রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রিফাত হত্যাকাণ্ড ও গণমাধ্যম


শেষ পর্যন্ত জানা গেল বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জড়িত। মিন্নি নিজে তা স্বীকার করেছেন, এ বক্তব্য বরগুনার পুলিশ সুপারের। এসপি জানিয়েছেন, একাধিক আসামি আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মিডিয়া আমাদের এভাবেই সংবাদটি পরিষ্কার করেছে। মিন্নি তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কতটুকু জড়িত ছিলেন কিংবা আদৌ জড়িত ছিলেন কি না, এর বিচার একদিন হবে। নিশ্চয়ই আমরা তখন জানতে পারব মিন্নি ওই হত্যাকাণ্ডে কতটুকু জড়িত ছিলেন; কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে বারবার তাড়িত করে তা হচ্ছে, কেন স্থানীয় আইনি সহায়তা পেলেন না মিন্নি? একজন নাগরিক যদি দোষী হন, তাহলেও এটা তাঁর সাংবিধানিক অধিকার তিনি একজন আইনজীবীর সহায়তা পাবেন। কেন স্থানীয় আইনি সহযোগিতা তিনি পেলেন না? এখানে কী স্থানীয় ক্ষমতাবানদের কোনো ‘হুমকি-ধমকি’ আছে?
পেশাগত কারণেই তো আইনজীবীরা এ ধরনের একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে ‘ভিকটিমের’ পক্ষে থাকবেন। প্রথম দিকে তাঁরা থাকলেন না কেন? এমনকি কোর্টও তো একজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারতেন? এ ক্ষেত্রেও তো তেমন কিছু হয়নি। নারীদের অধিকার নিয়ে যাঁরা ঢাকায় সোচ্চার, যাঁরা সভা-সমিতি করে নারীদের অধিকারের কথা বলেন, তাঁরাও তো একজন নারীর পাশে দাঁড়াতে পারতেন? হতে পারে সেই নারী হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত! কিন্তু একজন অসহায় নারী, যিনি স্বামী হারিয়েছেন মাত্র কয়েক দিন আগে, যিনি একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, হঠাৎ করে তিনি ‘খুনের আসামি’ হয়ে গেলেন! একজন স্থানীয় আইনজীবীকেও পেলেন না তাঁর পাশে, নারীবাদীদের কি তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো উচিত ছিল না? এ ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিল স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি কত বিভক্ত ও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল, সেখানে কারা ০০৭ বন্ড বাহিনী তৈরি করেছিল? কেন করেছিল? মাদক কারবারের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? আঙুল নির্দেশ করা আছে একজন ‘বিশেষ ব্যক্তি’ ও তাঁর সন্তানের দিকে। কথাটার সত্যটা কতটুকু? রিফাত হত্যাকাণ্ডে এই ০০৭ বন্ড বাহিনীর মূল মদদদাতাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হলো কেন, আমরা চাই সত্যটা বেরিয়ে আসুক। যদি মিন্নি সত্যি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁর শাস্তি হোক। কিন্তু এই মামলার ক্ষেত্রে মিন্নির পক্ষে প্রথম দিকে কোনো আইনজীবী না থাকা ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান সমাজে এ ধরনের খারাপ সংবাদের সংখ্যাই যেন বেশি। প্রতিদিনই এ ধরনের হাজারটা মন্দ সংবাদ আমাদের শুনতে হয়। জানতে হয়।
আর ভালো খবরগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায় মন্দ খবরের কারণে। সমাজে মন্দ খবরের সংখ্যাই যেন বেশি। অতি সাম্প্রতিককালে মন্দ খবরগুলোই যেন বেশি করে চোখে পড়ে। কিছুদিন আগে রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের ‘বালিশ’ কাহিনি সারা দেশে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেখানে রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ২১টি বহুতলবিশিষ্ট ভবন তৈরি করা হয়েছিল। ভবন তৈরি ও মালামাল সরবরাহের দুর্নীতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিল একটি সংবাদপত্র। তাতে দেখা যায়, একটি বালিশ ক্রয় করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা