেখানে তিনি দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। চীন ইতিমধ্যে কাতারে নিযুক্ত তালেবানের রাষ্ট্রদূত আবদুল গনি বারাদারকে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল (ডন, জুন ২০)। চীনের এই তৎপরতা প্রমাণ করে, চীন আফগানিস্তানের তালেবান সমস্যা সমাধানে একটি 'ভূমিকা' রাখতে চায়। চীন আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যকার আলোচনাকে সমর্থন করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন একটি মধ্যস্থতা করতে পারে- এমন একটি সম্ভাবনা তৈরি হলেও চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্নেষণ করলে আমার কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, চীন দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যা সমাধানের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের গুরুত্ব চীনের কাছে অনেক বেশি। 

মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আফগানিস্তানের মতো মিয়ানমারের সঙ্গেও চীনের সীমান্ত রয়েছে। চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। চীনের প্রচণ্ড 'জ্বালানি ক্ষুধা' চীনকে পরিপূর্ণভাবে মিয়ানমারের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার (২০২৪০ মিলিয়ন ডলার) মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগে হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের ক্যাকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন (১৩০০ মিলিয়ন) ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে এখানে, যাতে বলা হচ্ছে ১ লাখ স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। চীন একই সঙ্গে মিউস-মান্দালয় রেলওয়েলাইনও তৈরি করছে। এতে করে ক্যাকফু থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী মিউস পর্যন্ত রেললাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। চীন একই সঙ্গে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ৮১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাকফু-কুনমিং রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। মিউস-মন্দালয় রেলওয়ে লাইনের সম্প্রসারিত অংশই হচ্ছে ক্যাকফু কুনমিং রেলওয়ে লাইন। আমরা বিসিআইএম করিডোরের কথাও উল্লেখ করতে পারি। এই করিডোরের আওতায় ইউনান প্রদেশের সঙ্গে কক্সবাজারের সড়ক ও রেলপথ সংযুক্ত হবে। এ কারণেই চীন সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। সেটি এখন আর তৈরি হচ্ছে না। চীন সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ইউনান প্রদেশের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পারত। এমনকি সড়কপথে চীনা পণ্য বাংলাদেশেও আসতে পারত। তাতে করে চীনা পণ্যের দাম কমে যেত। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের এটা একটা অংশ। এখন রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বিসিআইএম কমিডোরের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। সুতরাং চীন এতদিন যে রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার কারণ মূলত এটাই। 
তাহলে কি আমরা চীনের আশ্বাসের ওপর ভর করে বসে থাকব? চীনের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করলে আমরা ভুল করব। বহুপাক্ষিকতার আলোকে এ সমস্যার সমাধানে আমাদের কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তে যে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানকারী মিশন কাজ করছে এবং গত বছর যারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছিলেন, সেই মিশনের সদস্য ক্রিস্টোফার সিদোতি সম্প্রতি বলেছেন, মিয়ানমারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ও শহুরে বস্তিতে বাস করছে, যে রকম পরিস্থিতি ছিল নাৎসি বাহিনীর অধীন ইউরোপে। এর আগে জাতিসংঘ রাখাইনে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যায় যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে এ ধরনের দাবি জোরদার করতে পারে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের দাবি জানাতে পারে বাংলাদেশ। মোদ্দাকথা, একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভার বহন করার আর্থিক সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। উপরন্তু এখানে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে রোহিঙ্গাদের মাঝে তাদের সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। এর ফলে শুধু বাংলাদেশই নয়, বরং এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীনের ওপর নির্ভরতা এ সমস্যা সমাধানে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। বহুপাক্ষিকতার আওতায় বাংলাদেশকে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। 

The Daily Samakal

ড. তারেক শামসুর রেহমান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক

0 comments:

Post a Comment