হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের বিচারের বহুল প্রত্যাশিত রায় ঘোষিত হয়েছে বুধবার। রায়ে সাতজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী রায় এবং এর মধ্য দিয়ে অন্তত একটি মেসেজ সবার কাছে পৌঁছে গেল- আর তা হচ্ছে, ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করে, আইন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারে। আইনের হাত অনেক লম্বা। এখান থেকে ‘মুক্তি’ পাওয়ার উপায় নেই।
কিন্তু বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পরও দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আচরণ ও দম্ভোক্তি প্রমাণ করল এই অপরাধীরা এতটুকুও অনুতপ্ত নয়। এমনকি তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সিম্বল সংবলিত ‘টুপি’ ব্যবহার করে তারা অন্তত এটি জানান দিতে চাইল যে, তারা আইএসের আদর্শ থেকে এতটুকু সরে আসেনি।
১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা এবং হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, ষড়যন্ত্র, অর্থ সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জড়িত ছিল। কিন্তু এজন্য তারা এতটুকুও অনুতপ্ত নয়। বরং আদালত প্রাঙ্গণে ও প্রিজনভ্যানে ‘আল্লাহ আকবর’ স্লোগান দিয়ে তারা জানান দিতে চাইল, সাধারণ মানুষ হত্যা করাকে তারা ‘ঈমানি কাজের’ অঙ্গ বলেই মনে করে!
প্রিজনভ্যান থেকে বের হওয়ার সময় তারা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাদের প্রায় সবার মুখেই হাসি ছিল। এটাই প্রমাণ করে মৌলবাদের শিকড় কত গভীরে প্রবেশ করেছে সমাজে! হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা তারা স্বীকার করেছে। কিন্তু তারা যে অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী, তা তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়নি।
আইএসের নেতা আবুবকর আল বোগদাদির মৃত্যুর পর আইএসের কর্মকাণ্ড এখন সীমিত হয়ে পড়েছে। সিরিয়া-ইরাক থেকে তারা উৎখাত হয়েছে। তথাকথিত ‘জিহাদি রাষ্ট্রের’ পতন ঘটেছে। কিন্তু তারপরও মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা যখন প্রকাশ্যেই আইএসের সিম্বল সংবলিত ‘টুপি’ ব্যবহার করে, তখন বুঝতে হবে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার।
হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে কিছু বিভ্রান্ত তরুণ সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তারা বিশ্বকে জানান দিতে চেয়েছিল, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে আইএস আছে! এর প্রায় সাড়ে তিন বছর পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়েও মাথায় আইএসের টুপি পরে তারা জানান দিতে চাইল- যে আদর্শকে তারা ধারণ করেছিল, তা তারা পরিত্যাগ করেনি। সারা বিশ্বের মিডিয়াতে এটি প্রচারিত হয়েছে।
হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময়ও আমরা বলেছিলাম, গুটিকয়েক বিভ্রান্ত যুবকের কর্মকাণ্ড দিয়ে এটি প্রমাণিত হয় না যে, বাংলাদেশে আইএস আছে। কিছু যুবক জঙ্গিবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। এরা আইএসের নাম ব্যবহার করেছিল বটে; কিন্তু আইএসের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে তা মিল খায় না। একটি বিদেশি চক্র মূলত বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত।
এরা বাংলাদেশের ধর্মভীরু মুসলমানদের তথা রাষ্ট্রটিকে চিহ্নিত করতে চায় একটি জঙ্গিবাদী তথা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামকে ধারণ করে আছেন হাজার বছর ধরে। কিন্তু জঙ্গিবাদী আদর্শকে তারা কখনও গ্রহণ করেননি। শান্তির ধর্ম ইসলামকে তারা লালন করেন, ধারণ করেন ব্যক্তি জীবনে।
কিন্তু তথাকথিত জিহাদিরা যখন ইসলামের নামে মানুষ খুন করে, আত্মঘাতী হয়, খাঁচায় মানুষ পুড়িয়ে মারে (আইএস সিরিয়াতে তাই করেছে)- সেই ‘ইসলামের’ সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। হলি আর্টিজানের ঘটনায় যখন ১৭ বিদেশি নাগরিককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হল, বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। মানুষ হত্যাকারীদের ঘৃণা করেছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম ধর্মে হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না।
নিঃসন্দেহে হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি মাইলফলক। এ রায়ের মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বকে একটি মেসেজ দিতে পারলাম যে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আইন এ ধরনের ‘ধর্মের নামে হত্যাকাণ্ড’কে সমর্থন করে না। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, এখানে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা যখন আইএসের সিম্বল সংবলিত টুপি মাথায় পরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স’কে কোনো অপশক্তি নস্যাৎ করে দিতে চায় কিনা?