দিয়ে, আর তা ভবনে তুলতে খরচ হয়েছে ৭৬০ টাকা। একটি বিদ্যুতের স্টোভ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে সাত হাজার ৭৪৭ টাকা। এবং যাঁরা এটা তুলেছেন তাঁদের উত্তোলন খরচ দেখানো হয়েছে স্টোভপ্রতি ছয় হাজার ৬৫০ টাকা (ঢাকা ট্রিবিউন, ৪ জুলাই)। শেষ অবধি এ বিষয়ে হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছেন। তাতে হাইকোর্ট নির্মাণাধীন ওই ভবনের আসবাবপত্র বিশ্বস্ততার সঙ্গে (গুড ফেইথ) কেনা ও উত্তোলনের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছেন (মানবজমিন, ৩ জুলাই)। আমরা জানি না শেষ অবধি দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে কি না? তবে সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সম্পর্কে মন্তব্য করেন, তখন দোষীদের বিচার হবে, এটা আশা করতেই পারি। কিন্তু এ ধরনের ‘বালিশ কাহিনি’ তো শত শত—এর কয়টিই বা সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়, কয়টির ক্ষেত্রেই বা হাইকোর্ট রুল ইস্যু করেন?
হাইকোর্টের এই রুল ইস্যুর কাহিনি যখন সংবাদপত্রে ঘোষিত হয়, তখন প্রকাশিত হয়েছে আরো কয়েকটি সংবাদ—বিটিসিএলের আধুনিকায়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ৮০০ কোটি টাকা, যেখানে একটি সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে এক লাখ টাকা করে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৮০ লাখ টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে সাত কোটিতে, আর ভবন তৈরির আগেই যন্ত্রপাতি কিনতে প্রতিনিধিদল গিয়েছিলেন জার্মানিতে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আছে আরেকটি সংবাদ—৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণে সুদ দিতে হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে চুক্তি হয়েছে ১৮ লাখ টাকার, অগ্রিম দিতে হয়েছে ১০ লাখ। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে, এক বছরে বেড়েছে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ‘বালিশ’ কাহিনির মতো আরো একটি সংবাদ—সাত লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে একটি রেইনট্রিগাছ! এটা পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পায়রা সেতুর (লেবুখালী) নদীর তীর রক্ষা প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে এ টাকা! আর সিলেট রেলওয়ে দুর্ঘটনার পর জানা গেল ‘বাঁশ কাহিনি’—রেলওয়ে স্লিপার যাতে খুলে না যায়, সে জন্য বাঁশ দিয়ে পেরেক মেরে আটকানো হয়েছে। সংবাদপত্রে রয়েছে সেই কাহিনি—হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ৮০টি নাটের জায়গায় রয়েছে ৩৫টি, তা-ও পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া এবং নষ্ট (সিলেট টাইমস)। আগের রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আমাদের জানিয়েছিলেন, রেললাইন স্লিপারে বাঁশ ব্যবহার সম্পূর্ণ যৌক্তিক। আর এবার মৌলভীবাজারে আন্ত নগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ দুর্ঘটনার পর বর্তমান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানালেন, ‘মানুষ হুমড়ি খেয়ে ট্রেনে ওঠে, তাই এই দুর্ঘটনা’। মন্দ সংবাদ তো আরো আছে—২০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.