রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সংবাদ, অনেক প্রশ্ন

গত ৩ নভেম্বর একটি দৈনিকে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাজউক কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসিক এলাকায় ১৪ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ এ মাসেই শুরু করতে যাচ্ছে। পূর্তমন্ত্রী এ ধরনের প্রকল্পের উদ্বোধন করে বাহবা নিতে চাইবেন নিঃসন্দেহে।
এ সংবাদটি এলো এমন এক সময়ে যখন রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট সম্পন্ন হলেও সেখানে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এখানে বসবাসরত ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে রাজউকের কর্মকর্তারা মাসের পর মাস সভা করেও সেসব ‘জটিলতা’ কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
রাজউকের উত্তরা প্রজেক্ট যখন বসবাসের অনুপযুক্ত এবং এর পরিচালনা যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, তখন নতুন করে আরেকটি বহুতল ভবন প্রকল্প তৈরি করে রাজউক আবারও ‘ভুল সিদ্ধান্তের’ দিকে যাচ্ছে কিনা, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
কনসেপ্ট হিসেবে বহুতল ভবন নির্মাণ ভালো। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়ার যে কোনো উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু এসব প্রকল্প কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, সে অভিজ্ঞতা রাজউকের নেই। উপরন্তু অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এ ব্যাপারে রাজউকের দক্ষতা প্রশ্নের মুখে।
উত্তরা ১৮ নং সেক্টরে যে আবাসন প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে সেখানে ভবন তৈরি শেষ হলেও বরাদ্দকৃত অ্যালোটিরা সেখানে বসবাস করতে পারছেন না। শত শত ফ্ল্যাট নির্মাণ শেষ হওয়ার পরও খালি পড়ে আছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন কেরানীগঞ্জের ঝিলমিলে বহুতল ভবন তৈরি করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এ প্রশ্ন তোলাই যায়। উন্নয়নের স্বার্থে বড় বড় প্রকল্প তৈরি করা ভালো। কিন্তু তা যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা না যায়, তাহলে এসব প্রকল্প সরকারের জন্য ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার ধারণা, উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের প্রকল্পটিও সরকারের জন্য ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে! সুতরাং ঝিলমিলে আরেকটি ‘গলার কাঁটা’ সৃষ্টি হয় কিনা সে বিষয়টি সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের প্রকল্পের দুর্নীতির সংবাদ এখন অনেকের মুখে মুখে। দোলনচাপা ভবনে যেসব লিফ্ট স্থাপন করা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে বসতিদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অত্যন্ত নিম্নমানের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে এসব ভবন তৈরি করা হয়েছে, যেখানে রাজউকের কোনো সুপারভিশন ছিল না। যেনতেনভাবে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে, যা সৃষ্টি করেছে ঝুঁকির। বিদেশে এ ধরনের অনেক হাউজিং প্রকল্পে ইতিমধ্যে ধস নেমেছে। রাজউক সেসব প্রকল্প থেকে আদৌ কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা চাই না উত্তরা কিংবা ঝিলমিল প্রকল্পও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হোক।
সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধনের ছবি বেশ ক’টি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের রাজউক অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা এ মানববন্ধনের আয়োজন করেন। তাদের অভিযোগ, উত্তরা রাজউক প্রকল্পে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। ফ্ল্যাটে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের মালামাল ও যন্ত্রাংশ। নির্ধারিত সময়ের আড়াই বছর পর এখনও অনেকে ফ্ল্যাট বুঝে পাননি।
অথচ তারা ইতিমধ্যে কিস্তিতে ফ্ল্যাটের মোট মূল্যের ৫০ থেকে ৭০ ভাগ অর্থ পরিশোধ করেছেন। এ প্রকল্পে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যতম আলোচনার একটি বিষয়। এ প্রকল্পে ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা এখন প্রকল্পটিকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। রাজউক ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখানে উদাসীন। দোলনচাপা ভবনে ডাকাতির সঙ্গে যারা জড়িত, পুলিশ তাদের খুঁজে বের করে আদালতে সোপর্দ করেছে।
কিন্তু এ এলাকা থেকে একজন কিশোরকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ আজ অবধি খুঁজে পায়নি কারা ওই অপহরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল। প্রকল্প এলাকায় ছিনতাই, সন্ধ্যাবেলায় মাস্তানদের অভয়ারণ্য আর রাতেরবেলা কোনো কোনো ফ্ল্যাটে ‘নক’ করে ফ্ল্যাট মালিকের উপস্থিতিতে ডাকাতির অপচেষ্টা- সবই এ এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা।
একের পর এক এ ধরনের ঘটনায় প্রকল্পটিকে ঘিরে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে এবং প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতি ভারত, মালয়েশিয়া ও জাপানের হাউজিং ব্যবসায় যে ধস নেমেছে, তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মালয়েশিয়ার কথা বলি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৮২টি হাউজিং প্রজেক্ট পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে (দ্য স্টার অনলাইন, ২৬ মে ২০১৬)। এর ফলে ৪০ হাজার ৮৬৬ ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
হাউজিং মন্ত্রী দাতুক হালিমা মোহাম্মদ সাদিক পার্লামেন্টে এ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অর্থ সহায়তা না পাওয়া এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রেতা পাওয়া যায়নি। ফলে হাউজিং প্রজেক্টগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে।