কারণ ওই টুপি কোত্থেকে এলো, কারা সরবরাহ করল, কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে? একটি কমিটি ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে। কমিটি জেলখানা ও সেই সঙ্গে কোর্ট-কাচারির সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি যাচাই করে দেখতে পারে। জঙ্গি দমনে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সাফল্য আছে। কিন্তু এই একটি ঘটনায় তাদের সব অর্জন যেন ম্লান হয়ে না যায়।
মনে রাখতে হবে, এটি কোনো ছোট্ট ঘটনা নয়, এর একটি ইমপ্যাক্ট আছে। যে ‘শক্তি’ হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল, সেই শক্তিই এই ‘টুপি’ সরবরাহের পেছনে আছে। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তারা বিশ্বের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল, আইএসের ‘টুপি’ দেখিয়ে একইভাবে তারা বিশ্বকে জানান দিল বাংলাদেশে এখনও জঙ্গি আছে! আমি এটাকে হালকাভাবে নিতে চাই না।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, আইএসের কোনো টুপি নেই। কিন্তু টুপিতে যে লোগো ব্যবহার করা হয়েছে, তা আইএসের, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না? আইএস তাদের প্রচার কাজ চালানোর জন্য কিছু ‘সিম্বল’ ব্যবহার করে- যেমন কালো কাপড়, কালো পাঞ্জাবি, আরবি শব্দ ইত্যাদি।
হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের সময় যে ভিডিও বার্তা প্রচারিত হয়েছিল, তাতে এসব সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছিল। কল্যাণপুরের ঘটনায়ও আমরা তা দেখেছি। এমনকি শ্রীলংকায় ইস্টার সানডের হত্যাকাণ্ডের সময়ও একই ধরনের সিম্বল আমরা দেখেছি। কাজেই এ ধরনের সিম্বল ব্যবহার করে তারা যে কৌশলে তাদের প্রচারকার্য চালায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েও তারা কৌশলে আইএসের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে গেল! বাংলাদেশ যখন তার জঙ্গিবিরোধী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে ও বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে, তখন কৌশলে অপরাধীরা আইএসের নাম ব্যবহার করল। যদিও তাদের এ ‘কৌশল’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেবে না। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বেড়ছে বৈ কমেনি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি কালো অধ্যায়। কিছু বিপথগামী তরুণ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে নিরীহ মানুষদের। তরুণদের এ হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। দীর্ঘদিন ধরে তারা এ পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য তাদের আগে প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। তারা হলি আর্টিজান বেকারিকে বেছে নিয়েছিল একটাই কারণে- আর তা হচ্ছে, সেখানে বিদেশিদের যাওয়া-আসা ছিল। সেখানে বিদেশিরা নিয়মিত ডিনার করতে যেতেন।
বিদেশিদের জিম্মি করে ও তাদের হত্যা করে তারা অন্তত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছিল- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র নষ্ট করা। বাংলাদেশ যে একটি শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ, তা তারা নষ্ট করতে চেয়েছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে খুব সহজেই বিদেশি মিডিয়ায় স্থান পাওয়া যাবে, তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে, এ বিষয়টি তাদের বিবেচনায় ছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন এবং বাংলাদেশে আসতে চাইবেন না। ফলে জঙ্গিরা সুবিধা পাবে।
এসব তরুণ (মোবাশ্বের, খায়রুল, রোহান, নিবরাস, শফিকুল) ছিল নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের সংগঠিত করেছিল তামিম চৌধুরী। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ। হত্যাকাণ্ড তারা সংঘটিত করেছিল বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণা করেছে। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ ঘৃণাভরে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যাখ্যান করেছে।
ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাড়ে তিন বছর পর তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিয়ে বাংলাদেশ তার জঙ্গিবিরোধী অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করল। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে আর বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি।
‘আইএসের কোনো টুপি নেই’- এ ধরনের বক্তব্যও কোনো ‘ম্যাচির্ওড’ বক্তব্য নয়। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বড় কর্তৃত্ব তারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার হতে দেয়নি। তারা কেন বলবে, ‘আইএসের কোনো টুপি নেই?’ বরং তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারত।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, আসামি রিগানকে প্রিজনভ্যান থেকে গারদে নেয়ার সময় তার মাথায় টুপি ছিল না। তবে গারদ থেকে এজলাসে হাজিরের সময় মাথায় কালো টুপি ছিল। অপর জঙ্গি রাজীব গান্ধীর মাথায়ও টুপি ছিল না; কিন্তু প্রিজনভ্যানে ওঠার সময় তার মাথায় আইএসের টুপি দেখা যায়।
তাহলে ধারণা করা স্বাভাবিক- কোর্টে, গারদে এই ‘টুপি’ সরবরাহ করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা জানত কখন ও কোথায় এ টুপি পরতে হবে। তারা তা পরেছে। নব্য জেএমবির সদস্যরা নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে ঢুকে পড়েছে কিনা, এটাই চিন্তার কারণ।
জঙ্গিবিরোধী অবস্থানের একটা অধ্যায় পার হল। এখন বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছিল। এখন দোষীদের বিচার সম্পন্ন করে কিছুটা হলেও বাংলাদেশ তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারল।
Daily Jugantor
30.11.2019
মন্তব্য