২ লাখ কোটি টাকা। দুধে ডিটারজেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, ফরমালিন, মসলায় টেক্সটাইল রং, তেল মানহীন। পাম অয়েলের সঙ্গে ফেভিকল গাম মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘খাঁটি গাওয়া ঘি’। কী অদ্ভুত দেশে আমরা বসবাস করি। ন্যূনতম বেঁচে থাকার নিরাপত্তাটুকুও যেন আমাদের আর নেই! সুশাসনের অভাব যেন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রিফাতকে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এই ঘটনায় হাইকোর্টের বিচারপতিরা মর্মাহত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এটা জনগণেরও ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মানুষ তো এমন ছিল না’। আদালতের আরো একটি মন্তব্য ছিল এ রকম—‘নয়ন বন্ড এক দিনে তৈরি হয়নি, তাকে কেউ না কেউ লালন করেছে’। মিথ্যা বলেননি হাইকোর্টের বিচারপতিরা। একজন সন্ত্রাসী যদি প্রশ্রয় না পায়, তাহলে সে প্রকাশ্যে এভাবে মানুষ খুন করতে পারে না। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথাই পরোক্ষভাবে বলে গেলেন মাননীয় বিচারপতিরা। সমাজ কিভাবে বদলে যাচ্ছে এটা তার বড় প্রমাণ। একজন ডিআইজি মিজান ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন, কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেন। আর ওসি মোয়াজ্জেমের কাহিনি তো সবার জানা। মন্দ সংবাদগুলো সব ভালো সংবাদগুলোকে চেপে রাখে। ভালো সংবাদগুলো আর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় না। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একটি মন্দ সংবাদ আরেকটি মন্দ সংবাদের জন্ম দেয়। একটি মন্দ সংবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের যখন বিচার হয় না, তখন মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ে। এ ধরনের হতাশা একটি দেশের জন্য কখনোই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনতে পারে না।
নয়ন বন্ড, ০০৭ বন্ড, মিন্নিরা তো আমাদের সমাজেরই প্রতিনিধি। বরগুনার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। আমরা চাই, সত্যটা বেরিয়ে আসুক। সরকারি দলের নেতাদেরও কেউ কেউ বলেছেন, ‘বন্ডরা এক দিনে তৈরি হয়নি!’ কথাটার মধ্যে মিথ্যা কিছু নেই। কিন্তু কেন ০০৭ বন্ড নামে একটি সংগঠন তৈরি হবে—এটা জানাও জরুরি। এটাও তো এক দিনে তৈরি হয়নি। কারো না কারো আশ্রয়ে, লালন-পালনে ০০৭ বন্ডের জন্ম। এরা কারা? সরকার কি এটা তলিয়ে দেখবে? এ ধরনের সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে না। বরগুনার একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশকে আমরা বিচার করতে চাই না। কিন্তু একটা ‘০০৭ বন্ড কাহিনি’ যেন আরেকটি বন্ড কাহিনির জন্ম না দেয়। একজন ব্যক্তির হাতে যদি ২৫ বছর দলের নেতৃত্ব থাকে, তাকে কেন্দ্র করে একটা সুবিধাবাদী নেতৃত্ব তৈরি হবেই। বরগুনার ক্ষেত্রেও তেমনি হয়েছে। এই সুবিধাবাদী শ্রেণিই তাদের স্বার্থে ‘বন্ড বাহিনী’ তৈরি করে।
মিন্নি কাহিনি এই মুহূর্তে আলোচিত। তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটা অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। আশার কথা, ঢাকা থেকে একদল আইনজীবী যাবেন মিন্নির পক্ষে লড়তে। তাঁরা সেই কথা জানিয়েছেন। কিন্তু বরগুনা আইনজীবী সমিতির সদস্য যদি তাঁরা না হয়ে থাকেন, তাঁরা আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারবেন কি? এটা একটা প্রশ্ন। মিন্নির মতো হয়তো এ ধরনের সংবাদ সব সময় সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। কিন্তু এর বাইরেও প্রতিদিনই যেসব অনিয়মের সংবাদ সংবাদপত্রে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাপা হয়, তা আমাদের আশাবাদী করে না। আমাদের হতাশায় ফেলে দেয়। ৪৮ বছরের বাংলাদেশের যে জীবন, এই জীবনে আমরা আশাবাদী হতে চাই। মিন্নি কাহিনি যেন আমাদের সেই আশাবাদের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।
নিউ ইয়র্ক, যুুক্তরাষ্ট্র
 kalerkantho
২৪ জুলাই, ২০১৯ 

তারেক শামসুর রেহমান

লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com




0 comments:

Post a Comment