আমরা ভারতের দেওয়ান হাউজিং প্রকল্পের কথাও এখানে উল্লেখ করতে পারি। দেওয়ান হাউজিং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন রুপি (১৫১ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য) ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অথচ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লাভ হয়েছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন রুপি (এশিয়া টাইমস, ১৬ জুলাই ২০১৯)। এ সমস্যা সিঙ্গাপুরেও আছে।
হাউজিং মন্ত্রী জুরাইদা কামারুদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছেন, যার মাধ্যমে পরিত্যক্ত বাড়ি ও ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করা যাবে (বারনামা, ১৪ মে ২০১৯)। জাপানের একটি তথ্য দিই। জাপানে হাউজিং ব্যবসায় এখন মন্দা চলছে। শত শত বাড়ি ও ফ্ল্যাট পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। পরিস্থিতি সেখানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিত্যক্ত বাড়িগুলো এখন নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনামূল্যে নাগরিকদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
তবে বলা হচ্ছে, বাড়ির মূল্য নয়, বরং মিউনিসিপ্যালিটির প্রোপার্টি ট্যাক্স তাদের পরিশোধ করতে হবে (সিএনবিসি, ২১ নভেম্বর ২০১৮)। বাংলাদেশে রাজউক যে বিশাল বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে (উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট, পূর্বাচল প্রজেক্ট), তা কি শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া কিংবা ভারতের দেওয়ান হাউজিংয়ের পরিস্থিতির দিকেই যাচ্ছে? অপরিকল্পিত পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব ও দুর্নীতি এসব মেগা প্রকল্পের ‘মৃত্যু’ ডেকে আনতে পারে।
সরকার জনস্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। একাধিক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে করে সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শৈথিল্য, অদক্ষতায় অনেক মহাপরিকল্পনা শেষ অবধি সফল হবে কিনা? রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (উত্তরা ১৮ নং সেক্টর) এমন একটি মহাপরিকল্পনা, যা এখন শুধু বিতর্কেরই জন্ম দিচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজউক তার দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেনি।
পঞ্চবটির এই এলাকাটি সুরক্ষিত নয়। এ এলাকার পাশ দিয়ে গেছে মিরপুর বেড়িবাঁধ, যা চলে গেছে আশুলিয়া পর্যন্ত। মিরপুরের এই বেড়িবাঁধটিতে একসময় রাতে প্রচুর ডাকাতি হতো। কিছুদিন আগে একজন অভিনেত্রী এ সড়কে ডাকাতির শিকার হয়েছিলেন। ২০১২ সালে এই প্রত্যন্ত এলাকায় রাজউক হাইরাইজ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রাজউক কখনও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি।
.যদিও তুরাগ থানা এখন পঞ্চবটি মোড়ে রাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ টহলের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু রাজউক কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী না দিয়েই দ্রুত ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এটাই ছিল তাদের বড় ভুল। ইতিমধ্যে নানা অভিযোগ উঠেছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও। সিডিউল অনুযায়ী যে লিফ্ট সরবরাহ করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে।
হস্তান্তর হয়নি অনেক ভবন। কিন্তু কেউ সেখানে গেলে দেখতে পাবেন কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে। দরজাগুলো এক বছর হওয়ার আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখানে রাজউকের যে ‘ইন্সপেকশনের’ দরকার ছিল, রাজউক তা করেনি। দোলনচাপা ভবনে একাধিকবার লিফট ছিঁড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা লিফট সংযোজন, তত্ত্বাবধানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা ‘অদৃশ্য কারণে’ বিষয়টির গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
উপরন্তু তারা দ্রুত চাপ দিচ্ছেন ভবনগুলো বুঝে নেয়ার জন্য। তাদের উদ্দেশ্য কী বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও। কোনোরকম দায়সারাভাবে লিফট, ভবন ও জেনারেটরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে চায় রাজউক। একটি কোম্পানি এ এলাকায় ৪৭টি লিফ্ট সরবরাহ করেছে। প্রতিটি লিফ্ট অত্যন্ত নিম্নমানের।
এ ধরনের হাইরাজ ভবনে যে ধরনের লিফ্ট থাকা দরকার, তা এখানে সরবরাহ করা হয়নি। উপরন্তু লিফ্ট সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুপারভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পিডব্লিউডি কর্মকর্তাদের ‘সখ্য’ ইতিমধ্যেই প্রকল্প এলাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে!
৯০৩০ কোটি টাকার প্রকল্প এটি। ৭৯টি হাইরাইজ ভবন এই এলাকায়, উত্তরা রাজউক প্রজেক্ট ‘এ’ ব্লকে তৈরি করা হয়েছে। এরপর ‘বি’ ব্লকে তৈরি করা হবে ৭২টি ভবনে ৬ হাজার ৪৮টি ফ্ল্যাট। তারপর ‘সি’ ব্লকে ৭২টি ভবনে তৈরি হবে আরও ৬ হাজার ৬০৮টি ফ্ল্যাট। এর অর্থ এ এলাকায় মোট ২২৩টি হাইরাইজ ভবনে মোট ১৮ হাজার ৭৩২টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে।
ইতিমধ্যে শুধু ‘এ’ ব্লকে ৭৯টি ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিক্রি করা হয়েছে এবং সেখানে মানুষ বসবাস করছে। ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লক এখনও নির্মাণাধীন। অথচ শত শত ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। এমতাবস্থায় ঝিলমিল প্রকল্পে এ ধরনের একটি বহুতল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। শুধু উন্নয়নের নামে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অর্থহীন। এতে দুর্নীতি বাড়ে এবং সাধারণ মানুষ এ থেকে উপকার পায় কম।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

১৬ নভেম্বর ২০১৯, d
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
সব খবর;


0 comments:

Post a Comment